হিল ভয়েস, ৫ জুন ২০২০, পার্বত্য চট্টগ্রাম: কোভিড-১৯ ভাইরাসের কারণে জনজীবন অচলাবস্থার মধ্যেও গত মে মাসে সেনাবাহিনী কর্তৃক ১৭টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় অন্তত ২৬টি বাড়িতে তল্লাসী চালানো হয়েছে এবং সেনা-মদদপুষ্ঠ সংস্কারপন্থী ও গণতান্ত্রিক-ইউপিডিএফ কর্তৃক ১৩টি ঘটনায় ৮ জন অপহরণ ও ৩টি জায়গায় গুলি বর্ষণের ঘটনা ঘটেছে বলে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মে মাসের মানবাধিকার পরিস্থিতির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
৫ জুন ২০২০ শুক্রবার পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির তথ্য ও প্রচার বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত ও প্রচারিত “মে ২০২০: পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকার পরিস্থিতির উপর মাসিক প্রতিবেদন” শীর্ষক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় যে, কোভিড-১৯ করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় সারাদেশের ন্যায় পার্বত্য চট্টগ্রামেও লকডাউনের কারণে জনজীবন যেখানে অচলাবস্থার মধ্যে পড়েছে এবং অর্থনৈতিক জীবন ও জীবিকা যেখানে কঠিন এক বাস্তবতা অতিক্রম করছে, সেখানে এই সময়েও বাংলাদেশ সরকার ও রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক আদিবাসী জুম্ম জনগণের উপর দমন, পীড়ন, নিয়ন্ত্রণ, নির্যাতন এবং পার্বত্য চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী ষড়যন্ত্র থেমে নেই। বরং এই কোভিড-১৯ মোকাবেলায় সৃষ্ট বাস্তবতার আড়ালে সরকার ও রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক ষড়যন্ত্র এবং চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে সোচ্চার অধিকারকর্মীদের অপরাধী হিসেবে পরিচিহ্নিত করার অপচেষ্টা ক্রমাগত জোরদার হয়ে চলেছে।
সরকার ও রাষ্ট্রীয় বাহিনী একদিকে রাষ্ট্রযন্ত্র ও প্রশাসনিক ক্ষমতাকে অপব্যবহার করে পার্বত্য চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম জাতীয় অস্তিত্ব পরিপন্থী নানা কর্মকান্ড ও নীলনকশা বাস্তবায়ন করে চলেছে, অপরদিকে তাদের সৃষ্ট ও মদদপুষ্ঠ সংস্কারপন্থী ও গণতান্ত্রিক-ইউপিডিএফকে দিয়ে পরিস্থিতিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। বস্তুত চুক্তি-পূর্ব সময়ের মতই পার্বত্য চট্টগ্রামে নিবিড় সামরিক শাসনসহ বিস্ফোরন্মুখ এক যুদ্ধপরিস্থিতি সৃষ্টি এবং জুম্মদের জাতিগতভাবে নির্মূলীকরণের আয়োজন পাকাপোক্ত করা হয়েছে। এখানে একদিকে রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক এবং অপরদিকে তাদের ভাড়াতে সশস্ত্র গোষ্ঠী সংস্কারপন্থী ও গণতান্ত্রিক-ইউপিডিএফক র্তৃক হত্যা, মামলা, গ্রেফতার, তল্লাসী, হুমকিসহ মানবাধিকার লংঘন, যখন তখন, যত্রতত্র সামরিক অভিযান ও হামলা ইত্যাদি নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে দেখা দিয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার, মানবাধিকার এবং পার্বত্য চুক্তির আলোকে স্বীকৃত অধিকারকে পদদলিত করে সেনাশাসন ‘অপারেশন উত্তোরণ’ এর বদৌলতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীসহ গোয়েন্দা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তথা সামরিক প্রশাসন পূর্বের মতই পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক অভিযান পরিচালনা করে প্রতিনিয়ত দমন, পীড়ন, হয়রানি, নির্যাতন, ধর্মীয় পরিহানি, তল্লাসী, বাড়ি ঘেরাও, আটক, গ্রেফতার, হত্যা ইত্যাদি চালিয়ে যাচ্ছে। বস্তুত পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়নকে নস্যাৎ করা ও জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে ধুলিস্যাৎ করা, সর্বোপরি