হিল ভয়েস, ১১ জুন ২০২০, বিশেষ প্রতিবেদন: সাম্প্রতিক সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ, হিন্দু ও খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বী আদিবাসী জুম্মদেরকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিতকরণের কার্যক্রম জোরদার হয়েছে। বিশেষ করে আর্থিক সুযোগ–সুবিধা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, গৃহ নির্মাণ, গরু–ছাগল পালন, সুদ–মুক্ত ঋণ ইত্যাদি প্রলোভন দেখিয়ে বান্দরবান জেলায় ধর্মান্তরকরণ চলছে। বান্দরবান জেলায় ‘উপজাতীয় মুসলিম আর্দশ সংঘ’, ‘উপজাতীয় মুসলিম কল্যাণ সংস্থা’ ও ‘উপজাতীয় আর্দশ সংঘ বাংলাদেশ’ ইত্যাদি সংগঠনের নাম দিয়ে জনবসতিও গড়ে তোলা হয়েছে এবং এসব সংগঠনের মাধ্যমে জুম্মদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিতকরণের কাজ চালানো হচ্ছে।
এমনকি লেখাপড়া শেখানোর লোভ দেখিয়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদেরকে তাদের মাতা–পিতা থেকে নিয়ে ঢাকা, গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় পিতা–মাতার অজান্তে মাদ্রাসায় ভর্তি করানো এবং ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করার সংবাদ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। অন্যদিকে জুম্ম নারীদেরকে ফুসলিয়ে কিংবা ভালবাসার প্রলোভন দেখিয়ে বিয়ে করা এবং ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করার ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে বিয়ের কিছুদিন পর বিবাহিত জুম্ম নারীকে শারীরিক নির্যাতন করা এবং নানা অজুহাতে তাড়িয়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এমনকি বিবাহিত জুম্ম নারীর সাথে যৌন জীবনের ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতেও দেখা গেছে।
বলাবাহুল্য, স্মরণাতীত কাল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি অমুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো, বম, খিয়াং, লুসাই, পাংখো, খুমী, চাক প্রভূতি আদিবাসী জাতি স্মরণাতীত কাল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করে আসছে, যারা বৌদ্ধ, হিন্দু ও খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বী এবং সম্মিলিতভাবে নিজেদেরকে ‘জুম্ম’ (পাহাড়ি) নামে পরিচয় দেয়।
১৯৪৭ সালে ভারত–পাকিস্তান বিভক্তির সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে বৌদ্ধ, হিন্দু ও খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বী এসব আদিবাসী জাতিসমূহের জনসংখ্যা ছিল ৯৭.৫%। আর ছিল মুসলিম বাঙালি জনসংখ্যা ১.৫% ও হিন্দু বাঙালি জনসংখ্যা ১.০%। ভারত বিভক্তি আইনকে সম্পূর্ণভাবে লঙ্ঘন করে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ব্রিটিশরা পার্বত্য চট্টগ্রামকে ইসলামিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের সাথে যুক্ত করে দেয়। এতে জুম্ম জনগণ প্রতিবাদ করে এবং ভারতে অন্তর্ভুক্তির দাবি জানায়। কিন্তু তৎকালীন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস তথা ভারতীয় নেতৃবৃন্দের উদাসীনতার কারণে জুম্ম জনগণের দাবি অগ্রাহ্য থেকে যায়।
অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির পর পরই তৎকালীন পাকিস্তান সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করার কার্যক্রম হাতে নেয়। তার মধ্যে অন্যতম হলো জুম্ম জনগণের রক্ষাকবচ হিসেবে বিদ্যমান ব্রিটিশ প্রবর্তিত আইন, বিধি ও বিধিব্যবস্থা বাতিল করা; আইন লঙ্ঘন করে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে পার্বত্য চট্টগ্রাম বসতি প্রদান করা; উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়নের (ডেভেলাপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের) মাধ্যমে জুম্ম জনগণের অর্থনৈতিক মেরুদ– ভেঙ্গে দেয়া এবং তাদের চিরায়ত ভূমি ও বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ করা; সর্বোপরি বৌদ্ধ, হিন্দু ও খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বী আদিবাসী লোকগুলোকে ধীরে ধীরে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশের সরকারসমূহও অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করার পাকিস্তানী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ অব্যাহত রাখে। যার অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত সরকারি অর্থায়নে সমতল অঞ্চলের চার লক্ষাধিক মুসলমান পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি প্রদান করা। সেই সাথে চলতে থাকে নানা প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে কিংবা হুমকি–ধামকি দিয়ে জুম্মদেরকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিতকরণের কার্যক্রম। ফলে যেখানে ১৯৪৭ সালে জুম্ম ও মুসলিমদের অনুপাত ছিল ৯৮ জন জুম্ম ২ জন মুসলিম, আজ ৭৩ বছর পর এই অনুপাত উল্টো হতে শুরু হয়েছে। বর্তমানে ৫৫ জন মুসলিম ৪৫ জন জুম্ম। আর আগামী ২০৪৭ সালের ঠিক উল্টো চিত্র অর্থাৎ ৯৮ জন মুসলিম ২ জন জুম্ম, এমনই অনুপাত দাঁড়াবে পার্বত্য চট্টগ্রাম নামক অঞ্চলে জনসংখ্যার।
১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পর ইসলাম ধর্মে দীক্ষিতকরণের কাজ কিছুটা ভাটা পড়েছিল। কিন্তু দীর্ঘ ২৩ বছরেও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায়, বিশেষ করে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরকারী শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকারের একনাগাড়ে দীর্ঘ ১২ বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকার পরও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় প্রশাসনের ছত্রছায়ায় মৌলবাদী গোষ্ঠী কর্তৃক জুম্মদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরকরণের কাজ বর্তমানে চাঙ্গা হয়েছে। নিম্নে এর কিছু উদাহরণ তুলে ধরা হলো–
শিক্ষার সুযোগ দানের ফাঁদ পেতে মাদ্রাসায় ভর্তি ও ইসলামে ধর্মান্তরিতকরণ
দেশের কিছু প্রত্যন্ত আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকার শিশুদের জোরপূর্বকভাবে তাদের স্ব স্ব ধর্ম থেকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হচ্ছে। এসমস্ত পরিবারসমূহ আর্থিক অস্বচ্ছলতা ও তাদের এলাকা থেকে স্কুলের দুর্গম্যতার কারণে তাদের শিশুদের স্কুলে পাঠাতে না পারায়, দরিদ্র ও নিরক্ষর আদিবাসী পরিবারের শিশুরা এরূপ ধর্মান্তরকরণের প্রধান শিকার। এই অমুসলিম আদিবাসী সম্প্রদায়কে ধর্মান্তরিত করার উদ্দেশ্যে ধর্মীয় মৌলবাদীরা সারা দেশকে ‘ইসলামীকরণ’-এর উদ্দেশ্য নিয়ে গোপনে কাজ করে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্ম জনগোষ্ঠীকে প্রলুব্ধ করার জন্য শিক্ষাকে ব্যবহার করছে।
