এম আর ত্রিপুরা
পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত লোমহর্ষক গণহত্যার মধ্যে অন্যতম ১৯৮১ সালে সংঘটিত গোমতি গণহত্যার আজ ৩৯ বছর। সেনাবাহিনী ও মুসলিম সেটেলাররা সংঘটিত করে এই নৃশংস গণহত্যা, যে গণহত্যার সেটেলারদের নেতৃত্ব দিয়েছিল তৎকালীন গোমতি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো: সাদেক মিয়া। এই গণহত্যার ফলে প্রায় ৬০ হাজার জুম্ম নর-নারী ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। তখন আমার বয়স ছিল মাত্র ৯ বছর। যে কিশোর বয়সে সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে হেসেখেলে কৈশোর জীবন পার করার কথা, লেখাপড়া করে নিজেকে গড়ে তোলার কথা, সেই বয়সে এই নৃশংস গণহত্যা, গণহত্যার পর দু:সহ শরণার্থী জীবন এবং সর্বশেষ কোন শর্ত ছাড়ায় স্বদেশে ফিরে এসে আবার প্রতি নিয়ত মৃত্যু মুখে পড়া নিরাপদহীন জীবনে পদার্পণ ইত্যাদি দুর্বিষহ অবস্থা প্রত্যক্ষ করেছি, ভুক্তভোগী হয়েছি। পার করেছি জীবনের কঠিন সময়।
১৯৮১ সালের জুন মাসের ২৬ তারিখ রোজ শনিবার সন্ধ্যা নাগাদ ৩০০ জন মুসলিম সেটেলার বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে ‘আল্লাহ আকবর, নারায়ে তাকবির’ শ্লোগান দিয়ে প্রথমে বেলছড়ি, বৈরাগীছড়া ত্রিপুরা পাড়া, ডাংগি পাড়া, মানিক হাবিলদার পাড়ার গ্রামে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালায়। আগুনের ধোঁয়া এবং তাপে পুরো আকাশ আর এলাকা ছুঁয়ে যায়। আমরা সবাই আযানের শব্দ আর মিছিলের শব্দ শুনে পাশের জঙ্গলে আশ্রয় নিই।
২০/২৫ মিনিটের ব্যবধানে আমাদের গ্রামের কার্বারী ব্রজেন কুমার ত্রিপৃুরা দৌঁড়ে এসে সবাইকে পালাতে বলে এবং এর কিছুক্ষণ পর মুসলিম সেটেলাররা এসে পুরো গ্রামে অগ্নিসংযোগ করে। আমরা পাশের জঙ্গলে লুকিয়েছি জানলে সোটেলাররা আমাদের সকলকে জবাই করে মেরে ফেলতো। আমরা যেখানে লুকিয়ে ছিলাম ঠিক সেখান থেকে ৭/৮ কিলোমিটার হবে ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত। আগুন যখন সমস্ত কিছু ভস্মিভূত করে দিল আমরা আর এক মুহূর্ত ওখানে থাকিনি। ব্রজেন কার্বারীর পরামর্শে আমরা ভারত সীমান্তের দিকে পাড়ি দিই। নারী-পুরুষ, শিশু এবং অন্তসত্তা নারীও ছিল আমাদের সাথে।
রাত তখন ১২/১ টা। গভীর রাতে রাস্তা পার হওয়ার সময় একটা টর্চ বাতির আলো দেখতে পেয়ে ভয়ে সকলে যে যার মত পালাতে থাকে এবং ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। জায়গাটি ছিল শান্তিপুর আর কৈরল্যাছড়ি মাঝামাঝি। প্রকৃতিও যেন কেঁদে ওঠেছে। প্রচন্ড বৃষ্টি সে রাতে। এক কিলোমিটার দূরত্বে টর্চের আলো দেখা গিয়েছিল। ভোর ৪ টার সময়ে আমরা ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্ত চেল্লাছড়া-করল্যাছড়ি বাজারে আমরা পৌঁছে যাই। সেখানে একটি বিওপি-বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) ক্যাম্প রয়েছে। সীমান্ত অতিক্রম করার সময় প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল তা না হলে আমরা ৫/৬ গ্রামের ৩০০০ জন নারী-পুরুষ সকলে ধরা পড়ে যেতাম।
অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, আমার দাদু একজন অন্তসত্তা ও তিনজন নারীসহ সীমান্তে ধরা পড়েন। তাদের সকলকে করল্যাছড়ি বাজারে সারাদিন বসিয়ে রাখা হয়। পরে হরামিয়া নামক এক বাঙালি মুসলিমকে দায়িত্ব দেয়া হয় ভারতের সীমান্তে পৌঁছিয়ে দেবার জন্য। সেই ব্যক্তি দাদু আর দুই নারীকে সীমান্তে পৌঁছে দিতে যান। দাদুর হাতে দুটি ব্যাগ ছিল। ব্যাগ দুটিতে প্রায় ৭ লাখ টাকা আর ১৫০ ভরি স্বর্ণলঙ্কার এবং ২০০ অধিক রৌপ্য ছিল। সীমান্তে না পৌঁছার আগে দাদু এবং নারীদের দু’ভাগে আলাদা করে দেয়া হয়। দু’জন নারীকে সীমান্তে পৌঁছে দেয়া হলেও দাদু আর ফিরে আসেননি। সমস্ত স্বর্ণ, রৌপ্য এবং টাকা কেড়ে নিয়ে দাদুকে মেরে ফেলা হয়।
শ্রী যোগেন্দ্র লাল ত্রিপুরা (হেডম্যান) যিনি গোমতি ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ছিলেন। তাদের গ্রাম এবং আমাদের গ্রামের মধ্যে দূরত্ব মাত্র এক কিলোমিটার হবে। মাঝখানে ৩০০/৪০০ জন মুসলিম পরিবারের চৌদ্দগ্রাম নামে একটা গ্রাম ছিল। সেই গ্রামের পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে আশ্রয় নেয় ৬০০-৭০০ মতো জুম্ম পরিবার। ভয়ে আতঙ্কে সারা রাত কাটিয়ে ভোর হবার পর পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে মনে করে যোগেন্দ্র হেডম্যানের কথায় সবাই গ্রামে ফিরে আসে। গ্রামে ফিরেছে খবর শুনে সেটেলাররা আবারও হামলা করতে যায়। পার্শ্ববর্তী গ্রামের সেটেলার আজিজ-এর নেতৃত্বে ১০০-১৫০ জন মুসলিম সেটেলার সীমান্ত পার করিয়ে দেয়ার ওয়াদা করে সবাইকে জঙ্গলের দিকে ডেকে নিয়ে যায়। তারপর সবাইকে জড়ো করে বেঁধে ফেলা হয়।
এদিকে ডিসি এবং ইউএনও গোমতি বাজার পরিদর্শনে যান এবং বাজারে আটক হওয়া ৫/৬ টি গ্রামের লোককে দেখে ফিরে যান। এর পরে শুরু হয় আসল তান্ডব। সেটেলার আজিজের নেতৃত্বে জঙ্গলে জোড়ায় জোড়ায় বেঁধে রাখা সকল জুম্মকে ধারালো দা দিয়ে একে একে সবাইকে জবাই করে হত্যা করা হয়। তাদের মধ্যে ২ জন গর্ভবতী নারী ছিলেন। তাদেরকে গোপনে বেলছড়ি-বেলতলী সীমান্ত পার করিয়ে নিয়ে যায় কিছু সেটেলার। এ গণহত্যায় মারা যায় প্রায় ৭০০ সাধারণ জুম্ম। সুইচালাং কুমার নামে এক গ্রামের কার্বারীকে দিনে দুপুরে বল্লম দিয়ে আঘাত করে হত্যা করে চাষযোগ্য জমিতে পুতে রাখা হয়। যে গ্রামে হত্যাকান্ড ঘটে সেখান থেকে এক কিলোমিটার দূরত্বে ১৯০নং বান্দরছড়া মৌজার হেডম্যানকে ঈশ্বর যীশুর মতো দু’হাত এবং দু’ পায়ে পেরেক মেরে গাছের সাথে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়।
