বাচ্চু চাকমা
২০শে মে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এটা কেবল একটি সংগঠনের প্রতিষ্ঠা দিবস নয়, এটি জুম্ম ছাত্র-যুবদের এক অগ্নিঝরা বৈপ্লবিক চেতনা, টগবগে তারুণ্যের স্ফুলিঙ্গ। ১৯৮৯ সালে ৪ঠা মে লংগদু গণহত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে ঢাকার রাজপথে নেমে এসেছিল পাহাড়ের প্রতিবাদী ছাত্র সমাজ। ১৯৮৯ সালে ২০ মে পার্বত্য চট্টগ্রামের একমাত্র প্রগতিশীল ছাত্র রাজনৈতিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের আত্মপ্রকাশ হয়েছিল। লংগদুর বুকে রক্তের স্রোতধারায় ও স্বজন হারানোর যন্ত্রণার চাপা গোঙানিতে পাহাড়ি ছাত্র সমাজ জেগে উঠার নতুন জাগরণের ডাক শুনতে পেয়েছিল। সেনাশাসনের ভয়াল আগ্রাসী হায়েনার থাবা অগ্রাহ্য করে ১৯৮৯ সালের ২০ মে পাহাড়ের ছাত্র সমাজ ঢাকার রাজপথে নেমে এসেছিল। ভরদ্বাজমনি ৭০ বছর বয়সে ভরা তারুণ্যের জীবন সঞ্জীবনী নিয়ে ছাত্র সমাজের আত্মবলিদানকে উদ্বোধন করে গিয়েছিলেন। সেই পথেই জীবন সমর্পিত করেছিলেন অমর বিকাশ, ক্যজাই মারমা, লাল রিজার্ভ বম, রূপম, সুকেশ, মনতোষ, সনজিৎ তঞ্চঙ্গ্যা, মংচসিং মারমা, পেসকা মারমাসহ আরো অনেক সাহসী যোদ্ধা। সেই সাথে দীর্ঘ দুই যুগের অধিক গেরিলা যুদ্ধের সময় হারিয়েছি মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাসহ শত শত বীর শহীদদের। সেইসব বীর আত্মত্যাগীদের বীরত্ব গাঁথাকে পিসিপির ৩১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী এদিনে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসার সাথে স্মরণ করছি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ’ অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, শাসকগোষ্ঠীর চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে পূর্ণ হতে চলেছে ৩১ বছর। এই সুদীর্ঘ ৩১ বছরে পিসিপি’র গর্ব ও অহংকার করার মতো আছে অনেক গৌরবোজ্জ্বল দিন। যেই দিনগুলোর মাঝে পিসিপি’র উত্তাল প্রতিবাদী মিছিল আর ছাত্র আন্দোলনের দিনগুলো উঁকি দিয়ে যায় আজও পরতে পরতে। স্বাভাবিকভাবে পিসিপি’র ২০ মে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আমাদেরকে করে স্মৃতিকাতর। এই পিসিপির ছাত্র সংগঠনের সাথে জুড়ে আছে আমার অনেক দিনের স্মৃতি। ছাত্র ও যুব তারুণ্যের উত্তেজনা আর অনেক সফল অনুষ্ঠানের আনন্দঘন মুহুর্ত-সেই দিনগুলো এখনো আমায় পিছু ডাকে। যদি সেই দিনগুলো ফিরিয়ে আনা সম্ভব হতো, মনে হয় আরো অধিকতর সংগ্রামীরুপে করা যেতো আরো অনেক সাংগঠনিক কাজ! পিসিপি’র এই সংগঠনের সাথে আছে যেমন বীরত্বপূর্ণ ঘটনা, আছে তেমনি দুঃখ ও প্রিয় সহযোদ্ধা হারানোর বেদনা।
পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের জন্মলগ্ন থেকে প্রতিবাদী মিটিং-মিছিল-সমাবেশে শাসকগোষ্ঠীর উদ্যত চোখ রাঙানি আর রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে হাজারো অকুতোভয় প্রতিবাদী ছাত্র যুবরা সমবেত হয়েছিলো। জেল-জুলুম-নিপীড়ন নির্যাতন কিংবা হত্যার হুমকি কোন কিছুই সে সময় মুক্তিকামী ছাত্র সমাজকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীর সকল বাধা বিপত্তিকে উপেক্ষা করে হাজারো ছাত্র সমবেত হয়েছিলো পিসিপি’র পতাকাতলে। জাগ্রত জনতার কন্ঠে শ্লোগান হতো পিসিপির পতাকায়-নবীন তোমার শোভা পায়, এসো নবীন দলে দলে-পিসিপির পতাকাতলে। সকল ষড়যন্ত্র বাতিল করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো আন্দোলন সংগ্রামে। কোন প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তি জুম্ম ছাত্র সমাজকে থামিয়ে রাখতে পারেনি। ছাত্র-জনতার সমাবেশে দাঁড়িয়ে অনেক সহযোদ্ধা দ্যর্থহীন কন্ঠে বৈপ্লবিক চেতনায় সুসজ্জিত হওয়ার শপথ নিয়েছিলো। কারণ, এই পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের চেতনা মানেই জীবন্ত এম এন লারমার চেতনা।