দরিদ্র অনেক আদিবাসী মানুষের সাধ আছে, কিন্তু সাধ্য নেই নিজেদের শিশুদের লেখাপড়া করানোর। আর সেটাকেই ধর্মান্তরিতকরণের মোক্ষম সুযোগ ও সম্ভাবনা হিসেবে বেছে নেয় ইসলামী মৌলবাদী চক্র। দরিদ্র ও নিরক্ষর আদিবাসী পরিবারের শিশুরা এরূপ ধর্মান্তরকরণের প্রধান শিকার।
যেহেতু পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকাংশ আদিবাসী জুম্ম জনগোষ্ঠী প্রত্যন্ত এলাকায় বসবাস করে থাকে, সেহেতু জুম্ম শিশুদের ভালো স্কুলে পড়ার সুযোগ থাকে না, যদিও সেখানে আদৌ স্কুল থাকে। স্কুলে যেতে ও স্কুল থেকে ফিরে আসতে আদিবাসী শিশুদের পায়ে হেঁটে অতিক্রম করতে হয় কয়েক মাইল। এছাড়া জুম্ম জনগোষ্ঠী জাতীয় সমাজের অন্যতম সবচেয়ে দরিদ্রতম অংশ হওয়ায়, আর্থিক দুরবস্থার কারণে অনেক আদিবাসী পরিবারের তাদের শিশুদের ভালো স্কুলে পাঠানোর সামর্থ্য থাকে না। ফলে তাদের শিশুদের জন্য ভালো শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারে এমন যে কোন সুযোগ যখন তারা খোঁজে।
জানা গেছে, ইসলামী ধর্মীয় মৌলবাদীরা তারা ভালো স্কুলে শিক্ষার ব্যবস্থা করবে এই প্রলোভন দেখিয়ে এবং বিভিন্ন সুযোগ–সুবিধার কথাবলে আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল আদিবাসী পরিবারগুলোকে আকৃষ্ট করে। কিন্তু বাস্তবে এইসব ধর্মীয় মৌলবাদীরা আদিবাসী শিশুদের কখনোই ভালো স্কুলে নিয়ে যায় না, বরং ইসলামে ধর্মান্তরিত করার অভিসন্ধি নিয়ে তাদেরকে ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাদ্রাসায় নিয়ে যায়। সেখানে সেই শিশুদের ধীরে ধীরে নিজের পরিবার, সমাজ ও সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে ইসলামী ধর্ম ও সংস্কৃতি শিখতে ওগ্রহণ করতে বাধ্য করে।
গত ১ জানুয়ারি ২০১৭, ঢাকায় এক মাদ্রাসায় পাচার হওয়ার সময়, পুলিশ বান্দরবান শহরের ‘অতিথি আবাসিক হোটেল’ থেকে চার আদিবাসী শিশুকে উদ্ধার করে। ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তিরিত আবু বক্কর সিদ্দিক (৪৫), যার পূর্ব নাম মংশৈ প্রু চৌধুরী ও মোহাম্মদ হাসান (২৫) এই পাচারকাজের অন্যতম মূল হোতা বলে জানা যায়। তাদেরকে উক্ত চারজন শিশুসহ হাতেনাতে গ্রেফতার করা হয়। অপরদিকে তাদের সঙ্গী সুমন খেয়াং গ্রেফতার থেকে পালিয়ে যায়। গ্রেফতারের পর বান্দরবান সদর থানায় একটি মানবপাচার মামলা দায়ের করা হয়। উদ্ধারকৃত শিশুরা সকলেই বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি উপজেলার তারাছা ইউনিয়নের বাসিন্দা। অপরাধ চক্রের সদস্যদের কর্তৃক শিশুদের পরিবারগুলোকে ঢাকায় বিনা খরচে তাদের শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করার প্রলোভন দেখানো হয়।
উদ্ধারকৃত শিশুরা, যারা সকলেই বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি উপজেলার তারাছা ইউনিয়ন থেকে, তারা হল– হেডম্যান পাড়ার উহ্লা অং মারমার মেয়ে মাসিং সই মারমা (১২) ও পাচিনু মারমার ছেলে থোয়াইলা মারমা (৮); বেতছড়ামুখ পাড়ার সাউপ্রু মারমার মেয়ে নুছিং উ মারমা (১২) এবং বৈদ্য পাড়ার অং থোয়াই চিং মারমার মেয়ে মেচিং প্রু মারমা (১৩)। পাচারকারী চক্রের সদস্যদের কর্তৃক শিশুদের পরিবারগুলোকে ঢাকায় বিনা খরচে তাদের শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করার প্রলোভন দেখানো হয়।