গদ্দাধর ত্রিপুরা। তিনি একজন কার্বারী। দুই ছেলেসহ তাকে বেঁধে রাখা হয়। তাদের বাবাকে যখন জবাই করছিল মুসলিম সেটেলার রাতখন বড় ছেলে কুসুম জালা ত্রিপুরা (পরে যিনি তাঁর বাবার পর কার্বারী হন) বাঁধা অবস্থায় লাফ দিয়ে পালাতে সক্ষম হয়। ছোট ছেলে কিরন চন্দ্র ত্রিপুরা আর বাবা গদ্দাধর ত্রিপুরাকে মেরে ফেলা হয়।
তখন চলছিল বর্ষার মৌসুম এবং সারা রাত বৃষ্টি ছিল। পুরো গ্রাম যখন জ্বলছিল তখন পুরো আকাশ লাল দেখা যাচ্ছিল। ফেনী নদীতে প্রচুর পানি বেড়ে যায়। আমরা সবাই ভেজা কাপড় নিয়ে চেল্লাছড়া পাড়া সীমান্ত পারি দিয়েছি। আমাদের টীম লিডার ছিলেন ব্রজেন কুমার ত্রিপুরা। অন্যদিকে আরও ১০/১৫ টি গ্রামের প্রায় প্রায় তিন হাজার মানুষ একজন ওসি’র সুরক্ষার বলয়ে ছিল। খবর পেয়ে দা, বল্লম নিয়ে হত্যা করার জন্য সেটেলাররা ছুটে আসলে ওসি তাদের থামিয়ে দেন এবং বলেন যা হবার হয়েছে এখন আর কোন কিছু করা যাবে না। সেটেলাররা ওসির সাথে বাক-বিতন্ডায় জড়িয়ে পড়ে। পরে শুনা যায় জুম্মদের বাঁচানোর অপরাধে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়।
শরণার্থী শিবির:
চেল্লাছড়া হয়ে শিলছড়ি যেটা ১নং শরণার্থী শিবির ছিল আমরা সেখানে পৌঁছালাম। সীমান্ত পার হবার সাথে সাথে ২০/৩০ জনের একদল সশস্ত্র বিএসএফ চেল্লাছড়া ত্রিপুরা পাড়ায় গিয়ে খোঁজ নিতে থাকে। তারা হিন্দি ভাষায় অনেক কিছু জানতে চাইলে হিন্দি জানা না থাকায় কিছুই বলতে পারছিলাম না। ভাগ্যক্রমে বিএসএফের দলে ত্রিপুরা ভাষা পারেন একজন দেববর্মা ছিলেন। যার নাম গংগামোহন দেববর্মা। তিনি সোর্স ছিলেন। তাঁর সহযোগিতায় আমাদের থেকে ঘটনার বিবরণ জানার পর বিএসএফের দল ভারতে উদয়পুরের উদ্ধর্তন কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করেন। সীমান্তের কাছাকাছিতে থাকা মুসলিম সেটেলাররা হামলা চালাতে পারে এমন সন্দেহে আমরা তাদের সাথে গভীর বাঁশ বনের মধ্য দিয়ে আবারও হাঁটতে শুরু করলাম। হাঁটার পথে প্রচন্ড ক্ষুধায় বাঁশ কোড়ল সিদ্ধ করে খেয়ে আবার হাঁটা ধরেছি।
উপর থেকে নির্দেশ এসেছে শীঘ্রই গুড়াকাপা বাজারে পৌঁছাতে হবে। খুব কষ্টে বিকেল ৪.০০ টায় চেল্লাছড়া হতে গুড়াকাপায় পৌঁছাই। ওখানে পৌঁছার সাথে সাথে আবারও প্রচুর বৃষ্টি হলো। বাজারের লোকজন আমাদের দুরাবস্থা দেখে কেউবা চাল কেউবা ডাল, তেল আর কাঁঠাল বিঁচি দেন। এসব নিয়ে খিচুরী রান্না হচ্ছিল। এমন সময় আমার জেঠিমা একটি কন্যা সন্তান প্রসব করেন। এরপর আরও খবর আসলো গুড়াকাপা থেকে শিলাছড়ি পৌঁছাতে হবে। রান্না ফেলে আবারও রওনা দিলাম। হাঁটতে হাঁটতে গন্তব্যে পৌঁছাতে ভোর ৬ টা বেজে গেল। সে সময় প্রতিদিন বৃষ্টি হতো। সেদিন ছিল বাজার বার। অপরিচিত লোক দেখে বাজারের লোকজন সবাই আমাদের দিকে তাকিয়েছিল।
