হিল ভয়েস, ২৬ জুন ২০২০, ঢাকা: চলমান কোভিড-১৯ মহামারীর সময়ে বিশেষত পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ এনে গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে আন্তর্জাতিক পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন।
২৬ জুন ২০২০, শুক্রবার পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের তিন কো-চেয়ার যথাক্রমে সুলতানা কামাল (বাংলাদেশ), ড. এল সাস্টামাটোপাউলাউ (গ্রীস) ও মীরনা কানিংহাম কেইন (নিগারাগুয়া) স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় যে, বিগত কয়েক মাসে তিন পার্বত্য জেলায় মহামারী ছড়িয়ে পড়ায় নিরাপত্তা বাহিনী ও পুলিশ এবং ভিজিল্যান্টি গ্রুপ কর্তৃক ব্যাপক মানবাধিকার লংঘনের রিপোর্ট পাওয়া গেছে, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে হয়রানি, ভীতিপ্রদর্শন, একতরফা বাড়ি তল্লাশী, ধর্মীয় উপাসনালয়ে হামলা, অপহরণ এবং আদিবাসী নেতা, কর্মী ও কয়েদিদের বিরুদ্ধে হুমকি। যে সময় মহামারী খাদ্যাভাব ও চিকিৎসা সেবা লাভের ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে আদিবাসী জনগণকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, সেসময় নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক হয়রানি ও ভীতিপ্রদর্শন এবং এইসব ভিজিল্যান্টি গ্রুপগুলোর কর্মকান্ড অব্যাহতভাবে শোচনীয় করে তুলেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয় যে, দুই নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক পার্টি, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) ও ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) কর্তৃক প্রেরিত তথ্য অনুসারে, পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম অধিকারকর্মীদের ভীতিপ্রদর্শন, হুমকি প্রদান ও হামলা করতে ভিজিল্যান্টি গ্রুপ গঠন ও অভিযানের অভিযোগ সম্পর্কে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। উভয় রাজনৈতিক গোষ্ঠীই ২০১৭ সাল হতে এধরনের কর্মকান্ডের তথ্য দিয়েছেন এবং অভিযোগ করেছেন যে, এসব ঘটনা সংঘটনকারীরা নিরাপত্তা বাহিনীর সহযোগিতা নিয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড, জোরপূর্বক নিখোঁজ, নির্যাতন, হয়রানি ও ভীতিপ্রদর্শন করে। এসব প্রতিবেদন অনুসারে, ভিজিল্যান্টি গ্রুপ এই বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত অন্তত ২৯ জন লোককে অপহরণ করেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে দুই রাজনৈতিক পার্টি, পিসিজেএসএস ও ইউপিডিএফ, সামরিক বাহিনী কর্তৃক ভীতিপ্রদর্শন ও হয়রানির করার কয়েকটি ঘটনারও রিপোর্ট দিয়েছে। এসব রিপোর্ট অনুসারে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত, অন্তত ২১ জন ইউপিডিএফ ও জেএসএস কর্মীকে ওয়ারেন্ট ছাড়াই গ্রেফতার করা হয়। এইসব গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে রয়েছেন ব্যবসায়ী, জনপ্রতিনিধি ও ছাত্র, পক্ষান্তরে নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক ২৪ ব্যক্তি নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে অন্তত ৫ জন পুরুষ ও নারী রয়েছেন যারা মহামারীর প্রাথমিক পর্যায়ে বাড়ি ফেরার সময় সামরিক চেকপোস্টের সামনে পুলিশ ও সামরিক বাহিনী দ্বারা শারীরিকভাবে নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন। অন্তত ৫ জন নারী যৌন হামলার শিকার হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। আদিবাসী গ্রামে অন্তত দুটি আলাদা হামলার ঘটনা সংঘটিত করা হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছেÑ একটি খাগড়াছড়ির গুইমারায় এবং অন্যটি রাঙ্গামাটির লংগদুতে। এপ্রিল ও মে’র মধ্যে অন্তত তিনটি বৌদ্ধ বিহারে অগ্নিসংযোগ হামলা সংঘটিত হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নিকট অভিযোগ করেও ফল পাওয়া যায়নি। জামিনে জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পরও অন্তত ১৯ জন জুম্মকে পুনরায় গ্রেফতার করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত ৩জুন, খাগড়াছড়ি জেলা কারাগারে ইউপিডিএফ নেতা পুলক চাকমার মৃত্যু বিষয়ে এখন পর্যন্ত তদন্ত হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয় না।