সুবিধাবঞ্চিত ও অশিক্ষিত পরিবেশ থেকে আসা অনেক প্রত্যন্ত আদিবাসী পরিবার তাদের শিশুদের অধিকতর ভালো ভবিষ্যতের মিথ্যা আশার ফাঁদে পড়েন। তবে এটা সবসময় বিনামূল্যে হয় না, পরিবারগুলোতে কয়েক হাজার টাকা থেকে শুরু করে কিছু টাকা খরচ করতে হয়। যেহেতু ধর্মান্তরিতকরণ সম্পর্কিত কোন বিষয়ে ইঙ্গিত দেয়া হয় না, তাই মা–বাবারা সহজেই তাদের শিশুদের জন্য ভালো ভবিষ্যতের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়।
কাপেং ফাউন্ডেশন ২০১৭ সালের তার বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনের পূর্ববর্তী সংখ্যায় আদিবাসী শিশুদের জোরপূর্বক ধর্মান্তরিতকরণের এরকম কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরে। তার পূর্ববর্তী ৭ বছরে অন্তত ৭০ জন আদিবাসী শিশু, অধিকাংশই খ্রিস্ট্রীয় ও হিন্দু ধর্মের সাথে যুক্ত, তাদেরকে দেশের বিভিন্ন অংশ থেকে পুলিশ কর্তৃক উদ্ধার করা হয়। এসব শিশুদের অধিকাংশই বান্দরবান জেলা থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল।
এর পূর্বে ২ জানুয়ারি ২০১৩, পুলিশ ঢাকার সবুজবাগ থানাধীন আবুযোর জিফারি মসজিদ কমপ্লেক্স নামের এক মাদ্রাসা থেকে ১৬ আদিবাসী শিশুকে উদ্ধার করে। শিশুদের জোর করে ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হয়। ত্রিপুরা ও চাকমা জাতিভুক্ত এসব শিশুদের পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতারণা করে নিয়ে যাওয়া হয়। এছাড়া ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ আদিবাসী ত্রিপুরা শিশুদের আরেকটি গ্রুপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতৃবৃন্দ ও ত্রিপুরা স্টুডেন্ট ফোরামের নেতৃবৃন্দ কর্তৃক ঢাকা থেকে উদ্ধার করা হয়। শিশুদেরকে বান্দরবানের চিম্বুক এলাকা থেকে ফিরোজপুর জেলার একটি মাদ্রাসায় নেয়া হচ্ছিল। তাদেরকে একটি মিশনারী স্কুলে ভর্তি করানো হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল।
এর আগে ২০১২ সালের জুলাই মাসেও গাজীপুর ও ঢাকার বিভিন্ন মাদ্রাসা থেকে ১১ জন আদিবাসী ত্রিপুরা শিশুকে উদ্ধার করা হয়। তাদের মধ্যে গাজীপুর জেলার মিয়া পাড়ার দারুল হুদা ইসলামী মাদ্রাসা থেকে ৮ শিশুকে এবং ঢাকার মোহাম্মদপুরের এক মাদ্রাসা থেকে ১ নারী শিশু ও গুলশানের দারুল হুদা মাদ্রাসা থেকে ২ শিশুকে উদ্ধার করা হয়।
২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে পুলিশ কর্তৃক কেবল বান্দরবান শহরের এক মোটেল ‘অতিথি বোর্ডিং’ থেকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ৩৩ শিশুকে উদ্ধার করে। বান্দরবানের থানচি উপজেলা থেকে এই শিশুদের সংগ্রহ করে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল ধানমন্ডী আদর্শ মদিনা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হবে এই প্রতিশ্রুতি ও প্রলোভন দেখিয়ে। এসময় পুলিশ গর্ডন ত্রিপুরা ওরফে রুবেল, ঢাকার দারুল ইহসান মাদ্রাসার ছাত্র আবু হোরাইরা ও শ্যামলীর বাসিন্দা আবদুল গণি নামের শিশুদের পাচারকারী তিন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে।