নিপীড়িত জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব সংরক্ষণ করাই পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের অন্যতম আদর্শ। যে লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও আদর্শ নিয়ে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ গঠিত হয়েছিলো- সেই আদর্শ ও চেতনার মশাল এখনো পাহাড়ের বুকে জ্বলজ্বল করছে। হয়নি এখনো পথভ্রষ্ট। আজো পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের সেই আদর্শের ধারা অক্ষুন্ন রেখে দৃঢ়তা ও সাহসিকতার সাথে এগিয়ে যাওয়ার জুম্ম তরুণদের আমি দেখতে পায়। পৃথিবীর ইতিহাসের বাগে বাগে আমরা দেখতে পেয়েছি আদর্শিক চেতনায় তরুণরাই যেকোন জাতির, যেকোন দেশের সংকটময় দিনে এগিয়ে এসেছে। তাই পিসিপির ৩১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী এই দিনে ছাত্র সমাজের গৌরবময় সংগ্রামের ইতিহাস স্মরণ করে দিতে আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। এই আদর্শিক চেতনা সম্পূর্ণ তরুণরাই পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের লাল ঝান্ডাকে উর্ধ্বে তুলে ধরে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। শাসকের হুংকার, জলপায়ীদের রাঙা বেয়নেট, বন্দুকের গুলির সামনে তারা দমে যায়নি। নীতি-আদর্শ ও লক্ষ্য বাস্তবায়নের প্রশ্নে তারা রয়েছে আপোষহীন।
হাজারো প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে পিসিপির প্রগতিশীল শক্তিকে এগিয়ে যেতে হয়েছে। আন্দোলনের দীর্ঘ ৩১ বছরের পথ চলায় কখনো কখনো প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তি কালো মেঘের মতো ছায়া ফেলে বাধা সৃষ্টি করেছিলো, তা কোনদিনই চিরস্থায়ী হতে পারেনি। মনে রাখবেন, সূর্যকে মেঘ কখনই চিরদিনের জন্য ঢেকে রাখতে পারে না। পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ হল উদীয়মান সূর্যের মতো। পরিস্থতি ও বাস্তবতার বিশেষে কখনো কখনো সাময়িকভাবে আড়াল করে রাখতে পারে মাত্র। ছাত্র তরুণ সমাজকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলতে চাই অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো এই প্রগতিশীল ছাত্র রাজনৈতিক সংগঠন। এই সংগঠনের প্রতি দুর্বলতায় আমাকে দুয়েক লাইন লেখার উদ্দীপনা সৃষ্টি করে দেয়।
জুম্ম তরুণদের বৈপ্লবিক রাজনীতিতে অংশগ্রহণের আহ্বান; আমাদের সমাজ ব্যবস্থা জটিল ও গোলমেলে একটা সন্ধিক্ষণে এসে থেমে গেছে। তাই বলে এই নয় আমাদের সমাজ একেবারে এই অবস্থার মধ্যেই ইতি টানবে। মনে রাখবেন, বস্তু গতিশীল ও পরিবর্তনশীল! আমাদের জুম্ম সমাজ কোনদিন এই অবস্থার মধ্যে থেমে থাকবে না। আমরা গতিশীল ও পরিবর্তনশীলতাকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, সেজন্য আমাদের সমাজ এগিয়ে যাবে, পরিবর্তন আসবেই। আমরা নৈরাজ্যবাদী নয়, আশাবাদী। আমরা স্বপ্ন দেখি, প্রতিদিন প্রতিক্ষণ স্বপ্ন বুনে চলি। আমরা আশাবাদী জুম্ম সমাজ একদিন তাদের নিজস্ব অধিকার ফিরে পাবে। আজ যেই যুবক মদ-জুয়া-হিরোইন-ইয়াবার নেশায় মত্ত একদিন সেই যুবকও হবে পরিবর্তন। সেই যুবকটির হাত ধরে গড়ে উঠবে জাতির ভবিষ্যৎ। শাসকগোষ্ঠীর আসল চেহারা সেই মরণ নেশায় মত্ত থাকা যুবকটিও একদিন বুঝবে। একদিন সেই যুবকটি তার সমস্ত মরণ নেশা ছেড়ে দিয়ে জুম্ম জাতির জন্যে এগিয়ে আসবে বেঁচে থাকার লড়াই সংগ্রামে। যেই যুবকটি সমাজের পেটি বুর্জোয়া চিন্তাধারার দোদুল্যমানতার খাঁচার মধ্যে বন্দী হয়ে পড়ে আছে সেই যুবকটি একদিন খাঁচা ভেঙে চলে আসবে সংগ্রামের ময়দানে। আমরা এখনও আশাবাদী যেই পাহাড়ি যুবকটি আমার একটু সময় লাগবে বলে দোটানায় পড়ে থাকা সেই যুবকটিই একদিন হবে আমাদের সংগ্রামের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। যেই যুবকটিকে ‘আই হেইট পলিটিক্স’ এবং ‘পলিটিক্স একদম খারাপ’ বলে সমাজের অধিকাংশ মানুষ রাজনৈতিক বিমুখতা করতে চাইছে সেই যুবকটিও একদিন বুঝবে রাজনৈতিক অধিকার ছাড়া জুম্ম জাতির সামগ্রিক মুক্তি আসবে না, রাজনীতিই তার জীবনের পাথেয় হয়ে থাকবে।