আমাদের আসার খবর পেয়ে শিলাছড়ি হাইস্কুলের ক্যাপ্টেন রাজেস দেববর্মা ছুটে এলেন। আমাদের থাকার জন্য একটি স্কুল দু’ সপ্তাহের জন্য বন্ধ ঘোষণা করলেন। তিনি স্কুলের প্রতিটি শিক্ষার্থীর অভিভাবকের কাছ থেকে চাউল সংগ্রহ করে দিলেন এবং দূর্গা পুজার জন্য উত্তোলিত টাকা আমাদের প্রতিটি পরিবার প্রতি ১০০ রুপী (ভারতীয় মুদ্রা) করে দিলেন। শুরু হলো নতুন শরণার্থী শিবির তৈরির কাজ। এলাকাবাসী গাছ-বাঁশ দিয়ে সহযোগিতা করলেন। সরকারী রেশনও মঞ্জুর করার পর চাল, ডাল, মরিচ, লবণ, দুধ, তেল, শুটকি, রসুন এবং পেঁয়াজ ইত্যাদি আসা শুরু হলো।
পাশে একটি মগদের (ভারতে মারমারা মগ নামে পরিচিত) বৌদ্ধ বিহার ছিল। সেখানে প্রতিদিন আমরা ভাত খাওয়ার জন্য যেতাম। এদিকে ১৫ দিনের মধ্যে শিবির তৈরির কাজ সম্পন্ন হলো। আবহাওয়ার সাথে খাপ খাওয়াতে না পেরে প্রতিদিন জ্বর, অসুখ-বিসুখে ভুগতো শিবিরগুলোতে। ৩, ৪, ৫, ৬, ৭ এবং ৮নং শিবির ক্যাম্পে প্রতিদিন মৃত্যুর ঘটনা ঘটতো। ভাগ্যক্রমে আমাদের ১ ও ২নং ক্যাম্পে এ ধরনের তেমন কোন ঘটনা ঘটেনি।
নারায়ণ নামক সরকারি এক কর্মচারী রোজ গুড়ার দুধ দিয়ে দুধ বানিয়ে শরণার্থী শিবিরে বাচ্চাদের জন্য খাওয়াতে আসতেন। কোনভাবে পরিবেশের সাথে তাল মেলাতে পারছে না শিবিরগুলো। চৌদ্দটি শিবিরে প্রায় ৬০,০০০ (ষাট হাজার) চাকমা, মারমা আর ত্রিপুরা শরণার্থী ছিল। তারা সকলে মাটিরাঙ্গা, তবলছড়ি, রামগড়, তাইন্দং, গোমতি, গুইমারা আর পিলাক থেকে পালিয়ে এসেছেন। ১৯৮১ সালের অক্টোবর মাসে বাংলাদেশ থেকে একদল সরকারি আমলা আমাদের শিবির পরিদর্শন করতে আসেন। শিবিরের পক্ষেও একদল প্রতিনিধি তাদের সাথে যোগ দেন এবং অনতিবিলম্বে শরনার্থীদের ফিরিয়ে নিতে বলেন।
শরণার্থী ফিরিয়ে নেবার কাজ শুরু হলে রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে এক প্রকার দ্বন্দ্ব লেগে যায়। তৎকালীন ত্রিপুরা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নৃপেন চক্রবর্তীও শরার্থী শিবির পরিদর্শন করেন। কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে কোন ধরনের আলোচনা ছাড়া তিনি শরণার্থীদের তাড়াহুড়া করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে বলেন। ৫, ৬ এবং ৯ নং ক্যাম্পের কয়েকজন মারমা নারী স্বদেশে ফেরত আসতে রাজী হননি এবং তারা রাস্তায় শুয়ে অবরোধ করলেন। সরকারি আমলারা আটকে পড়লেন। প্রচুর লাঠিচার্জ হয়। ৪ জন নারী আহত হন। তাদের ভয় ছিল যেহেতু কোন শর্ত ছাড়াই দেশে পাঠাচ্ছে তাই আবারও নিরাপত্তাহীন হয়ে থাকতে হবে দেশে।
একদিনের মধ্যে প্রায় ৬০,০০০ (ষাট হাজার) শরণার্থী পরিবারকে রাজ্য সরকার পাঠিয়ে দেয়। প্রতি পরিবারকে ৫০ কেজির এক বস্তা চাল, নগদ ১,৫০০ টাকা, ১ কেজি লবণ, ১ কেজি ডাল, একটি ইনজেকশন (চোট লাগলে ঘায়ের ব্যথা উপশমের জন্য) দেয়া হয়। ততক্ষণে শীত মৌসুম এসে গেছে। খুব ঠান্ডা। আমাদেরকে কোন কাপড় দেয়া হয়নি। খোলা আকাশের নিচে ঘুমাতে হলো। ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। নিষ্ঠুর, নির্মম আর অমানবিক সেটেলারদের কারণে আজ হাজার হাজার মানুষের জীবন অনিশ্চিত। রাতে সেটেলাররা হৈচৈ করতো। আমরা জঙ্গলেও ভয়ে ঘুমাতে পারতাম না।
