বাচ্চু চাকমা
বাংলাদেশের ইতিহাসে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ ক্রমাগত হয়রানি, হুমকি ও নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছে। আওয়ামীলীগ সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে সাম্প্রতিক সময়ে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা আরও বেড়েছে। আওয়ামীলীগ ২০০৯ সাল থেকে একনাগাড়ে প্রায় সাড়ে ১১ বছর ক্ষমতায় রয়েছে। এই সময়েও যে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন-হয়রানি বন্ধ হয়নি, বন্ধ হয়নি ভূমি বেদখলের মহোৎসব। তার প্রমাণ রামু, নাসিরনগর, গোবিন্দগঞ্জ, সাঁথিয়া, দিনাজপুর এবং সাম্প্রতিক ঘটনাবলী উল্লেখযোগ্য।
পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি ও বাস্তবতা খুবই জটিল ও নাজুক। ইসলামিক মৌলবাদ, উগ্র ধর্মান্ধ, ইসলামী সম্প্রসারণবাদ ও উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারকবাহক বাংলাদেশ শাসকগোষ্ঠীর বহুমাত্রিক আগ্রাসনের শিকার পাহাড়ের জুম্ম জনগণ। জুম্মদের হাজার হাজার একর জায়গা বেদখল ও তাদের স্বভূমি থেকে উচ্ছেদ করে বহিরাগত মুসলমান সেটেলারদের বসতিপ্রদানের মাধ্যমে ভূমি আগ্রাসনের চিত্র খুবই ভয়ংকর! ব্যবসা-বানিজ্য, ব্রিজ-কালভার্ট-রাস্তাঘাট নির্মাণ, পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন, সরকারি-বেসরকারি নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকার প্রকল্পের মাধ্যমে উন্নয়ন আগ্রাসন, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, ধর্মীয় আগ্রাসন ও ইসলাম ধর্মের ধর্মান্তরকরণ চলছে। জুম্ম নারী ও শিশুর উপর ধর্ষণ, হত্যা ও সহিংসতা, সেনাশাসন জারি রেখে এই আগ্রাসনের মাত্রাকে অধিকতর শক্তিশালী ও জোরদার করা হচ্ছে।
বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারীর সময়েও পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর ব্যাপক তল্লাসী অভিযান, রাত-বিরাতে ঘরবাড়ি তল্লাসী, ঘরের জিনিসপত্র তছনছ করে দেওয়া, নির্দোষ জুম্মদের হাতে অস্ত্র গুজিয়ে দিয়ে সন্ত্রাসী সাজানো, পাইকারী হারে মিথ্যা মামলা দিয়ে মানুষকে ঘরছাড়া ও এলাকা ছাড়া করা, জেল-জুলুম, হয়রানিসহ ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সংঘটিত করে চলেছে সেনাবাহিনী ও তাদের মদদপুষ্ট সংস্কারপন্থী ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সন্ত্রাসী গোষ্ঠীরা। পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি ঘটনা ঘটলে জনসংহতি সমিতিকে দায়ী করে ফেসবুকে ফেইক আইডি ও অনলাইন পোর্টালে অপপ্রচার যেমনি চালানো হয় তেমনিভাবে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্রও থেমে নেই। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর আশ্রয়-প্রশ্রয়ে গত ১লা জুন ২০২০ থেকে রাঙ্গামাটি সদর উপজেলায় জীবতলী ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পাড়ায় সেনা-সমর্থিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সংস্কারপন্থী ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সেখানে অবস্থান করছেন, এবং এলাকার স্থায়ীয় মানুষকে হুমকি, ধামকি, মারধর, জোরপূর্বক চাঁদা আদায়, মোবাইল ছিনতাই ও জীবতলীস্থ জনসংহতি সমিতির সদস্যদের ফোন করে হুমকি প্রদান ইত্যাদি সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছে।
সেনাবাহিনী, গোয়েন্দা বাহিনী, ক্ষমতাসীন দল, প্রশাসন তথা সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে হানাহানি ও সংঘাত, রক্তপাত, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, অস্ত্রবাজি অভিযোগ এনে জনসংহতি সমিতি এবং আঞ্চলিক দল নামধারী কতপয় সংগঠনের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে আসছে। অথচ সেনাবাহিনী, গোয়েন্দা বাহিনী, ক্ষমতাসীন দল, প্রশাসন তথা সরকারই পার্বত্য চুক্তি সম্পাদনের পর থেকেই তথাকথিত আঞ্চলিক দল সৃষ্টি করে একের পর এক ভূঁইফোড় সংগঠন ও সশস্ত্র গোষ্ঠীকে খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজি, সশস্ত্র সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাতে মদদ দিয়ে আসছে। তারা নিজেরাই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সৃষ্টি করে সন্ত্রাসী কার্যক্রম মদদ দিয়ে পার্বত্যাঞ্চলে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে, আবার তারাই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে চলেছে এবং সন্ত্রাসী খোঁজার নামে গুলি চালিয়ে নিরীহ লোকদের হত্যা করছে। আর সন্ত্রাসীদের দমনের নামে চুক্তি বাস্তবায়নে সোচ্চার ব্যক্তিবর্গ ও জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বের উপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে।