যেই পাহাড়ি যুবকটিকে বুঝানো হয় জুম্মরা ৩/৪ ভাগ হয়ে গেছে, পাহাড়িরা ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে প্রাণ হারাচ্ছি বলে সংগ্রামে অনুৎসাহিত করে, আন্দোলন করলেও আমরা পারবো না বলে হতাশার বানী শুনায় সেই যুবকটি একদিন নিশ্চয়ই বলবে “সংগ্রাম ছাড়া জুম্ম জাতির মুক্তি মিলবে না, আমিও সেই জুম্ম জনগণেরই একজন, আমিও অত্যাচারী শাসকের কাছ হতে মুক্তি পাবো না”। তাই হে জুম্ম তরুণ! আহ্বান আমার নয়, স্বয়ং মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমারই ছিলো আজ জুম্ম জাতির ক্রান্তিলগ্নে সকল বাধাকে উপেক্ষা করে জুম্ম জাতির জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বৃহত্তর সংগ্রামে সামিল হোন। আর নয় দোদুল্যমানতা, ব্যক্তিস্বার্থপরতা ও আত্মকেন্দ্রিকতা সকল প্রকার ক্ষুদ্রতাকে পেছনে ফেলে দিয়ে বৃহত্তর স্বার্থে ও জুম্ম জাতির সামগ্রিক স্বার্থে নিজেকে উৎসর্গিত করুন। শাসকগোষ্ঠীর বধ্যভূমি পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে এখনই ঝাঁপিয়ে পড়ুন।
মনে রাখবেন, না পাওয়ার বেদনা থেকেই জন্ম হয় মানুষের সংগ্রাম। না পাওয়ার যন্ত্রণা মানুষকে আরও বস্তুর গভীর হতে গভীরে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত করে। সেই গভীরতায় মানুষকে দেখিয়ে দেয় সঠিক দিশা। পার্বত্য চট্টগ্রামের লক্ষ লক্ষ মানুষের বেদনা আর যন্ত্রণাকে সাথে নিয়ে মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা নেমেছিলেন লড়াই সংগ্রামে। লক্ষ লক্ষ পাহাড়ি মানুষের হারানো জীবনকে ফিরে না পাওয়ার যন্ত্রণাকে নিজেই গভীরভাবে অনুভব করেছিলেন। অধিকারহীন মানুষের দুঃখ ও যন্ত্রণাকে যখন আপন করে নিয়েছিলেনতখনই তাদের জন্য লড়াই করতে প্রস্তুত হলেন। তিনি জানতেন রাজনৈতিক অধিকার ছাড়া জুম্ম জাতির সামগ্রিক মুক্তি সুদূর পরাহত। সেজন্যে রাজনৈতিক অধিকার ফিরে পাওয়ার এক বুক আশা নিয়ে অসমশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে মাঠে নেমেছিলেন। আজ জুম্ম সমাজ পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে টিকে থাকবে কি থাকবে না এমনই একটা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। শাসকগোষ্ঠী চায় আমাদের বিলুপ্তি, বিপরীতে আমরা চাই আমাদের প্রতিষ্ঠা। এই দুয়ের মধ্যেকার লড়াই আজ অনিবার্য পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা জীবিত অবস্থায় লড়াই করেছিলেন এখনও সেই লড়াই সংগ্রাম থেমে নেই। চলছে অবিরাম, চলছে নিরন্তর গতিতে। প্রয়াত নেতার যোগ্য উত্তরসূরী জুম্ম জনগণের জীবন্ত কিংবদন্তি প্রিয়নেতা জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার ওরফে সন্তু লারমার নেতৃত্বে এখনও জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার আদায়ের লড়াই সংগ্রাম চলছে। পরিস্থিতি ও বাস্তবতার নিরিখে সংগ্রামের গতি বাড়ে আর হয়তো কমে। এটাই অধিকারকামী জনতার একমাত্র পার্টির আন্দোলনের কৌশল। সংগ্রামের ইতিহাস বলে দেয় পৃথিবীর বুকে অধিকারের জন্য যত লড়াই সংগ্রাম, বিপ্লব হয়েছে সেই লড়াইয়ের সময় সেই জাতির মধ্যে সুবিধাবাদী, প্রতিক্রিয়াশীল, বিভেদপন্থী ও বিপ্লবীর মুখোশধারী উপদলীয় চক্রান্তকারীরা যুগে যুগে ছিল এবং বিপ্লব সফল না হওয়া পর্যন্ত থাকবে।
আজ পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে দীর্ঘ ৪৮ বছর ধরে জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার আদায়ের সংগ্রাম চলছে, এখানেও সেই একই বিভেদপন্থী, প্রতিক্রিয়াশীল, সুবিধাবাদী ও ক্ষমতালোভী গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চক্রদের উত্তরসূরী শাসকগোষ্ঠীর কোলে জন্ম নেওয়া প্রসিত-রবি শংকরদের ইউপিডিএফ। তারপর একই কায়দায় জন্ম হওয়া ২০০৭-০৮ সালে জরুরি অবস্থা সময় আদর্শচ্যুত ও দলচ্যুত তাতিন্দ্র-সুধাসিন্দুদের সংস্কারপন্থীদল ও সংস্কারপন্থীদের সাথে গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ মুখোশধারী তথা শাসকগোষ্ঠীর লালিত সন্ত্রাসীরা আজ পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিকে ঘোলাটে ও অস্থিতিশীল করে তুলছে। যদিও ইউপিডিএফ আজ একটু চুপছে রয়েছে, জুম্ম জনগণ আশা করেছিল প্রসিত-রবি শংকরদের ইউপিডিএফ তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে, তারা জুম্ম জনগণের পক্ষে চলে আসবেন, জনসংহতি সমিতির সাথে সামিল হবেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ইউপিডিএফ এখনও দোটানার মধ্যে পড়ে আছে এবংদোদুল্যমানতা থেকে মুক্ত হতে পারেনি।
