হিল ভয়েস, ১২ আগস্ট ২০২০, ঢাকা: আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস ২০২০ উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম গতকাল ১১ আগষ্ট একটি অনলাইন ওয়েবিনারের আয়োজন করে। সন্ধ্যা ৭ টায় অনুষ্ঠিত উক্ত ওয়েবিনার আলোচনায় বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক ও প্রতিনিধিবৃন্দ ছাড়াও আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের আদিবাসী নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারন সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং এর পরিচালনা ও সভাপতিত্বে উক্ত আলোচনায় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত নরওয়ে অ্যাম্বেসির প্রতিনিধি খ্রিষ্টিন টি ওয়ারিংসা, বাংলাদেশে কর্মরত ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি ড. হান্স লামব্রেসড, বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সিনিয়র উপদেষ্টা মিজ হেইক আলেফসেন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান, চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায়, নরওয়ের ট্রামসো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. টনি ব্লেই, এশিয়া ইন্ডিজিনাস পিপসলস্ প্যাক্ট (এআইপিপি) এর সাধারণ সম্পাদক গাম এ শিমরে।
এছাড়া উক্ত আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন সুইজারল্যান্ড অ্যাম্বাসি বাংলাদেশ এর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক প্রধান কর্মকর্তা টমাস বাউমগার্টনার, নেদারল্যান্ড অ্যাম্বাসি বাংলাদেশ এর সিনিয়র পলিসি এডভাইসর রুজান সারওয়ার, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার প্রতিনিধি টউমো পটিয়েনেন, ডেনিস অ্যাম্বাসি বাংলাদেশ এর রাষ্ট্রদূত উইনি এসট্রুপ পিটারসেন, ফিলিপিনের আদিবাসী নেত্রী জোয়ান কার্লিং, জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক এ´পার্ট ম্যাকানিজম কাউন্সিলের সদস্য ও বাংদেশ আদিবাসী ফোরামের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক বিনোতাময় ধামাই, আদিবাসী নারী নেত্রী চঞ্চনা চাকমা, আদিবাসী অধিকার কর্মী চন্দ্রা ত্রিপুরা সহ বিভিন্ন মিডিয়ার সাংবাদিক ও অন্যান্য আদিবাসী নেত্রীবৃন্দ।
প্রারম্বিক বক্তব্যে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সহ-সাধারন সম্পাদক ও কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা বলেন, সারাবিশ্বে চলমান মহামারীর মধ্যে বাংলাদেশের আদিবাসীরা খুব কঠিন অবস্থার মধ্যে জীবন যাপন করছে। খাদ্যাভাব, বেকারত্ব অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সুবিধা থেকে শুরু করে বিভিন্ন অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন বলেও জানান তিনি। এছাড়া করোনার ব্যাপক বিস্তার রোধে বাংলাদেশে আদিবাসীরা নিজেদের প্রথাগত লক-ডাউন পদ্বতি অনুস্মরণ করে সফল হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী তরুণরা শহর থেকে ফেরা আদিবাসী চাকুরীজীবি ও শ্রমিকদের জন্য সঙ্গনিরোধক আলাদা ঘর নির্মাণ করে করোনা মোকাবেলায় সহযোগীতা করেছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
চাকমা সার্কেল চীফ ও জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক পার্মানেন্ট ফোরামের সাবেক সদস্য ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায় আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেন, চলমান মহামারীর কারণে আদিবাসীরা খাদ্য সংকটের মধ্যে পড়েছে। এমন কঠিন সময়েও তারা ভূমি ও প্রথাগত বনভূমি হারাচ্ছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
