হিল ভয়েস, ৬ মে ২০২০, রাঙ্গামাটি: গত বছর এপ্রিল মাসে রাঙ্গামাটি জেলাধীন বাঘাইছড়ি উপজেলার সার্বোয়াতলী ইউনিয়নের শিজকমুখ সার্বজনীন বৌদ্ধ বিহারের জায়গা জবরদখল করেই নতুন সেনাক্যাম্প স্থাপন করা হয়। স্থাপনের পর থেকেই সেনা ক্যাম্পের সেনাসদস্যরা বিহারের নানা ধর্মীয় কর্মকান্ডে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির পাশাপাশি আশেপাশের জুম্ম এলাকায় নানা অজুহাতে ঘরবাড়িতে তল্লাশী, লোকজনকে হুমকি প্রদান ও হয়রানি করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
তারই ধারাবাহিকতায় গত ৫ মে ২০২০ রাত আনুমানিক ১০:০০ টার দিকে ওয়ারেন্ট অফিসার মো: সাহাদাতের নেতৃত্বে ঐ সেনা ক্যাম্পের একদল সেনাসদস্য পার্শ্ববর্তী শিজক গলাচিবা গ্রামের কীর্তি রঞ্জন চাকমা ওরফে ভুত্তো লাল (৪০), পীং মৃত পঞ্চবান চাকমার বাড়ি ঘেরাওকরে বলে স্থানীয়রা জানান। কীর্তি রঞ্জন চাকমাকে বাড়িতে না পেয়ে তার স্ত্রীকে হরয়ানিমূলকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং বিভিন্ন প্রকারহুমকি প্রদান করে।
এরপর সেনাদলটি একই গ্রামের প্রীতি চাকমা (৩৮), পীং স্নেহ কুমার চাকমা এর বাড়িও ঘেরাও করে। বাড়িতে কেউ না থাকায় স্থানীয়দের নিকট সে বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে চলে যায়। উল্লেখ্য, প্রীতি চাকমার পিতা বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে কর্মরত এক সদস্য।
স্থানীয়রা জানান যে, গত ২৬ এপ্রিল ২০২০ তারিখও ওয়ারেন্ট অফিসার মো: সাহাদাতের নেতৃত্বে একদল সেনাসদস্য একই ইউনিয়নের দক্ষিণ শিজক গ্রামের বাসিন্দা জুপিটার চাকমা ওরফে বাপ্পী (৩৫), পীং বিমলাক্স চাকমার বাড়ি ঘেরাও করে বাড়িতে তল্লাশী চালায়। বাড়ির লোকদের বিভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে হয়রানি করে এবং জুপিটার চাকমাকে তাদের কাছে হাজির না করলে অসুবিধা হবে হুমকি প্রদান করে। উল্লেখ্য, জুপিটার চাকমা ওরফে বাপ্পী জনসংহতি সমিতির একজন সদস্য।
স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি জানান যে, শিজকমুখ সার্বজনীন বৌদ্ধ বিহারটি স্থাপন করা হয় ১৯৬১ সালে। গত ২৫ এপ্রিল ২০১৯ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা সেনা রিজিয়নের অধীন দূর্ভেদ্য ২১ বীর মাইনী সেনা জোনের জনৈক মেজরের নেতৃত্বে একদল সেনাসদস্য উক্ত শিজকমুখ সার্বজনীন বৌদ্ধ বিহারে আসে। ঐদিনই বৌদ্ধ বিহারের মালিকানাধীন এলাকায় জোরপূর্বক এবং পার্বত্য চুক্তি লংঘন করে উক্ত নতুন সেনাক্যাম্প স্থাপন করা হয়।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায় যে, বিহারের যে স্থানে ক্যাম্পটি স্থাপন করা হয় সেখানে মূলত প্রয়াত ভান্তেদের অন্তোষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠান সম্পাদন করা হতো। শিজকমুখ সার্বজনীন বৌদ্ধ বিহারের বিহারাধ্যক্ষ ও পার্বত্য ভিক্ষু সংঘের সংঘরাজ (প্রধান) অভয়তিষ্য মহাথেরো মারা গেলে বিহার কর্তৃপক্ষ ও এলাকার জনগণ গত ১০-১২ ডিসেম্বর ২০১৯ ঐ স্থানে তিনদিন ব্যাপী অন্তোষ্টিক্রিয়া করতে চাইলে সেনাসদস্যরা বাধা প্রদান করে। ফলে সেসময় বাধ্য হয়ে প্রয়াত ভিক্ষু অভয়তিষ্য মহাথেরোর অন্তোষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠান সম্পাদন করতে হয় শিজক নদীর তীরে।শুরু থেকেই এভাবে ক্যাম্পের সেনাসদস্যরা ঐ বিহারের বিভিন্ন ধর্মীয় কর্মকান্ডে নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে আসছে।
