হিল ভয়েস, ১৪ জুন ২০২০, বিশেষ প্রতিবেদন: পার্বত্য চট্টগ্রামে মৌলবাদী ও জুম্ম বিদ্বেষী কিছু ইসলামী গোষ্ঠী কর্তৃক সুপরিকল্পিতভাবে আদিবাসীদের ইসলামে ধর্মান্তরিত করার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত হচ্ছে। এধরনের পরিকল্পনা বা কার্যক্রম অনেক আগে থেকে শুরু হলেও সাম্প্রতিককালে এর তৎপরতা অনেক জোরদার হয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। ধর্মান্তরিতকরণের এই প্রক্রিয়া স্থানীয়ভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় যেমন চলছে, তেমনি ভালো শিক্ষার প্রলোভন দেখিয়ে আদিবাসী জুম্ম শিশুদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে নিয়ে গিয়ে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করা হচ্ছে।
২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ঢাকা ত্রিবিউন, ইউএনপিও, বুড্ডিস্টডোর.নেট, হেরাল্ডমালয়েশিয়া.কমসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে ও প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি ২০১০ হতে জানুয়ারি ২০১৭ সালের মধ্যে সাত বছরে কেবল পুলিশ কর্তৃক ধর্মান্তরে জড়িত ইসলামী চক্রের হাত থেকে ৭২ জন আদিবাসী জুম্ম শিশুকে উদ্ধার করা হয়েছে। এর বাইরে যে আরও অনেক আদিবাসী পরিবার ও শিশু এধরনের অপরাধী চক্রের শিকার হয়েছেন তা সহজেই অনুমেয়। সাম্প্রতিককালে এই ধর্মান্তরিতকরণের তৎপরতা আরও ব্যাপকতা লাভ করেছে বলে জানা গেছে।
সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে, ইউটিউবে প্রচারিত বিভিন্ন ভিডিও, পোস্ট এবং দেশি-বিদেশী বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন, তথ্য-উপাত্ত থেকে তা আরও সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিগত কয়েক বছরের মধ্যে, বিশেষত কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পরপরই বান্দরবান পার্বত্য জেলার আলিকদম উপজেলাসহ বিভিন্ন এলাকায় আদিবাসীদের এ ধরনের ধর্মান্তরিতকরণের ব্যাপক কার্যক্রমের খবর পাওয়া গেছে। যেখানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সম্মতি ও সহযোগিতা রয়েছে বলে স্বীকার করা হয়েছে।
আপাত দৃষ্টিতে এই ধর্মান্তরিতকরণ প্রক্রিয়াকে বিচ্ছিন্ন বা সাধারণ মনে হলেও নিবিড়ভাবে লক্ষ্য করলে এটি একটি পরিকল্পিত ও সুসমন্বিত কার্যক্রমের অংশ বলে প্রতীয়মান। এই কার্যক্রমে মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর যে প্রত্যক্ষ হাত রয়েছে তা বলাই বাহুল্য। আর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যে এই প্রক্রিয়াকে নিবিড়ভাবে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে তাও সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অপরদিকে ক্ষমতাসীন সরকারি দলের জুম্ম সম্প্রদায়ের স্থানীয় নেতৃত্ব ও কর্তৃপক্ষের চোখের সামনেই এসব নির্বিঘ্নে ঘটে চলেছে। অবশ্য আদিবাসীদের ধর্মান্তরকরণ ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে সহযোগিতা ও মদদদানের ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের সম্পৃক্ততা এর পূর্বেও বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে।
