নিপন ত্রিপুরা
জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রাণধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চলমান। আশির দশকের মাঝের সময় থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি একাই সে লড়াই চালিয়ে গেলেও নব্বইয়ের দশকে হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের আবির্ভাব ঘটে।ফলে জুম্ম জনগণের সংগ্রাম গণতান্ত্রিক ও অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দুর্বার আন্দোলন গড়ে উঠে। জীবন বাজি রেখে পাড়া-মহল্লা থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্ররাও দলে দলে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনে যোগ দিতে শুরু করলে শাসকগোষ্ঠী ভড়কে উঠে। ভয় পেয়ে তৎকালীন সরকার তথা শাসকগোষ্ঠী আন্দোলনকে নসাৎ করে দেয়ার জন্য শুরু করে গুম-খুন, অপহরণ ও হত্যা করার ষড়যন্ত্র। জুম্মদের গ্রাম পোড়া থেকে শুরু করে নিরাপত্তা বাহিনীর প্রত্যক্ষ মদদে জুম্মদের উপর সংঘটিত করে এক ডজনের বেশি গণহত্যা। সে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ১২ জুন ১৯৯৬ সালে দিবাগত রাতে কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করা হয়। জুম্ম জনগণ হারায় আন্দোলনের প্রতিবাদের অগ্নিকন্যাকে।
কল্পনা চাকমা কে?
রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি নেতৃতের জুম্ম জনগণের সশস্ত্র প্রতিরোধের সময়ে জন্ম নেয়া কল্পনা চাকমা ছোটকালে শান্ত ও প্রাণবন্ত ছিলেন। জন্ম ১ মে ১৯৭৬ রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার নিউ লাল্যাঘোনা গ্রামে। পিতা গুণরঞ্জন চাকমা ও মাতা বাঁধুনি চাকমা। পাঁচ সন্তানের মধ্যে কল্পনা সবার ছোট। শৈশব থেকে প্রাণবন্ত কল্পনা একদিকে যেমন শিক্ষানুরাগী আরেকদিকে তেমনি তীক্ষ্ন সমাজ ও রাজনীতি সচেতন এক তরুণী ছিলেন। জুম্ম জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রগতিশীল আদর্শে সদা বিশ্বাসী ছিলেন। চরম দারিদ্র্যের কশাঘাতের মধ্যে বড় হতে থাকলেও রাষ্ট্রীয় আগ্রাসন, বৈষম্য, নারীর প্রতি ধর্মীয় অবজ্ঞা, জাতিগত নিপীড়ন-নির্যাতন এসব কখনো তাঁর চোখ এড়িয়ে যায়নি। ১৯৯১ সালে কল্পনা চাকমা বাঘাইছড়ি উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। পরে বাঘাইছড়ি উপজেলার কাচালং ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। অপহৃত হওয়ার আগ পর্যন্তকাচালং ডিগ্রী ২৩ বছর বয়সী কল্পনা কলেজের বিএ প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন।
রাজনীতিতে অংশগ্রহণ
হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সূতিকাগার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হলেও ধীরে ধীরে সারা পার্বত্য চট্টগ্রাম জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। সে সময়ের পার্বত্য চট্টগ্রামের জ্বলন্ত পরিস্থিতির মধ্যে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের যৌথ আন্দোলন কল্পনার চেতনাকে সংগ্রামের দিকে শাণিত করে। রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের উপর দমন-পীড়ন, নিপীড়ন, নির্যাতন