হিল ভয়েস, ৯ আগস্ট, ২০২০, ঢাকা: রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার কমলা পুর বিলপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আদ্রিয়াস মার্ডি। ঢাকায় এসে একটি কুরিয়ার সার্ভিসে মালামাল টানার কাজ নিয়েছিলেন। মাসে ১০ হাজার টাকা বেতন। তার বাবা হুসেন মার্ডি কৃষি শ্রমিক।
নিজের জমি হারিয়েছেন অনেক বছর আগে। অন্যের জমিতে কাজ করে দুই ছেলে, এক মেয়ে সহ পাঁচ জনের সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। তাই দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করা আদ্রিয়াস সংসারের সহায়ক হতে ঢাকা মুখী হন। সেখানে এক বছর ভালো ভাবেই কাজ করে টাকা-পয়সা পাঠিয়েছেন। করোনা কালে তার চাকরিটি চলে যাওয়ায় ফিরে আসেন গ্রামে। গ্রামে ও কাজ নেই। কারণ, ঢাকায় কমর্রত শত শত গার্মেন্ট কর্মী এখন গ্রামে এবং তারা সবাই ভাগ বসিয়েছেন কৃষি কাজে।
শুধু আদ্রিয়াসের পরিবারই নয়- ওই গ্রামের জোসেফ টুডু, জোসেফ হেমব্রম, বিমল, নীরেন সহ আরও অনেকে করোনার প্রভাবে কাজ হারিয়েছেন। জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন জানান, উত্তরাঞ্চলে প্রায় ১৫ হাজার আদিবাসী যুবক কর্মহীন হয়ে গ্রামে ফিরে এসেছেন। সেখানে এই জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ১৮ লাখ। তাদের মধ্যে অর্ধেকই সাঁওতাল। ওঁরাও, মুন্ডা রাজোয়ার, গঞ্জু , বাগদী, মাল পাহাড়ী, ভূঁইমালী, কড়া, কডাসহ ৩৮ টি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর মানুষ রয়েছে।
এই মানুষ গুলোর সবারই আদি পেশা ছিল কৃষি ও শিকার। তবে ভূমি থেকে উচ্ছেদ এবং বন উজাড় হয়ে যাওয়ায় পেশা ছাড়তে বাধ্য হন। ফলে বাধ্য হয়েই গত কয়েক বছরে তারা নগর মুখী হতে থাকেন। ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জের পোশাক শিল্পসহ বিভিন্ন কোম্পানিতে কাজ শুরু করেন।
জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন বলেন, ‘আদিবাসীদের জীবিকার সংকট ভূমি, থেকে উচ্ছেদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। আগে ধানকাটা-মাড়াই ও রোপণের কাজগুলো মূলত আদিবাসীরাই করত। এখন কর্মহীন বাঙালি গার্মেন্ট কর্মীরাও এসব কাজে যোগ দিয়েছে। বনজ ফলমূল, পশুপাখি, শামুক, ঝিনুক, কাঁকড়া উজাড় হয়ে গেছে। ফলে খাদ্য সংকটও তীব্র হয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে করোনাকালে ডাক্তার সংকট এবং নানা রকম সতর্কতা জনিত কারণে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবাও নিতে পারা যাচ্ছে না। লকডাউনের কারণে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রাম করে এসব না পাওয়ার কথাও জানানো যাচ্ছে না।
জাতীয় আদিবাসী পরিষদের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক মানিক সরেন তাদের একটি জরিপের উল্লেখ করে বলেন, ‘১৯৭১ সালের পর থেকে দিনাজপুর, নওগাঁ, বগুড়া, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, পঞ্চগড়, রংপুর, জয়পুরহাট ও ঠাকুরগাঁও জেলার কমপক্ষে দুই হাজার ৪৩৫ টি আদিবাসী পরিবার জমি জমা থেকে উচ্ছেদ হয়ে ভূমিহীনে পরিণত হয়েছে। এই উচ্ছেদের ফলে তিন হাজার ৮২৭ দশমিক ২৮ একর জমি অন্যদের হয়ে গেছে। বাড়িঘর থেকে শুরু করে শ্মশান, কবরস্থান, পূজামন্ডপ, ধর্মীয় স্থানও রক্ষা হচ্ছে না। দখলদারের মধ্যে বনবিভাগও রয়েছে। অন্তত এক হাজার ১৮৫ দশমিক ৭৬ একর জমি দখল করে নিয়েছে বন বিভাগ। ফলে ঘটেছে দেশ ত্যাগের অনেক ঘটনাও।’
মানিক সরেন জানান, শুধু ভূমি নয়, অভাব-অনটনের মধ্যে নানা সুযোগ-সুবিধার হাত ছানি নিয়ে হাজির হওয়া ধর্ম ব্যবসায়ী মিশনারি গুলোর প্রভাবে রক্ষা করা যাচ্ছে না তাদের নিজস্ব ধর্ম-সংস্কৃতি। ধর্মের সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে কৃষ্টি-কালচারও। তারা এখন আর পূজা-পার্বণ করেন না। রীতি বদলের কারণে বিয়েতেও আর ঢোল বাজছে না। শুধু ভাষাটা ছাড়া তাদের সংস্কৃতির কিছুই আর নেই। এসব কারণেই ১৯৯৩ সাল থেকে আদিবাসী বিষয়ক মন্ত্রণালয়গঠন ও ভূমির ওপর অধিকার রক্ষার জন্য বিশেষ ভূমি কমিশন গঠনের দাবি জানিয়ে আসছেন তারা।
জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন বলেন, ‘আওয়ামী লীগ টানা তিন দফা ক্ষমতায় আছে। এই দলটির তিন বারের নির্বাচনী ইশতে হারেই ভূমিক মিশন গঠনের অঙ্গীকার ছিল। কিন্তু আজ পর্যন্ত তা গঠিত হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘সর্বাগ্রে চাই ভূমি কমিশন। সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয়, চাকরি, শিক্ষার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সহযোগিতা লাগবে। জমি দখলকে কেন্দ্র করে হত্যা, ধর্ষণ, মিথ্যা মামলায় হয়রানি, দেশ ত্যাগের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। কোনো রাজনৈতিক দলই আমাদের পাশে বাস্তবে নেই। এমনকি বামপন্থীরাও নেই। বিএনপি-জামায়াত-আওয়ামী লীগের ভূমি দস্যুরা সব এক।’
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, ‘স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছর হতে চলল, দেশের ৩০ লক্ষাধিক আদিবাসী জনগণ মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। সম্পূর্ণ এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে আদিবাসী ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবন ধারাকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। ক্রমাগত ভাবে আদিবাসীদের ভূমি অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এক সময় যেসব অঞ্চলে আদিবাসীরা সংখ্যা গরিষ্ঠ ছিল, সেখানে পপুলেশন ট্রান্সফারের ফলে আদিবাসী জনগণ নিজ ভূমিতে সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। তার ওপর এসে পড়েছে এই কভিড-১৯, যার কারণে আদিবাসী ও অন্যান্য প্রান্তিক মানুষের জীবন-জীবিকা আরও অনিশ্চিত ও হুমকির মুখোমুখি হয়েছে।’