৪ জুন ২০২০ নিপন ত্রিপুরা তার এক ফেসুবুক স্ট্যাটাসে লেখেন, ‘সম্প্রীতির বান্দরবানে আর্থিক অস্বচ্ছলতাকে কাজে লাগিয়ে প্রান্তিক অঞ্চলে বসবাসরত ত্রিপুরাদের অবাধে ধর্মান্তরিত করার ইতিহাস অনেক বছরের পুরনো। সাম্প্রতিক সময়ে তা বহুগুণ বেড়ে গেছে।’
একই দিন ‘লংদুকসা মউগ্রো এম’ তার এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে এ প্রসঙ্গে লেখেন, ‘সহজ-সরল সাধারণ জুম্ম আদিবাসীদের ভুলিয়ে ভালিয়ে ইসলামিকরণ করা হচ্ছে। কিভাবে মোনাজাত করা হয় শেখানো হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে ইসলামিকরণ প্রক্রিয়ার অংশ এটি। এখানে খোদ সরকার সংশ্লিষ্ট রয়েছে বলে জানা গেছে। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের মধ্যে ইসলামিকরণ ও বাঙালিকরণ প্রকল্পের ধুম পড়েছে বান্দরবানের আলীকদমে।’
প্রান্তিকতা, দারিদ্র্য ও নিরক্ষরতাই ধর্মান্তরিতকরণের সুযোগ
পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের দীর্ঘদিনের অন্যতম সুবিধাবঞ্চিত, অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাদপদ ও অবহেলিত এবং রাজনৈতিকভাবে অশান্ত ও অবদমিত এক এলাকা। ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তান আমলে যেমনি এই অঞ্চল চরম অবহেলা, শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার হয়েছে, তেমনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরও এই অঞ্চলের মানুষের রাজনৈতিক অধিকার ও আন্দোলনকে দমন-পীড়নের কারণে জনগণের সামগ্রিক জীবনধারাকে বরাবরই একটা ভঙ্গুর পরিস্থিতি অতিক্রম করতে হয়েছে।
১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধান, সংঘাত নিরসন ও জুম্মসহ স্থায়ী অধিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হলেও বিগত ২৩ বছরেও সেই চুক্তি পূর্ণাঙ্গভাবে, এমনকি চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে পার্বত্য সমস্যার সমাধান, এলাকায় শান্তি ও জনগণের সুষম উন্নয়ন এবং জুম্মদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনধারার উন্নয়ন এখনও সেই তিমিরেই রয়ে গেছে।
বিশেষত চুক্তি স্বাক্ষরকারী দল আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন সরকার টানা একযুগের অধিক ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও, সর্বোপরি চুক্তি লংঘন ও চুক্তির সাথে বিরোধাত্মক ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনজীবনে নেমে এসেছে অনিশ্চয়তা, অস্থিতিশীলতা, হতাশা ও ক্ষোভ। এই অবস্থায় সরকার ও প্রশাসনের ছত্রছায়ায় বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল কর্তৃক বৃদ্ধি পেয়েছে জুম্মদের ভূমি বেদখল, স্বভূমি থেকে উচ্ছেদ, তাদের উপর নিপীড়ন, বঞ্চনা ইত্যাদি। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের আরও অনেক আদিবাসী জুম্মর জীবনধারা অধিকতর প্রান্তিক অবস্থার দিকে যেতে বাধ্য হয়েছে।
একদিকে আদিবাসীদের এই প্রান্তিক অবস্থা, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, আর্থিক দূরবস্থা, তাদের নিরক্ষরতা ও অজ্ঞতা, অপরদিকে সরকার, প্রশাসন ও স্থানীয় স্বার্থবাদীদের আনুকূল্য ও পৃষ্টপোষকতাÑএই দুই বাস্তবতার সুযোগকে কাজে লাগিয়েই ইসলামী মৌলবাদী চক্র তাদের ধর্মান্তরিতকরণের নীলনকশা বাস্তবায়নে ও জোরদারকরণে উৎসাহিত হয়েছে।
বান্দরবান কি ধর্মান্তরকারীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে?
পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন পার্বত্য জেলাই ইসলামী মৌলবাদী ধর্মান্তরকারী গোষ্ঠীর টার্গেট ও কর্মক্ষেত্র হলেও, সাম্প্রতিককালে বান্দরবান পার্বত্য জেলায় ইসলামী গোষ্ঠী কর্তৃক দরিদ্র আদিবাসী জুম্মদের ইসলামে ধর্মান্তরিতকরণ তৎপরতা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। মনে হয়, বান্দরবান যেন এখন ইসলামে ধর্মান্তরিতকরণের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। একটি সূত্রের মতে, বান্দরবান পৌরসভা, আলিকদম, রোয়াংছড়ি, লামাসহ বিভিন্ন এলাকায় ১০টির অধিক জুম্ম মুসলিম পাড়া বা বসতি রয়েছে। এইসব ধর্মান্তরিত জুম্ম মুসলিমদের বলা হচ্ছে ‘নও মুসলিম’ বা ‘উপজাতি মুসলিম’। এই ধর্মান্তরিত মুসলিম বসতিগুলোকে ঘাটি হিসেবে ব্যবহার করে এবং কিছু বাছাইকৃত নও মুসলিমকে সুবিধা দিয়ে তাদের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত ধর্মান্তরের কার্যক্রম সম্প্রসারণের চেষ্টা চলছে।
বান্দরবানের আলিকদম উপজেলা পরিষদ জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা একে এম আইয়ুব খান, ডাঃ ইউসুফ আলী, হাফেজ মাওলানা সালামাতুল্লাহ, আলিকদম সদরের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ফরিদ আহম্মদ, আলিকদম উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আবুলকালাম, মোঃ জাহিদ, সাহাব উদ্দিন, মাওলানা ইমরান হাবিবি, মোহাম্মদ আইয়ুব প্রমুখ এই প্রক্রিয়ায় সক্রিয় রয়েছে বলে অভিযোগ ও বিভিন্ন প্রমাণ পাওয়া গেছে।
অপরদিকে আদিবাসী থেকে ধর্মান্তরিত যেসব নও মুসলিম এসব ধর্মান্তরকরণের সাথে জড়িত তাদের মধ্যে যাদের পরিচয় পাওয়া গেছে, তারা হল- জনৈক চাকমা ধর্মান্তরিত মুসলিম মোঃ শহিদ, উপজাতীয় মুসলিম আদর্শ সংঘের সহ-সভাপতি মৌলভী হেলাল উদ্দিনত্রিপুরা, উপজাতীয় মুসলিম আদর্শ সংঘের সম্পাদক ধর্মান্তরিত মুসলিম ইব্রাহিম ত্রিপুরা, মুসলিম পাড়া মডেল একাডেমির শিক্ষক ধর্মান্তরিত মুসলিম সাইফুল ইসলাম ত্রিপুরা, আবু বক্কর ছিদ্দিক (পূর্ব নাম অতিরম ত্রিপুরা), খাগড়াছড়ির মোঃ আব্দুর রহিম (পূর্ব নাম ভিনসেন্ট চাকমা), মোঃ আব্দুর রহমান (পূর্ব নাম ভন্দ চাকমা), মোঃ ইব্রাহিম (পূর্ব নাম ভবাৎ চাকমা) প্রমুখ।
সম্প্রতি বান্দরবানের আলিকদমের এক টিলায় কলাবাগানের মধ্যে শিশু ও নারীসহ কয়েকজন সাধারণ জুম্মকে মোনাজাতের প্রশিক্ষণের ভিডিও প্রচারিত হয়। ভিডিওটিতে আলিকদম উপজেলা পরিষদ জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা একে এম আইয়ুব খান কর্তৃক মোনাজাত অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করতে দেখা যায়। এতে এসময় ৩ জন শিশু, বিভিন্ন বয়সের ৪ জন নারী, ১০/১১ জন বিভিন্ন বয়সের আদিবাসী পুরুষকে মোনাজাতের প্রশিক্ষণ দিতে দেখা যায়। মোনাজাতে বেশ কয়েকজন মুসলিম বাঙালিও অংশগ্রহণ করেন।
আলিকদম উপজেলা পরিষদ জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা একে এম আইয়ুব খান কর্তৃক ধারনকৃত ও প্রচারিত আরেক ভিডিওতে জানা গেছে, ইতোমধ্যে আলিকদম উপজেলার থানচি সড়ক সংলগ্ন ১১ কিলোমিটার নামক এলাকায় ধর্মান্তরিত মুসলিমদের নিয়ে ‘ইসলামপুর’ নামে একটি পল্লী গড়ে তোলা হয়েছে। স্থাপন করা হয়েছে ‘মুসলিম পাড়া মডেল একাডেমি’। এই ধর্মান্তরিত মুসলিমরা যাতে নিজেদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ভুলে গিয়ে গোঁড়া মুসলিম হিসেবে গড়ে উঠতে পারে সেই উদ্দেশ্যে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে মসজিদ ও মাদ্রাসা। ‘উপজাতীয় মুসলিম আদর্শ সংঘ, বাংলাদেশ’ নামে সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছে। এমনকি এই ধর্মান্তরিত আদিবাসী মুসলিম পরিবারের তরুণীদের সরাসরি মুসলিম ছেলেদের সাথে বিয়ে দেয়ার জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে। ১১ কিলো এলাকায় অন্তত ৪৫ পরিবার আদিবাসী ধর্মান্তরিত মুসলিম রয়েছে বলে জানা গেছে।