অন্যদিকে সেনাবাহিনী গত ৮ মে ২০২০ রাতের বেলায় সংস্কারপন্থী সন্ত্রাসীদেরকে এসকর্ট দিয়ে সরাসরি খাগড়াছড়ি থেকে গাড়িতে করে এসে বান্দরবানে নিয়ে আসে। ইতোমধ্যে তারা একাধিক গ্রুপে বিভক্ত হয়ে বান্দরবান জেলার বেশ কয়েকটি এলাকায় সেনা ক্যাম্পের পাশে অবস্থান নিয়েছে। বান্দরবানে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করা, সংস্কারপন্থীদের দিয়ে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা, জুম্মদের উপর সেনাবাহিনীর দমন-পীড়ন জোরদার ও জায়েজ করা এবং বান্দরবানের পরিস্থিতিকে আরও জটিল ও অস্থিতিশীল করার হীনউদ্দেশ্য নিয়েই সেনাবাহিনী ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এবং প্রত্যক্ষ সহায়তা দিয়ে সংস্কারপন্থী সন্ত্রাসীদের বান্দরবানে অনুপ্রবেশ করিয়েছে। সেনাবাহিনী, গোয়েন্দাবাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতৃত্বসহ সরকার জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বকে ধ্বংস করার মাধ্যমে জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনকে নস্যাৎ করার লক্ষ্যে জনসংহতি সমিতির নেতৃত্ব ও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে সোচ্চার ব্যক্তিবর্গকে ‘সন্ত্রাসী’, ‘চাঁদাবাজ’, ‘অস্ত্রধারী’, ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ হিসেবে পরিচিহ্নিত করতে উঠে পড়ে লেগেছে।
তারই অংশ হিসেবে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজ-অস্ত্রধারী খোঁজার নামে বান্দরবানে আনাচে-কানাচে রাত-বিরাতে তল্লাশী অভিযান, গ্রেফতার, মিথ্যা মামলা দায়ের, এলোপাতাড়ি গুলি করে হত্যা, গুম, হুমকি, হয়রানিসহ ফ্যাসীবাদী দমন-পীড়ন চালাচ্ছে, অন্যদিকে প্রত্যক্ষভাবে আশ্রয়-প্রশ্রয়ের মাধ্যমে সংস্কারপন্থী ও গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ-এর সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের পূর্ণ সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। ২৬ জুন ২০২০ পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের তিন কো-চেয়ার যথাক্রমে সুলতানা কামাল (বাংলাদেশ), ড. এল সাস্টামাটোপাউলাউ (গ্রীস) ও মীরনা কানিংহাম কেইন (নিগারাগুয়া) স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় যে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত, অন্তত ২১ জন ইউপিডিএফ ও জেএসএস কর্মীকে ওয়ারেন্ট ছাড়াই গ্রেফতার করা হয়। নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক ২৪ ব্যক্তি নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। এইসব গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে রয়েছেন ব্যবসায়ী, জনপ্রতিনিধি ও ছাত্র। সুস্থ তদন্তপূর্বক বিচারের দাবী জানিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন।
গত ১০ জুলাই ২০২০ রোয়াংছড়িতে সেনাবাহিনীর এলোপাতাড়ি ব্রাশফায়ারে গুলিবিদ্ধ হয়ে শান্তিলতা তঞ্চঙ্গ্যা নিহত ও তার ৫ বছরের শিশু আহত হয়েছে। সে সময় রাংগোয়াই তঞ্চঙ্গ্যা, শান্তিলতা চাকমা ও তাদের দুই সন্তানকে নিয়ে জুমের কাজ শেষে বাড়িতে ফিরছিলেন। সেনাবাহিনী তাদেরকে সন্ত্রাসী মনে করে তাদের উপর এলোপাতাড়ি গুলি বর্ষণ করে। নির্বিচারে এভাবে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করা সেনাবাহিনীর মানবাধিকার উলঙ্গ লংঘন বলে অনেকে তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছেন। এই নৃশংস ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত ১০ জুলাই ২০২০ ‘প্রথম