স্বাগতম চাকমা
কোভিড-১৯ এর মহামারীর প্রভাবে বিশ্বের হাজার হাজার মানুষের জনজীবন আজ বিপর্যস্ত। বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের ব্যাপ্তি কমিয়ে আনতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করার ফলে শিক্ষার্থীদের অধ্যয়নের ঘাটতি কমাতে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইনে পাঠকার্যক্রম পরিচালনা করছে। দেশের এই সরকারী এবং বে-সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত জুম্ম জনগোষ্ঠীদের মধ্যে বহুসংখ্যাক শিক্ষার্থী স্নাতক (সম্মান) পর্যায়ে পড়াশোনা করছে, যাদের বেশির ভাগই প্রান্তিক। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শুরু হওয়া অনলাইন পাঠকার্যক্রমে তারা কিভাবে অংশ গ্রহণ করছে বা কতটুকু তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পেরেছে তার একটি ধারণা এই প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে। দেশের এই প্রান্তিক শিক্ষার্থীদের অনলাইন পাঠ কার্যক্রমের সমস্যা সম্পর্কে নীতি নির্ধারকদের ধারণা দিতে এই প্রবন্ধ সাহায্য করবে।
চীনের উহানে কোভিড-১৯ শনাক্তের পর, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা কোভিড-১৯-কে একটি মহামারী হিসেবে ঘোষণা দেয় (WHO,2020)। কোভিড-১৯ ভাইরাসটি আক্রান্ত একজন ব্যাক্তির হাঁচি, কাশি, থুতু ইত্যাদির সংস্পর্শের মাধ্যমে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সেই কারণে সংক্রমণ কমানোর উদ্দ্যেশে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভ্রমণ সবকিছুতে গুরুত্বারোপ করে লকডাউনের পরামর্শ দেয় (WHO,2020)। ফলে করোনা ভাইরাস মানুষের জনজীবন, অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতের উপর অনেক বিরূপ প্রভাব ফেলে। সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখা এবং করোনা ভাইরাসের বিস্তার সীমার মধ্যে রাখতে বিশ্বের হাজার হাজার বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয় (Naciri et al.,2020)। করোনা ভাইরাসের প্রভাবে বিশ্বের ১.২ বিলিয়ন শিশু এবং তরুণ বিদ্যালয় থেকে দূরে থাকতে বাধ্য হয়েছেন এবং ১২০টির বেশি দেশে বিদ্যালয় বন্ধ রয়েছে (Giannini,2020)।
বিশ্বের উন্নত দেশ অষ্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাজ্য,যুক্তরাষ্ট্র,মিশর,মালয়েশিয়া সহ বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের সরাসরি কার্যক্রম বন্ধ রেখে, অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং সিলেবাস সমূহকে অনলাইনে পরিচালনার উপযোগী করে তৈরি করেছেন (Crawford et al.,2020)। গবেষকদের মতে কোভিড-১৯ এর সময়ে শিক্ষার্থীদের অধ্যয়নের শূন্যতা কমাতে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম শিক্ষার্থীদের শেখার বিকল্প পদ্ধতি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে (Naciri et al.,2020)। বাংলাদেশে গত ৮ মার্চ কোভিড-১৯ শনাক্তের পর সরকার ১৮ মার্চ হতে কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ না আসা পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা দেয়। কোভিড-১৯ এর সময়কালে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনাকে অব্যাহত রাখতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন দেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোকে অনলাইনে পাঠদান কার্যক্রম পরিচালনা করতে নির্দেশ প্রদান করে।
দেশের বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনলাইনে পাঠদান কার্যক্রম প্রথমদিকে শুরু হলেও সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জুলাই মাসে অনলাইন পাঠদান কার্যক্রম শুরু করে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশ গুলোতে অনলাইনে পাঠকার্যক্রম পরিচালনার মূল বাধা হচ্ছে যথাযথ ইন্টারনেট সংযোগ না থাকা এবং যার কারণে শিক্ষার্থীরা অনলাইন পাঠকার্যক্রমে যুক্ত হলেও ইন্টারনেট সংযোগ কিছুক্ষণ পর পর বিচ্ছিন্ন হওয়ার ফলে তাদের শিক্ষা অকার্যকর হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়াও অনলাইন পাঠকার্যক্রমে অংশ গ্রহণ করার মতো নিজস্ব ল্যাপটপ, মোবাইল