হিল ভয়েস, ২৯ মে ২০২০, রাঙ্গামাটি: রাঙ্গামাটি জেলাধীন বাঘাইছড়ি উপজেলার সার্বোয়াতলী ইউনিয়নের শিজকমুখ সার্বজনীন বৌদ্ধ বিহার পরিচালনা কমিটির সম্মতি ছাড়া বিহারের জায়গা বেদখল করে নতুন সেনাক্যাম্প স্থাপন করার পর থেকেই ক্যাম্পের সেনা সদস্যরা বিহারের নানা ধর্মীয় কর্মকান্ডে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির পাশাপাশি আশেপাশের জুম্ম এলাকায় নানা অজুহাতে বাড়িতে তল্লাশী, লোকজনকে হুমকি প্রদান ও হয়রানি করে আসছে।
সম্প্রতি এই ধর্মীয় পরিহানি ও হয়রানির পাশাপাশি সেনাক্যাম্পের সেনাবাহিনী কর্তৃক এলাকার জনগণের কাছ থেকে জোরপূর্বক বিনামূল্যে কাঠ, কলা কাঁদিসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। সেনাসদস্যরা যা নির্দেশ দিচ্ছে সেই অনুযায়ী দ্রব্যসামগ্রী ক্যাম্পে পৌঁছে দিতে বাধ্য হচ্ছে এলাকাবাসী।
বিভিন্ন জিনিসপত্র আদায়ের নিম্নোক্ত কিছু অভিযোগ তুলে ধরা হলো-
১. উগলছড়ির লাল্যাঘোনার গাছ ব্যবসায়ী মোঃ বাদশা মিয়া সওদাগর সেনাক্যাম্প নির্মাণের জন্য তার বাগান থেকে বিনামূল্যে ১৪টি খুটি দিতে বাধ্য হন;
২. শিজকমুখ গ্রামের কারুন্যা চাকমার পুত্র মেনন চাকমা দংগ বিন্যামূল্যে ১৫০ ঘনফুট কাঠ দিতে বাধ্য হন;
৩. চিন্তারামছড়ার বঙ্কিম চন্দ্র চাকমার পুত্র বিজয় লাল চাকমা ক্যাম্প নির্মাণের জন্য বিনামূল্যে ১৫০ ঘনফুট কাঠ দিতে বাধ্য হন;
৪. গলাচিপার বিনয় কুমার চাকমার পুত্র সুশীল চাকমা নামে একজন সাধারণ কলা ব্যবসায়ীকে প্রতি সপ্তাহে ৩/৪ কাঁদি (ছড়া) কলা দিতে বাধ্য করা হয়;
৫. চিন্তারামছড়ার রঞ্জন্যা চাকমার ছেলে এমেল শান্তি চাকমাকেও বিন্যামূল্যে সপ্তাহে ৩/৪ কাঁদি কলা দিতে বাধ্য করা হয়;
৬. গলাচিপার নিরুলাল চাকমার পুত্র অমর কান্তি চাকমাকে বিনামূল্যে ১০/১২টি কলার চারা পৌঁছে দিতে বাধ্য করা হয়;
৭. শিজক বাজারের আধু চাকমার পুত্র মানেক জ্যোতি চাকমা একজন প্রত্যাগত জেএসএস সদস্য, বর্তমানে স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন। তাকেও গত ২৪ মে ২০২০ বিনামূল্যে সূর্যমুখী কলার কাঁদি (ছড়া) দিতে বাধ্য করা হয়;
৮. শিজকমুখের ললিত মোহন চাকমার পুত্র ছন্দক চাকমাকে তার গাছ থেকে বিনামূল্যে ডাব দিতে বাধ্য করা হয়;
৯. শিজক বাজারের বিনয় কান্তি চাকমাকেও বিনামূল্যে কলার কাঁদি (ছড়া) দিতে বাধ্য করা হয়।
এছাড়াও সেনাক্যাম্পটি স্থাপনের পর থেকে সেনাবাহিনী বিহারের ধর্মীয় কমকান্ডে বাধা এবং বাড়িতে তল্লাশীসহ স্থানীয় জনগণকে নানাভাবে হয়রনি করে চলেছে বলে জনগণের অভিযোগ।