এছাড়া পিসিজেএসএস মহামারীর সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থানীয় জনগণের কাছ থেকে কর্পোরেট গোষ্ঠী কর্তৃক ব্যাপক ভূমি বেদখলের অভিযোগের উপর রিপোর্ট প্রদান করেছে। রিপোর্টের এক ঘটনায়, একটি কোম্পানি, মেরিডিয়ান, স্থানীয় সরকারী কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় বান্দরবানের লামায় ৩০০০ একর ভূমি অবৈধভাবে দখল করার এবং এলাকা থেকে জোরপুর্বক ¤্রাে পরিবারগুলোকে উচ্ছেদ করার অভিযোগ রয়েছে। ইউপিডিএফ এর প্রদত্ত অন্য এক রিপোর্টে, খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গায় ২০ জন সামরিক সদস্যদের একটি দল একটি পরিত্যক্ত ক্যাম্পের জায়গার এলাকা দাবি করে জুমচাষীদের জুমঘর ভেঙে দিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
ঢাকা-ভিত্তিক শিক্ষক-গবেষক ও অধিকারকর্মীদের একটি দলের সাম্প্রতিক এক স্বাধীন প্রতিবেদনেও মহামারীর সময় আদিবাসী সম্প্রদায়ের গার্মেন্ট শ্রমিকদের মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা চিহ্নিত করা হয়েছে। মহামারীর সময় তাদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সম্পর্কে ন্যুনতম নির্দেশনাসহ শ্রমিকদের কাজে ফিরতে হবে কিনা সে সম্পর্কে মালিক ও বিজিএমইএ কর্তৃক সৃষ্ট বিভ্রান্তি এসব শ্রমিকদের অধিকারের প্রতি গভীর অসম্মান প্রদর্শন করেছিল, যে শ্রমিকরা একটা মজুরি স্তরে মালিকদের ও দেশের জন্য প্রচুর বৈদেশিক মূদ্রা আনতে সাহায্য করে, যা তাদেরকে সামান্যই ছেড়ে দেয় যদি স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ব্যয় কোন অর্থে পরিপূরণ করা হয়, যদি তারা কোভিড-১৯ ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হন। এই পরিস্থিতি গার্মেন্ট শ্রমিকদের অরক্ষিত অবস্থাকে আরো একবার উন্মোচিত করেছে। তাদের কর্মস্থান থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে ফিরে আসায়, পুলিশ কর্তৃক এইসব গার্মেন্ট শ্রমিকদের উপর অভিযুক্ত শারীরিক হামলাও আদিবাসী নারী গার্মেন্ট শ্রমিকরা কীভাবে তাদের জীবনের সর্বোচ্চ ঝুঁকির সম্মুখীন হয়েছিল তা দেখিয়ে দেয়।
এমতাবস্থায়, পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন পার্বত্য চট্টগ্রামে সুবিচার নিশ্চিত করতে অবিলম্বে পদক্ষেপ গ্রহণ করা, মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগসমূহ তদন্ত করা এবং সেইসব দায়ীদের জবাবদিহির আওতায় আনার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে আহ্বান জানিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন নিম্নোক্ত জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে আহ্বান জানায়:
১. নিরাপত্তা বাহিনীর কোন বাধা ব্যতিরেকে এলাকার সকল জনগণকে চিকিৎসা সুযোগ প্রদানের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ প্রদান করা।
২. সকল প্রকার হয়রানি, ভীতি প্রদর্শন, অথবা একতরফা বাড়ি তল্লাশি থেকে বাংলাদেশের আদিবাসী জনগণকে সুরক্ষা নিশ্চিত করা।
৩. পার্বত্য চট্টগ্রাম ইস্যু নিয়ে কর্মরত সিভিল সোসাইটি গ্রুপগুলো যাতে খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সাহায্য বিতরণে সহযোগিতার উদ্দেশ্যে কোন প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই এলাকার সকল অংশে প্রবেশ করতে পারে তা নিশ্চিত করা।
৪. কারারুদ্ধ ব্যক্তিদের দ্রুত মুক্তি নিশ্চিত করা এবং মহামারীর অধিকতর বিস্তার প্রতিরোধে তাদেরকে বাড়ি ফিরতে অনুমতি প্রদান করা।
৫. উপরোল্লিখিত হয়রানি, ভীতিপ্রদর্শন, আক্রমণ ও জোরপূর্বক নিখোঁজ সম্পর্কিত সুনির্দিষ্ট অভিযোগসমূহ বিষয়ে নিরপেক্ষ ও দ্রুত তদন্ত পরিচালনা করা, এবং ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি ন্যায়বিচার ও ঐসব দায়ীদের জন্য জবাবদিহি নিশ্চিত করা।