আলো’তে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে, “আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অঘটনের পেছনে না ছুটে অঘটন যাতে না ঘটে, তা নিশ্চিত করতে হবে”। সেজন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে অস্থায়ী সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করা প্রয়োজন। কিন্তু শাসকগোষ্ঠী ও তার আর্শিবাদপুষ্ট সেনাবাহিনীরা আজ উল্টো পথে হাঁটছে। ‘প্রথম আলো’তে প্রকাশিত সংবাদে আরও বলা হয়েছে, “পার্বত্য চট্টগ্রামকে কোনোভাবেই চুক্তির আগের অবস্থায় নিয়ে যাওয়া যাবে না। সেখানে খুনোখুনি বন্ধ করতেই হবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, পার্বত্য চট্টগ্রামে সব অঘটন ও গোষ্ঠী দ্বন্দ্বের মূলে চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়া। তাই সরকারকে সমস্যার রাজনৈতিক দিকটিও বিবেচনায় নিতে হবে”।
শাসকগোষ্ঠী বাংলাদেশের এক দশমাংশ অঞ্চল পার্বত্য চট্টগ্রামে দেশের এক-তৃতীয়াংশ সৈন্য মোতায়েন করেছে। চুক্তি অনুযায়ী আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদ সম্বলিত বিশেষ শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার কথা থাকলেও আজ আঞ্চলিক পরিষদকে সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, উন্নয়ন কার্যক্রম, পার্বত্য জেলা পরিষদ ও উন্নয়ন বোর্ডের কার্যক্রম, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, এনজিও কার্যক্রম ইত্যাদি সমন্বয় সাধন ও তত্বাবধানের কোন ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। ধার নেই, তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দারের মতো আঞ্চলিক পরিষদকে অর্থব করে রাখা হয়েছে।
দেশের শাসকগোষ্ঠী মুসলিম সেটেলার, উগ্র জাতীয়তাবাদী ও উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে একদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে চলেছে, অন্যদিকে জুম্মদের জায়গা-জমি জবরদখল, স্বভূমি থেকে উচ্ছেদ, সাম্প্রদায়িক হামলা, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, নারী ধর্ষণ ইত্যাদি কার্যক্রমে মদদ দিয়ে চলেছে। জনসংহতি সমিতির তথ্য অনুসারে বিগত ছয় মাসে (২০২০ সালের জানুয়ারি-জুন) মুসলিম সেটেলার কর্তৃক ২৩ ঘটনা সংঘটিত করা হয়েছে। এই ২৩টি ঘটনায় ৪ জন জুম্ম নারী ও শিশুর উপর সহিংসতা, জুম্মদের উপর ২টি সাম্প্রদায়িক হামলা, ভূমি জবরদখল কিংবা বেদখলের চেষ্টায় ৮১৮ পরিবার ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখী, জুম্ম গ্রামবাসীদের ৩,০২১ একর জায়গা জবরদখল, ভূমি বিরোধকে কেন্দ্র করে জুম্মদের বিরুদ্ধে ২টি মামলা দায়ের ও ২ জনকে গ্রেফতার এবং প্রায় ৫,০০০ একর রাবার বাগান পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
অপরদিকে সরকারি সুবিধা, টেণ্ডারবাজি, সরকারি প্রকল্প আত্মসাতের সুযোগ দিয়ে শাসকদলের মধ্যে সুবিধাবাদী ও দালাল জুম্মলীগ সৃষ্টি করে তাদের মাধ্যমে পার্বত্য চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে চলেছে। পার্বত্য চুক্তির সুবিধা নিয়ে তিন পার্বত্য সংসদীয় আসনের সাংসদ ও পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বার, ক্ষমতাসীন দলের পাতি নেতা থেকে শুরু করে এসব জুম্ম লীগাররা এলাকার জনগণের উন্নয়নের নামে হরিলুট করে চলেছে। উন্নয়নের নামে এলাকার বন ও পরিবেশকে দ্রুততার সাথে ধ্বংস করে ফেলছে। দেখতে দেখতে তারা আজ আঙ্গুল ফুলে কলা গাছে পরিণত হচ্ছে।
বাংলাদেশ শাসকগোষ্ঠী জুম্মদের সমস্ত তাঁবেদার ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে একত্রিত করে পার্বত্য চট্টগ্রাম জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে বানচাল করার জন্য শেষ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। একদিকে জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব বিলুপ্তির জন্য শাসকগোষ্ঠীর চারিদিকে ব্যুহচক্র রচনা করে চলেছে, অন্যদিকে মানবতার দুশমন, সরকারের লাঠিয়াল বাহিনী সংস্কারপন্থী ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) জুম্ম জনগণের আন্দোলনের শক্তিকে গলাটিপে হত্যা করে পাহাড়ের