এছাড়া তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রান্তিক অঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসীদের এখনো নির্ভরযোগ্য জীবিকার উৎস জুম চাষ। কিন্তু এই জুম চাষীদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করতে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। প্রথাগত ভূমির উপর নির্ভরশীল পেশার সাথে জড়িত সকল আদিবাসী পেশাজীবিরা এবং বিভিন্ন ইনফরমাল সেক্টরে কর্মরত পেশাজীবিরাও এই মহামারীর ফলে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বলে দাবী করেন তিনি। এছাড়া সরকারী বেসরকারী সংস্থাগুলোর মাধ্যমে প্রদত্ত ত্রাণ সহায়তা এসব প্রান্তিক আদিবাসীদের কাছে পৌঁছাইনি এবং পৌঁছলেও সেটা খুব অপর্যাপ্ত বলে দাবী করেন তিনি।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রতিনিধি টউমো পটিয়েনেন বলেন, আদিবাসী জনগণ মারাত্মক আর্থ-সামাজিক প্রান্তিকরণের শিকার হচ্ছে এই মহামারীর সময়ে।দ্রুত আয়ের উপায়হীনতা, অপর্যাপ্ত সামাজিক ও স্বাস্থ্য সুরক্ষামূলক সুযোগের অভাব এবং কার্যকর তদারকি ব্যবস্থার অভাবে আদিবাসীরা আরো অধিক ঝুঁকির দিকে যাচ্ছে বলেও উদ্বেগ জানান পটিয়েনেন।
এশিয়া ইন্ডিজিনাস পিপলস প্যাক্ট (এআইপিপি) এর সাধারন সম্পাদক গাম এ শিমরে বাংলাদেশের আদিবাসীদেরকে এই কঠিন সময়ে নিজেদের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে আদিবাসী দিবস উৎযাপন এবং চলমান মহামারী মোকাবেলায় কার্যকর প্রথাগত উদ্যোগ গ্রহনের জন্য অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, চলমান মহামারীর মধ্যে এশিয়া অঞ্চলে দক্ষিণ-পন্থী জনতুষ্ঠিবাদ ও কর্তৃত্ববাদের উত্থানের ফলে নাগরিকদের অবস্থানকে মারাত্মকভাবে সংকুচিত করে ফেলেছে। যার ফলে ন্যায় বিচারের জন্য রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবহার করে বিরোধ নিষ্পত্তিকরণের ব্যবস্থায় নাগরিক সমাজ অকার্যকর অবস্থার মধ্যে পড়েছে এবং এ অবস্থায় আদিবাসী সমাজে নিজস্ব গণতান্ত্রিক প্রথাগত সরকার ব্যবস্থা আগের তুলনায় আরো জরুরী হয়ে পড়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।
নরওয়ের ট্রমসো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. টনি ব্লেই বলেন, আদিবাসীরা এমনিতেই খাদ্য সংকট সহ নানা ধরণের সংকটের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করে। তার উপর চলমান এই মহামারীর ফলে বাংলাদেশের আদিবাসী আরো অধিক খাদ্য সংকট এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। এছাড়া নারী ও তরুণদের অবস্থাও খুব শোষণীয় বলে দাবী করেন তিনি। এইমহামারীর সময়েও আদিবাসীদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা বৃদ্ধি এবং ভূমি দখল ও প্রথাগত ভূমি থেকে উচ্ছেদ, হত্যা,আদিবাসী নারী নীপিড়ন ও ধর্ষণের ঘটনার শিকার হচ্ছেন যা খুবই দু:খজনক।
আদিবাসী অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের এক্সপার্ট ম্যাকানিজম কাউন্সিলের সদস্য ও আদিবাসী ফোরামের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক বিনোতাময় ধামাই বলেন, করোনা মহামারীর মধ্যে বাংলাদেশের আদিবাসীরা ক্রমাগত তাঁদের প্রথাগত ভূমি অধিকার লঙ্গনের শিকার হ্েচ্ছন। বনভূমি সংরক্ষণের নামে বন থেকে আদিবাসীদের সম্পদ আহরণে বাধা প্রদান ও সীমিতকরণ করা হচ্ছে বলেও দাবী করেন তিনি।
এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন না করার ফলে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি তো হচ্ছেই না বরং পাহাড়ে আদিবাসীদের ভূমি দখল করে বাঙালী বসতীকরণ চলমান রয়েছে যা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে বলেও দাবী করেন তিনি।