স্থানীয় সূত্র অনুযায়ী, মাত্র মাস দুয়েক আগে বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার আলেক্ষ্যং ইউনিয়নের ছাঃলাওয়া পাড়ায় (শীলবান্ধা পাড়া) ৫ মারমা পরিবারকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে। সেই ধর্মান্তরিত পরিবারগুলি হল– ১. অংঙৈসিং মারমা (পরিবারের সদস্য ৫ জন); ২. খ্যাইসাথুই মারমা (পরিবার সদস্য ৪জন); ৩. রেগ্যচিং মারমা (পরিবারের সদস্য ৬ জন); ৪. সিংনুমং মারমা (পরিবারের সদস্য ৫ জন), সাবেক মেম্বর, তার এক মেয়ে ১০-১৫ বছর আগে এক মুসলিম ছেলেকে বিয়ে করে; ৫. লোইসাংমং মারমা (পরিবারের সদস্য ৭ জন)।
জানা গেছে, এরা কেউই জেনে-বুঝে বা আগ্রহী হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেনি। তাদের আর্থিক দূর্বলতার সুযোগে সুকৌশলে তাদেরকে মুসলমান হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। রেগ্যচিং মারমা ও অংঙৈচিং মারমার দুই সন্তানকে ভালো ভবিষ্যতের প্রলোভন দেখিয়ে মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে বিনিময়ে তাদেরকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে। জানা গেছে, সোলার প্যানেল দেওয়ার নাম করে তাদের কাছ থেকে আইডি কার্ড সংগ্রহ করা হয় এবং এরপর তাদেরকে মুসলমান হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
প্রধান হোতা ডাঃ ইউসুফ আলী ও মাওলানা একে এম আইয়ুব খান?
স্থানীয় সূত্র ও বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে, আলিকদমসহ বান্দরবানে আদিবাসী জুম্মদের ইসলামে ধর্মান্তরিতকরণের সাথে সাম্প্রতিককালে সবচেয়ে সক্রিয় ও তৎপর হিসেবে দেখা গেছে ডা: ইউসুফ আলী নামে এক বহিরাগত চিকিৎসক ও আলিকদম উপজেলা জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা একে এম আইয়ুব খানকে। তারা আদিবাসীদের অভাব-অনটনের সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে প্রতিনিয়ত আদিবাসীদের ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন এবং গরীব-অশিক্ষিত আদিবাসীদের ধর্মান্তরের জন্য এফিড্যাভিটসহ আইনি ও আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডাঃ ইউসুফ আলীর গ্রামের বাড়ি বগুড়ায়, তবে বর্তমানে কক্সবাজারে থাকেন। সেখানে ঈদগাহ মডেল হসপিটাল ও ডায়াবেটিস কেয়ার সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও আবাসিক সার্জন হিসেবে দায়িত্বে আছেন। জানা গেছে, তিনি অত্যন্ত সুক্ষভাবে ও সুকৌশলে বান্দরবানের আলিকদমসহ বিভিন্ন এলাকায় যেখানে সুযোগ পাচ্ছেন সেখানে আদিবাসী জুম্মদের ধর্মান্তরিতকরণে সক্রিয়ভাবে সাহায্য-সহযোগিতা, বুদ্ধি-পরামর্শ ও পৃষ্টপোষকতা দিয়ে যাচ্ছেন। অপরদিকে, তিনি যেহেতু নিজে একজন চিকিৎসক এবং আর্থিকভাবে সমর্থ, সেকারণে অনেক সময় বিনা পয়সায় চিকিৎসার নামে অথবা কিছু আর্থিক সহযোগিতার নামেও আদিবাসীদের ধর্মান্তরিতকরণ করছেন।
ডা: মং এ নু চাক এর সাথে ক্যামেরাই ছবি তুলে তিনি গত ৩ জুন তার এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে লেখেন, We hate racism but believe in brotherhood (অর্থাৎ, আমরা বর্ণবাদ ঘৃণা করি, তবে ভ্রাতৃত্বে বিশ্বাস করি)। কিন্তু তিনি যে গরীব আদিবাসীদের সরলতা, দারিদ্র ও শিক্ষার অভাবের সুযোগ নিয়ে তাদেরকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করার মধ্য দিয়ে মুসলিম বাঙালি বর্ণবাদ চাপিয়ে দিচ্ছেন এবং তাদের স্বকীয় সংস্কৃতির ধ্বংস করে চলেছেন সেই বোধ কি তিনি হারিয়ে ফেলেছেন? মধুর কথার ফুলঝুরিতে, মানব সেবার আড়ালে তিনি কি এই আধুনিক যুগেও মধ্যযুগীয় কায়দায় অত্যন্ত অমানবিক ও ঘৃণ্য কাজ করছেন না?