আরো জানা যায় যে, ক্যাম্প স্থাপনের পর ভিক্ষু ও দায়ক-দায়িকারা বিহারে প্রার্থনা করতে গেলে সেনা সদস্যরা বাধা প্রদান করে। বন্দনা করতে বারণ করা হতো ভিক্ষুদের। সময় অসময়ে সেনা সদস্যরা জুতা পায়ে বিহার প্রবেশ করে থাকে। পুজা-পার্বনের সময় সেনাবাহিনী চারিদিকে টহল দিয়ে নজরদারি করে থাকে। পুরুষরা বিহারে গেলে তাদেরকে অহেতুক জিজ্ঞাসাবাদ ও হয়রানি করা হতো। বিশেষ করে দায়িকারা বিহারে যেতে সংকোচ বোধ করতো। তবে দায়ক-দায়িকাদের হয়রানি ও জিজ্ঞাসাবাদ কিছুটা কমে আসে, যখন ২৯৯ পার্বত্য রাঙ্গামাটি সংসদীয় আসনের সাংসদ দীপংকর তালুকদারের নিকট এসব বিষয় তুলে ধরা হয়।
তা সত্ত্বেও ক্যাম্পের সেনা সদস্যদের এলাকায় ঘরবাড়ি তল্লাসী, হয়রানি, গ্রেফতার, মারধর ইত্যাদি কখনোই বন্ধ হয়নি। ক্যাম্পটি স্থাপনেরপর থেকে সেনা সদস্যরা এলাকায় গ্রামবাসীদের ঘরবাড়ি নিয়মিত তল্লাসী চালিয়ে আসছে। ২০১৯ সালে এই ক্যাম্পের রিপোর্টের ভিত্তিতে বরযাত্রীবাহী ট্রলারকে দুরছড়ি সেনা ক্যাম্প কর্তৃক প্রায় পুরো দিন আটকে রাখা হয়। শুধু তাই নয়, ২০১৯ সালে সার্বোয়াতলী ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের মেম্বার ত্রিদীপ চাকমা, নিউ ফরেষ্ট বিজিবি ক্যাম্পের পোটার রাঙাধন চাকমা ও মহিষপষ্যা গ্রামের জগদীশ চাকমা নামে কমপক্ষে তিনজন গ্রামবাসীকে এই ক্যাম্পের সেনা সদস্যরা গ্রেফতার করে জেলে প্রেরণ করে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জনপ্রতিনিধি জানান, বৌদ্ধ বিহারের জায়গায় ক্যাম্পটি স্থাপনের বিষয়টি মাইনী জোনের জোন কম্যান্ডারের নিকট তুলে ধরা হয় এবং সেখান থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার আবেদন করা হয়। এটা উত্থাপনের পর উল্টো উক্ত ব্যক্তিকে হুমকি দেয়াহয় যে, সরকারের প্রয়োজনে শত শত লোকের কষ্ট হলেও সরকার যে কোন জায়গায় ক্যাম্প তুলতে পারবে। প্রয়োজনে উক্ত জনপ্রতিনিধির বাস্তুভিটায় ক্যাম্প তুলতে পারবে। চলমান নাজুক পরিস্থিতিতে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না বলে জোন কম্যান্ডার উক্ত জনপ্রতিনিধিকে হুমকি প্রদান করেন।
ফলে বৌদ্ধ বিহারের জায়গায় ক্যাম্প স্থাপনের বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসন, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিকপ রিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির নিকট তুলে ধরার জন্য এলাকাবাসী চিন্তাভাবনা করলেও সেনা নির্যাতনের ভয়ে কেউ সাহস করেনি। ক্ষমতাসীন দলের বর্তমান স্থানীয় সাংসদ, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, রাঙ্গামাটি জেলার ডেপুটি কমিশনাররা বিষয়টি দেখেও না দেখার ভান করে থাকেন বলে জনৈক এলাকাবাসী জানান।