হিল ভয়েস, ১১ মে ২০২০, রাঙ্গামাটি: গত ৯ মে ২০২০ রাঙ্গামাটি জেলার লংগদু উপজেলাধীন হাড়িকাবায় সেটেলার বাঙালি কর্তৃক রাঙ্গামাটিগামী জুম্ম কৃষক ও ব্যবসায়ীদের উপর সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা নিয়ে publicvoice24.com নামক একটি ভূইফোড় অনলাইন নিউজ পোর্টাল থেকে উস্কানিমূলক ও ভূয়া সংবাদ পরিবেশন করে সাম্প্রদায়িক উস্কানী দেওয়া হচ্ছে বলে আজ ১১ মে ২০২০ মিঠুল চাকমা বিশাল তার ফেসবুক স্টাটাসে অভিযোগ তুলে ধরেন।
মিঠুল চাকমা বিশাল তার ফেসবুক স্টাটাসে উল্লেখ করেন যে, উক্ত নিউজ পোর্টালে ঘটনার যথাযথ কারণ ও বিবরণ উল্লেখ না করে কেবলমাত্র একতরফাভাবে পাহাড়িদেরকে দোষারোপ করা হয়েছে, যা সম্পূর্ণ উদ্দেশ্য-প্রণোদিত। উক্ত নিউজ পোর্টালে বলা হয়েছে যে, “সীমান্ত নিয়ে দ্বন্দ্বের জের ধরেই ঘটনাটি ঘটেছে এবং পাহাড়িরা দেশীয় অস্ত্র ছকটা নিয়ে বাঙালিদের উপর আক্রমণ করেছে। এতে করে ১৫-২০ জন বাঙালি আহত হয়েছে” বলেও সাজানো সংবাদ পরিবেশন করা হয়।
এখানে আরো উল্লেখ করা হয়েছে যে, পাহাড়ি-বাঙালিদের মধ্যে সীমান্ত সমস্যা নাকি দীর্ঘদিনের এবং এই সমস্যাকে সমাধান করার জন্য সেনাবাহিনী ও পুলিশ বিষয়টি এই বলে মীমাংসা করে দেয় যে, “পাহাড়িরা বাঙালিদের এলাকায় যাবে না এবং বাঙালিরা পাহাড়িদের এলাকায় যাবে না। তাই গত ৯ মে পাহাড়িরা কলার ট্রলার নিয়ে বাঙালিদের সীমান্ত দিয়ে গেলে বাঙালিরা নাকি বাধা দেয় এবং এতে পাহাড়িরা ক্ষুব্ধ হয়ে বাঙালিদের উপর আক্রমণ করে।” পাহাড়িদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ সম্পূর্ণ ভূয়া, বানোয়াট এবং উস্কানীমূলক বলে মিঠুল চাকমা বিশাল উল্লেখ করেন।
উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশে মার্চের প্রথম দিকে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পরেই জাতীয়ভাবে সারাদেশে লকডাউনের কোন ঘোষণা না আসলেও দেশের বিভিন্ন জেলা এবং উপজেলা প্রশাসন, গ্রাম, পঞ্চায়েত প্রভৃতি প্রশাসন নিজ উদ্যেগে গ্রাম, উপজেলা, জেলা লকডাউনের সিদ্ধান্ত নেয় এবং সেই অনুযায়ী তারা কর্মপরিকল্পনাও স্থির করে। তারই ধারাবাহিকতায় পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন-গ্রামও লকডাউন করা হয়। ঠিক তেমনি লংগদুর বিভিন্ন গ্রামেও এই লকডাউন ব্যবস্থা চালুকরা হয় এবং বহিরাগত কাউকেই গ্রামে প্রবেশ করতে বাধা দেওয়া হয়। তাছাড়া গ্রামের কেউ বাইরের শহর থেকে এলে তাদেরকে হোম কোয়ারেন্টিনে রাখার ব্যবস্থা করা হয়।
কিন্তু লকডাউন চলাকালীন সময়েও লংগদুর হারিহাবা গ্রামের পার্শ্ববতী বাঙালিদের পাড়া থেকে সেটেলাররা প্রতিনিয়তলকডাউন ভেঙে গ্রামে প্রবেশ করতে থাকে। গরু চড়ানোর নাম করে পাহাড়িদের জমির ধান গরুকে খাইয়ে দিত, গরুর ঘাস কাটার নাম করে পাহাড়ি গ্রামে ঢুকে পাহাড়িদের জমির ধান কেটে নিয়ে আসত এবং তরি-তরকারি খোঁজার নাম করে পাহাড়ি এলাকার একেবারে অভ্যন্তরে প্রবেশ করে পাহাড়িদের ফসল নষ্ট করে দিত।
তারই অংশ হিসেবে ২৯ এপ্রিল দুপুর ২:০০ টার দিকে আবু বক্কর নামের এক বাঙালি সেটেলার ও তার বোনসহ বেশ কয়েকজন লোক পাহাড়িদের গ্রামে গরুর ঘাস কাটতে গেলে পাহাড়িরা তাদেরকে গ্রামে প্রবেশ করতে বাধা দেয় এবং বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাদেরকে ফেরত পাঠনোর চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু আবু বক্কর সেদিকে কান না দিয়ে উল্টো উত্তেজিত হতে থকে এবং এক পর্যায়ে তাদের মধ্য হাতাহাতি হয় এবং সেটেলাররা গ্রামে ঢুকতে না পেরে ফিরে যায়।