কল্পনাকে আরও বেশি সংগ্রামী করে তোলে। তাই এসএসসি পাস করার পর সরাসরি হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। খুব কম সময়ের মধ্যে তিনি পাহাড়ে নির্যাতিত নারীদের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের মুখপাত্র হয়ে ওঠেন। হিল উইমেন্স ফেডারেশনকে একদিকে সমাজের অন্যায় ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলার, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নে বিরুদ্ধে ব্যারিকেডের মঞ্চ হিসেবে গড়ে তোলেন। প্রতিবাদী স্বভাবের কারণেই কল্পনা চাকমা খুব সহজে শাসক-শোষক ও নিপীড়কগোষ্ঠীর আক্রমণের চক্ষুশূলে পরিণত হন। তবে তাদের চোখ রাঙানিতে তিনি হতোদ্যম হয়ে পড়েননি। তার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় কল্পনাকে অপহরণের প্রায় তিন মাস আগে। লাল্যাঘোনা গ্রামে ১৯৯৬ সালের ১৯ মার্চ রাতের আধাঁরে পাহাড়িদের কয়েকটি বাড়িতে দুষ্কৃতকারীরা আগুন ধরিয়ে দেয়ার প্রতিবাদ মিছিলে কল্পনা নেতৃত্ব দেন। এ নিয়ে স্থানীয় কজইছড়ি ক্যাম্পের এক কর্মকর্তার সঙ্গে তাঁর তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়।
জুম্ম নারী মুক্তি আন্দোলনে কল্পনা চাকমার ভূমিকা
বিশ্বে নারী অধিকারের প্রেক্ষাপটে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম নারীদের অবস্থান আরও শোচনীয়। যুগ যুগ ধরে সামন্তীয় যাতাকলে পিষ্ট জুম্ম নারীরা প্রান্তিক হাওয়ায় বিশেষত দেশের সংবিধানে দেশের আদিবাসীদের যথাযথ স্বীকৃতি না থাকায় পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম নারীদের উপর শোষণ, নির্যাতন বঞ্চনা ও মানবাধিকার লংঘনের ঘটনার ব্যাপক ও গভীর। সাধারণত জুম্ম সমাজে নারীদের উপর সহিংসতা কম হলেও, নারীর মর্যাদা থাকলেও পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনীতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীদের সবসময় অবহেলা করা হয়। তার চেয়ে সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে উগ্র জাতীয়তাবাদী, উগ্র মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িকতার ধারক-বাহক রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের মদদে সেটেলার ও নিরাপত্তা বাহিনীর কতিপয় সদস্যের দ্বারা জুম্ম নারীদের উপর হত্যা, ধর্ষণ, শ্লীলতাহানীর ঘটনা এখনো অবধি চলমান রয়েছে।
রাজনৈতিক অধিকার ও নারী অধিকারের জন্য কল্পনা চাকমা যে সময়ে আন্দোলন করেছেন, সে সময়টা এখনকার মতো সহজ ও মসৃণ ছিল না। স্থানীয় প্রশাসন ও নিপীড়কগোষ্ঠীর বাধা তো ছিলই, একই সঙ্গে তাঁকে পেরিয়ে আসতে হয়েছে পারিবারিক ও সামাজিক বাধাও। কল্পনার রাজনৈতিক সক্রিয়তা নিয়ে প্রতিবেশীরা বিরূপ মন্তব্য করতে ছাড়েননি। কিন্তু কল্পনার লক্ষ্য ছিল সেসব বাধা উপেক্ষা করে নারীমুক্তির সীমানায় পৌঁছানো। তিনি প্রচুর পড়ার চেষ্টা করতেন। কখনো কখনো কাচালং কলেজের শিক্ষক ও অগ্রজদের কাছে গিয়ে পরামর্শও নিতেন। রাজনৈতিক সহকর্মীদের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের আনাচ-কানাচে সাংগঠনিক সফর করে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের জন্য এভাবেই তিনি নিজেকে ধীরে ধীরে গড়ে তুলছিলেন।
