হিল ভয়েস, ২৮ মে ২০২০, আন্তর্জাতিক ডেস্ক: কোভিড–১৯ মহামারী কেবল একটি দুর্দশাজনক বৈশ্বিক ঘটনা নয়, ইহা বিশেষত মানবাধিকার, সংঘাত, বর্ণবাদ, ও খাদ্যাভাবের সবচেয়ে ভয়ানক ব্যাপারসমূহ উন্মোচিত করছে, এই কথা বলেছে এশিয়ার আদিবাসী বিষয়ক সংস্থা এশিয়া ইন্ডিজেনাস পিপলস প্যাক্ট (এআইপিপি) গত ২৭ মে ২০২০ থাইল্যান্ডের চিয়াংমাই থেকে প্রকাশিত ইহার ‘কোভিড–১৯ ও মানবতা: বিপন্নতায় মানবাধিকার’ শীর্ষক প্রতিবেদনে।
এআইপিপি বলছে, ঠিক যে সময়টাতে এশিয়ার সর্বত্র, বিশেষত ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল ও থাইল্যান্ডে আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত হাজার হাজার অভিবাসী কর্মজীবী চাকরি হারিয়েছেন এবং বিভিন্ন স্থানে আটকে পড়েছেন এবং বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছেন, সেই পরিস্থিতিকে ব্যবহার করে সরকারসমূহ সামরিক অভিযান, ভূমি বেদখল, সুরক্ষামূলক অধিকারসমূহ খর্ব করা, পরিবেশ বিষয়ক আইন ও রক্ষাকবচসমূহ দূর্বল করা ইত্যাদি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, যার মধ্য দিয়ে সরকার তার দমন–পীড়নকে আড়াল করার সুযোগ নিচ্ছে।
“অনেক দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো এই মহামারীর সময় ধ্বসে পড়ছে। জনগণ যখন লকডাউনে এবং তাদেরকে বাইরে যাওয়া ও প্রতিবাদকরা অথবা আদালতে যাওয়া থেকে নিবৃত্ত থাকতে বাধ্য হচ্ছে, ঠিক তখনই সরকারসমূহ আদিবাসীদের সাংবিধানিক অধিকারগুলো খর্বকরে দিচ্ছে, এবং জনগণকে তাদের বনভূমি থেকে উচ্ছেদ করছে এবং সামরিক অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে” বলেন এআইপিপি’র সেক্রেটারি জেনারেল গ্যাম এ সিমরে।
মানবাধিকার, সামরিকায়ন ও অপরাধী হিসেবে চিহ্নিতকরণ এর ক্ষেত্রে, এআইপিপি উল্লেখ করে যে, জাতিসংঘের মহাসচিব কর্তৃক অবিলম্বে একটি বৈশ্বিক যুদ্ধবিরতি এবং মহামারী বিস্তারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মনোযোগ প্রদানের আহ্বান সত্ত্বেও কোভিড–১৯ মোকাবেলার প্রচেষ্টা আদিবাসী অঞ্চলসমূহে সামরিক অভিযান থামায়নি।
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে সামরিক ও আইন–শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা সম্পূর্ণ বিচারহীনতার সাথে অব্যাহতভাবে ঘটে চলছে। সরকার ও সামরিক বাহিনীর মূল লক্ষে পরিণত হয়েছেন পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য আদিবাসী অধিকারের কর্মী–সমর্থকরা। সমাজের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করে, তাদেরকে সশস্ত্র দুর্বৃত্ত, চাঁদাবাজ, বিচ্ছিন্নতাবাদী ইত্যাদি লেবেল বা পরিচিতি দেয়া হচ্ছে।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে মানবাধিকার লংঘনের কয়েকটি ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। সন্ত্রাস দমনের অজুহাতে মানবাধিকার লংঘনের নিম্নোক্ত ঘটনাসমূহের রিপোর্ট পাওয়া গেছে:
● সন্ত্রাসী অনুসন্ধানের নামে কোন তল্লাশী ওয়ারেন্ট ছাড়াই প্রায় ২৯টি বাড়িতে ব্যাপক তল্লাশী চালানো হয়।
