হিল ভয়েস, ২৯ আগস্ট ২০২০, রাজশাহী: রাজশাহীর জেলার ক্যাথলিক খ্রিষ্টান ধর্মপল্লিতে আবাসন প্রকল্প করা হচ্ছে। এতে উচ্ছেদের আতঙ্কে রয়েছে পল্লিতে বসবাসরত ১৩০টি আদিবাসী পরিবার। তাদের অভিযোগ, তাদের মতামত না নিয়েই ক্যাথলিক খ্রিষ্টান কর্তৃপক্ষ পল্লির দশমিক ৪৬৭৫ একর জমি ‘দি রাজশাহী খ্রিষ্টান কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি’র কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। এ জমির ওপর আদিবাসীদের ১২-১৩টি বাড়ি রয়েছে।
রাজশাহীর ক্যাথলিক খ্রিষ্টান ধর্ম প্রদেশের অধীন পবা থানার পারিলা ইউনিয়নের মুশরইল ধর্মপল্লিটি প্রায় ২০ বছর আগে গড়ে ওঠে। পল্লির বাসিন্দাদের ভয়, এভাবে পর্যায়ক্রমে পুরো পল্লিতে আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলা হবে। শর্ত মেনে তাঁরা আবাসন প্রকল্পের প্লট কিনতে পারবেন না এবং তাদের সে ধরনেরও অর্থ নেয়। ফলে এ প্রক্রিয়ায় পর্যায়ক্রমে ধর্মপল্লি থেকে তাঁদের উচ্ছেদ করা হবে। যদিও হাউজিং সোসাইটি বলছে, তারা সহজ কিস্তিতে প্লট দেবে। এখানকার বাসিন্দারা প্লট কিনলে ধর্মপল্লির আশ্রয়ে না থেকে নিজের জমিতে থাকতে পারবেন।
ধর্মপল্লির বাসিন্দাদের সূত্রে জানা যায়, মূলত ইতালীয় নাগরিক ফাদার (পুরোহিত) পাওলো চেচিরীর উদ্যোগেই এ পল্লি গড়ে ওঠে। ইতালিতে থাকা তাঁর পরিবার, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে তিনি এ পল্লির জমি কেনেন। এখানে রাজশাহী জেলার বিভিন্ন স্থানে বসবাসরত ভূমিহীন হতদরিদ্র সাঁওতাল, ওঁরাও, পাহাড়িয়াসহ বিভিন্ন আদিবাসীদের ১৩০টি পরিবারের বাসস্থান গড়ে দেওয়া হয়। বংশপরম্পরায় বসবাস করতে পারার আশ্বাস দিয়ে তাদের নিয়ে আসা হয়। গড়ে তোলা হয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
তারা আরও জানান, চিচেরীর সহায়তায় বহু আদিবাসী শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হন। তাঁদের কাছে চেচিরী পরম শ্রদ্ধেয়। তিনি এ রকম আরও পল্লি করেছেন। কয়েক বছর আগে চেচিরী বাংলাদেশ থেকে ইতালি চলে গেছেন। এরপর থেকে এসবের দেখাশুনার দায়িত্ব পান দেশি বাঙালি ফাদাররা। বাঙালি ফাদাররা তাদের সাথে তেমন যোগাযোগ রাখেন না যার কারণে এ বাঙালি ফাদারদের সঙ্গে ধর্মপল্লিগুলোর আদিবাসী মানুষদের আর আগের মতো আন্তরিক সম্পর্ক নেই। বিভিন্ন সহায়তা, বিশেষ করে শিক্ষা সহায়তা বন্ধ হয়ে যায়। ইতোমধ্যে কয়েকটি পল্লিতে খ্রিষ্টান মিশন পরিচালিত প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেছে। পর্যায়ক্রমে সব বিদ্যালয়ই বন্ধ হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন বাসিন্দারা।
কথা হয় পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক ফাদার চেচিরীর সঙ্গে কাজ করা একজন দেশি ফাদারের সঙ্গে। তিনি বলেন, অনেক ভালোবেসে চেচিরী হতদরিদ্র মানুষগুলোকে পল্লিতে ঠাঁই দিয়েছিলেন। তাঁদের উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। এখন তিনি ইতালিতে বসে যদি শুনতে পান, তাঁর ভালোবাসার মানুষগুলোকে পল্লি থেকে উচ্ছেদের তৎপরতা চলছে, তিনি মনে খুবই দুঃখ ও কষ্ট পাবেন ।
উচ্চশিক্ষায় চেচিরীর সহায়তা পেয়ে কমল হাসদা এখন একজন চিকিৎসক। তিনি বলেন, ‘তাঁর সহায়তা না পেলে এ পর্যায়ে আসতে পারতাম না। তাঁর ভালোবাসা ভোলার নয়। কিন্তু যখন থেকে শুনতে পাচ্ছি তাঁর ভালোবাসার মানুষগুলোকে উচ্ছেদ করা হবে, তখন থেকে রাতে ঘুমাতে পারি না। বুক ফেটে কান্না আসে। এটা অধর্ম, অন্যায়। পল্লির মানুষেরা এটা মানবে না।’
হাউজিং সোসাইটির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি নরেন্দ্রনাথ টুডু প্রথম আলোকে বলেন, ‘আদিবাসী মানুষদের উন্নত আবাসন ব্যবস্থা সৃষ্টির জন্য এ সোসাইটি গঠন করা হয়েছে। কিন্তু যেখানে আদিবাসী মানুষেরা আগে থেকে বসবাস করছেন, সে নিজ জমি কেনার ঘোর বিরোধী আমি। আর ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা করে কাঠা, প্রথমেই ৩৫ ভাগ টাকা পরিশোধ ও ৩৬ কিস্তিতে সমুদয় টাকা পরিশোধের শর্তে মুশরইল ধর্মপল্লির একটি পরিবারও জমি কিনতে পারবে না। তাদের উচ্ছেদ করা হবে অমানবিক কাজ।’
রাজশাহী ক্যাথলিক খ্রিষ্টান ধর্ম প্রদেশের প্রধান বিশপ জারভেজ রোজারিও এ ব্যাপারে বলেন, কাউকে উচ্ছেদের জন্য জমি বিক্রি করা হয়নি। সহজ শর্তে তাঁদের পুনর্বাসন করা হবে। আজীবন আশ্রিত না থেকে তাঁরা নিজের জমিতে মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপন করুন, এ উদ্দেশ্যেই এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ধর্মপল্লিতেই পর্যায়ক্রমে এ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ধর্মপল্লিগুলোর যে জমি রয়েছে, তার খাজনাও অনেক। সেই খাজনার টাকাও বাসিন্দারা দেন না। তাঁদের অনেকেই শুধু পেতে চান, কিছু দিতে চান না। এ মানসিকতা পরিবর্তন দরকার।
পল্লির প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো বন্ধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে গেছে। শিক্ষার্থীরা পল্লির পাশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ুক, এটাই আমরা চাই। সেখানে শিক্ষার্থীদের জন্য উপবৃত্তিসহ নানা সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে সরকার। আমরা আর বিদেশি সাহায্য পায় না তেমন। সব ক্ষেত্রেই ব্যয় সংকোচন করতে হচ্ছে। এ জন্য বিদ্যালয়গুলো চালাতে কষ্ট হচ্ছে।’
সূত্র : প্রথম আলো