কল্পনা চাকমা গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন, নিপীড়িত শ্রেণি ও জনমানুষের মুক্তি ছাড়া আলাদাভাবে নারীমুক্তি সম্ভব নয়। তিনি বিশ্বাস করতেন পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রাধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কেবল জুম্ম নারীর মুক্তি সম্ভব। তাই তিনি জুম্ম জাতির স্বাধিকার ও মুক্তির স্বপ্ন দেখতেন। সেজন্য স্বাধিকার আন্দোলনে নারীদেরও এগিয়ে আসার জন্য বার বার আহ্বান জানাতেন। তিনি তাঁর বক্তব্যে সমাজে পিছিয়ে পড়া অংশ হিসেবে নারী সচেতনতার ওপর জোর দিতেন। সমাজ ও ধর্মে নারীদের প্রতি যে বৈষম্যমূলক ধারণা ও রীতি রয়েছে, সেগুলো সংস্কারেরও দাবি তুলেছিলেন কল্পনা চাকমা। তাঁর সেসব দাবি এখনও পাহাড়ি নারীরা একটু একটু করে তুলতে শুরু করেছেন। সমাজ ও জাতি নিয়ে কল্পনার চিন্তা, চেতনা ও দূরদর্শিতা ছিল অত্যন্ত প্রখর। পাহাড়ে স্বাধিকার অর্জনের মধ্য দিয়ে নারীর মুক্তি অর্জন ছিল তাঁর স্বপ্ন।
কল্পনা চাকমার রাজনৈতিক দুরদর্শিতা
কল্পনা চাকমা নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন। সেখানে টুকে রাখতেন নিজের চিন্তা, অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা। বিভিন্ন গুণীজনের স্মরণীয় ও প্রেরণামূলক বক্তব্যগুলোও লিখে রাখতেন। পাশে তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে লেখা থাকত নিজের অভিমত। এমনকি নিয়মিত চিঠি লিখে কল্পনা তাঁর সহযোদ্ধাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতেন।
এক সহযোদ্ধাকে লেখা চিঠিতে কল্পনা লিখেছিলেন, ‘ভেবেছি, পরীক্ষায় পাস না করা পর্যন্ত সংগ্রাম স্থগিত রাখব, কিন্তু নেহাত অন্যায় আমার সামনে ঘটে যাচ্ছে কিছুতেই সহ্য করতে পারি নাই। প্রতিবাদ করতে হয়েছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে।’ আরেক সহযোদ্ধাকে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কী ভাবছি? উত্তরে আমি বলব, সেটা সময়েই জবাব দেবে। কেননা যেটা স্থির করা হয়, সময়ের প্রয়োজনে অনেক কিছু পরিবর্তন ঘটতে পারে।’ একটি প্রশ্নের জবাবে কল্পনা লিখেছিলেন, ‘অধিকার আদায়ের সংগ্রামে আমি ভূমিকা রাখতে পারি কি না? যতদূর সম্ভব অবশ্যই থাকবে। অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ১ বছর যাবৎ আন্দোলন করে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছি এবং সবাইকে অগ্রণী ভূমিকা পালনের জন্যও জনসমাবেশের ডাক দিয়েছি।’ আন্দোলনে নারীদের ভূমিকার প্রশ্নে কল্পনার বক্তব্য ছিল, ‘পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের ভূমিকাও থাকতে হবে। বিশেষ করে নারী নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ ইত্যাদির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে এবং প্রত্যেককে স্বাবলম্বী হতে হবে।’ (কল্পনা চাকমার ডায়েরি, ২০০১)
তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মী কবিতা চাকমাকে লেখা এক চিঠিতে কল্পনা লিখেছিলেন, ১৯৯৪ সালের বেইজিংয়ের চতুর্থ নারী সম্মেলনে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের প্রতিনিধি হিসেবে তাঁরা (প্রতিনিধিরা) যেন পার্বত্য চট্টগ্রামের ১৩টি জাতিসত্তার ঐতিহ্য, সংস্কৃতির বিষয়গুলো তুলে ধরেন। এ জন্য প্রয়োজনে স্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে আলোচনা করে মতামত নেওয়ার কথাও তিনি উল্লেখ করেন।
অপহরণ ঘটনা ও শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক ধামাচাপা দেওয়ার অপতৎপরতা
কল্পনা চাকমার উত্তরোত্তর সাংগঠনিক কর্মতৎপরতা শাসকগোষ্ঠীর জন্য এক আতঙ্কের কাল হয়ে দাঁড়ায়। ভয় পেয়ে উগ্র জাত্যাভিমানি, উগ্র সাম্প্রদায়িকতাবাদী শাসকগোষ্ঠী ছলে-বলে কৌশলে কল্পনাকে আন্দোলন সংগ্রাম থেকে বিরত রাখার অপচেষ্টা চালিয়েছিল বটে কিন্তু সাহসী কল্পনা সেসবের কর্ণপাত করেননি। তাই তার কণ্ঠকে রুদ্ধ করে দেয়ার জন্য তার প্রতিভূ বাঘাইছড়ির কজইছড়ি সেনা (১৭ ই.বি. রেজি.) ক্যাম্পের তৎকালীন কমান্ডার লে. ফেরদৌস কায়ছার খান, ভিডিপি‘র পিসি নুরুল হক ও ভিডিপি সদস্য সালেহ আহমেদের নেতৃত্বে ১০-১২ জনের পরিচিত-অপরিচিত সশস্ত্র সেনা-ভিডিপি‘র জওয়ান ২৩ বছর বয়সী নারী নেত্রী কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়।
কল্পনার বড় ভাই ও মামলার বাদী কালিন্দি কুমার চাকমার বয়ান ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন কর্তৃক প্রকাশিত ‘কল্পনা চাকমার ডায়েরি‘ থেকে জানা যায়, ঘটনার রাত একটার দিকে অপহরণকারীরা বাড়ি ঘেরাও করে তাঁদেরকে ডাকতে থাকে। ঘুমের ঘোরে ডাক শুনে কালিন্দি কুমার উঠে এসে দরজার সামনে আসতেই অপহরণকারীরা দরজার রশি কেটে প্রবেশ করে। অপহরণকারীদের মধ্যে দুইজনের পরনে ছিল লুঙ্গি, বাকীরা কেউ খাকি, কেউ সেনা পোশাকে ছিল। এ সময় দুর্বৃত্তরা বাতি জ্বালাতে দেয়নি। অন্ধকারে বাড়ির সবাইকে বারান্দায় ডেকে জড়ো করা হয়। একে একে চোখে টর্চ লাইট মেরে নাম জিজ্ঞেস করতে থাকে। এ সময় কল্পনার সেঝো ভাই লাল বিহারী চাকমা (ক্ষুদিরাম)-এর মুখে টর্চ মারলে তিনি আলো ঠেকাতে থাকেন। এ সময় আলোর প্রতিফলনে ক্ষুদিরাম লে. ফেরদৌস, পিসি নুরুল হক ও সালেহ আহমেদকে চিনে ফেলেন। প্রথমে তাঁকেই বাইরে নিয়ে যায় বন্দুকধারীরা। বাইরে নিয়ে তাঁকে কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে ফেলে এবং হ্রদের হাঁটু পানিতে নামায় সেনা জওয়ানরা। তারপর বড় ভাই কালিন্দি কুমার ও কল্পনাকে বাইরে নিয়ে তাঁদেরকেও চোখে কাপড় বেঁধে দেয়। এরপর লে. ফেরদৌস ক্ষুদিরামকে মারতে গুলির নির্দেশ দেয়ার সাথে সাথে ক্ষুদিরাম পানিতে লাফ দিয়ে পালাতে সক্ষম হন। সাথেসাথে একাধিকবার গুলি করা হলেও পানিতে ডুব দেয়ায় অক্ষত অবস্থায় বেঁচে যান ক্ষুদিরাম। বিবস্ত্র অবস্থায় পালিয়ে রাতে একজনের বাড়িতে আশ্রয় নেন তিনি। এদিকে গুলির শব্দ পেয়ে তাঁর ভাইকে মেরে ফেলা হয়েছে ভেবে কালিন্দি কুমারও পালাতে চেষ্টা করলেও কিন্তু পারছিলেন না। পরে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে তিন বন্দুকধারী সেনাকে ধাক্কা দিয়ে পালাতে সক্ষম হন। সকালে খবর পেয়ে গ্রামের মানুষ ছুটে যান কল্পনাদের বাড়িতে। খুঁজতে থাকে ক্ষুদিরাম ও কল্পনাকে। সকাল সাতটার দিকে ক্ষুদিরাম চলে আসেন কিন্তু কোনো হদিস পায়নি কল্পনার। তবে ঘটনাস্থল থেকে আনসার-ভিডিপি‘র ব্যবহৃত খাকি কাপড়ের ব্যান্ডেল ভর্তি ৩০৩ রাইফেলের গুলি ও ক্ষুদিরামের লুঙ্গি পাওয়া যায়।