বাংলাদেশে কর্মরত ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি ড. হান্স লামব্রেসড বলেন, আদিবাসী অধিকারকে উপলব্ধি করা মানে করোনা মোকাবেলা এবং এ মহামারীর সংকট উত্তোরণের কৌশলগুলিতে তাঁদের অংশগ্রহন নিশ্চিত করা।সকল কার্যক্রমে আরো কার্যকরী এবং ভালো প্রতিফলন পেতে আদিবাসীদের পরামর্শ গ্রহনও জরুরী বলে দাবী করেন তিনি।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ সরকার কেবল মাত্র ২৭ টি আদিবাসীদেরকে স্বীকার করে নিয়েছে যেখানে বিভিন্ন গবেষকরা ৫০ টি আদিবাসী জনগোষ্ঠী কিংবা অনেকেই ৭৭ টির অধিক আদিবাসীর উপস্থিতি তুলে ধরেছেন।
করোনা মেকাবেলায় আদিবাসীদের অনুস্মৃত পদ্বতি অধিক কার্যকর দাবী করে তিনি বলেন, করোনা মহামারী মোকাবেলায় মূল ধারার বাঙালিরা আদিবাসীদের এই কৌশল সমূহ অনুস্মরণ করতে পারে।
এছাড়া রাষ্ট্র আদিবাসীদের অধিকার রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে দাবী করে তিনি আরো বলেন, বিভিন্ন জায়গায় আদিবাসীদের মানবাধিকার পরিস্থিতি দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। বাংলাদেশের আদিবাসীদের অধিকার ও আত্মপরিচয়কে অস্বীকার করার ফলে তাঁরা এদেশ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বলেও মত দেন এই অধ্যাপক। এছাড়া আদিবাসীদের অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রগুলোকে আরো অধিক মনোযোগী হওয়ারও আহ্বান জানান তিনি।
নেদারল্যান্ড অ্যাম্বাসি বাংলাদেশ এর সিনিয়র পলিসি এডভাইসর রুজান সারওয়ার আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেন, আদিবাসীদের অধিকার রক্ষায় এবং তাঁদের উন্নয়নের জন্য আমরা কাজ করছি। আগামীতে আদিবাসীদের উন্নয়নের জন্য সবসময় পাশে থাকার প্রত্যয়ও ব্যক্ত করেন তিনি।
ফিলিপিনের আদিবাসী নেত্রী জোয়ান কার্লিং আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেন, আদিবাসী নারীরা, যারা তাদের পরিবার ও সমাজের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির সেবা দিয়ে থাকে তারা এ মহামারীর সময়ে অধিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। করোনা মহামারী আদিবাসীদের স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন সুবিধায় বৈষম্য, নিরাপদ পানীয় জলের অভাব,ভূমি দখল এবং উচ্ছেদ সহ নানা ধরণের হুমকির মধ্যে ফেলেছে যা তাদের টিকে থাকার জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অংশীদারিত্বের চেতনার এই সংকট উত্তোরণে ভূমিকা রাখতে পারে বরেও দাবী করেন তিনি।
এছাড়া ঢাকায় নিযুক্ত নরওয়ে অ্যাম্বেসির প্রতিনিধি খ্রিষ্টিন টি ওয়ারিংসা বলেন, করোনা মোকাবেলায় আমাদেরকে টেকসই সমাধানের কথা ভাবতে হবে। সকল উদ্যোগে আদিবাসীদের অংশগ্রহন নিশ্চিত করার কথাও জানান তিনি।
সমাপনি বক্তব্যে আদিবাসী ফোরামের সাধারন সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, আদিবাসী দিবস প্রতি বছরের ন্যায় আনন্দঘন পরিবেশে পালন করার কথা ছিল। কিন্তু এই মহামারী এটিকে বেদনাদায়ক ও ভারাক্রান্তভাবে পালনে বাধ্য করেছে। এই মহামারী আদিবাসীদেরকে আরো অধিক আর্থ-সামাজিক ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে যার জন্য বিভিন্ন দেশ ও সংস্থাগুলোকে তাঁদের উন্নয়নে এবং মানবাধিকার রক্ষায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
এছাড়া উক্ত আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সদস্য সচিব চঞ্চনা চাকমা, তরুণ আদিবাসী অধিকার কর্মী চন্দ্রা ত্রিপুরা। উক্ত আলোচনায় বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার কূটনৈতিক প্রতিনিধিরা আদিবাসীদের উন্নয়নে পাশে থাকবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।