বিশেষ করে ছাত্র ও যুব সমাজের প্রতি আহ্বান থাকবে, আমাদের মধ্যেকার ভুল চিন্তাধারাগুলো অধিকতরভাবে প্রাধান্য পেয়ে বসেছে। জুম্ম জাতির একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে কি আমরা এভাবে থাকবো? নাকি সংগ্রামের সক্রিয় থেকে প্রতিকূল পরিস্থিতি ও বাস্তবতাকে পরিবর্তনের ভূমিকা রাখবো। শাসকগোষ্ঠী যে ষড়যন্ত্র বেড়াজাল রচনা করে চলেছে, সেটা তো আমাদেরকে ভাঙতে হবে। এধরনের পরিস্থিতির সাথে মোকাবেলা করার জন্য আমাদের করণীয় কি হবে? শাসকগোষ্ঠী যা করছে সেটা যদি আমরা মেনে নিতে পারি তাহলে গা ভাসিয়ে থাকলেই চলবে। চুপ করে বসে থাকলেই শাসকগোষ্ঠী তার আসল কার্যক্রম অবাধে চালিয়ে যেতে পারবে। আর যদি মেনে নিতেনা পারি তাহলে আপনাকে প্রতিরোধে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে, গা ভাসিয়ে চুপ করে থাকলেও শাসকগোষ্ঠী তাদের দমন-পীড়নের ষ্টীমরোলার থেকে কাউকে মুক্তি দেবে না। চূড়ান্তভাবে দালাল হোক বা সুবিধাবাদী হোক কাউকে শাসকগোষ্ঠী রেহাই দেবে না। এটাইফ্যাসীবাদের বৈশিষ্ট্য।
শাসকগোষ্ঠী যেহেতু গণতান্ত্রিক নয়, সেহেতু একমাত্র প্রচলিত নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে অধিকার দাবি করা বোকামী ছাড়া কিছুই নয়। সেজন্যে আপনাদের অধিকতর আন্দোলনে যেতে হবে। তার জন্য বেশি প্রয়োজন সেই যুব সমাজকে যাদের মধ্যে রয়েছে “মুখে হাসি, বুকে বল, তেজে ভরা মন”। যেই যুব সমাজ এখনও দোদুল্যমানতার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, মা বাবা ও সকল পিছুটানকে প্রাধান্য দিয়ে চলেছে, সেই ছাত্র ও যুব সমাজকে সংগ্রামে প্রয়োজন। যেই চিন্তাধারাগুলো আমাদের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় সেগুলো পরিহার করতে হবে। এই আন্দোলন করতে গিয়ে আমাদের মধ্যেকার নানা হতাশা, নিরাশা যাতে বাসা বাঁধতে না পারে তার জন্য নিজেকে সব সময় সদাজাগ্রত রাখতে হবে। নিজেকে সঠিক চিন্তায় শাণিত করতে হবে। নিজেকে আরও অধিকতর বা উচ্চ মাপের আন্দোলনের যাওয়ার জন্য প্রস্তুত করা দরকার। মনে রাখবেন আমাদের দৃঢ় সংকল্প ও প্রতিজ্ঞা করতে হবে যে, অধিকার না পাওয়া পর্যন্ত অধিকতর আন্দোলন থেকেবিচ্যুত হবো না।
যারা অধিকতর সংগ্রামী, ত্যাগী ও বিপ্লবী একমাত্র তারাই এধরনের সংকল্প ও প্রতিজ্ঞায় অটল থাকতে পারে। কিন্তু সামন্তশ্রেণি ও বুর্জোয়াশ্রেণি চিন্তাধারার মানুষগুলোর মুখে সংকল্প ও প্রতিজ্ঞা করলেও বাস্তবে তারা পালন করতে পারে না। শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে ফাঁকিবাজি, ধোকাবাজি ও বেঈমানী মানসিকতা থাকতে পারে, কিন্তু অধিকারকামী ও সংগ্রামী মানুষের মধ্যে তা নেই। আমাদের জুম্ম সমাজের মধ্যে যুবকদের স্মরণ করা দরকার, ছাত্র-তরুণ অবস্থায় মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা, বর্তমান নেতা সন্তু লারমা ও প্রিয় অগ্রজ যারা, তারা এক সময় একটা ঐতিহাসিক দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। মনে রাখা দরকার, আন্দোলনকে এমনিতেই ফেলে রাখাযায় না, নিষ্ক্রিয় করেও রাখা যাবে না এবং আন্দোলন হতে সরে যাওয়া কখনোই সঠিক নয়। ঐতিহাসিক দায়িত্ব থেকে জুম্ম ছাত্র ও যুবসমাজ কখনো পিছু হটতে পারে না। আন্দোলনে নবীন আর প্রবীণ সমাবেশ হবে, নবীনদের অনেক ঘাত-প্রতিঘাত মুখোমুখি হতে হবে।মনে রাখবেন, আমাদের সংগ্রামে মান-অভিমানের কোন স্থান নেই। সেভাবে ছাত্র ও যুব সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ যৌবনযার, যুদ্ধে যাবার শ্রেষ্ঠ সময় তার।
জুম্ম জনগণ শাসকগোষ্ঠীর সশস্ত্র চেহরা, নগ্ন চেহারা, বিকৃত চেহারা দেখার আর তেমন বাকি নেই। শাসকগোষ্ঠীর কালাকানুন, সেটেলার বাঙালি, সেনাবাহিনী, সামরিক বেসামরিক আমলাদের সশস্ত্র রুপ কিভাবে মোকাবেলা করবেন? এই প্রশ্ন থেকে যায় ছাত্র ও যুব সমাজের কাছে। পদানত জীবন, শোষণ, নিপীড়নের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত জীবন আমরা কখনো কামনা করি না। পার্বত্য চট্টগ্রামের জীবন, যৌবন সবকিছু ছাত্র ও যুব সমাজের হাতে রয়েছে। শাসকগোষ্ঠী জীবন, যৌবন কখনো আমাদের দেবে না। আদায় করে নিতে হবে, কেড়ে নিতে হবে। আজ একটু স্মরণ করুন হাজার হাজার জুম্ম জনগণ আন্দোলন থেকে সরে গেছে, শুধুমাত্র সরে যায়নি দালালীপনার চরম সীমায় পৌঁছে গেছে। পেছন থেকে জুম্ম জাতিকে ছুরি মারছে। কি করবেন? তারপরও চুপ করে বসে থাকবেন, নাকি শুধু ঘন্টা বাজিয়ে যাবেন?