এ দিন সকাল ১১টায় গ্রামবাসীরা কালিন্দি কুমার চাকমাকে নিয়ে বাঘাইছড়ি থানা নির্বাহী কর্মকর্তা (টিএনও) হাসান জাহাঙ্গীর আলমের কাছে যায়। এ সময় তাঁদের সাথে ছিলেন ইউপি চেয়ারম্যান দীপ্তিমান চাকমা। টিএনও নিজেই কালিন্দি কুমারের জবানবন্দি লিখে নেন। জবানবন্দী দেয়ার সময় কালিন্দি কুমার ঘটনাস্থলে পাওয়া এ্যামিউনিশন পচটিও টিএনও‘র কাছে জমা দেন। কিন্তু টিএনও লিখিত জবানবন্দী কালিন্দি কুমারকে পড়ে শোনাননি বলে অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে ক্ষুদিরামকে নিয়ে কজইছড়ি সেনা ক্যাম্পে যান সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান সাম্রাজ্য চাকমা। পরে কালিন্দি কুমার থানায় গিয়ে এফআইআর (মামলা নং ২/৯৬১, তাং ১২/৬/১৯৯৬ইং; ধারা- ৩৬৪) ডায়ের করেন। কিন্তু ওসি শহিদুল্লাহ বাদীর জমাকৃত প্রমাণাদি লোপাতসহ প্রদত্ত জবানবন্দী বিকৃতি করে অভিযুক্ত লে. ফেরদৌস, পিসি নুরুল হক ও সালেহ আহমেদের নাম বাদ দিয়ে সাধারণ একটি এফআইআর করেন।
ঘটনার ১৫ দিন পর ২৭ জুন ১৯৯৬ কল্পনা চাকমার মুক্তির দাবিতে পাহাড়ী গণপরিষদ, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন বাঘাইছড়িতে সকাল-সন্ধ্যা সড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালন করে। কর্মসূচি চলাকালীন রুপন চাকমা (১৫) নামে একজন এসএসসি পরীক্ষার্থীকে সেটেলার বাঙালিরা পুলিশের কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। অবরোধ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে যাওয়া মনোতোষ চাকমা (১৫), সমর বিজয় চাকমা (১৬) ও সুকেশ চাকমা (১৬) ছাত্রদেরকে সেটেলার বাঙালিরা রাস্তায় ধাওয়া করে কুপিয়ে মেরে ফেলে। এছাড়াও সেদিন কমপক্ষে ১৬ জন অবরোধকারী আহত হয়। আজ অবধি এই চারজনের হত্যাকারীদের বিচার করা হয়নি।
জাতীয় নির্বাচনের ভোটদান অনুষ্ঠানের মাত্র সাত ঘন্টা আগে একজন নারী নেত্রী অপহৃত হলেও বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। কল্পনা চাকমাকে উদ্ধারের ব্যাপারেও কোনোরকম ব্যবস্থাও নেয়া হয়নি। তারপর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে সরকার গঠন করেন শেখ হাসিনা। তারাও ‘ঘটনাটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ঘটেছে‘ অজুহাত দেখিয়ে এ ব্যাপারে গড়িমসি করতে থাকে।
অন্যদিকে সেনাবাহিনীও ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার জন্য অপচেষ্টা চালাতে থাকে। অপহরণ ঘটনাটিকে সেনাবাহিনী ‘হৃদয়ঘটিত ব্যাপার‘ বলে অপপ্রচার করতে থাকে। কোনো ছলচাতুরী কাজ না হওয়ায় অবশেষে কল্পনা চাকমার সন্ধানদাতাকে ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার প্রদানের ঘোষণা দিয়ে হেলিকপ্টারযোগে প্রচারপত্র (লিফলেট) বিলি করে যা সংবাদ মাধ্যমেও বহুল আলোচিত হয়। নাটকীয়তার সাথে একটি