আমরা বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত তবলছড়ি-শিলাছড়ি দিয়ে প্রত্যাবর্তন করি। স্বদেশে যখন ফিরি তখন আমরা সবকিছু হারিয়ে সর্বশান্ত। ২/৩ মাস যাবত সরকারি কোন ত্রাণ বা সহযোগিতা পাইনি আমরা। দুঃখের বিষয় হলো, স্বদেশেই ফিরেই বেশি উপেক্ষিত ছিলাম আমরা। ২/৩ মাস পর সরকার আমাদের কিছু শুকনো ধান দেয়। কিন্তু এতদিনের অর্ধাহার, অনাহার, নিরাপত্তাহীনতায় আমাদের জীবন দূর্বিষহ হয়ে ওঠে ছিল। কঠিন বাস্তবতা মুখোমুখি হয়েছি। যার শরণার্থী জীবনের অভিজ্ঞতা রয়েছে একমাত্র সে জানে কত কষ্টের জীবন। না পারে মারা যেতে, না পারে বাঁচতে। এধরনের অভাবের তাড়নায় বাধ্য হয়ে আমরা ধান্য (আবাদী) জমি বিক্রি করতে লাগলাম সেটেলারের কাছে। খুব সস্তায় জমি বিক্রি করতে হয়েছিল। এভাবে দিন যেতে লাগল। গম-আটা খেয়ে জীবন বাঁচাতে লাগলাম।
আমরা শরণার্থী হয়েছি বলে অনেকেই তাচ্ছিল্য করতে লাগল। ১৯৮১ সালে আমরা জমি বর্গা করে চাষ করতে লাগলাম। একবার শরণার্থী হয়ে সব হারিয়ে সর্বশান্ত হয়েছি। তখন দেশে সামরিক শাসক এরশাদের জমানায় চলছে চরম নৈরাজ্য আর সহিংহতা। আমি মাঝে মধ্যে বাজারে যেতাম আটার গুড়া কিনতে। কাকা বর্গা জমিতে চাষ করেন। তার জন্য পিঠা বানিয়ে নিয়ে যেতাম। আমরা পরিবারে ছিলাম ৮ জন সদস্য। ভারত থেকে ফেরার ৫-৬ মাস পর আমি কালীঘর পাড়া সরকারি প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি হই। এরপর তারাবনছড়া স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম। নালকাটা নিম্ন মাধ্যমিক স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হই। সে স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন খগেশ্বর ত্রিপুরা যিনি বর্তমানে খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের সদস্য হয়েছেন।
পরিস্থিতি কঠিন হতে থাকলে কাকারা আবারও ভারতে চলে যান। আমি কাকার শ্বশুরের বাড়িতে আশ্রয় নিই৷ কৃষি গবেষণা আদর্শ স্কুলে ভর্তি হয়ে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত সমাপ্ত করি। ১৯৮৯ সালে খাগড়াছড়ি সরকারি আবাসিক হোস্টেলে থাকার সুযোগ হয় এবং নবম শ্রেণিতে পড়াশুনা শুরু করি। ১৯৯২ সালে খাগড়াছড়ি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় সেন্টার হতে কুমিল্লা বোর্ডের অধীনে এসএসসি পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগ নিয়ে উত্তীর্ণ হই। এরপর রামগড় সরকারি কলেজে ভর্তি হই। পড়াশুনা করার খরচ মেটাতে রামগড়ের ফিলিমন হাওলাদার বাড়িতে লজিং থেকে পড়াশুনা করি। হঠাৎ কাকার মৃত্যুর সংবাদ এল। আমি খুব অসহায় হয়ে পড়ি।
