হিল ভয়েস, ৫ জুলাই ২০২০, পার্বত্য চট্টগ্রাম: জুন ২০২০ মাসে জুম্ম জনগণের উপর দমন-পীড়নের অংশ হিসেবে সেনাবাহিনী কর্তৃক ২টি নতুন ক্যাম্প স্থাপন এবং গোয়েন্দা বাহিনী কর্তৃক ১ জুম্মকে অপহরণসহ অন্তত ৪ জুম্মকে গ্রেফতার ও ৩ ব্যক্তিকে মারধর করা হয়েছে বলে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির জুন মাসের মাসিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া জুন মাসে সেনা-সমর্থিত সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হাতে ২ জুম্ম খুন ও ৩ জনঅপহরণের শিকার হয়েছে এবং মুসলিম সেটেলার কর্তৃক কমপক্ষে ৪০ একর জমি জবরদখলের মুখে রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির তথ্য ও প্রচার বিভাগ কর্তৃক ৫ জুলাই ২০২০ প্রকাশিত “জুন ২০২০: পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকার পরিস্থিতির উপর মাসিক প্রতিবেদন” শীর্ষক মাসিক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, কোভিড-১৯ ভাইরাসের বিস্তার প্রতিরোধে গৃহীত লকডাউন ব্যবস্থার কারণে সারাদেশের ন্যায় পার্বত্য চট্টগ্রামেও জনজীবন, অর্থনৈতিক জীবন ও জীবিকা, সামাজিক জীবন নজিরবিহীন এক কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে বাধ্য হয়েছে। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও বাস্তবতা, প্রেক্ষাপট এবং স্বাতন্ত্র্যপূর্ণ নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্টের কারণে এই পরিস্থিতি যেন আরও সংকটজনক হয়ে উঠেছে। একদিকে দীর্ঘ ২৩ বছরেও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় আদিবাসী জুম্ম জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনধারা যেমন থমকে দাঁড়িয়েছে, তেমনি সরকার ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর চুক্তিবিরোধী ভূমিকা ও ষড়যন্ত্র; জুম্ম বিরোধী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর আগ্রাসন এবং সরকার ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর তল্পীবাহক, দালাল, সুবিধাবাদী ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর নানা উৎপীড়ন, অত্যাচার ও সন্ত্রাসের কারণে জুম্মদের স্বাভাবিক ও সামগ্রিক জীবনধারা বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে।
সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে বন্ধ রেখেছে। ফলে চুক্তিতে স্বীকৃত অধিকার থেকে জুম্মরা যেমন বঞ্চিত হচ্ছে, তেমনি চুক্তির আলোকে স্থাপিত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের ভূমিকা তথা বিশেষ শাসনব্যবস্থার কার্যকারিতা আজ মুখ থুবড়ে পড়েছে। বস্তুত সরকার, সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিগণ নিজেরাই আজ পার্বত্য চুক্তি লংঘন ও এর স্বার্থবিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। চুক্তির পূর্বের মতই পার্বত্য চট্টগ্রামে আবারো সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব ও সেনাশাসন কার্যকর করা হয়েছে। বিশেষত কোভিড-১৯ সংকটের সময়ে সেনাবাহিনী মোতায়েন বা তাদেরকে দায়িত্ব প্রদানের বদৌলতে তারা কোভিড-১৯ মোকাবেলার নামেও সাধারণ জুম্ম জনগণসহ চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে যুক্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও এর সহযোগী সংগঠনের সদস্যদের হত্যা, গ্রেফতারসহ বিভিন্ন ধরনের মানবাধিকার বিরোধী নিপীড়ন-নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে।
