হিল ভয়েস, ২ মে ২০২০, বান্দরবান: বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি উপজেলার সদর ইউনিয়নের কয়েকটি তঞ্চঙ্গ্যা গ্রামে পর পর তিনদিন ধরে সেনাবাহিনী ব্যাপক তল্লাসী অভিযান চালিয়েছে। তিনদিনে তঞ্চঙ্গ্যা গ্রামবাসীদের ঘুম থেকে জাগিয়ে কমপক্ষে ২৩টি বাড়ি তল্লাসী করেছে। তল্লাসীকালে সেনা সদস্যরা বাড়ির লোকজনকে নানাভাবে হয়রানি ও অহেতুক জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। এছাড়া মধ্যরাতে নিরীহ ছয়জন গ্রামবাসীকে জড়ো নানাভাবে হয়রানি করে। এতে এলাকায় ব্যাপক আতঙ্ক ও ক্ষোভ দেয়া দিয়েছে।
স্থানীয় সূত্র থেকে জানা যায় যে, আজ ০২ মে ২০২০ গভীর রাত আনুমানিক ১.০০ ঘটিকা হতে ৩.০০ ঘটিকা পর্যন্ত রোয়াংছড়ি সেনা ক্যাম্প থেকে একদল সেনা উপজেলার আলেক্ষ্যং ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের নাতিংঝিড়ি পাড়ার ১০ জন ব্যক্তির বাড়িতে তল্লাশী চালায়।
নাতিংঝিড়ি পাড়ার যে ১০ জন গ্রামবাসীর বাড়ি তল্লাসী করা হয়েছে তারা হলেন- সানু তঞ্চঙ্গ্যা (৪৮), পীং মৃত জীতেন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা; লিক্ক্যা তঞ্চঙ্গ্যা (৫০), পীং মৃত ললিত চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা; কোলি তঞ্চঙ্গ্যা (২৭), পীং মহিন কুমার তঞ্চঙ্গ্যা; মোহন লাল তঞ্চঙ্গ্যা (৬৫); ওয়াসিন তঞ্চঙ্গ্যা (২৭), পীং মোহন লাল তঞ্চঙ্গ্যা; অরবিন্দু তঞ্চঙ্গ্যা (৭৫); খোকন তঞ্চঙ্গ্যা (৩৫); পারিক্যা তঞ্চঙ্গ্যা (৫০); শাসন মনি তঞ্চঙ্গ্যা (কারবারি) (৭০); ও দিলি কুমার তঞ্চঙ্গ্যা (৫০)।
গতকাল ০১ মে ২০২০ শুক্রবার আনুমানিক রাত ১০.৩০ ঘটিকা হতে ১২:০০ ঘটিকার সময় রোয়াংছড়ি সদর ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের তাইম্রংছড়া পাড়ায় রোয়াংছড়ি সেনা ক্যাম্প থেকে একদল সেনাবাহিনী সদস্য উক্ত পাড়ায় টহল দেয়। এসময় গ্রামের ৬ জন গ্রামবাসীকে ধরে নিয়ে উক্ত পাড়ার সুন্দলাল তঞ্চঙ্গ্যা (মাঝি) বাড়ির উঠানে জড়ো করে অহেতুক জিজ্ঞাসাবাদ ও হয়রানি করে।
তাইম্রংছড়া পাড়ার যাদেরকে জড়ো করে হয়রানি ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে তারা হলেন- রাত্রি কুমার তঞ্চঙ্গ্যা (কারবারি) (৫২), পীং মৃত চিগন চোগা তঞ্চঙ্গ্যা; লক্ষী কুমার তঞ্চঙ্গ্যা (৪৮), পীং মৃত চিগন চোগা তঞ্চঙ্গ্যা; রাঙ্গো লাল তঞ্চঙ্গ্যা (৪৮), পীং ললি মোহন তঞ্চঙ্গ্যা; কালো সেন তঞ্চঙ্গ্যা (৪০), পীং কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা; মিলন তঞ্চঙ্গ্যা (৫০), পীং মৃত খুলাধন তঞ্চঙ্গ্যা; ও সুন্দ লাল তঞ্চঙ্গ্যা (মাঝি) (৫৫), পীং মৃত খুলাধন তঞ্চঙ্গ্যা।
এসময় গ্রামের অন্তত অর্ধ-ডজন ঘরবাড়ি তল্লাশি করে সেনা সদস্যরা। তল্লাসীকালে সেনা সদস্যরা সন্ত্রাসীরা কোথায়, কে সন্ত্রাসীদের লালন পালন করে, গ্রামের মধ্যে সন্ত্রাসী কারা কারা ইত্যাদি জিজ্ঞাসা করে। সন্ত্রাসীরা আসলে ক্যাম্পে খবর দিতে হবে বলে নির্দেশ সেনা সদস্যরা চলে যায়।