১৯৮৯ সাল হতে আমি গোপনে গোপনে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে পড়ি। হোস্টলে থাকতাম। রাজনীতি করি তা কোনভাবে প্রচার করা যাবে না। তাহলে হোস্টেলে থাকতে পারবো না। হোস্টলের পরিচালক তৎকালীন জেলা প্রশাসক খোরশেদ আনসার খান নিজেই। মাঝখানে পড়াশুনা করা বন্ধ হতে চলেছে। লজিং-এর মালিক আমাকে ধর্মান্তরিত হতে বললেন। হিন্দুধর্ম থেকে খ্রীস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হলে তিনি পড়াশুনা করার ব্যয় বহন করবেন। কিন্তু আমি ধর্মত্যাগ করলাম না। এরপর গোমতির শ্রী চন্দ্রহার মহাজন (কার্বারী)-এর বাসায় লজিং থাকি। পিসিপি করতাম জেনে অনেক দালাল আর প্রতিক্রিয়াশীলরা সেনা ক্যাম্পে অভিযোগ দিত। আমাকে রোজ হাজিরা দিয়ে আসতে হতে ক্যাম্পে। আমার কারণেও লজিং মালিককে ক্যাম্পে হাজিরা দিতে হতো এবং একবার সেনাবাহিনী তাকে প্রচন্ড নির্যাতন করে।
এই চন্দ্রহার কার্বারী আর অসাধ্য সাধন ত্রিপুরার বিরুদ্ধে শান্তিবাহিনীর কালেক্টর বানিয়ে ষড়যন্ত্র করে ক্যাম্পে অভিযোগ দেয়া হয়।তাদের উপর সেনাবাহিনী প্রচুর নির্যাতন চালায়। সকলে জানতো তারা দুজন সাধারণ কৃষক। গোমতি এলাকায় বেড়াতে যাওয়া তৎকালীন পিসিপি’র একজন কেন্দ্রীয় নেতা বিপ্লব কান্তি ত্রিপুরাকে সেনা ক্যাম্পে হাজির হতে বাধ্য করা হয়। এর নেপথ্যে ভাগ্যধন ত্রিপুরার ষড়যন্ত্র ছিল। পরে যিনি আওয়ামী লীগ-বিএনপি দল বদল করে থাকেন। একদিন আমাদের এলাকায় সফর করতে আসেন পিসিপি’র তৎকালীন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শ্রী ভূবন ত্রিপুরা (বর্তমানে সহকারি কমিশনার), প্রতিকার চাকমা (বর্তমানে সুপ্রীমকোর্টের এডভোকেট) এবং প্রমেশ্বর চাকমা প্রমুখ। তারা আমার বাড়িতে দুপুরের আহার ছাড়েন। তার জন্য টানা ৩ মাস রোজ হাজিরা দিতে হয়েছিল সেনাক্যাম্পে।
১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে উক্ত সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার হলে দালালরা আমাদের দলে যোগ দিতে আসে। আশ্রয় না পেয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেয় এবং এরপর বিএনপির জমানায় বিএনপিতে যুক্ত হয়। এটাই আমার জীবনের বিভীষিকাময় দিনলিপি। দূর্বিষহ জীবন ছিল আমাদের। জন্মের সাত দিন পর আমার মা প্রয়াত হন। এরপর কাকাদের যত্নে বড় হয়েছি। একসময় কাকাকেও হারিয়েছি। আমার আরেক কাকা জনসংহতি সমিতির সদস্য ছিলেন। তিনি এরপর ভারতে চলে যান এবং সেখানে মারা যান।
শরণার্থী জীবন খুব কষ্টের। জীবনের কোন স্থিতি নেই। জীবনকে হাতের মুঠোয় নিয়ে পথ চলা। বর্তমান তরুণ সমাজকে আহ্বান করবো আসুন আমাদের অধিকারহারা ইতিহাস পড়ুন, সংগ্রামের ইতিহাস পড়ুন। বিজাতীয় শাসক-শাসক দ্বারা আমরা কি পরিমাণ নির্যাতনের শিকার হচ্ছি তা উপলব্ধি করুন। জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষায় এগিয়ে আসুন। তা না হলে আমরা অচিরেই ধ্বংস হয়ে যাবো। ঘুম থেকে জেগেওঠার সময় চলে যাচ্ছে। সময় থাকতে লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ুন।