বর্তমান নেতা সন্তু লারমা বলেছিলেন, “বাঁচো অথবা মরো”। তিনি এখনও তারুণ্যকে প্রাধান্য দেন, তারুণ্যকে গভীরভাবে উপলদ্ধি করেন। তাহলে ছাত্র ও যুব সমাজ কি গভীরে গিয়ে উপলদ্ধি করতে পারে না, নিশ্চয়ই পারবে। আমরা এখনও আশাবাদী, সেজন্যেই তো তারুণ্যের সঞ্জীবনীকে নিয়ে লিখতে বসি বারবার। আমরা জানি, শাসকগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামে ইসলামীকরণ নীতি প্রয়োগ করে আসছে। এক সময় রাশিয়ার বুকে রাশিয়ায় জার শাসনামলে অরুশীয় জাতিসমূহকে বলপূর্বক রুশীকরণের নীতি প্রয়োগ করেছিল। ঠিক একইভাবে শাসকগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামে অবাধ অনুপ্রবেশ, বিভিন্ন স্থানের জুম্ম নাম মুছে দিয়ে ইসলামী নামকরণ, মসজিদ-মাদ্রাসা ব্যাঙের ছাতার মতো গজে উঠছে। ইসলামী সম্প্রসারণবাদ কায়েম করে জুম্ম জাতির নাম নিশানা মুছে দেওয়ার সুগভীর ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এসব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে পাহাড়ের বুকে তরুণদের প্রতিরোধের দেয়াল নির্মাণ করতে হবে।
আমাদের প্রিয় অগ্রজরা প্রমাণ করে দিয়েছেন, ক্ষুদ্র শক্তি নিয়েও শাসকগোষ্ঠীর কাছ থেকে অধিকার ছিনিয়ে আনা সম্ভব। বৃহৎ শক্তির সাথে লড়াই করার জন্য আমাদের প্রয়োজন শুধু সাহস, মেধা, যোগ্যতা, আদর্শ ও কৌশল। নীতি, আদর্শগত সুসংগঠিত কোন জাতিকে যতই শক্তিশালী হোক না কেন পৃথিবীর কোন শাসকগোষ্ঠী পরাজিত করতে পারেনি। পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস মানেই হলো নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে অধিকারকামী মানুষের ইতিহাস। জুম্ম জাতির ইতিহাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ইতিহাস। রক্তের বন্যা বয়ে গিয়েছিলো পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে, হে জুম্ম তরুণ সেটা স্মরণ করো। পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে, পার্বত্য চট্টগ্রামের মাটি ও প্রকৃতির সাথে আমাদের বেড়ে উঠা। রক্তাক্ত লাশ এবং নৃশংস গণহত্যা ও সাম্প্রদায়িক হামলার নীরব সাক্ষী এই পাহাড়, পাহাড়ের বর্তমান নাজুক পরিস্থিতি আমাদের প্রতিরোধে যাওয়ার চূড়ান্ত ইঙ্গিত দিচ্ছে। তারপরও কি খুলে বলতে হবে, শাসকগোষ্ঠীর আচরণে ইঙ্গিত মেলে না?
আপনার পরিচয় এখন হয়তো একজন ছাত্র ও যুবক। যখন রাজনীতিতে যুক্ত হবেন, তখন আপনার প্রধান পরিচয় হবে রাজনৈতিকপ রিচয়। আপনি তখন হবেন একটা দলের অন্যতম সদস্য। নিজেকে এখন প্রশ্ন করেন, কেন রাজনীতিতে যুক্ত হলেন? রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার পর ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতি হিসাব করছেন কি? রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে কি পেলাম আর কি পেলাম না এই জাতীয় হিসাব কোনদিনই করবেন না। শোষিতের জন্য রাজনীতি করেন যেহেতু কি পেলাম সেটা বড় কথা নয়, জাতিকে কি দিতে পেরেছি সেটাই বড় কথা। আর লাভ-ক্ষতি অবশ্যই হিসাব করবেন, তবে ব্যক্তিগত নয়, হিসাব হবে সামগ্রিক স্বার্থে, শাসক আর শোষিতের মধ্যে। জুম্ম জাতি ধ্বংস এবং প্রিয় জুমভূমিকে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। এই ধ্বংসের জন্য দায়ী কে? তাহলে আপনার চারিদিকে ঘটে যাওয়া বাস্তব সমস্যা বা ঘটনাবলী স্মরণ করে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করবেন। দেখবেন প্রশ্নের উত্তরগুলো হুট করে বেড়িয়ে এসেছে।