ঘটনার সুত্র ধরে একই দিন বিকেল ৪:০০ টার সময় ৫০০-৬০০ সেটেলার এসে লংগদু সদর ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের মনপুদি বাজারে এসে পুরো বাজারটিকে ঘিরে ফেলে এবং বাজারে থাকা ৭নং ওয়ার্ডের মেম্বার অজয় বিকাশ চাকমা (৫১)-কে ধরে নিয়ে গিয়ে মারধর করে। পরে বিষয়টি সেনাবাহিনীরা জানতে পারলে দোষীদেরকে ক্ষমা ভিক্ষা করতে বলা হয় এবং বিষয়টি সেখানেই মিটমাট করে দিয়ে ভবিষ্যতে এরকম কেন ঘটনা ঘটবে না বলে সেনাবাহিনী মেম্বারকে আশ্বাস দেয়। কিন্তু সেটেলাররা মনেপ্রাণে তা মেনে নেয়নি। ভেতরে ভেতরে সেটেলারদের মনে ক্ষোভের সঞ্চার হতে থাকে এবং তারা সুযোগ খুঁজতে থাকে পাহাড়িদেরহামলা করার জন্য।
মিঠুল চাকমা বিশাল আরো উল্লেখ করেন যে, লংগদুর হারিহাবা গ্রামে আসা-যাওয়া করতে হলে একটি খাল দিয়ে যেতে হয়,যেটি সেটেলারদের গ্রামের সীমান্ত বরাবর প্রবাহিত, বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে পানির স্তর শুকিয়ে গেলে উক্ত খাল ব্যতীত অন্য কোন পথ খোলা থাকে না। তাই সেই খাল দিয়ে পাহাড়িরা যাতায়াত করলেই সেটেলাররা তাদের বাধা দেয়ার চেষ্টা করে এবংঅনেক সময় ধাওয়া করে বলেও জানা যায়।
গত ০৮ মে ২০২০ কয়েকজন পাহাড়ি ট্রলারে কৃষি পণ্য বোঝাই করতে হারিহাবা গ্রামের সীমান্তে চলে যায়, সেখানে সেটেলাররা তাদের ধাওয়া করলে তারা কোনমতে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়। পরদিন কলা বোঝাই ট্রলার নিয়ে রাঙামাটি যাওয়ার সময় মনপুদি বাজারে পৌঁছলে বাঙালি সেটেলাররা পাহাড়িদের উপর অতর্কিতে হামলা চালায়। এসময় ট্রলারে থাকা তিনজন যাত্রীর মধ্যে একজন কোনমতে পালিয়ে যায় এবং বাকি দুইজনকে মারধর করা হয় ও সেই সাথে তাদের কাছ থেকে নগদ ২ লক্ষ ৬৫ হাজার টাকা ও মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়া হয় বলে জানা যায়। পরে ঘটনাটি জানাজানি হয়ে গেলে সেনাবাহিনী এবং পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
কিন্তু উল্লেখিত অনলাইন নিউজ পোর্টালে ১৫-২০ জন সেটেলার বাঙালি আহত হয়েছে বলে যে সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে তাসম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, যা পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা বৈ কিছু নয়।
মিঠুল চাকমা বিশাল আরো উল্লেখ করেন যে, আমরা সকলেই জানি পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা একটি রাজনৈতিক সমস্যা।বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে এই সমস্যাকে আরো জটিল এবং আরো স্পর্শকাতর করে তোলা হয়েছে। তাই এই ধরনের ভূয়া অনলাইন নিউজ পের্টালের মাধ্যমে বিকৃত, সাজানো ও অসম্পূর্ণ সংবাদ প্রচার না করে, পার্বত্য চট্টগ্রামে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা উস্কে না দিয়ে, জনমনে বিভ্রান্তি না ঘটিয়ে সঠিক তথ্য দিয়ে সংবাদ পরিবেশন করার জন্য মিঠুল চাকমা বিশাল তার ফেসবুক স্টাটাসে আহ্বান জানান।