হিল ভয়েস, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০, নরসিংদী: নরসিংদীর ঘোড়াশাল ইউরিয়া সারকারখানায় বসবাসরত প্রায় অর্ধ শতাধিক হরিজন সম্প্রদায়ের সদস্যরা চাকরী হারানোর পর এবার থাকার জায়গাটাও হারাচ্ছে। এই অবস্থায় হতাশা আর আতঙ্কের মাঝে দিন পার করছে তারা।
ঘোড়াশাল ইউরিয়া সারকারখানা প্রতিষ্ঠাকাল থেকে কারখানায় কাজ করার পাশাপাশি তার পাশে বসবাস করে আসছেন অর্ধ শতাধিক হরিজন পরিবার। তাদের কেউ কেউ অফিসে, কেউ বাইরে আবার কেউবা স্কুল কলেজে ঝাড়–দাড়ের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। সম্প্রতি কারখানাতে সংস্কার কাজ শুরু হলে তাদের চাকরিচ্যুত করে কর্তৃপক্ষ। এবার তাদের বাসস্থান থেকেও বিতারিত করার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এঅবস্থায় দিশেহারা কারখানায় বসবাসরত প্রায় অর্ধশত হরিজন সম্প্রদায়ের সদস্য।
ঘটনার সত্যতা জানতে সরেজমিনে গেলে দেখা যায়, নারী-পুরুষ, শিশু সহ বাইরে বসে আছে। চোখে মুখে যেন হতাশা আর আতঙ্কের ছাপ। কারণ জানতে চাইলে তারা জানান, আমরা গরীব, জাতে ছোট, তাই আমাদের কেউ চোখে দেখেনা, মুল্যায়নও করেনা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছল ছল চোখে একজন জানান, আমাদের থাকার ঘরে কারখানা কর্তৃপক্ষ এসে তালা দিয়ে গেছেন, এখন আমরা কোথায় যাবো? কি করবো? কোথায় রাত কাটাবো? আমাদের নিজস্ব কোন বাড়িঘর নেই, কেউ বাসাভাড়া দেয়না বাসা। কথাগুলো বলার সময় অনেকের চোখেই জল লক্ষ করা গেছে। একটু এগিয়ে গিয়েই চোখে পরে একটি দরজায় তালা ঝুলছে।
খোজ নিয়ে জানা যায়, ঘোড়াশাল সারকারখানার ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) ও বিভাগীয় প্রধান দিল আফরোজ আক্তার ২২ জুন ২০২০ স্বাক্ষরিত ০২৩/৫/৬০৮ স্মারকে বলা হয়েছে কারখানার আবাসিক এলাকার ই-টাইপ এবং এফ-টাইপ- বসবাসকারী যে সকল স্থায়ী ও অস্থায়ী শ্রমিক/কর্মচারী চাকরী হতে বাদ পড়েছেন এবং অবসরে গেছেন তাদের মধ্যে যারা বাসা ছাড়েননি তাদের ৫দিনের মধ্যে বাসা ছেড়ে না দিলে কর্তৃপক্ষ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য হবে।
নোটিশের প্রেক্ষিতে হরিজন সম্প্রদায়ের সদস্যদের পুনরায় কারখানা কর্তৃপক্ষ বাসা ছাড়ার নির্দেশ দিলে বাংলাদেশ হরিজন ঐক্য পরিষদ পলাশ উপজেলা শাখার পক্ষ থেকে তাদের পূর্ণবাসন সাপেক্ষে ব্যবস্থা করার জন্য ২৭ আগষ্ট পলাশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর একটি লিখিত আবেদন জানায়।
আবেদনের প্রেক্ষিতে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করার জন্য পলাশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুমানা ইয়াসমিন ঘোড়াশাল-পলাশ ইউরিয়া ফার্টিলাইজার প্রকল্প পরিচালক বরাবর একটি নির্দেশনা প্রদান করেন। পরবর্তীতে কারখানা কর্তৃপক্ষ হরিজন সম্প্রদায়ের পুনর্বাসন না করেই তাদের বাসা ছেড়ে দেয়ার জন্য নির্দেশ দেন। এরই অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার কারখানা কর্তৃপক্ষ তাদের লোকজন দিয়ে হরিজনদের একটি বাসায় তালা ঝুলিয়ে দেয়।
এবিষয়ে কথা হয় বাংলাদেশ হরিজন ঐক্য পরিষদ নরসিংদী জেলা শাখার যুব ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক চন্দন বাসফোর এর সাথে। তিনি বলেন, আমি আগে এই বাসায় থেকে পাশ্ববর্তী তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কাজ করতাম। এখন এখানেই বাসা পেয়েছি। কিন্তু এখানে আমার স্বজনরা থাকেন। তাদের কোথায় নিয়ে যাবো। কোথায় তারা বাসা বাধবে?
বাংলাদেশ হরিজিন যুব ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সদস্য সচিব ও এখানে বসবাসকারী পঙ্কজ বাসফোর জানায়, আমার বাবা মা এখানে থেকে কারখানায় কাজ করেছেন। কর্তৃপক্ষ আমাদের সকলের চাকরী হারা করেছেন, এখন থাকার বাসস্থানও নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বলেছেন পূর্ণবাসন সাপেক্ষে ব্যবস্থা করার জন্য। আমরাও তাই দাবী জানাই।
এবিষয়ে ঘোড়াশাল ইউরিয়া সারকারখানা সিবিএ সভাপতি আমিনুল ইসলাম ভূইয়া জানান, যেহেতু দুটি কারখানাকে একত্রিত করে একটি প্রকল্প গ্রহন করা হয়েছে তাই তাদের সকলের প্রয়োজন না থাকায় কর্তৃপক্ষ তাদের বাদ দিয়েছেন। তবে তাদের পুনর্বাসন ছাড়া বাসা থেকে বিতারিত করাটা অমানবিক। কারণ তাদেরকে কেউ বাসা ভাড়া দিতে চায়না। তারা পারিবারিকভাবেই থাকতে পছন্দ করে। তবে হঠাৎ করে বাসায় তালা মারার ঘটনায় বসে মিমাংসা করার চেষ্টা করবো।
এ বিষয়ে ঘোড়াশাল-পলাশ ফার্টিলাইজার প্রকল্প ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) অহিদুজ্জামান মোবাইলে জানান, আমরা কারো চাকরী খাইনি। এছাড়া আমরা কারো বাসা ছাড়ার জন্য নির্দেশও দেইনি। তবে তাদের কারখানা কি করেছে সেটা তাদের বিষয়।
এখন চলছে করোনার সময়। স্বাভাবিক সময়েই যেখানে কেউ তাদের বাসা ভাড়া দিতে চায় না, এ সময়ে বাসা ভাড়া পাওয়াটা তাদের জন্য এক ধরনের আকাশ কুসুম কল্পনার সমান। সেই অবস্থায় তারা প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি কামনা করেছেন।