গত ২৮ মে ২০২০ তিনি তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লেখেন, ‘আমাদের এক প্রিয় নওমুসলিমা পারভীন ত্রিপুরা। মানিকগঞ্জের এক মহিলা মাদ্রাসায় পড়ত। মা ও বর্তমান বাবা নও মুসলিম। সে মাদ্রাসায় পড়ালেখার কারণে তার তাকওয়া ছিল প্রশংসনীয়। বাবা-মা মুসলিম হলেও ইসলামি সংস্কৃতির চেয়ে ত্রিপুরা সংস্কৃতিকে প্রাধান্য বেশি দেয়। …তাকে একবার ছুটিতে এনে আর মাদ্রাসায় যেতে দেয় না। সে যেন বাইরে যেতে না পারে এজন্য তার বোরখাটা পুড়ে ফেলে বাবা। তাকে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালায়। সে শর্ত দেয় পাত্রকে হাফেজ ও আলেম হতে হবে। কিন্তু তারা এক ছেলের সাথে তার অমতে বিয়ে ঠিক করে। সে বুঝতে পারে তার ইসলামের উপর চলা বন্ধ হয়ে যাবে। তখন সেতার বান্ধবীর সাথে কথা বলে রাখে। ফজরের আগে উঠে বান্ধবীর বোরখা নিয়ে পালায়। … রাতে খবর পাই সে মাদ্রাসায় গিয়ে পৌঁছেছে। আমরা আশ্বস্ত হই। সে আর বাড়িতে আসে না।’
ডাঃ ইউসুফ আলী পরে এই পারভীন ত্রিপুরার সাথেই কক্সবাজারের ঈদগাহ কেন্দ্রীয় মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা সালামাতুল্লাহ’র বিয়ের ব্যবস্থা করেন।
পারভিন ত্রিপুরার বিষয়ে ফেসবুকের কথোপকথনে জনৈক Hillary Try Mhvc মন্তব্য কলামে লেখেন, ‘দোয়া ত করি ৩/৫ বছর পর মেয়াদ শেষ হলে বাপের বাড়ি দরজায় সামনে আসবেন না পারভিন বেগম ত্রিপুরা আপা’। এর জবাবে, ডাঃ ইউসুফ আলী লেখেন, ‘কেন, অবশ্যই যাবে, শুদ্ধিকরণ মিশন নিয়ে যাবে। অলরেডি তার ছোটভাই কুরআন হিফজ শুরু করেছে।’ এখানে ডাঃ ইউসুফ আলী ‘শুদ্ধিকরণ মিশন নিয়ে যাবে’ বলে কী বোঝাতে চেয়েছেন? এটা কি এই সমস্ত পারভিন বেগম ত্রিপুরা বা চাকমা-মারমা ধর্মান্তরিত মুসলিমদের দিয়ে বেধর্মী বা অশুদ্ধ আদিবাসীদের ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করার মধ্য দিয়েই তিনি তথাকথিত শুদ্ধিকরণ মিশন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথারই সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দেননি?