● নিরাপত্তা বাহিনী ও সরকার–সমর্থিক সশস্ত্র গোষ্ঠী কর্তৃক ৩ নিরীহ জুম্ম নাগরিককে অপহরণ করা হয়।
● পার্বত্য চট্টগ্রামে দুই ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যসহ ১৭ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয় এবং সেনাক্যাম্পে আটকাবস্থায় রাখা হয়।
● নিরাপত্তা বাহিনী ও সরকারের সাহায্যপুষ্ট সশস্ত্র গোষ্ঠী কর্তৃৃক ১৭ ব্যক্তিকে নির্যাতন করা হয়।
● নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রামে এক ব্যক্তিকে অপহরণ ও হত্যা করা হয় এবং ক্রসফায়ারে নিহত বলে প্রচার করা হয়।
● এছাড়া গত ২৮ এপ্রিল ২০২০ খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার দীঘিনালা এলাকায় একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী কর্তৃক দুই জুম্মকে গুলি করে হত্যা করা হয় বলে খবর পাওয়া যায়।
সামরিকায়ন ও কোভিড–১৯ এর করালগ্রাসের মধ্যে থাকার ফলে নারীরা তাদের স্বাধীন চলাফেলা, জীবিকা কর্মকান্ডে এবং তাদের পরিবারে খাবারের প্রাথমিক সরবরাহকারী হিসেবে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
গুরুতর অবস্থায় এক গর্ভবতী জুম্ম নারীকে বোটযোগে হাসপাতালে যাওয়ার পথে প্রায় এক ঘন্টা যাবৎ রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার বরকল উপজেলাধীন সুবলং ক্যাম্পে নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক আটকে রাখা হয়। সেভাবে অনেক্ষণ ধরে আটকে রাখার ফলে হাসপাতালে পৌঁছার পূর্বেই তিনি মারা যান।
তাছাড়া চাকরি হারিয়ে বাড়ি ফেলার পথে গত ১৬ এপ্রিল ২০২০ ষোল বছরের এক মেয়েসহ ৫ আদিবাসী নারী আহত হন। এই ঘটনাটি ঘটে পুলিশ যখন খাগড়াছড়ির বাড়িতে প্রত্যাবর্তনকারী আদিবাসী কর্মজীবীদের মারধর করে। অধিকন্তু ২০২০ সালের মার্চ মাসে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি সেটেলার কর্তৃক দুই আদিবাসী নারীকে ধর্ষণ করার খবর পাওয়া গেছে।
মানবাধিকার, জীবনজীবিকা ও ভূমি অধিকার প্রসঙ্গে এআইপিপি’র উল্লেখ করে যে, বাংলাদেশে দেশব্যাপী লকডাউনের কারণে হাজার হাজার আদিবাসী চাকরিহীন এবং খাদ্য সংকটে ভুগছেন এবং প্রত্যাবর্তনকারী অভিবাসী কর্মজীবীরা তীব্র খাদ্য নিরাপত্তার মুখে পড়েছে যা অত্যন্ত উদ্বেজনক।
এআইপিপি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায়সমূহের সম্মতি ব্যতিরেকেই ভূমি বেদখল ও খনিজ আহরণ পরিচালনা অব্যাহতভাবে চলছে। এআইপিপি সদস্য–সংগঠনসমূহ থেকে প্রতিবেদন এসেছে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান পার্বত্য জেলার বিভিন্ন এলাকায় আদিবাসী জুম্ম গ্রামবাসীদের তাদের গ্রাম থেকে উচ্ছেদ ও তাদের ভূমি দখল করার জন্য আদিবাসীদের প্রায় ৫০০০ একর পরিমাণ রাবার বাগান পুড়িয়ে দেয়া হয়। ভূমি বেদখলকারীরা ক্ষমতাবান কোম্পানি এবং রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি অথবা তারা নিজেরাই রাজনৈতিক দলের নেতা হওয়ায়, দুই পক্ষের এই মুখোমুখী অবস্থার এক পর্যায়ে নিরীহ গ্রামবাসীদের গ্রেফতার করা হয়।