বুকে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েমে হিংস্র ও উন্মাদ হয়ে পড়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের এহেন নাজুক পরিস্থিতিতে একথা স্মরণ করা যেতে পারে যে, পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের সময় জুম্ম জনগণের প্রাণপ্রিয় নেতা জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা জুম্ম জনগণের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, “চুক্তি স্বাক্ষর করতে যতটুকু সংগ্রাম ও ত্যাগ করতে হয়েছে, চুক্তি বাস্তবায়ন করতে তার চেয়েও অধিক সংগ্রাম ও ত্যাগ স্বীকার করতে হবে”। ২২ বছর আগে প্রিয় নেতার বক্তব্যে উচ্চারণ করা উক্তি আজ পাহাড়ের বুকে দৃশ্যমান এবং বিজ্ঞানভিত্তিক সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। আজ অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠী তাঁবেদার বাহিনী ও ভাড়াটে গুন্ডা বাহিনীকে দিয়ে জুম্ম জনগণের আন্দোলনের ঐক্যবদ্ধ শক্তির উপর অত্যন্ত সুক্ষ্মভাবে হিংস্র আক্রমণ শুরু করেছে, সুতরাং লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হয়ে যান।
যেকোন ত্যাগের বিনিময়ে জুম্ম জনগণের জাতির জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব রক্ষা করতেই হবে। তাই তো জনসংহতি সমিতি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য অধিকতর ও উচ্চতর আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। এই সংগ্রাম ও আন্দোলনের মূলশক্তি হলো পাহাড়ের সমগ্র জুম্ম জনগণ। প্রিয়নেতা সন্তু লারমা বলেছিলেন, “আমার মনের-চিন্তায় আমি এখনও তারুণ্যেকে স্থান দিই এবং গভীরভাবে উপলদ্ধি করি”। চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য উচ্চতর আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে পার্বত্য চট্টগ্রামের ছাত্র ও যুব সমাজের প্রতি এটাই তাঁর অন্যতম একটা আহ্বান। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে সফল করার জন্য এই তারুণ্য শক্তি সবাই অমানুষিক পরিশ্রম করবে, তাদের মনে ক্লান্তির পাখিরা ডাক দেবে না। আমরা করবো জয় একদিন, সেটি অন্তরের গভীরে গেঁথে নিয়ে সংগ্রামের ময়দানে নিজেকে সঁপে দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসের মঞ্চ থেকে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে তাড়াতে তারুণ্য শক্তিরা সদল বলে সামিল হবে।
পাহাড়ের সমকালীন পরিস্থিতি ও বাস্তবতা দেখে মনে হয়, শাসকগোষ্ঠীর আর্শিবাদপুষ্ট সেনাবাহিনী ও তাদের সমর্থিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠী, প্রতিক্রিয়াশীলরা তাদের পরাজয়কে নিশ্চয়ই মেনে নেবে না, বান্দরবান জেলায় রোয়াংছড়িতে তাদের উলঙ্গ আচরণেই পরিষ্কার করে ফুটে উঠেছে, তারা সর্বশেষ মরণ-কামড় দিতে চাইছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরে পাহাড়ের বুকে শান্তি স্থাপনের বিপরীতে প্রতি মুহুর্তে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পূর্ব অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ আজ সেই পরিস্থিতি ও বাস্তবতা মর্মে-মর্মে উপলদ্ধি করছে। জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সশস্ত্র সংগ্রামের ইতিহাস থেকে শাসকগোষ্ঠী এতটুকু শিক্ষা গ্রহণ করেনি। শিক্ষা গ্রহণ করেনি বলে আজও প্রতি মুর্হুতে পাহাড়ের বুকে রক্তের স্রোতধারা বয়ে দিয়ে চলেছে।
পাহাড়ের রক্তের হোলিখেলায় মেঠে উঠেছে শাসকগোষ্ঠী ও সেনা-সমর্থিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সংস্কারপন্থী নামক রাজাকারেরা। আজ শাসকগোষ্ঠী ও সেনা-সমর্থিত প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীরা পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসের রথচক্রের গতিরোধ করার জন্য যত অপচেষ্টাই করুক না কেন, জুম্ম জনগণের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে কখনো রোধ করতে পারবে না, আন্দোলন অবশ্যই হবে, অত্যাচারী স্বৈরশাসকের একদিন অনিবার্যভাবে পরাজয় ঘটবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসের মঞ্চ থেকে একদিন শাসকগোষ্ঠী ও তার তাবেদার বাহিনীকে বিদায় নিতে হবে। নিপীড়িত জুম্ম জনগণের জয় হোক!