কিংবা ট্যাব না থাকায় অনেক শিক্ষার্থীকে পাঠকার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে নিরুৎসাহিত করছে (Ramij,2020)। অধিকন্তু শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের অনলাইনে শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করতে কারগরি দক্ষতা যথেষ্ট নাই। শিক্ষার্থীদের মধ্যে যাদের অনলাইনে পাঠকার্যক্রমে অংশগ্রহণের মতো উপাদান আছে এবং যাদের মধ্যে অংশগ্রহণ করার মতো সুযোগ কিংবা উপাদান নেই, এই দুইয়ে’র মধ্যে অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রম বৈষম্যর সৃষ্টি করছে (Surkhali,2020)।
অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ছেড়ে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরা নিজ বাড়িতে চলে আসে এবং যার কারণে তাদের শিক্ষা উপকরণ হলে রেখে আসায় অনেক শিক্ষার্থীর স্বাভাবিক অধ্যয়ন এবং অনলাইনে পাঠ কার্যকর হচ্ছে না (Raju,2020)। অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রমকে গতিশীল এবং কার্যকরী করতে শিক্ষার্থীদের যথাযথ প্রযুক্তিগত পৃষ্ঠপোষকতা এবং শিক্ষার বিষয়বস্তুকে সহজলভ্য অর্থাৎ মোবাইল ডিভাইসে ব্যবহারের প্রতিকূল করে তৈরি করতে হবে (Ali,2020)। কোভিড-১৯ সময়কালে শিক্ষার্থীদের ব্যবহারের জন্য উচ্চ গতির ইন্টারেনেট বিনামূল্যে বা কম দামে ব্যবহারের জন্য নেটওয়ার্ক কোম্পানিদের সাথে বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষের মধ্যস্থতা করতে হবে (World Bank,2020)।
বায়োটেড নামক একটি প্রশিক্ষণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান, তাদের মে ৯-১১ সময়ে পরিচালিত এক সার্ভে বলছে কোভিড-১৯ সময়কালে মাত্র ২৩% শিক্ষার্থী অনলাইনে পাঠ কার্যক্রম পরিচালনার পক্ষে মত দেন এবং বাকী ৭৭% শিক্ষার্থী এর বিপক্ষে মত দেন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাত্র ৫৫.৩% শিক্ষার্থীর অনলাইন কার্যক্রমে সংযুক্ত হওয়ার মতো ল্যাপটপ, ট্যাব বা মোবাইল রয়েছে এবং ৪৪.৭% শিক্ষার্থীর অনলাইন পাঠকার্যক্রমে সংযুক্ত হওয়ার মতো উপাদান নেই বলে বায়োটেড তাদের সার্ভে রিপোর্টে জানিয়েছে (Islam et al., 2020)। যদিওবা পুরো বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা এসব সমস্যার ভুক্তভোগী হচ্ছে কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম অঞ্চলের বসবাসরত আদিবাসী শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ যেনো দ্বিগুণ বেশি। এইসব অঞ্চলের বেশির জায়গায় যেখানে বিদ্যুৎ এর ঘাটতি প্রচুর, সেইখানে ইন্টারনেট তো বিলাসিতা।
এমতাবস্থায় পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত প্রান্তিক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্নাতক (সম্মান) পর্যায়ে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মতামত তুলে ধরা হলো। সাগর ত্রিপুরা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বলছেন তাদের শ্রেণিতে অনলাইন পাঠ কার্যক্রম শুরু হলেও কোনো অনলাইন ক্লাসে সে অংশগ্রহণ করতে পারে নি।সে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণার পরে তার গ্রামে চলে আসে।তাদের গ্রামে নেটওয়ার্ক ফ্রিকুয়েন্সি ভালো নয় এবং নেটওয়ার্কের জন্য উঁচু কোনো পাহাড়ের চূড়া তার উঠা লাগে কিন্তু তাও সবসময় পাওয়া যায় না বলে সে জানিয়েছে।অনলাইনে কোনো ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে না পারা এবং ক্লাসে তার উপস্থিতি না থাকায় সাগর ত্রিপুরা তার ভবিষ্যৎ শিক্ষা জীবন নিয়ে চিন্তিত।
অন্যদিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জেন্টল চাকমা নিয়মিত অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করলেও ক্লাসচলাকালীন সময়ে কিছুক্ষণ পর পর নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে তার অনলাইন পাঠ তেমন কার্যকর প্রভাব রাখছে না এবং নেটওয়ার্কের ডাটা প্যাকেজের উচ্চ মূল্যের কারণে ক্লাসে অংশগ্রহণ তার পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে।অন্যদিকে, তার বই সহ অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে রেখে আসায় তার স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম ব্যহত হচ্ছে।