এই ডা: ইউসুফ আলীর নেতৃত্বেই আলিকদমের ধর্মান্তরিত আদিবাসী মুসলিমদের ‘ইসলামপুর’ নামক মুসলিম পাড়ায় মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মাণ করা হয়। সেখানে তিনি তার নেতৃত্বে কক্সবাজারের বায়তুশ শরফ থেকে ডাক্তারদেরকে নিয়ে এসে মাঝে মধ্যে বিনামূল্যে চিকিৎসা ব্যবস্থারও আয়োজন করেন।
ডা: ইউসুফ আলী তার ১৩ মে ২০২০ তারিখে ছবিসহ এক ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘ডানের বাচ্চা সাইমুনা ত্রিপুরা, পিতা-ওমর ফারুক ত্রিপুরা; বামের বাচ্চা আয়েশা ম্রো, পিতা-ইব্রাহিম ম্রো; মাঝখানে আমি বাঙালি। অনেক পার্থক্য, দুটি বড় মিল। প্রথম মিল আমরা মানুষ আর দ্বিতীয় মিল আমরা মুসলিম।’ বাচ্চা দুটিকে তিনি দুপাশে দুটি রেখে ছবি উঠেন। বাচ্চাগুলো এখনও অবুঝ, দেড়-দুই বছরের বেশি হবে না।
ডা: ইউসুফ আলীর অন্যতম সহচর হচ্ছেন মাওলানা একে এম আইয়ুব খান, যিনি আলিকদম উপজেলা পরিষদ জামে মসজিদেরইমাম। জানা যায়, তিনি আলিকদমের ১১ মাইল এর ধর্মান্তরিত মুসলিমদের যাবতীয় বিষয় দেখাশোনা ও তত্ত্বাবধানসহ বান্দরবানের আদিবাসীদের ইসলামে ধর্মান্তরিতকরণের ক্ষেত্রে অন্যতম সমন্বয়কারীর ভূমিকা পালন করে থাকেন। এই ধর্মান্তরকরণের প্রচার ও প্রসার কাজেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
সম্প্রতি বান্দরবানের আলিকদমের এক টিলায় কলাবাগানের মধ্যে শিশু ও নারীসহ কয়েকজন সাধারণ জুম্মকে মোনাজাতের প্রশিক্ষণ ও দীক্ষা অনুষ্ঠানের ভিডিও প্রচারিত হয়। এতে ৩ জন শিশু, বিভিন্ন বয়সের ৪ জন নারী, ১০/১১ জন বিভিন্ন বয়সের আদিবাসী পুরুষকে দেখা যায়। এসময় বেশ কয়েকজন মুসলীম বাঙালিও অংশগ্রহণ করেন। এই মোনাজাত প্রশিক্ষণ ও দীক্ষা অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন মাওলানা একে এম আইয়ুব খান।
জানুয়ারি ২০১৯ এর দিকে ধারণকৃত এবং পরে ইউটিউবে প্রচারিত এক ভিডিওতে মাওলানা একে এম আইয়ুব খান বলেন, “..সম্মানীত দ্বীনী ভাইয়েরা, আপনারা যারা এই ভিডিওটি দেখতে পাচ্ছেন, আপনারা খুব খেয়াল করেন। কিছুদিন আগেও আমরা একটা ভিডিও দিয়েছিলাম। আমার আইয়ুব খান এই পেইজে। নও মুসলীমদের বান্দরবান উপজেলার আলিকদমের থানচি সড়কে আরকি, থানচি সড়কে এগারো কিলোতে কিছু আমাদের ভাইয়েরা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তাদের কিছু বাচ্চা, প্রায় ১৭-১৮ জন ছেলেদেরকে পড়ানো হচ্ছে মাদ্রাসায়। তাদের জন্য আমাদের এক দ্বিনী ভাই তার আব্বারই ইচ্ছার সোয়াবের জন্য এই যে আমাদের নও মুসলীম ভাইদের জন্য একটা মসজিদ আমরা নির্মাণ করেছি। এই যে আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, এই মসজিদটি..”