গত ২৫ মে ২০২০ রাত আনুমানিক ৮:০০ টায় উক্ত সিজকমুখ নতুন সেনাক্যাম্পের একদল সেনাসদস্য সিজকমুখ উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক তুষার কান্তি চাকমার বাড়ি ঘেরাও করে বাড়িতে তল্লাশী চালায়। এসময় সেনাসদস্যরা তুষার কান্তি চাকমা সন্ত্রাসীদের খাবার দিয়েছে বলে ভিত্তিহীন অভিযোগ করে এবং বিভিন্ন হুমকি প্রদান করে। ঐদিন তুষার কান্তি চাকমা তার জমির ধান বাড়িতে আনার জন্য প্রতিবেশি ৬/৭ জন লোকের সহযোগিতা নেন এবং তাদের জন্য খাবারের আয়োজন করেন।
গত ৫ মে ২০২০ রাত আনুমানিক ১০:০০ টার দিকে ওয়ারেন্ট অফিসার মো: সাহাদাত এর নেতৃত্বে ঐ সেনাক্যাম্পের একদল সেনাসদস্য পার্শ্ববর্তী শিজক গলাচিবা গ্রামের কীর্তি রঞ্জন চাকমা ওরফে ভুত্তো লাল (৪০), পিতা-মৃত পঞ্চবান চাকমার বাড়ি ঘেরাও করে। কীর্তি রঞ্জন চাকমাকে বাড়িতে না পেয়ে তার স্ত্রীকে হরয়ানিমূলকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং বিভিন্ন প্রকার হুমকি প্রদান করে। এরপর সেনাদলটি একই গ্রামের প্রীতি চাকমা (৩৮), পিতা-স্নেহ কুমার চাকমা এর বাড়িও ঘেরাও করে। বাড়িতে কেউনা থাকায় স্থানীয়দের নিকট সে বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে চলে যায়।
গত ২৬ এপ্রিল ২০২০ ওয়ারেন্ট অফিসার মো: সাহাদাত এর নেতৃত্বে একদল সেনাসদস্য দক্ষিণ সিজক গ্রামের বাসিন্দা জনসংহতি সমিতির সদস্য জুপিটার চাকমা ওরফে বাপ্পী (৩৫), পিতা-বিমলাক্স চাকমার বাড়ি ঘেরাও করে বাড়িতে তল্লাশীচালায়। বাড়ির লোকদের বিভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে হয়রানি এবং হুমকি প্রদান করে।
এছাড়া বিহারের ধর্মীয় গুরু অভয়তিষ্য মহাথেরো মারা গেলে বিহার কর্তৃপক্ষ ও এলাকার জনগণ গত ১০, ১১ ও ১২ ডিসেম্বর ২০১৯ ঐ স্থানে অন্তোষ্টিক্রিয়া করতে চাইলে সেনাসদস্যরা বাধা প্রদান করে। ফলে সেসময় বাধ্য হয়ে প্রয়াত ভান্তে অভয়তিষ্য মহাথেরোর অন্তোষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠান সম্পাদন করতে হয় সিজক নদীর তীরে।
উল্লেখ্য যে, গত ২৫ এপ্রিল ২০১৯ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর খাগড়াছড়ি সেনা রিজিয়নের অধীন দূর্ভেদ্য ২১ বীর মাইনী সেনাজোনের জনৈক মেজরের নেতৃত্বে একদল সেনাসদস্য উক্ত শিজকমুখ সার্বজনীন বৌদ্ধ বিহারে আসে। ঐদিনই বৌদ্ধ বিহারের মালিকানাধীন এলাকায় জোরপূর্বক এবং পার্বত্য চুক্তি লংঘন করে উক্ত নতুন সেনাক্যাম্প স্থাপন করা হয়। অপরদিকে বৌদ্ধ বিহারটি স্থাপন করা হয় ১৯৬১ সালে।