শুধু তাই নয়, সেনাবাহিনী ষড়যন্ত্র করে জুম্মদের মধ্য থেকে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী, স্পাই সৃষ্টি করে জুম্মদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিচ্ছে এবং প্রকাশ্যে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা দিয়ে প্রতিনিয়ত পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করে চলেছে। সাম্প্রতিককালে সেনা-সমর্থিত ও মদদপুষ্ট সংস্কারপন্থী ও গণতান্ত্রিক-ইউপিডিএফ’এর জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী সন্ত্রাসী কর্মকান্ড অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। অপরদিকে সরকার, সেনাবাহিনী, বিজিবি, গোয়েন্দা বাহিনী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর বহুমুখী ষড়যন্ত্রে মুসলিম সেটেলারদের কর্তৃক তিন পার্বত্য জেলার বিভিন্ন স্থানে জুম্মদের ভূমি বেদখল করার অপচেষ্টা অনেকাংশে জোরদার করা হয়েছে।
জুন ২০২০ মাসে গোয়েন্দা বাহিনী কর্তৃক ১ জুম্মকে অপহরণসহ সেনাবাহিনী কর্তৃক তিন পার্বত্য জেলায় অন্তত ৪ জুম্মকে গ্রেফতার, ৩ ব্যক্তিকে মারধর করা হয়েছে। এছাড়া জুন মাসে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে ও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে সেনাবাহিনী রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলার বিভিন্ন স্থানে সংস্কারপন্থী ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজির কর্মকান্ড বিস্তারে প্রত্যক্ষ ও উলঙ্গভাবে সহায়তা প্রদান করেছে। অপরদিকে জুন ২০২০ মাসে সেনাবাহিনী পার্বত্য চুক্তি লংঘন করে রাঙ্গামাটি সদর উপজেলায় ১টি এবং খাগড়াছড়ি জেলার গুইমারা উপজেলার হাফছড়ি ইউনিয়নে আরও ১টি নতুন সেনা ক্যাম্প স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
পূর্বের মতই জুন ২০২০ মাসেও সেনা-সমর্থিত সংস্কারপন্থী ও গণতান্ত্রিক-ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীদের হত্যা, অপহরণ, মারধর, চাঁদা দাবি, জরিমানা আদায়, আটক, হুমকি, কোন ব্যক্তিকে গ্রামবন্দি রাখা, জোরপূর্বক সভায় যোগদান করতে বাধ্য করাসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী ও নিপীড়নমূলক কর্মকান্ড অব্যাহত রয়েছে। এমনকি দিন দিন তা আরও বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। জুন মাসে উক্ত দুই দলের সন্ত্রাসীদের হাতে ২ জুম্ম খুন, ৩ জন অপহরণ, ৫ জন মারধর, ৩ ইউপি সদস্য হুমকি, ৪ ব্যক্তির ৪টি মোবাইল ছিনিয়ে নেয়ার শিকার হওয়াসহ অনেকেই চাঁদা ও জরিমানা প্রদানে এবং আটক, হুমকি, গ্রামবন্দি, জোরপূর্বক সভায় যোগদানে বাধ্য হয়েছে।
তবে জুন ২০২০ মাসে সেনাবাহিনীর মানবাধিকার লংঘনমূলক বিভিন্ন কর্মকান্ড এবং সংস্কারপন্থী ও গণতান্ত্রিক-ইউপিডিএফ’এর সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের পাশাপাশি, উদ্বেগজনকভাবে সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ও অবৈধভাবে বসতি প্রদানকারী মুসলিম সেটেলারদের কর্তৃক নতুন করে জুম্মদের ভূমি বেদখলের তৎপরতা। তারা এমনকি স্থানীয় প্রশাসনের নাকের ডগায় এসব অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি রাঙ্গামাটি জেলার লংগদু উপজেলার পৃথক ৩টি জায়গায়, খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি উপজেলার একটি জায়গায় এবং বান্দরবান জেলার লামা উপজেলার একটি জায়গায় ও নাইক্ষ্যংছড়ি আরেক জায়গায় বহিরাগত মুসলিম সেটেলারদের কর্তৃক এধরনের ভূমি বেদখলের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। ফলে সেসব জায়গায় সাম্প্রদায়িক সংঘাতের সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছে।
জুন ২০২০ মাসে মুসলিম সেটেলারদের কমপক্ষে ৪০ একর জমি জবরদখল ও ৮ জুম্ম পরিবার শিকার হয়েছে। অন্যদিকে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে করোনাভাইরাসের লকডাউন ভেঙ্গে কক্সবাজারের শরণার্থী ক্যাম্প থেকে পালিয়ে এসে রোহিঙ্গারা অবাধে বান্দরবান জেলায় প্রবেশ করছে বলে রিপোর্ট পাওয়া গেছে। বান্দরবান পৌরসভার ৩নং ওয়ার্ডের কালাঘাটার ‘পাইংসি ঘোনা’ নামক পাড়ায় তারা আশ্রয় নেয়। রোহিঙ্গা সশস্ত্র জঙ্গীরা নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় বাংলাদেশ-মিয়ারমার সীমানার ৩৯-৪১নং পিলার দিয়ে মিয়ানমার থেকে এনে ইয়াবা ও বিভিন্ন ধরনের মাদক এবং স্বর্ণ ব্যবসার সাথে জড়িত বলে জানা গেছে।