তিনি আর বলেন, “…যদি কেউ কিছু করতে চান, আপনারা সরাসরি এসে করতে পারেন। এখানে কোন ধরনের অসুবিধা হবে না। আমরা এখানে সেনাবাহিনীদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছি এবং উনারা আমাদেরকে সহযোগিতা করেন।” তবে ইহা তদন্তের বিষয় যে, তারা তাদের এ কাজে আরও কার কার সহযোগিতা ও পৃষ্টপোষকতা গ্রহণ করছেন।
লক্ষ্য যখন জুম্ম নারী
জুম্মদের ধর্মান্তরিত করার এবং আধিপত্য বিস্তার ও জাতিগত নির্মূলীকরণের অন্যতম পন্থা হিসেবে লক্ষ্যভুক্ত করা হয় আদিবাসী নারীকে। ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, অপহরণ, যৌন হয়রানি ইত্যাদি সহিংসতা ছাড়াও জুম্ম সমাজকে আঘাত করার অন্যতম উপায় হিসেবে বেছে নেয়া হয় তথাকথিত ভালোবাসা বা ছলনার ফাঁদে ফেলে জুম্ম নারীদের করায়ত্ত করা। আর জুম্ম নারীকে বিয়ে করা বা ভাগিয়ে নিয়ে যাওয়া মানেই হচ্ছে তাকে সহজে ইসলামে ধর্মান্তরিত করা।
এই সহিংসতা বা বিয়ে করে ধর্মান্তরিত করা- সবকিছুতেই সরকার বা প্রশাসন তথা রাষ্ট্রের উদাসীনতা, আশ্রয়-প্রশ্রয়, মদদ ও পৃষ্টপোষকতা থাকে। যে কারণে চুক্তির পূর্বে ও পরে শত শত জুম্ম নারী ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যাসহ নানা সহিংসতার শিকার হলেও কোন ঘটনারই যথাযথ ও দৃষ্টান্তমূলক বিচার পাওয়া যায়নি। সাম্প্রতিক কালে ধর্ষণের অভিযুক্তদের কাউকে কাউকে গ্রেফতার করা হলেও শেষ পর্যন্ত তারা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পায় না।
সম্প্রতি সহিংসতার পাশাপাশি, বাঙালি মুসলিমদের কর্তৃক ভালোবাসা বা ছলনার ফাঁদে ফেলে জুম্ম নারীদের বিয়ে করে ধর্মান্তরিত করা বা সমাজ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা, যাকে বলা হচ্ছে ‘লাভ জিহাদ’, সেটা অনেক বৃদ্ধি পাওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এতে অনেক জুম্ম নারী চরম প্রতারণার শিকার হচ্ছে এবং বিপদগ্রস্ত হচ্ছে।
অতি সম্প্রতি এমন প্রতারক ও বিকৃত রুচিসম্পন্ন এক মুসলিম যুবকের প্রতারণা তথাকথিত লাভ জিহাদের শিকার হয় আদিবাসী ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের এক শিক্ষিত নারী। ঐ মুসলিম যুবক প্রেমের অভিনয় করে উক্ত ত্রিপুরা নারীর সাথে শারীরিক সম্পর্কও গড়ে তোলে এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সেসবের ভিডিও ফুটেজ ধারণ করে। একপর্যায়ে মুসলিম যুবকটি ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে মেয়েটিকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করে পরিবার ও সমাজের অমতে বিয়েও করে। পরে ঐ যুবক ত্রিপুরা মেয়েটিকে বিভিন্ন অসামাজিক কর্মকান্ডে জড়িত করার চেষ্টা করে। এসময় মেয়েটি ছেলেটির ভয়ংকর উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে তার কাছ থেকে সরে আসার প্রচেষ্টা চালায়। আর এসময় মুসলিম যুবকটি তাদের শারীরিক সম্পর্কের ভিডিও ফুটেজ সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করে। ফলে মেয়েটি পারিবারিক ও সামাজিকভাবেগভীর সংকটের মধ্যে পড়ে।
গত ৩০ মে ২০২০ Pb Chakma Lxr Wangza তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে Ismail Abir এর একটি পোস্ট শেয়ার করেন। সেখানে Ismail Abir লেখেন, ‘হে মুসলিম যুবকেরা আমাদের “লাভ জিহাদ” চলবে। আমাদের তাকিয়া (মিথ্যাচার) হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ধর্মের মেয়েরা বুঝবে না। তাদের কাছে ভালোবাসা নামক অস্ত্র এমনভাবে প্রয়োগ করো যেন এরা বুঝতে না পারে। তাই আমাদের আগে যে মিশন ছিল সেগুলোকে আপডেট করতে হবে।
যেমন: ১। তাদের ব্লাকমেইল করুন; ২। (এটা অনেকের জন্য অপাঠ্য এবং অশ্রাব্য তাই দেয়া গেল না); ৩। ছলেবলে একবার হলেও বিছানায় নিন, আবার, যদি বিয়ে করতে পারেন তবে নিম্নের কাজ করুন- (১) বিয়ে করে ধর্মান্তর করুন ও হিন্দুদের মাঝে তাকে দিয়ে ইসলাম প্রচার করুন। (২) তাদের পেট থেকে কমপক্ষে ৫টা বা তার থেকে বেশি বাচ্চা জন্ম দিন। আর যদি পারেন একটা বাচ্চা পেটে দিয়ে ছেড়ে দিন। ওই মেয়ে আরেক মুসলিম খুজে নেবে, কোন হিন্দু তাকে গ্রহণ করবে না। (৩) যে কয়টা পারবেন সেই কয়টা বিধর্মীদের বিয়ে করবেন আর পেটে বাচ্চা দিয়ে ছেড়ে দিন।’
উল্লেখ্য যে, এ পর্যন্ত বহু আদিবাসী জুম্ম নারী এধরনের প্রতারণা বা লাভ জিহাদের শিকার হয়ে তাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে বিপর্যয়ের শিকার হয়েছেন। বস্তুত আদিবাসীদের প্রতি সহিংস দৃষ্টিভঙ্গি ও আদিবাসী নারীদের প্রতি পাশবিক লালসা থেকেই এই ধরনের চিন্তা ও ঘটনার জন্ম।
ধর্মান্তরিতকরণ কি জাতিগত নির্মূলীকরণেরই অংশ!