জুম্ম জনগণকে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে জাতিগতভাবে নির্মূলীকরণের হীন উদ্দেশ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত এসকল রাষ্ট্রীয় বাহিনী চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে সোচ্চার জনসংহতি সমিতির নেতা-কর্মী ও সমর্থক জনগণকে ‘সন্ত্রাসী’ ও ‘চাঁদাবাজ’ তথা অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের দমনের নামে সর্বাত্মক এই নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে।
তারই অংশ হিসেবে গত মে মাসে ১ জন আহত, ১ জনকে আটকাবস্থায় অমানুষিক নির্যাতন, অন্তত ২৬টি বাড়িতে তল্লাসী, ৪টি জুমঘর ভেঙে দেয়া, ১টি বৌদ্ধ বিহার নির্মাণে বাধা, ১টি নতুন সেনাক্যাম্প নির্মাণের উদ্যোগসহ প্রায় প্রতিনিয়ত সেনা টহল অভিযান, অহেতুক হয়রানি ও হুমকি প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া বান্দরবানে সেনাবাহিনীর আলিকদম-কুরুকপাতা-পোয়ামুহুরী সড়ক নির্মাণের ফলে ম্রো, ত্রিপুরা ও মারমা জনগোষ্ঠীর ৬০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব সংরক্ষণের লড়াইকে ধ্বংস করার জন্য এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাশাসন স্থায়ীকরণসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে ইসলামী সম্প্রসারণ সুপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষে সরকার ও রাষ্ট্রীয় বাহিনী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আশ্রয়-প্রশ্রয়, মদদ ও পৃষ্টপোষকতা দিয়ে সংস্কারপন্থী ও গণতান্ত্রিক-ইউপিডিএফ খ্যাত সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে ব্যবহার করে পার্বত্য চট্টগ্রামে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে চলেছে। বস্তুত সরকার ও রাষ্ট্রীয় বাহিনী এইসব সশস্ত্র গোষ্ঠীকে তাদের ক্রীড়নকে পরিণত করে তাদেরকে দিয়ে খুন, অপহরণ, মুক্তিপণ, চাঁদাবাজি, হুমকি প্রদান করে যাচ্ছে এবং চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে সোচ্চার অধিকারকর্মী ও জনগণকে জিম্মী করে রাখার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
ইতোমধ্যে রাষ্ট্রীয় বাহিনী প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ও স্কর্ট দিয়ে এইসব সশস্ত্র গোষ্ঠীকে খাগড়াছড়ি জেলা থেকে রাঙ্গামাটি জেলার সুবলং, রাঙামাটি সদরের বিভিন্ন স্থান এবং বান্দরবান জেলায় নিয়ে এসে জনগণের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র জোরদার করেছে। বিগত মে২০২০ মাসে সংস্কারপন্থী ও গণতান্ত্রিক-ইউপিডিএফ কর্তৃক ৭ জন এবং মগপাটি কর্তৃক ১ জন, মোট ৮ জন অপহৃত, অপহরণের পরমোটা অংকের মুক্তিপণ আদায়, ২ জনকে মারধর, ৩ জন নারীকে হুমকি, ৩টি জায়গায় গুলি বর্ষণ এবং অসংখ্য পরিবার ও পেশাজীবীর কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলাধীন লংগদু উপজেলায় বাঙালি সেটেলারের সাম্প্রদায়িক হামলায় ৬ জন জুম্ম আহত এবং বাঘাইছড়ি উপজেলার আমতুলী ইউনিয়নে একজন জুম্ম প্রহৃত হন। করোনাভাইরাসের পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে বান্দরবান জেলার আলিকদম উপজেলায় স্বেচ্ছাসেবকলীগের সাবেক সভাপতি জয়নাল আবেদিন কর্তৃক তৈন মৌজার নয়াপড়া ইউনিয়নের এলাকা হতে হাজার হাজার ঘনফুট পাথর অবৈধভাবে উত্তোলন করে পাচার করা; থানচিতে সাংগু সেতুর পাশ্ববর্তী সাংগু নদী থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের নেতাসহ ২ ব্যবসায়ী কর্তৃক অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা এবং লামা বন বিভাগের আওতাধীন বমু রিজার্ভ এর কুলাইক্ষাঝিরি হতে ৭০ বছরের উর্দ্ধে এইসব দুর্লভ মাতৃবৃক্ষ কেটে পাচার করার ঘটনা ঘটেছে।