অন্যদিকে লাদেন গ্রুপ নামে খ্যাত মুহাম্মদিয়া জামিয়া শরিফা লামা উপজেলায় দখল করেছে ৭ হাজার একর পাহাড় ভূমি। লাদেন গ্রুপের কার্যক্রমের মধ্যে অন্যতম হলো আদিবাসীদের বসতভিটা ও জুমভূমি জবরদখল করা, বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে অর্থ দিয়ে আদিবাসী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ও খ্রিস্টানদের ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করা এবং ঢাকায় উন্নত ও উচ্চ শিক্ষার প্রলোভন দিয়ে আদিবাসী শিশু–কিশোরদের কৌশলে ঢাকায় নেয়া। এই গ্রুপ ফাসিয়াখালীর মৌজার হেডম্যান মংথুই প্রু মারমার ২৫ একর জমিসহ ফাসিয়াখালী ও সাঙ্গু মৌজার আদিবাসী ম্রো, ত্রিপুরা ও মারমাদের শত শত একর জমি অবাধে দখল করে নিয়েছে। লাদেন গ্রুপের বিরুদ্ধে জায়গা–জমি জবরদখল করে অবৈধভাবে বাণিজ্যিক বাগান করা এবং এসব অঞ্চলে জঙ্গি তৎপরতা চালানোর অভিযোগ রয়েছে।
অপরদিকে বান্দরবান জেলার লামা উপজেলায় ‘কোয়ান্টাম ফাউন্টেশন’ নামে জাতীয় পর্যায়ের একটি এনজিও কর্তৃক ২০০১ সাল প্রতিষ্ঠিত কোয়ান্টাম স্কুল ও কলেজে নানা প্রলোভন দেখিয়ে জুম্ম ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি করা হয়। কোয়ান্টাম আবাসিক স্কুলে জুম্ম ছাত্রছাত্রীদের মাতৃভাষায় কথা বলতে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়ে থাকে। ফলে মাতৃভাষায় কথা বলার সুযোগের অভাবের কারণে জুম্ম শিশুরা মাতৃভাষা ভুলে যেতে থাকে। বিশেষ করে কোয়ান্টামে ইসলাম ধর্মের প্রতি অনুরক্ত ও সেই ধর্মীয় সংস্কৃতিতে জুম্ম ছাত্রছাত্রীদের গড়ে তোলার অভিযোগ রয়েছে। উক্ত কলেজে জুম্ম ছাত্রছাত্রীদেরকে সরাসরি ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিতকরণে উদ্বুদ্ধ না হলেও ইসলামী আদব–কায়দা ও জীবনাচারে গড়ে তোলা হয়। তাদেরকে শ্রেণিকক্ষে ‘সালামালিকুম’, ‘ওলাইকুম সালাম’ ইত্যাদি ইসলামী সম্বোধন ব্যবহার করতে বাধ্য করা হয়। নামাজ কিভাবে আদায় করতে হয় তা শেখানো হয়।
কোয়ান্টাম সংস্থা শুরু থেকে জুম্মদের মনজয় করার উদ্দেশ্যে প্রত্যেক কোরবান ঈদের সময় শত শত গরু জবাই করে আশপাশের এলাকার সকল জুম্মদেরকে ডেকে ডেকে তালিকা করে গরুর মাংস ভাগবন্টন করে দিতো। এর পেছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল আপন সেজে সহজ সরল জুম্মদের, বিশেষ করে ম্রোদের জায়গা জমি দখল করে নেয়া ও তাদেরকে ইসলামী খাদ্য–সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত করা। ৬–৭ মে ২০১৭ তারিখে ঢাকা থেকে এক নাগরিক প্রতিনিধিদল কোয়ান্টাম কর্তৃক লামায় ম্রো গ্রামবাসীর প্রায় ২,০০০ একর ভূমি বেদখল করা এবং জুম্ম ছাত্রছাত্রীদের মাতৃভাষায় কথা বলার সুযোগের অভাবের কারণে তাদের মাতৃভাষা ভুলে যাওয়ার অভিযোগ তদন্ত করতে গেলে সেনাবাহিনী বাধা প্রদান করে। ফলে তদন্ত না করে নাগরিক প্রতিনিধিদলকে ঢাকায় ফিরতে হয়।
বাংলাদেশের সংবিধান দেশের শিশুদেরকে জোরপূর্বক ধর্মীয় শিক্ষা প্রদানে নিষেধ করে। সংবিধানের ৪১(২) ধারায় উল্লেখ রয়েছে যে, ‘কোন শিক্ষা–প্রতিষ্ঠানে যোগদানকারী কোন ব্যক্তির নিজস্ব ধর্ম–সংক্রান্ত না হইলে তাঁহাকে কোন ধর্মীয় শিক্ষ গ্রহণ কিংবা কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা উপাসনায় অংশগ্রহণ বা যোগদান করিতে হইবে না।’ তবু আদিবাসী শিশু ও তাদের পরিবার শিক্ষার ফাঁদে পড়ায়, আদিবাসী শিশুদের জোরপূর্বক ইসলামে ধর্মান্তরিতকরণ অব্যাহতভাবে চলছে। রাষ্ট্র একদিকে আদিবাসী শিশুদের শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হচ্ছে, অপরদিকে ইহা সংবিধানকে লংঘন করছে।