বাংলাদেশের সংবিধানে ‘ইসলাম’কে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। অপরদিকে সংবিধানে, ‘হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমান মর্যাদা ও সমান অধিকার নিশ্চিত করবে’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০১১ সালের শুমারী অনুযায়ী বাংলাদেশে মাত্র ৮.৫% ভাগ হিন্দু এবং মাত্র ১% ভাগ বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও অন্যান্য ধর্মের লোক রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের ইসলাম যেন এই স্বল্প সংখ্যক ভিন্নধর্মী আদিবাসীদের অস্তিত্বও ধ্বংস করতে তৎপর হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামকে আদিবাসী জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চল থেকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করে ইসলামীকরণ করা এবং পার্বত্যাঞ্চল থেকে জুম্মদের জাতিগতভাবে নির্মূলীকরণের অন্যতম অংশ হিসেবে এই ধর্মান্তরিতকরণ চলছে বলে অনেক আদিবাসী জুম্মর অভিযোগ। এমনকি আরাকান, কক্সবাজার ও তিন পার্বত্য জেলাকে নিয়ে একটি ইসলামী জঙ্গী গোষ্ঠীর নতুন একটি ইসলামিক রাষ্ট্র কায়েমের যে অভিপ্রায় ও ষড়যন্ত্র এটি তারই এক অংশ কিনা তাও উড়িয়ে দেয়া যায় না।
বস্তুত দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই এই ইসলামীকরণের ষড়যন্ত্র শুরু হয়। তবে এই কার্যক্রম আরও জোরদার হয় আশির দশকের শুরুতে ১৯৭৯-৮০ সালের দিকে হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দেশের সমতল অঞ্চল থেকে ৪-৫ লক্ষ বহিরাগত সেটেলার বাঙালি পার্বত্য চট্টগ্রামে অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে জুম্মদের জায়গা-জমিতে বসতিদানের মধ্য দিয়ে। ১৯৮০ সালের দিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি জেলার লংগদুতে সৌদি আরব ও কুয়েতের অর্থায়নে স্থাপন করা হয় ইসলামিক মিশনারী সংগঠন ‘আল রাবিতা’। এর রয়েছে হাসপাতাল ও কলেজ।
কার্যত এর প্রদান উদ্দেশ্য ইসলামী ভাবধারাকে সম্প্রসারিত করা, সেটেলার বাঙালিদের সহায়তা এবং আদিবাসী জুম্মদের ইসলামে ধর্মান্তরিতকরণের প্রচেষ্টা চালানো। এই প্রতিষ্ঠানের সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক দেখা যায় মূলত জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র শিবিরের সাথে। লংগদু ছাড়াও, রাঙ্গামাটির বরকল উপজেলায় এবং বান্দরবানের আলিকদম উপজেলায়ও এর হাসপাতাল রয়েছে বলে জানা যায়। ১৯৯০ সালে আল রাবিতা মিশনারী কেন্দ্র আলীকদমে ১৭ জন মারমাকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করে।
বস্তুত এই ধর্মান্তরিতকরণের ফলাফল বা পরিণতি যে আদিবাসী জুম্মদের সংখ্যালঘুকরণ, তাদের উপর সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বা তাদের সংস্কৃতি ধ্বংসকরণ, তাদের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জীবনধারায় ক্ষতিসাধন, জুম্ম অধ্যুষিত পার্বত্য অঞ্চলকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণতকরণ, সর্বোপরি জুম্মদের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে জাতিগতভাবে বিলুপ্তকরণেরই নামান্তর, তা বলাইবাহুল্য।