হিল ভয়েস, ২৬ আগস্ট ২০২০, খাগড়াছড়ি: আজ মর্মান্তিক ও বর্বরোচিত মহালছড়ি সাম্প্রদায়িক হামলার ১৭ বছর। ২০০৩ সালের ২৬ আগস্ট খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার মহালছড়ি উপজেলায় ৫টি মৌজার ১৪টি জুম্ম গ্রামে সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় সেটেলাররা হামলা চালিয়ে তিন শতাধিক বাড়িঘর সম্পূর্ণভাবে ভস্মীভূত ও লুটপাট করে। খুন করা হয় আট মাসের এক শিশু ও বিনোদ বিহারী খীসা নামে ৮০ বছরের এক জুম্ম বৃদ্ধকে। ধর্ষণের শিকার হয় ১০ জন জুম্ম নারী। ধ্বংস করা হয় ৪টি বৌদ্ধ মন্দির, ১টি সরকারী প্রাধমিক বিদ্যালয় ও জুম্মদের কয়েকটি দোকানঘর। আহত হয় শতাধিক জুম্ম।
ঘটনার সূত্রপাত:
২০০৩ সালের ২৪ আগস্ট সেনাবাহিনীর স্পাই রুপন মহাজন (৩০) নামক এক ব্যবসায়ী সিঙ্গিনালা মাঠ থেকে নিখোঁজ হয়। পরিবারের অভিযোগ ইউপিডিএফ কর্মীরা অপহরণ করে ৫ লক্ষ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেছে। কথিত এ অপহরণ নাটক সাজিয়ে অপহরণের শিকার ব্যক্তির মুক্তির জন্য রতন মেম্বার ও ইউসুফ মেম্বারের নেতৃত্বে বিকাল ৪:০০ টার দিকে সেটেলাররা খাগড়াছড়ি-মহালছড়ি সড়ক অবরোধ করে। বাজারে বাঙালি সমন্বয় পরিষদের ব্যানারে এক প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে বক্তারা প্রকাশ্যে জুম্মদের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক সাম্প্রদায়িক বক্তব্য দিয়ে উপস্থিত সেটেলারদের উত্তেজিত করে তোলে। এতে সেনা-পুলিশের ভূমিকা পক্ষপাতমূলক দেখা যায়।
সমাবেশের আশেপাশে থাকা প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে বক্তারা এভাবে বলতে থাকেন, প্রশাসন আমাদের পক্ষে, আর্মিরা আমাদের পক্ষে, থানা আমাদের পক্ষে, তাহলে কিসের ভয়? আগামীকালের মধ্যে অপহৃত ব্যক্তিকে ছেড়ে দেয়া না হলে আমরা জ্বালাও পোড়াও শুরু করে দেবো। এদিকে সিন্দুকছড়ি ইউপি চেয়ারম্যান সুইনুপ্রু চৌধুরী অপহরণ ও অবরোধ সম্পর্কে জানার জন্য বাজারে গেলে সেটেলার বাঙালিরা তাঁকে একটি দোকান ঘরে সারারাত আটকে রেখে নির্যাতন করে পরদিন ছেড়ে দেয়। তাঁর মোটর সাইকেলটি ভাঙচুর করা হয়।
ঘটনার দিন (২৬ আগস্ট ২০০৩):
সেইদিন ছিল বাজার বার। জুম্মরা কাঁচা তরকারী বিক্রির জন্য বাজারে ঢুকতে চাইলে সেটেলাররা দলে দলে বাধা দেয়। পরে জুম্মরা বাবুপাড়া সংলগ্ন রাস্তার পাশে বাজার বসালে সেখানেও এসে সেটেলাররা বাধা ও দোকানগুলো ভাঙচুর করে চলে যায়। ঠিক সকাল ৯:০০ টার দিকে সেটেলাররা মিছিল নিয়ে আচমকা জুম্মদের উপরে হামলা চালায়। পরে সেনাসদস্যরা এসে হামলায় অংশ নেয়। স্লুইসগেট সংলগ্ন দোকান থেকে বৃদ্ধ বিনোদ বিহারী খীসাকে সেনা-সেটেলাররা টেনে-হিচঁড়ে বের করে বন্দুকের বাট দিয়ে আঘাত করে হত্যা করে। ঘটনার সময় জুম্মদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগের জন্য ২১ ইবিআরের সেনা সদস্যরা বোটযোগে সেটেলারদের জন্য পেট্রোল ও কেরোসিন সরবরাহ করে।
ভস্মীভূত গ্রামগুলোর নাম: ১. বাবুপাড়া, ২. স’মিল পাড়া, ৩. মধ্যম পাহাড়তলী, ৪. কেরেঙ্গানাল, ৫. বসন্ত বৈদ্য পাড়া, ৬. দুরপয্যানাল, ৭. রামেসু কার্বারী পাড়া, ৮. লেমুছড়ি, ৯. নোয়াপাড়া, ১০. ভূয়টেক, ১১. থলীপাড়া, ১২. চংড়াছড়ি, ১৩. হাসপাতাল ও টিএন্ডটি পাড়া এবং ১৪. হেমন্ত পাড়া।
এ হামলায় পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রতিবাদের ঝড় উঠে। দেশের সচেতন ও প্রগতিশীল ব্যক্তি, সংগঠন ও সংস্থা এ ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছিল।
কিন্তু এ বর্বরোচিত হামলার ১৭ বছর পার হলেও হামলাকারী সেনা সদস্য-সেটেলারদের বিরুদ্ধে কোন আইনি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বিচারহীনতার এহেন সংস্কৃতির জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্মদের উপর প্রতিনিয়ত এ ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলা বেড়েই চলেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর বর্তমান পর্যন্ত জুম্মদের উপর ২০টির বেশি সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হয়েছে।