তবু এ পর্যন্ত সরকারি সংস্থা ও বেসরকারি সংগঠনসমূহের তরফ থেকে আদিবাসী শিশুদের তাদের নিজেদের ধর্ম থেকে অপর একটি ধর্মে দীক্ষিতকরণ থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে কোন উদ্যোগ দেখতে পাওয়া যায় না। সরকারি ও বেসরকারি উভয় সংস্থা থেকে কতজন শিশু ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়ে সে ব্যাপারে যথাযথ কোন তথ্য–উপাত্ত পাওয়া যায় না। যদি অবিলম্বে এ ধরনের ধর্মান্তরকরণ প্রতিরোধে কোন পদক্ষেপ নেয়া না হয়, তাহলে অনেক আদিবাসী শিশু তাদের বিশ্বাস, সংস্কৃতি, ভাষা, ও জীবিকা হারিয়ে ফেলবে।
উপজাতীয় মুসলিম আর্দশ সংঘ ও তাবলীগ জামায়াত কর্তৃক আলিকদম ও লামায় ধর্মান্তরকরণ
বান্দরবান জেলার আলিকদম উপজেলা থানচি সড়ক ১১ কিমি এলাকায় ১ জানুয়ারি ২০১৮ সালে ১৪টি অসহায় ও গরিব পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা দেওয়ার নাম করে তাদের মাঝে সুদ মুক্ত ঋণ, তাদের মাঝে গৃহপালিত গরু–ছাগল দেওয়া হবে, তাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগ করে দেওয়া সহ নানা ধরনের প্রলোভন দেখিয়ে দরিদ্র পাহাড়িদের মন ভুলিয়ে সুযোগ বুঝে গোপনে উপজাতীয় মুসলিম আর্দশ সংঘ ও দাওয়াতে তাবলীগের মাধ্যমে তাদেরকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করছে।
গোপন তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, ঈদগাঁও মডেল হাসপাতাল এন্ড ডায়াবেটিস কেয়ার সেন্টারের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ডা: মো: ইউসুফ আলী মানবকল্যাণ কাজ তথা অসহায়, গরীব, দু:স্থ রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবাসহ নানান মানব সেবামূলক কাজকর্মের মাধ্যমে স্থানীয় গরিব পাহাড়িদের সম্পর্ক গড়ে তোলে। তেমনি তার হাসপাতালে চিকিৎসা করতে আসা উপজাতীয় মুসলিমদের সাথে পরিচয় ঘটে। তাদের সমস্যার কথা জেনে এ পরিবারগুলোর সন্তানদের লেখাপড়ার সুব্যবস্থা করে। বর্তমানে বিভিন্ন মাদ্রাসায় ১৯ জনের মত জুম্ম ছেলেমেয়ে মুসলিম রয়েছে। অনেকে ঈদগাঁও’র বিভিন্ন মাদ্রাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া শেষ করছে।
কয়েকজন উপজাতীয় মুসলিমদের সাথে কথা বলে জানা যায় যে, ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে তাদেরকে বিভিন্নভাবে আর্থিক সহযোগিতা ও সুযোগ সুবিধা দেওয়া হবে; গরু–ছাগল, নগদ অর্থ, গৃহ নির্মাণ করে দেওয়াসহ সুদ ঋণ দেওয়া হবে ইত্যাদি প্রলোভন দেখানো হয়। খ্রীস্টান ধর্ম থেকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়া আবু বক্কর ছিদ্দিক (যার পূর্বের নাম অতিরম ত্রিপুরা) বলেন, কোর্ট গিয়ে এফিডেভিট মূলে ধর্ম ও নাম পরির্বতন করে মুসলিম হতে হয়। তিনি আরো বলেন, বর্তমানে তার ছেলে সাইফুল ইসলাম (পূর্বের নাম রাফেল ত্রিপুরা) ডা: ইউসূফ আলী হাসপাতালে চাকরিরত আছে।
তিনি বলেন, বাইবেলে লেখা আছে যে তোমরা সত্যকে খোঁজ, সত্য তোমাদের মুক্ত করবে। সে সত্যকে খুঁজতে গিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন বলে তিনি জানান। তার মা, বাবা, ভাইসহ সবাই মুসলিম হয়েছে। অন্যদিকে আলিকদমের জেসমিন আক্তার (পূর্বের নাম ঝর্ণা ত্রিপুরা), রোয়াংছড়ির সাদেকুল ইসলাম (জয়খর্ন ত্রিপুরা), গয়ালমারার নুরুল ইসলাম (প্রশান্ত ত্রিপুরা) সবাই এফিডেভিট মুলে ধর্ম ইসলাম গ্রহণ করেছেন বলে জানান। তবে তারা আরো উল্লেখ্য করেন যে, ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর ডা: ইউছুপ আলীর সাথে যোগাযোগ করলে তিনি তাদেরকে মানবিক দৃষ্টিকোণ দিয়ে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন।