নাম সর্বস্ব মানবাধিকার সংস্থা তদন্ত চালিয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের এক অজপাড়া গাঁয়ে কল্পনার সন্ধান পেয়েছে দাবি করে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তদন্ত রিপোর্টও প্রকাশ করে। ২৪ পদাতিক ডিভিশন তাকে পুরস্কার দিয়েছে কিনা সে খবর আর জানা যায়নি। মহান মানবাধিকারকর্মী সে শিক্ষকের রহস্যও উন্মোচিত হয়নি। শুধু তাই নয়, অপহরণকারী লে. ফেরদৌস কায়ছার খান মেজর পদোন্নতি লাভ করে সিলেটের এক সেনানিবাসে কর্মরত থাকার কথাও জানা যায়।
পক্ষপাতদুষ্ট মামলার তদন্ত ও বিচারিক প্রক্রিয়া
দেশে-বিদেশে তুমুল প্রতিবাদে অনেকটা চাপের মুখে সরকার অবশেষে ঘটনার তিন মাস পর ৭ সেপ্টেম্বরে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আব্দুল জলিলকে প্রধান করে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করতে বাধ্য হয়। কমিটির অন্য সদস্যদ্বয় হলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. অনুপম সেন ও তৎকালীন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন। কমিটি ১৯৯৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ৪০ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। কিন্তু সরকার আজও অবধি তদন্ত প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেনি।
ঘটনার পরের বছর ১৭ জানুয়ারি ১৯৯৭, বাঘাইছড়ি থানার মামলাটি জেলার বিশেষ শাখায় হস্তান্তর করা হয়। আট বছর পর ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর আবার জেলা থেকে বাঘাইছড়ি থানায় পুনঃহস্তান্তর করা হয়। ১৪ বছর পর ২০১০ সালের ২১ মে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয় বাঘাইছড়ি থানা পুলিশ। পুলিশের এই তদন্ত প্রতিবেদনটি প্রকৃত অভিযুক্তদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রেখে করা হয়েছে বলে কালিন্দি কুমার চাকমা অভিযোগ এনে আদালতে নারাজী আবেদন করেন। বাদীর আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত ২০১০ সালের ২ সেপ্টেম্বর মামলা তদন্তে সিআইডি‘র চট্টগ্রাম জোনকে নির্দেশ দেন। সিআইডি দুই বছর তদন্ত করে ২০১২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করে। সিআইডি‘র প্রতিবেদনও পূর্বের দাখিলকৃত দুটি প্রতিবেদনের মতোই। সিআইডি‘র প্রতিবেদনের উপরও বাদী কালিন্দি কুমার চাকমা নারাজী আবেদন করলে আদালত ২০১৩ সালের ১৬ জানুয়ারি রাঙামাটির পুলিশ সুপার (এসপি)-কে তদন্তের করার র্নিদেশ দেন। এসপি প্রায় এক বছর তদন্তের দায়িত্ব নেয়ার পর কল্পনা চাকমার দুই বড় ভাইয়ের ডিএনএ সংগ্রহের অনুমতি চাইলে আদালত সুপারিশ করেন। কিন্তু কালিন্দি কুমার ও ক্ষুদিরাম ডিএনএ দিতে রাজি হননি। এ ব্যাপারে কালিন্দি কুমার চাকমা বলেছিলেন, ‘আমার ডিএনএ পরীক্ষার বিষয়টি একেবারে অযৌক্তিক ও অপ্রাসঙ্গিক। রাষ্ট্র এসব পরীক্ষার কথা বলে তদন্ত কালক্ষেপণ করছে‘। তিনিবলেন, ‘অপহৃতকে জীবিত অথবা মৃত সন্ধান পাওয়ার পর চিহ্নিত করা গেলে না হয় ডিএনএ পরীক্ষার প্রয়োজন ছিল। রাষ্ট্র কল্পনা চাকমাকে সন্ধানই পায়নি, আমি কেন ডিএনএ পরীক্ষা করাবো?