ভূবন চাকমা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের একজন শিক্ষার্থী তাদের বিভাগে বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধ ঘোষণার পরে কোনো অনলাইন ক্লাস হয় নি বলে জানিয়েছেন এবং কোভিড-১৯ এর মহামারীর সময়ে সে তার শিক্ষা জীবন, সেশন জট নিয়ে চিন্তিত হলেও বাস্তবতার কারণে তাঁকে মানিয়ে নিতে হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অধিকাংশ প্রান্তিক অঞ্চলের হওয়ায় অনেকের নেটওয়ার্ক ফ্রিকুয়েন্সি স্থিতিশীল না হওয়ায় অনেকের পক্ষে অনলাইনে ক্লাস করা সম্ভব নই বলে তিনি মনে করেন।
সৌরভ চাকমা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনষ্টিটিউটের একজন শিক্ষার্থী। তিনি লেখককে বলেছেন তার এলাকায় বিদ্যুৎ ঠিকমতো না থাকার ফলে অনেক সময় মোবাইলে চার্জ থাকে না।মোবাইল নেটওয়ার্ক স্থিতিশীল নয় বলে, ক্লাস চলাকালীন নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং ডাটা প্যাকেজের উচ্চ মূল্যর কারণে মাঝে মাঝে অনলাইন ক্লাসে অংশ গ্রহণ অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে বলে সৌরভ চাকমা জানিয়েছেন।
আপন চাকমা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের একজন শিক্ষার্থী।তার বিভাগে অনলাইন ক্লাস পরিচালিত হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন। তবে আপন চাকমা মনে করেন নেটওয়ার্কের ফ্রেকুয়েন্সি স্থিতিশীল নয় এমন পরিস্থিতিতে অনলাইনে ক্লাস কার্যকর হবে না এবং শিক্ষার্থীরা যেখানে সরাসরি ক্লাস রুমে বসে অভ্যস্ত সেখানে অনলাইন ক্লাস শিক্ষার্থীদের জন্য তেমন কার্যকর হবে না।
অন্যদিকে অনন্ত তঞ্চঙ্গ্যা, একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাদের বাড়ি থেকে অনলাইনে ক্লাস করার মতো নেটওয়ার্ক ফ্রিকুয়েন্সি নেই বলে জানিয়েছেন। তারও কারো সাথে যোগাযোগ করার জন্য বাড়ি থেকে দূরের কোনো জায়গা বা পাহাড়ের চূড়ায় যেতে হয়, সে সেশন জট এবং অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ নিয়ে চিন্তিত যেহেতু নেটওয়ার্ক ফ্রেকুয়েন্সির দুর্বলতার কারণে তার ক্লাসে উপস্থিতি নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিমেল চাকমা সদর এলাকায় থেকেও নেটওয়ার্কের দুর্বলতার কারণে ক্লাস চলাকালীন নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বলে অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণে তার সমস্যার কথা জানিয়েছেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামের স্নাতক (সম্মান) পড়ুয়া অধিকাংশ জুম্ম শিক্ষার্থী অনলাইন পাঠ কার্যক্রমের সাথে যুক্ত হতে পারছেন না। অনলাইন পাঠ কার্যক্রমে সামাজিক মিথষ্ক্রিয়া কম থাকা, প্রযুক্তির খরচ বেশি সহ কোর্স নেটওয়ার্কের দুর্বলতার কারণে তার কার্যকারীতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায় (Kumar,2010)। তবে বিশ্ব ব্যাংক (World Bank,2020) মনে করে যেসব একাডেমিক বিষয় বেশির ভাগ বক্তব্য নির্ভর সেসব বিষয় অনলাইন পাঠ কার্যক্রমের সাথে যুক্ত করা সহজতর হবে এবং শিক্ষার্থীদের পাঠ কার্যক্রমকে গতিশীল করে তুলবে।
বৈশ্বিক মহামারী কোভিড-১৯ শিক্ষা খাতে বিরুপ প্রভাব ফেলেছে। উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা সহজতর হলেও উন্নয়নশীল দেশে অনলাইনে পাঠ কার্যক্রম পরিচালনা করা বেশ কঠিন। অনেকেই ক্লাসে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারছে আবার অনেকে ক্লাসে অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিত হয়েছে, ফলে অনলাইন পাঠ কার্যক্রমে যেমন বৈষম্য তৈরি করেছে তেমনি তার কার্যকারীতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। যেমনটি পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকে পড়ুয়া বেশিরভাগ জুম্ম শিক্ষার্থীরা অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে পারছে না। প্রান্তিক এই শিক্ষার্থীদের অনলাইনে পাঠ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ নিশ্চিত এখন সময়ের দাবি।
স্বাগতম চাকমা: সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।