হিল ভয়েস, ২৬ জুলাই ২০২০, বান্দরবান: বান্দরবানের লামা উপজেলার লামা-চকরিয়া সড়কের পাশে পাঁচ মাইল (কুমারী) নামক স্থানে প্রকাশ্যে স্কেভেটর দিয়ে পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি করা হচ্ছে। গত এক মাস ধরে “হোমল্যান্ড প্ল্যান্টার্স” নামে একটি কোম্পানি এই পাহাড় কাটা হলেও প্রশাসনের কেউই বিষয়টি জানেন না বলে দাবি করেছেন। বলা যায় অনেকটা নিরব ভূমিকা পালন করছে।
স্থানীয় অধিবাসী অভিযোগ করেছেন যে, কেবল লামা উপজেলায় নয়, আলিকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায়ও দীর্ঘকাল ধরে এভাবে রাবার বাগান কোম্পানী ও বহিরাগত প্রভাবশালীরা মালামাল পরিবহনের সুবিধার্থে রাস্তা তৈরির জন্য পাহাড় কেটে আসছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ অনুযায়ী, সরকারি-বেসরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন কাজে পাহাড়-টিলা কাটা বা অন্য কোনো উপায়ে ভূমিরূপ পরিবর্তন করা যাবে না বলে উল্লেখ রয়েছে। গত ২৫ জুলাই ২০২০ শনিবার দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, এই আইন লঙ্ঘন করে ‘হোমল্যান্ড প্ল্যান্টার্স’ নামে একটি কোম্পানি প্রকাশ্যে স্কেভেটর দিয়ে বাগানের রাস্তা করার নামে ৬/৭টি পাহাড় কাটচ্ছে।
ইতিমধ্যে ৬/৭ পাহাড়ের অর্ধেক কেটে ফেলা হয়েছে। এসময় স্কেভেটর সহ ২০/২৫ জন শ্রমিক পাহাড় কেটে পিকআপে মাটি ভরছিলেন। পাহাড় কাটার কাজে কর্মরত শ্রমিকদের সাথে আলাপকালে জানা যায় কাটা ৬/৭টি পাহাড় ছাড়াও আরো ২/৩টি পাহাড় কাটা হবে।
লামা-চকরিয়া মেইন সড়ক দিয়ে প্রতিদিন লামা উপজেলা প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা যাওয়া আসা করেন। মেইন রোড় দিয়ে গেলেই পাহাড় কাটা দেখা যায়। রাস্তা পাশে গেলেই চোখে পড়ে বিশাল বিশাল পাহাড়গুলোর অধিকাংশ কাটা হয়েছে।
হোমল্যান্ড প্ল্যান্টার্স বাগানের কেয়ারটেকার মো. সাইফুল বলেন, ‘বিষয়টি সবাই জানে। সবাইকে ম্যানেজ করে আমরা পাহাড় কাটার কাজ শুরু করেছি। বাগানের মালিক তারিক আহমদ আমেরিকায় থাকেন। সেখান থেকে তিনি সব কিছু পরিচালনা করেন।
বাগানের মূল দায়িত্ব আছেন সুজিত সাহেব। সুজিত এর সাথে যোগাযোগ করতে নাম্বার চাইলে সাইফুল আরো বলেন, তার নাম্বার দেয়া যাবেনা। আপনারা কিছু জানতে চাইলে লামার শীর্ষ কর্মকতাদের সাথে কথা বলেন।
লামা থানা পুলিশের অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘পাহাড় কাটার বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে। আমি ঘটনাস্থলে গিয়ে বিষয়টি দেখব।
লামা উপজেলা পরিবেশ রক্ষা পরিষদের সভাপতি মো. তৈয়ব আলী বলেন, জীববৈচিত্র্য ও প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় অবিলম্বে পাহাড় কাটা বন্ধ করা উচিত। যাঁরা পাহাড় কাটছেন, ফৌজদারি আইনে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করা দরকার। তাহলে এলাকায় বিষয়টি দৃষ্টান্ত হিসেবে থাকবে।
জানতে চাইলে লামা উপজেলা নির্বাহী অফিসার নূর-এ জান্নাত রুমি বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা ছিল না। আমি বদলি জনিত কারণে রোববার লামা উপজেলা হতে চলে যাচ্ছি। নতুন ইউএনও মো. রেজা রশিদকে বিষয়টি বলে যাবো। যারা পাহাড় কেটেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য।
এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর বান্দরবান জেলার সহকারী পরিচালক সামিউল আলম কুরসি বলেন, ‘খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
স্থানীয়রা জানিয়েছে যে, কেবল লামা উপজেলায় নয়, আলিকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায়ও বিভিন্ন রাবার বাগান কোম্পানী ও বহিরাগত প্রভাবশালী ইজারাদাররা মালামাল পরিবহনের সুবিধার্থে দীর্ঘকাল ধরে এভাবে পাহাড় কেটে রাস্তা করে আসছে।
যার অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে পার্বত্য চট্টগাম উন্নয়ন বোর্ডের অর্থায়নে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় পিএইচপি রাবার কোম্পানী কর্তৃক ভুঁয়া প্রকল্প দেখিয়ে বাইশারী হেডম্যান চাক পাড়া হতে লংগডু চাকপাড়া পর্যন্ত গ্রামহীন ও জনশুন্য এলাকায় রাস্তা নির্মাণ।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান মো: শফিউল্লাহ কর্তৃক পর্যটনের নামে প্রায় এক হাজার একর জায়গা অবৈধ দখল করে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের এক কোটি ২০ লাখ টাকার অর্থায়নে রাস্তা ও বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে ১৫টি পাহাড় কেটে পরিবেশ ধ্বংস করে প্রায় ৮ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। ঝিরি ভরাট করে বাঁধ নির্মাণের কাজ চলছে।
নাইক্ষ্যংছড়ির বাইশারীতে প্রফেসর নিজাম উদ্দীন রাবার বাগানেও বাগানের মালামাল সরবরাহের সুবিধার্থে এলজিইডি অর্থায়নে আদিবাসী জুম্মদের জায়গা দখল পূর্বক পাহাড় কেটে ও পরিবেশের ক্ষতি করে ব্রিকসলিং রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৬ নির্মাণ প্রকৌশলী ব্যাটালিয়ন (১৬ ইসিবি) আলিকদম উপজেলা হতে আলিকদম-কুরুকপাতা-পোয়ামুহুরী সড়ক নির্মাণ কাজ করছে, যেখানে অবাধে পাহাড় কাটা হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যতার ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে এবং জুম্মদের অনেক গ্রামের ক্ষতি হচ্ছে।
এভাবে অনেক কোম্পানী, প্রভাবশালী ইজারাদার, ক্ষমতাসীন নেতা ও বহিরাগত ভূমিদস্যুরা রাবার বাগান, উদ্যান চাষ ও পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের নামে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের অর্থায়নে পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি করছে। প্রশাসন ও পুলিশ দেখেও না দেখার ভান করে নিরব ভূমিকা পালন করছে।