এর আগে ৩০ এপ্রিল ২০২০ শুক্রবার ভোর আনুমানিক ২.৩০ ঘটিকা হতে ৪.০০ ঘটিকা পর্যন্ত রোয়াংছড়ি সেনা ক্যাম্প থেকে রোয়াংছড়ি উপজেলার আলেক্ষ্যং ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের ওয়াগই পাড়ায় তল্লাসী চালায়। এসময় সেনা সদস্যরা ৭ জন গ্রামবাসীর বাড়িতে তল্লাসী করে।
ওয়াগই পাড়ার যে ৭ জন গ্রামবাসীর বাড়ি তল্লাসী করা হয়েছে তারা হলেন- বিশ্বনাথ তঞ্চঙ্গ্যা (৪৮), পীং মোহন লাল তঞ্চঙ্গ্যা, চেয়ারম্যান, আলেক্ষং ইউনিয়ন; বিমল তঞ্চঙ্গ্যা (কারবারি) (৮০), পীং মৃত ভালাধন কারবারি; স্বপ্ন সেন তঞ্চঙ্গ্যা (৩৮), পীং শুক্লসেন তঞ্চঙ্গ্যা; রবীন্দ্র সেন তঞ্চঙ্গ্যা (৪১), পীং শুক্লসেন তঞ্চঙ্গ্যা; দেবাশীষ তঞ্চঙ্গ্যা (শিক্ষক) (৪০), পীং মৃত পালং তঞ্চঙ্গ্যা; জ্ঞান রঞ্জন তঞ্চঙ্গ্যা (সাবেক প্রধান শিক্ষক) (৭০), পীং মৃত নলনি মোহন তঞ্চঙ্গ্যা; ও রিগ্যান বড়–য়া (৩৫)।
অন্যদিকে আজ ২ মে ২০২০ রাঙ্গামাটি জেলার বিলাইছড়ি উপজেলাধীন ৬ ইষ্ট বেঙ্গলের গাছকাটছড়া সেনাক্যাম্প হতে প্রায় শ খানেক সেনা সদস্য বিলাইছড়ি উপজেলার কেংড়াছড়ি ইউনিয়নের মেরাংছড়া মারমা পাড়ায় টহল দেয়। এ সময় নতুন ক্যাম্প স্থাপনের একটি জায়গা পরিদর্শন করে বলে স্থানীয়রা জানান। উক্ত জায়গার মালিক হচ্ছেন মাঅং কার্বারী, মিসাউং মারমা, সিংলাপ্রু মারমা ও রুনাইপ্রু মারমা পীং চাইল্যঅং মারমা। তাদের নামে উক্ত জায়গাটি বন্দোবস্ত রয়েছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা যায়।
আজ ২ মে বরকল উপজেলার চাইচাল পাড়া বিজিবি ক্যাম্পে একদল সদস্য বরকল উপজেলার গুইছড়ি (মগ পাড়া) গ্রামের প্রধান কমল কান্তি কার্বারীর (চাগা হুলু) বাড়ি ঘেরাও করে। তবে কাউকে হয়রানি করা হয়েছে বলে জানা যায়নি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পর ২০০১ সালে তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকার ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামক একপ্রকার সেনা শাসন জারি করে। পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহারের পরিবর্তে নতুন নতুন ক্যাম্প স্থাপন করে চলেছে।
উক্ত ‘অপারেশন উত্তরণ’-এর বদৌলতে একদিকে সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে অবাধে অভিযান চালিয়ে অবৈধ গ্রেফতার, মারধর, জেলে প্রেরণ, ঘরবাড়ি তল্লাসী, হয়রানি করে যাচ্ছে, অপরদিকে সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, উন্নয়ন, বিচারব্যবস্থা ইত্যাদি অবৈধভাবে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে।
অন্যদিকে নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বাহিনী, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসনসহ দেশের রাষ্ট্রযন্ত্র পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে সোচ্চার জুম্মদেরকে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ ও দুষ্কৃতিকারী হিসেবে পরিচিহ্নিত করার একের পর এক ষড়যন্ত্র অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে এভাবে সেনাবাহিনী সন্ত্রাসী খোঁজার নামে গ্রামে গ্রামে ব্যাপক তল্লাসী চালিয়ে যাচ্ছে এবং নিরীহ জুম্ম গ্রামবাসীদের হয়রানি, অস্ত্র গুঁজে দিয়ে গ্রেফতার, জেলে প্রেরণ, মারধর করে চলছে।