আপনার জাতির উপর লোমহর্ষক গণহত্যা করা হয়েছে, ভূমি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, আমাদের অর্থনীতি লুন্ঠন করে নেওয়া হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চল কিন্তু এই জুম্ম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করার হীন চক্রান্ত চলছে, আপনার ভাইকে ক্রসফায়ারে গুলি করে মারা হচ্ছে, আপনার বোনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হচ্ছে, আপনার ভাইকে মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত করে অবৈধভাবে জেলে প্রেরণ করা হচ্ছে, সমগ্র জুম্ম জাতির উপর চলছে সেনাশাসন ও সেনানির্যাতন। এছাড়াও জুম্ম জাতির জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব ধ্বংস করার সকল আয়োজন শাসকগোষ্ঠী পরিকল্পনা করে রেখেছে। আপনি চাইলে সেই দলে যুক্ত হতে পারেন, তার মধ্যে জুম্মলীগ আওয়ামীলীগ, জুম্মদল বিএনপি, জাতীয় পার্টি, নব্য নীতিচ্যুত ও দলচ্যুত তাতিন্দ্র-সুধাসিন্দু-বিমল-অংশুমানদের নিয়ে গঠিত সংস্কারপন্থী দল, গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ ও মূল ইউপিডিএফ। আপনি চাইলে পাদিতে পারেন অথবা সরাসরি সেখানে যুক্ত হতে পারেন। সেজন্যে প্রতিটি জুম্ম ছাত্র ও যুবকদের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে। আপনি কি জাতীয় দল তথা সেনা ডিজিএফআইয়ের পালিত পুত্র তাতিন্দ্র-সুদর্শনদের সংস্কারপন্থী দলে যুক্ত হবেন, নাকি জুম্ম জনগণের সবচেয়ে প্রিয় দল, লড়াকু ও পোড় খাওয়া পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিতে (সন্তু লারমার নেতৃত্বে চলা) যুক্ত হবেন। আপনি কি করবেন, সেটা একান্তই নিজের ইচ্ছানুযায়ী হবে।
আমি বলবো সবার আগে নিজেকে জানুন, নিজেকে জেনেই নিজেকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করবেন। অন্যরা এসে আপনাকে পরিবর্তন করে দেবে না। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে জিয়া আমলে আখ্যা দিয়েছে অর্থনৈতিক সমস্যা। সেকারণেই পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড গঠন করে দিয়ে সেখানে বসিয়ে দিলেন চট্টগ্রাম বিভাগের জিওসিকে। এভাবে কত প্রতারণা, কত ধোকাবাজি, কত বেঈমানী করে চলেছে আমাদের জুম্ম জাতির সাথে। জনসংহতি সমিতি ও জুম্ম জনগণের সংগ্রামের এক পর্যায়ে চুক্তি হল আওয়ামী লীগ সরকার আমলে ১৯৯৭ সালে ২ ডিসেম্বর। জুম্ম জনগণের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও বাংলাদেশ সরকার এর সাথে ঐক্যমতে পৌঁছালেন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর হল। চুক্তি পরবর্তী ইতিহাস আপনার কাছে অজানা নয়, চরম প্রতারণা আর বেঈমানীর পরিচয় দিলেন বাংলাদেশ সরকার। পার্বত্য চট্টগ্রাম জুম্ম জনগণ দিন দিন শাসকগোষ্ঠীর প্রতি ঘৃণা ও হতাশা বেড়ে চলেছে। এই জন্যে বারবার ছাত্র ওযুব সমাজের ঐতিহাসিক দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দিতে চাইছি।
পার্বত্যাঞ্চলের সামগ্রিক পরিস্থিতি ও বাস্তবতাকে নিয়ে আপনি কি ভাবছেন এবং আপনার নিজের জীবনকে নিয়ে কি ভাবছেন। আমি রাজনীতি করি না, কেউ বলতে পারবে না। যে দল ক্ষমতায় যায়, সরকার গঠন করে তাকে কারা ভোট দেয়? নিশ্চয়ই সমগ্র দেশের জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে সেই দল সরকার গঠন করে। সেই দলটি কোন অরাজনৈতিক দল নয়, অবশ্যই রাজনৈতিক দল। সেই দলকে আপনি ভোট দিয়েছেন, সমর্থন করেছেন তাহলে আপনি রাজনীতি করেন না কেন বলবেন? প্রত্যক্ষ হোক আর পরোক্ষভাবে হোক আপনি রাজনীতিতেই যুক্ত আছেন। অপরদিকে রাজনীতিই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে, আপনার শার্ট-প্যান্ট কত টাকা হবে, আপনার নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল, জিনিসপত্র কত টাকা হবে, বই-খাতা কলম কত টাকা হবে, সবকিছু রাজনৈতিক-অর্থনীতিই নির্ধারণ করে দিচ্ছে। তারপরও কি বলবেন আপনি রাজনীতি করেন না?
তবে রাজনীতি প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। শাসকদের রাজনীতি ও শোষিতদের রাজনীতি। বহু মানুষের, বহু জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বা সমগ্র জীবনধারাকে নিয়েই হল রাজনীতি। শোষণ থেকে মুক্ত হওয়ার একটা রাজনীতি আর শোষণকে ধরে রেখেই আরেকটি রাজনীতি। এই রাজনীতির সাথে তরুণদের যুক্ত হয়ে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সঠিক রাজনীতিকে বের করতে হবে। সকল মানুষই রাজনীতির সাথে যুক্ত। আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে ঘিরে এই দুই ধরনের রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকি। আমরা শোষণ, নিপীড়ন, দুঃশাসন দূরীভূত করার রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছি। আত্মকেন্দ্রিকতার মধ্যে থেকেই আমাদের জীবন আবদ্ধ হলে হবে না। মহান প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত হতে হবে। তবে প্রশ্ন হল এই, নিজের জীবনকে কোন ধরনের চিন্তা চেতনায় সুসজ্জিত করবেন? সেটার সঠিক পথকে দেখিয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু বাস্তবে বদলানো অনেক কঠিন। সেই কঠিন কাজেই ছাত্র ও যুব সমাজকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। সকল মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার রাজনীতিতে আপনাকে যুক্ত হতে হবে। আমরা সবাই মানুষ, সকল মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা হওয়া দরকার।
জুম্ম জাতি আজ বিলুপ্তির পথে ধাবিত হয়েছে, সেখান হতে ফিরে আসা খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। এই কঠিনতম বিষয়টা নিয়ে ছাত্র ও যুবকদের গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে। মনে রাখবেন, রাজনীতি করতে গেলে একটা দলবদ্ধ প্রচেষ্টা দরকার, সেখানে বহু মানুষের ভূমিকা থাকা দরকার। বহু মানুষকে ঘিরে যে কর্মসূচি সেটা সঠিকভাবে সমাধান করতে হবে। জুম্ম জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য দলের দরকার, নীতি, আদর্শ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য পরিপূর্ণ একটা পার্টি দরকার। সেখানে আপনার, আমার দ্বিমত থাকার কোন কথা নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে জাতীয় দলগুলো আছে, পাশাপাশি জনসংহতি সমিতি রয়েছে, রয়েছে সংস্কারপন্থী ও ইউপিডিএফ নামধারী বিভেদকামী গোষ্ঠী।বিশেষ করে এই দলগুলোকে ছাত্র ও যুব সমাজ কোন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণকে নিয়ে যে রাজনীতি কোনদলটি সঠিক সেটা ছাত্র ও যুব সমাজকে বেছে নিতে হবে। দোদুল্যমানতায় পড়ে থাকলে জুম্ম জাতি ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই আসুন পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম জনগণের জন্য সঠিক রাজনৈতিক দল বেছে নেওয়ার যোগ্যতা অর্জনে সচেষ্ট হই। দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও দোদুল্যমানতা হতে মুক্ত হওয়ার সকল কার্যক্রম এখনই শুরু করেন। স্মরণে রাখবেন, শুরুটা যেন শুরুতে না থাকে আর শুরুটা যেন শেষ হয়েও না যায়।
বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের কি করতে হবে? শাসকগোষ্ঠী এই নিপীড়কশ্রেণি শুধুমাত্র আমাদের জনগণকে নয়, গরীব মেহনতি মানুষের প্রতি তাদের অমানবিক আচরণ চালিয়ে যাচ্ছে। আমি আর পরিষ্কার করে বলতে চাই, পার্বত্য চট্টগ্রামে তিনটি রাজনৈতিক দল আছেবলে আমি মনে করিনা। কারণ, ইউপিডিএফ আর সংস্কারপন্থীরা শাসকগোষ্ঠীর গর্ভে জন্ম নিয়েছিল। এটা জুম্ম ছাত্র ও যুব সমাজকে ভুলে যাওয়া ঠিক হবেনা। এই দুইটি দলের মধ্যে বর্তমানে সংস্কারপন্থী শাসকগোষ্ঠীর সাথে লেজুড়বৃত্তি করে জুম্ম জনগণের অধিকার কিভাবে প্রতিষ্ঠা করবে আমার কাছে পরিষ্কার নয়। এই দলগুলোকে পাহাড়ের মানুষ রাজনৈতিক দল হিসেবে কখনো স্বীকৃতি দিতে পারে না। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনকে এই ইউপিডিএফ আর সংস্কারপন্থীরা গলাটিপে হত্যা করতে চেয়েছে বারবার। তাই ছাত্র সমাজকে জুম্ম জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার আন্দোলনকে মসৃণ হিসেবে দেখলে হবে না, আন্দোলনে রক্ত পিচ্ছিল পথ পাড়ি দিতে হবে। ইউপিডিএফ আর সংস্কারপন্থীদের নতুন করে দেখার বা মূল্যায়ন করার কোন কারন দেখছি না। অতীতে সংগ্রামের সময় এরচেয়ে অধিকতর শক্তিশালী প্রতিক্রিয়াশীল দল সৃষ্টি করা হয়েছিল জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে। তাদের সাথে পার্টি জনসংহতি সমিতি মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছিল। তাহলে আজকে আমাদের মধ্যে সন্দেহ, অবিশ্বাস উদ্ভব হবে কেন?