এদিকে লামা উপজেলার গয়ালমারা গ্রামে বসাবসরত ত্রিপুরাদের উপজাতীয় মুসলিম কল্যাণ সংস্থা ও উপজাতীয় আর্দশ সংঘ বাংলাদেশ, তাবলিগ ও জামায়াত–এর আলেম হাফেজ মো: জহিরুল ইসলাম, হাফেজ মো: কামাল, মো: মোহাম্মদুল্লাহ, হাফেজ মো: সালামাতুল্লাহ, মৌলভী হেলাল উদ্দিন ত্রিপুরা এবং সাইফুল ইসলাম ত্রিপুরা সভাপতি উপজাতীয় নুও মুসলিম আর্দশ সংঘ তাদের নেতৃত্বে গয়ালমারা ৪৫টি পরিবারকে আর্থিক ও নানা ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে।
অন্যদিকে আলিকদমের জেসমিন আক্তার পূর্বের নাম ঝর্ণা ত্রিপুরা, রোয়াংছড়ির সাদেকুল ইসলাম পূর্বের নাম জয়খর্ন ত্রিপুরা, গয়ালমারায় নুরুল ইসলাম পূর্বের নাম প্রশান্ত ত্রিপুরা সবাই ইসলামী ধর্মান্তরকরণের শিকার হয়েছেন। আলিকদম–থানচি ১১ কিলো এলাকাসহ মোট ৪৫ পরিবার ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছেন।
সরেজমিন তদন্তে জানা যায় যে, বান্দরবান পৌর এলাকার বাস ষ্টেশনে ১৯৯৯ সালের দিকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত ত্রিপুরা ও খিয়াং রয়েছে ৩০–এর অধিক পরিবার এবং টাংকি পাড়ায় ২০০১ সাল থেকে বসবাস রয়েছে নুও ত্রিপুরা মুসলিমদের ১৫–এর অধিক পরিবার।
লামা উপজেলার লাইনঝিড়িতে ১৯৯৫ সাল থেকে ত্রিপুরা মুসলিমদের ১৭–এর অধিক পরিবার ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছে। গত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মোঃ রাসেল ত্রিপুরা (পূর্বের নাম রামন্দ্র ত্রিপুরা)-এর স্ত্রী সারেবান তাহুরা ত্রিপুরা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল। আলিকদম–থানচি সড়কের ক্রাউডং (ডিম পাহাড়) এলাকায় (রূপসী ইউনিয়ন) ২০০০ সাল থেকে ত্রিপুরা মুসলিমদের রয়েছে ১৬ পরিবারের মতো।
দীঘিনালা রিজিয়ন কমান্ডার কর্তৃক ধর্মান্তরকরণ
১৯৯২ সালে দীঘিনালা রিজিয়ন কমান্ডার কর্ণেল মাহবুব হাসান আর্থিক প্রলোভন দেখিয়ে জোর করে আটজন চাকমাকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করেন। ধর্মান্তরিতরা ব্যক্তিরা হলেন– ১. বলিরঞ্জন চাকমা, নামকরণ মোঃ সাজেদ আলী শেখ; ২.স্বর্ণা চাকমা, নামকরণফাতেমা খাতুন; ৩. রসিক গুরি চাকমা, নামকরণ মোসাম্মত রওশন আরা বেগম; ৪. মিলাবো চাকমা, নামকরণ মোসাম্মত তসলিলা খাতুন; ৫. দিঘী কুমার চাকমা, নামকরণ মোঃ আবদুল্লাহ; ৬. সুখী চাকমা, নামকরণ মোসাঃ সখিনা খাতুন এবং ৭. শংকর চাকমা, নামকরণ আবদুল শহীদ মোঃ সাইফুল ইসলাম। তাদের ইসলামে ধর্মে দীক্ষা দেন মৌলবী হাফেজ মোহাম্মদ আবুল বাশার। তাদের শপথনামা পাঠ করান দীঘিনালা থানার নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাসুদ রানা। যাদের ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হয় তারা সকলে দীঘিনালার বানছড়া গ্রামের বাসিন্দা। (সূত্রঃ স্নেহ কুমার চাকমা, জীবনালেখ্য, পৃষ্ঠা# ২০৮)।
চলবে… (পার্বত্য চট্টগ্রামে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিতকরণ–২)….