চাকমা অপহরণ ঘটনা ও মামলার বিশ বছর ও পাঁচ মাসের অধিক সময় পর গত ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ মামলার ৩৯তম তদন্ত কর্মকর্তা রাঙ্গামাটির তৎকালীন পুলিশ সুপার আবুল কালাম আজাদ তাঁর চূড়ান্ত রিপোর্ট রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার কগনিজেন্স আদালতে দাখিল করেন। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, তাঁর রিপোর্টে পূর্বের রিপোর্টের বক্তব্যগুলো চর্বিতচর্বন করে প্রকৃত পক্ষে দোষীদের ও অভিযুক্তদের আড়াল করার অপচেষ্টা চালানো হয় এবং ‘…সার্বিক তদন্তে লেঃ ফেরদৌস, ভিডিপি নূরুল হক ও পি.সি সালেহ আহমেদের উক্ত ঘটনায় জড়িত থাকার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি’ বলে দাবি করা হয়। এমনকি রিপোর্টে ‘কল্পনা চাকমা অপহৃত হয়েছে মর্মে প্রাথমিকভাবে সত্য বলিয়া প্রমাণিত হয়’ বলে স্বীকার করা হলেও ‘দীর্ঘ ২০ বৎসর ৩৯ জন তদন্তকারী অফিসারের আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও কল্পনা চাকমাকে অদ্যাবধি উদ্ধার করা সম্ভব হয় নাই এবং অদূর ভবিষ্যতেও সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ’ বলে দায়িত্বহীন ও হতাশাব্যঞ্জক বক্তব্য প্রদান করা হয়। পাশাপাশি ‘ভবিষ্যতে কল্পনা চাকমা সম্পর্কে কোন তথ্য পাওয়া গেলে বা তাহাকে উদ্ধার করা সম্ভব হইলে যথানিয়মে মামলাটির তদন্ত পুনরুজ্জীবিত করা হইবে’ বলে প্রকারান্তরে মামলার কার্যক্রম বা তদন্ত কাজ বন্ধ রাখার সুপারিশ করা হয়।
কল্পনা অপহরণ মামলার বাদী কালিন্দী কুমার চাকমা ইতোমধ্যে উক্ত ৩৯তম তদন্তকারী কর্মকর্তার চূড়ান্ত প্রতিবেদন এবং মামলার কার্যক্রম বন্ধ রাখার সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করে আদালতে নারাজি আবেদন দাখিল করেছেন এবং উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত করে যথাযথ বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন। এবিষয়ে আদালত গত ৮ জুন ২০১৭ প্রথম শুনানির আয়োজন করেন এবং নারাজির উপর পুলিশের প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। এরপর থেকে আদালত একের পর এক শুনানির দিন ধার্য করলেও পুলিশ এ বিষয়ে বার বার প্রতিবেদন দাখিলে অপারগতা প্রকাশ করে ক্রমাগত সময় চাইতে থাকেন। এ বিষয়ে আদালত সর্বশেষ ২০১৯ সালের ৩ জুলাই পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করলেও তার রায় আজো পাওয়া যায়নি। গুনে গুনে ২৪ বছর পার হয়ে গেলেও রাষ্ট্র এখনো এক কল্পনা চাকমার সন্ধান দিতে পারিনি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি
শুধু কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনা নয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধান এবং পার্বত্য অধিবাসীদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরও চুক্তিটি যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ায় বিশেষত সেটেলার বাঙালি ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা বহু জুম্ম নারী যৌন নিপীড়ন ও সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এসব ঘটনায় যথাযথ বিচারনা হাওয়ায় খোদ রাষ্ট্রযন্ত্র দ্বারা পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম নারীদের চরম অমর্যাদা ও নিরাপত্তাহীনতার বাস্তবতা সৃষ্টি করার চিত্র ফুটে উঠেছে। বস্তুত কল্পনা চাকমার চলমান তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া এ দেশের অন্যায়-অবিচার ও অপরাধের বিচারহীনতার অপসংস্কৃতিকেই অত্যন্ত প্রকটভাবে ফুটিয়ে তুলেছে এবং জাতিগত সংখ্যালঘু আদিবাসীদের প্রতি চরম নির্যাতন ও বৈষম্যকে উন্মোচিত করেছে যা স্বাধীনতার চেতনা বিরুদ্ধ।