আমাদের পার্টি জনসংহতি সমিতির আদর্শকে যথাযথভাবে গ্রহণ করতে না পারার কারণে আমাদের মধ্যে পশ্চাৎপদ চিন্তা চেতনা ঘিরে ধরেছে। আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম ও আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে অন্যান্য দেশের আন্দোলনের সাথে গুলিয়ে ফেললে আমার মনে ঠিক হবে না। আজকে পার্বত্য চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কোন লেশমাত্র পরিবেশ নেই। যেহেতু গণতান্ত্রিকআন্দোলনের কোন ভিত্তি নেই, তাহলে ছাত্র সমাজ বৃহত্তর ও অধিকার আন্দোলনকে কতটুকু অনুভব করতে পারে? এই বিষয়ে যুক্তি দিয়েপরিষ্কার করে যদি বিচার বিশ্লেষণ করতে না পারি তাহলে পাহাড়ের মানুষকে বুঝিয়ে জুম্ম জনগণের সমর্থন আদায় করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। মনে রাখবেন, এধরনের আন্দোলন শুধুমাত্র জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা থাকলেই হয় না। নিজেকে যদি প্রগতিশীল চিন্তাধারা আলোকে জাগিয়ে তুলতে না পারি তাহলে যেকোন সময় বিপথে চলে যেতে বাধ্য হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণকে বিলুপ্ত করার নানা ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। তার মধ্যে আজ পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীকে দিয়ে অগণতান্ত্রিক পন্থায় সফল হওয়ার ব্যর্থ অপপ্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। এই কাজে শাসকগোষ্ঠীর বড় বাধা হল জনসংহতি সমিতি। সেকারণেই মিথ্যা মামলা, ধরপাকড়, জেল জুলুম, অত্যাচার, অবিচার, জনসংহতি সমিতির সদস্যদের বাড়িঘরে তল্লাসী, অপারেশন উত্তরণের নামে এক ধরনের সেনাশাসন জারী রেখে জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বকে চিরতরে নির্মূল করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বারবার।
তাই এসব বিষয়গুলো ছাত্র-তরুণ সমাজকে গভীরভাবে উপলদ্ধি করতে হবে। পাহাড়ের বুকে আজ আমাদের সময়টা হয়তোবা যেনতেন করে কাটিয়ে দিতে পারবো, কিন্তু আমাদের নতুন প্রজন্ম ছেলেমেয়েরা অনাগত দিনে কিভাবে থাকবে। সেটা ছাত্র ও যুব সমাজকে মূল্যায়নে নিয়ে আসতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে নীতি আদর্শ ভিত্তিক রাজনীতি পরিচালনা করতে না পারলে আমরা জুম্ম জাতি ধ্বংস হওয়া শুধু সময়ের দাবি। আমি মনে করি, আমাদের আন্দোলন সংগ্রাম সফল হওয়া আর না হওয়া তরুণ ছাত্র সমাজের উপরই নির্ভর করবে। এই জুম্ম তরুণ ছাত্র সমাজ কতটুকু বৈপ্লবিক চেতনায় সুসজ্জিত সেটার উপরই নির্ভর করবে জাতির আগামী দিনগুলি কি হবে। সেজন্য আমাদের ছাত্র সমাজের মধ্যে সন্দেহ, অবিশ্বাস ও দোদুল্যমানতা থাকতে পারেনা। একারণে নিজেকে আরও অধিকতর আদর্শিক চেতনায় তৈরি করতে হবে। আমরা কখনো একা নই, মুক্তিকামী জুম্ম জনগণ রয়েছে, রয়েছে আমাদের পক্ষে পৃথিবীর মানবাধিকার শক্তি ও রাষ্ট্রগুলো। দেশের মধ্যেও আজকে প্রগতিশীল শক্তি আমাদের সাথে রয়েছে, তার মধ্যে প্রগতিশীল মেডিয়া থেকে শুরু করে দেশের সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী ও প্রগতিমনা মানুষেরা সবাই আমাদের আন্দোলনের পক্ষে রয়েছে।
মনে রাখতে হবে বস্তুর আভ্যন্তরীণ শক্তি সক্রিয় হলে বাহ্যিক শক্তি এগিয়ে আসতে দ্বিধাবোধ করেনা। আর বাহ্যিক শক্তি সক্রিয় থাকলেও আভ্যন্তরীণ শক্তি যদি দুর্বল হয় তাহলে আমাদের সংগ্রামকে এগিয়ে নেওয়া কখনো সম্ভব হবে না। আজ জুম্ম ছাত্র সমাজকে চিন্তার গভীরে গিয়ে উপলদ্ধি করতে হবে যে, আমাদের লড়াই জুম্ম জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। এই লড়াই একটা অসমশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই হলেও অসম্ভব কোন কিছু নয়। শাসকগোষ্ঠীর সাথে এই লড়াই সংগ্রাম প্রয়াত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল। শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পড়ে আমরা প্রয়াত নেতাকে হারিয়েছি, কিন্তু তারপরও জুম্ম জাতির সংগ্রাম থেমে থাকেনি। পার্বত্য চট্টগ্রামের ছাত্র সমাজের গৌরবময় সংগ্রামের ইতিহাস রয়েছে। সেই ইতিহাসের আলোকে ছাত্র সমাজকে আরও অধিকতর সংগ্রামী, সাহসী ও নির্ভীক হতে হবে। আমাদের সমাজে চারিদিকে প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তা বিরাজমান। আমাদের মধ্যে মধ্যবর্তী শ্রেণির চিন্তাধারা বিরাজমান যা একদিন সুবিধাবাদী হিসেবে আবির্ভাব ঘটে। সেই সকল প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তাধারা থেকে জুম্ম ছাত্র সমাজকে বেরিয়ে এসে জাতির কান্ডারী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিকূল পরিস্থিতিকে অনুকূলে নিয়ে আসার মহান কাজে নিজেকে যুক্ত করতে হবে।
আজ দিবালোকের মত পরিষ্কার শাসকগোষ্ঠী জুম্ম জনগণের প্রতি এতটাই নির্দয় ও নির্মম যে, বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীর সময়ে মানুষস বাই আতংকিত, তারপরও পার্বত্য চট্টগ্রামে চলছে ‘অপারেশন উত্তরণ’-এর বদৌলতে একদিকে সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে অবাধে অভিযান চালিয়ে অবৈধ গ্রেফতার, মারধর, জেলে প্রেরণ, ঘরবাড়ি তল্লাসী, হয়রানি করে যাচ্ছে, অন্যদিকে নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বাহিনী, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসনসহ দেশের রাষ্ট্রযন্ত্র পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে সোচ্চার জুম্মদেরকে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ ও দুষ্কৃতিকারী হিসেবে পরিচিহ্নিত করার একের পর এক ষড়যন্ত্র অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে সেনাবাহিনী সন্ত্রাসী খোঁজার নামে গ্রামে গ্রামে ব্যাপক তল্লাসী চালিয়ে যাচ্ছে এবং নিরীহ জুম্ম গ্রামবাসীদের হয়রানি, অস্ত্র গুঁজে দিয়ে গ্রেফতার, জেলে প্রেরণ, মারধর করে চলেছে। শাসকগোষ্ঠীর এহেন আচরণ থেকে সহজেই প্রমানিত হয় যে, আজ পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম জনগণের বেঁচে থাকার কোন বাস্তবতা নেই। সেজন্য পাহাড়ের বুকে ছাত্র সমাজকে ইস্পাত কঠিন আন্দোলনে সামিল হওয়া ছাড়া বিকল্প কোন রাস্তা নেই।