সরকার বর্তমানে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের কার্যক্রম একেবারে বন্ধ করে দিয়েছে। করোনাকালেও সরকার পার্বত্য চুক্তি বিরোধী ও জুম্মস্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রম সর্বাত্মকভাবে বাস্তবায়ন করে চলেছে, যার মূল লক্ষ্য হলো অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামে পরিণত করার পাকিস্তানী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা। জঘন্য এই বর্ণবাদী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনী, গোয়েন্দা বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন, ক্ষমতাসীন দল, সেটেলার বাঙালি সংগঠন, উগ্র সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী শক্তিকে ব্যবহার করা থেকে শুরু করে পার্বত্য চট্টগ্রামে সক্রিয় সংস্কারপন্থী সশন্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ ও আরাকান লিবারেশন পার্টি (মগ পার্টি) নামক বিদেশী সশন্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠনকে পার্বত্য চট্টগ্রামে হত্যা, অপহরণ ও চাঁদাবাজি তৎপরতায় আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে। অপরদিকে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন ও ভূমি অধিকারসহ মৌলিক অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলনরত ব্যক্তি ও সংগঠনসহ পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সদস্যদেরকে ‘সন্ত্রাসী, অস্ত্রধারী, চাঁদাবাজি ও বিচ্ছিন্নতাবাদী’ আখ্যা দিয়ে চুক্তি-পূর্ব সময়ের মতো তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের, ধর-পাকড়, ঘরবাড়ি তল্লাসী, ক্যাম্পে নিয়ে মারধর, জেলে প্রেরণ ইত্যাদি দমন-পীড়ন চালাচ্ছে। ফলে বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণকে এক শ্বাসরুদ্ধকর নিরাপত্তাহীন জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে।
বলাবাহুল্য এ সমস্ত কোন সহিংস ঘটনার জন্য রাষ্ট্র, সরকার, বিচার বিভাগ, প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও নিরাপত্তা বাহিনী কেউ এর দায়-দায়িত্ব এড়াতে পারে না। দায়সারা বক্তব্য ও ভূমিকা গ্রহণ করে কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনার মত বর্বরোচিত ও জঘন্য মানবাধিকার লংঘনের ঘটনার ন্যায়বিচার ব্যর্থ হতে পারে না। দোষীদের চিহ্নিত করে অবশ্যই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। রাষ্ট্র, সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেই তা নিশ্চিত করতে হবে। বস্তুত পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানের লক্ষ্যে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়িত না হওয়া ও চুক্তির আলোকে এখনও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনব্যবস্থা কার্যকর না হওয়ার কারণে এবং সামরিক বাহিনী কর্তৃক বিচার বিভাগসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল বিষয় নিয়ন্ত্রণ করার কারণে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরও জুম্ম নারী তথা আদিবাসী নারীর উপর নির্যাতন-নিপীড়ন, হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ ইত্যাদি এখনও অব্যাহত রয়েছে। তাই কল্পনা অপহরণ ঘটনার সুবিচার নিশ্চিতকরণসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে নারীর সমমর্যাদা ও সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা ও নিরাপত্তার স্বার্থে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের বিকল্প নেই।
পৃথিবীতে খুব কম মানুষ পাওয়া যায় যারা ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য আপোষহীন ও নির্ভীক। কল্পনা চাকমাও এমন সাহসী, নির্ভীক ও আপোষহীনদের অন্যতম একজন। আজ হয়তোবা তিনি নেই। শাসকগোষ্ঠী রাতের আঁধারে কল্পনাকে অপহরণ করে তুলে নিয়ে তাঁর প্রতিবাদী কণ্ঠকে রোধ করতে চেয়েছিল বটে কিন্তু কল্পনার সেই তেজস্বী চেতনা আজকের দিনের পাহাড়ি নারীদের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছে। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও অন্যায়, অবিচার, জুলুম ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে পাহাড়ের নারীরা একজোট হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলছেন। কল্পনাআজো মিছিল-স্লোগানের দেদীপ্যমান।
- তথ্যসূত্র:
- ১। পাহাড়ের জ্বলন্ত মশাল- ইলিরা দেওয়ান
- ২। কল্পনা চাকমা অপহরণের ২০ বছর, জানা-অজানা কিছু তথ্য -পপেন ত্রিপুরা
নিপন ত্রিপুরা: সাংগঠনিক সম্পাদক, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ।