সোহেল তনচংগ্যা
আমি একজন ছাত্র। আমার পরিচয় তনচংগ্যা ভাষা দ্বারা নির্ধারিত হয়। ছোট বেলায় যখন আমি আমার নিজ গ্রামে আমার বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা করতাম, তখন একদল আর্মি সপ্তাহ বা মাসে (প্রায় সময়ই) আমাদের গ্রামে আসতো এবং আমাদের চকলেট বা অন্য কিছু একটি জিনিস দিয়ে শান্তিবাহিনী কোথায় আছে জিজ্ঞাসা করতো। তখনকার সময়ে আমি কিছুই বুঝতাম না। যখন গ্রাম ছেড়ে রাংগামাটি শহরে পড়াশুনা করতে আসি তখন আমার মা-বাবা, আত্মীয় স্বজন আমাকে প্রায়ই পরামর্শ দিতো আমি যেন রাজনীতির সাথে যুক্ত না হই, রাজনৈতিক বন্ধুদের সাথে যাতে মেলামেশা না করি।
আসলে বর্তমানে যারা ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত রয়েছে তাদের সংস্পর্শে আসা আদৌ কি উচিত না? কিন্তু আমি আমার মা-বাবার অমত সত্ত্বেও যারা ছাত্র রাজনীতি (পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ) করে তাদের সংস্পর্শে আসার চেষ্টা করেছি। যখন রাংগামাটি থেকে নিজের বাড়িতে যাই তখন আমার ২-৩ টি আর্মি এবং বিজিবি ক্যাম্প পাড়ি দিয়ে যেতে হয়। তখনও আমি উপলব্ধি করতে পারিনি কেন আসলে পার্বত্য এলাকায় এত ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিল। তারপর একদিন আমি রাংগামাটি ছেড়ে চট্টগ্রামে এক জেঠাতো ভাইয়ের বাসায় বেড়াতে যাই। কিন্তু সেখানে থেকে লক্ষ্ এবং উপলব্ধি করেছি পার্বত্য চট্টগ্রামে শাসন ব্যবস্থা আর সমতল অঞ্চলের শাসন ব্যবস্থা কি মাত্রায় তফাৎ।
আমার মধ্যে প্রশ্ন জাগে, কেন শাসনব্যবস্থার এত তারতম্যতা। সমতলে যারা বসবাস করছে তারা যেমন মানুষ আর আমরা যারা পার্বত্য অঞ্চলে বসবাস করছি আমরাও একই রক্ত মাংসে গড়া মানুষ। তাহলে কেন এত বৈষম্য, কেন এত গরমিল। জানি না বর্তমান জু্ম্ম ছাত্র সমাজ আজও এই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে কিনা। তবে আমি মনে করি বর্তমান ছাত্র সমাজকে এই সব প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া উচিত।
পরিতাপের বিষয় হলো, কেন আমাদের এহেন হীন দৃষ্টিতে দেখা হয়। আমার নিজস্ব পরিচয়, সংস্কৃতি ও ভাষা রয়েছে। একটি জাতি টিকে থাকার জন্য অন্যতম মূল উপজীব্য উপাদান হচ্ছে তার ভাষা। কিন্তু আজকে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের দ্বারা আমার মাতৃভাষাকে কেড়ে নেয়ার এবং বিকৃত করে দেবার চেষ্টা চলছে। আমার পরিচয়কে হরন করে দেয়ার চেষ্টা চলছে। দেখেন, বর্তমান ভারত এবং পাকিস্তান সেই ১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভাগ হয়েছিল। তখন পাকিস্তান নামক একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। কিন্তু কিছুদূর যেতে না যেতে সে রাষ্ট্রটি আবারও দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একটি পূর্ব পাকিস্তান যেটি বর্তমান বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্র এবং দ্বিতীয়টি হলো পশ্চিম পাকিস্তান যেটি বর্তমান পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র- এই দুই রাষ্ট্র জন্ম লাভ করেছে।
পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তান দুই অঞ্চলে মুসলমানের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। তারপরও তাদের দু’য়ের মধ্যে কিসের কারণে এত দ্বন্দ্ব লেগেছিল? তার উত্তর হলো পূর্ব পাকিস্তানের বেশির ভাগ মানুষ কথা বলতো বাংলায় আর পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষ কথা বলতো উর্দুতে। যে মুহূর্তে পাকিস্তান সরকার উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করার ঘোষণা করলো তা পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষী জনগণ মানতে বাধ্য ছিল না। সেজন্য তারা ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন করেছিল। আন্দোলনকারীদেরর উপর পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালিয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা থেমে থাকেনি। নিপীড়ন, নির্যাতন এবং ত্যাগের মধ্যে তারা আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল এবং ১৯৭২ সালে ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল।
বর্তমান সময়ে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পেয়েছে যেখানে অনেক নিপীড়ন, নির্যাতন এবং ত্যাগ নিহিত রয়েছে।আর সেদেশেরই মানুষ অর্থাৎ বাঙালি জাতির শাসকরা আজ বাংলাদেশে আরও ৫৪ টির অধিক জাতির মাতৃভাষাকে অস্বীকার করছে। নিজ মাতৃভাষার জন্য বাঙালিরা জীবন দিয়েছিল সেই বাংলাদেশের বাঙালি শাসকরা আজকে আরেকটি জাতির মাতৃভাষাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইছে। যারা প্রত্যেকে নিজ ভাষা দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করে সে ভাষাকে রাজনৈতিকভাবে কেন বিলুপ্ত করে দিতে চায় বিজাতীয় শাসকগোষ্ঠী?
আজকে যারা জুম্ম ছাত্র-যুব সমাজ তাদের এই সব প্রশ্নে উপনীত হওয়া উচিত। আমার থেকে বয়োজ্যেষ্ঠ যারা, তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে ভাবছে কিনা? ভাবলে কীভাবে ভাবছে? আমার থেকে কম বয়সী বা সমবয়সী যারা, তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে যে কঠিন বাস্তবতা এবং জটিল অবস্থা বিরাজমান তা নিয়ে চিন্তা করছে কিনা? তারা আসলে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে উপলব্ধি করছে কিনা?
পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে রাজনৈতিকভাবে সমাধানের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ১৯৯৭ সালে ২ ডিসেম্বরে সম্পাদিত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম অধিবাসীদের পক্ষে জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা, সভাপতি, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ, আহ্বায়ক, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটি- এই দুই প্রতিনিধির মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল। যেটি জুম্ম জনগণের জন্য একটি মুক্তির সনদ হিসেবে বিবেচিত। যেখানে জুম্ম জনগণের সুখ-দুঃখের কথা উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু আজ দীর্ঘ ২৩ বছর অতিবাহিত হয়ে যাচ্ছে কিন্তু জুম্ম জনগণসহ পার্বত্য চট্টগ্রাম স্থায়ী অধিবাসীর যে অধিকার পাবার কথা সে অধিকার সম্পূর্ণ উপেক্ষিত রয়েই গেছে। বরং তাদেরকে নানাভাবে নিপীড়ন-নির্যাতন, দমন-পীড়ন, নারীদের ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যা, ভূমি কেড়ে নেয়া ও উচ্ছেদ করা হচ্ছে। আগেকার প্রত্যাহারকৃত অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প আবারও পুনর্স্থাপন করা হচ্ছে। সেনাবাহিনী দ্বারা প্রতিনিয়ত হয়রানিমূলক আচরণ করার ঘটনা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আমার বয়স ১৮ বছর চলছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বয়স ২৩ বছর অতিবাহিত হতে চলেছে। আমার চেয়ে বয়সে বেশি বড় এই চুক্তি। অথচ আমার এ সময়ে চুক্তির সুবিধা ভোগ করার কথা, অধিকার পাবার কথা। কিন্তু চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো যেমন-ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, আইন শৃঙ্খলা, সাধারণ প্রসাশন, পুলিশ, বন ও পরিবেশ ইত্যাদি বিষয়সহ রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা এখনো তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদে হস্তান্তর করা হয়নি। ফলে আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্বলিত পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনব্যবস্থা আজও বাস্তবায়িত হয়নি।
অপরদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম মূল রাজনৈতিক সমস্যাকে ঢাকতে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান জমানায় যেভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার অর্থনৈতিক ও সামরিক উপায়ে সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছিল, সেভাবে বর্তমান সরকারও পার্বত্য সমস্যাকে সমাধানের উঠে পড়ে লেগেছে। জেনারেল জিয়া পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে অর্থনৈতিক সমস্যা হিসেবে ঘোষণা করে ১৯৭৬ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড গঠন করে এবং চট্টগ্রাম সেনানিবাসের ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসিকে পদাধিকার বলে উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান করে জেলারেলদের দ্বারা উন্নয়ন বোর্ড পরিচালিত হতে থাকে। জুম্মদের জাতীয় অস্তিত্ব ধ্বংস করে দেবার পেছনে সমস্ত রাষ্ট্রশক্তি নিয়োজিত ছিল। কিন্তু তাতে পার্বত্য সমস্যার সমাধান হয়নি। কারণ সমস্যাটি ছিল রাজনৈতিক।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও এখনও চুক্তি মোতাবেক জুম্মদের অধিকার প্রদান পূর্বক তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেনি সরকার। অথচ যেখানে আমার এই পাহাড়ি জন্মভূমিতে সুন্দর এবং নিরাপদে বিচরণ করার কথা সেখানে আমাকে আজ প্রতিবাদের মিছিলে যেতে হচ্ছে, পড়ার টেবিল ফেলে তপ্ত রোদে স্লোগানের কন্ঠে বলতে হচ্ছে ‘অবিলম্বে ভূমি অধিকার ফিরিয়ে দাও, দিতে হবে’, ‘ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন কর, করতে হবে’। কারণ আমি এই জন্মভূমিতে নিরাপদ নই। আজ একজন সাধারণ ছাত্র হয়ে আমার যে ন্যায্য অধিকার পাবার কথা সেই অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, বঞ্চিত করা হচ্ছে রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্র থেকে। তাহলে আমি কিভাবে একজন অধিকারহারা ছাত্র হয়ে মনে করবো এখানে যারা পাহাড়ী সহজ সরল জু্ম চাষ করে স্বকীয় সংস্কৃতি ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে জীবন নির্বাহ করে তাদের নিজেদের অধিকার আছে।
দেখতে দেখতে চুক্তির বয়স দীর্ঘ ২৩ বছর হয়ে গেলো। এই যে দীর্ঘ সময় কোনরকম জুম্ম জনগণের ভাগ্য পরিবর্তন হয়নি। আমার যে অধিকার তা নিয়ে বেঁচে থাকার কথা। কিন্তু বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, সরকার চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়িত নাকরার ফলে এখানে নানা অপশক্তি যেমন- জুম্ম দালাল, জুম্ম স্বার্থপরিপন্থী কায়েমী গোষ্ঠী, জুম্ম রাজনৈতিক দালাল, প্রতিক্রিয়াশীল ও চুক্তি বিরোধী শক্তি এবং মৌলবাদী জঙ্গী গোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করার জন্য তারা একের পর এক ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। উলঙ্গভাবে পার্বত্য চুক্তিকে লঙ্ঘন করছে। যার ফলশ্রুতিতে জুম্ম জনগণের উপর চরম বির্পযয় নেমে আসছে।
সম্প্রতি চীনের উহানে করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব হওয়ার পর ভাইরাসটি গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্ব আজ নির্বাক, নিস্তব্ধ এবং মর্মাহত। তার মধ্যে বাংলাদেশও বাদ যায়নি। ভাইরাসটির সংক্রমণ ঠেকাতে গোটা বিশ্ব আজ লকডাউনে পরিণত হয়েছে।ঠিক সে সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে লকডাউনের সুযোগে পার্বত্যাঞ্চলের প্রতিটি প্রান্তে চলছে সেনা অভিযান, তল্লাসী, গ্রেফতার। লক্ষ করার মতো, সেনারা লকডাইন ভেঙে গ্রামে প্রবেশ করছে। চলছে সেনা ক্যাম্প পুনর্স্থাপনের তোড়জোর। এতে করে নতুন করে সংঘাত এবং সহিংসতার আশঙ্কা করছে সাধারণ মানুষ।
যদি পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন হতো তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনো চার শতাধিত অস্থায়ী ক্যাম্প থাকতো না। থাকতো না ‘অপারেশন উত্তরণ’-এর মতো একপ্রকার সেনাশাসন ও সেনা কর্তৃত্ব। পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রামে যে ৬টি সেনানিবাসে থাকতো, যেসকল সেনাবাহিনী দেশের দুর্যোগের সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের অধীনেই সিভিল প্রশাসনকে সহায়তা করতো। বলা যায়, তখন গড়ে উঠতো একটা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। থাকতো না সেনা নিপীড়ন ও বঞ্চনা।
দেশের শাসকগোষ্ঠীকে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত। প্রয়াত মহান নেতা মানবেন্দ্র নারয়ণ লারমা বলেছিলেন, “যে জাতি নিজ অধিকারের জন্য লড়াই করতে জানে না সে জাতির বাঁচার কোন অধিকার নেই”। ১৯৭১ সালে বাঙালি জাতিকে যেমন তাদের ভাষা এবং স্বাধীনতার জন্য কোন শক্তি দাবিয়ে রাখতে পারেনি, তেমনি আমাদের ভাষা এবং জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম এবং লড়াইকেও কোন অপশক্তি দমিয়ে রাখতে পারবে না।
পার্বত্য চট্টগ্রামে নানা প্রান্তে থাকা যে জু্ম্ম শিক্ষার্থী রয়েছে তাদের এই বিষয়ে একটু ভাবা উচিত, কেন আমরা নিপীড়নের শিকার হচ্ছি? কেন পার্বত্য চট্টগ্রামে এত নৃশংস ধর্ষণ এবং ধর্ষণের হত্যাকান্ড ঘটছে? কেন সেটেলার বাঙালিরা আমাদের উপর সহিংসতা-হত্যাকান্ড চালায়? কেন সাম্প্রদায়িক হামলা হচ্ছে? কেন আমাদের ভূমি কেড়ে নেয়? কেন আমাদের বাড়িঘর আগুনে পুড়িয়ে দেয়? এসবের প্রতিবাদের ভাষা এবং মুক্তির পথ দেখিয়ে দিয়ে গেছেন প্রয়াত মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। যিনি জুম্ম জাতির জাতীয় জাগরণের অগ্রদূত, নিপীড়িত-নির্যাতিত-শোষিত-অধিকারকামী মানুষের পরম বন্ধু।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চলকে বিজাতীয় শাসকগোষ্ঠী ইসলামী অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য নানাভাবে ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। গোটা অঞ্চলকে বাঙালিকরণ বা বাঙালিয়ান করার ষড়যন্ত্র করছে। জুম্ম সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দেবার চেষ্টা চলছে। জুম্ম জাতি আজ অস্তিত্বের সংকটের মুখে রয়েছে। তাই আমাদেরকে সেই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ভূমি অধিকার আদায়ের জন্যই লড়াই করতে হবে।
শাসকগোষ্ঠী যেহেতু গণতান্ত্রিক নয় ও ফ্যাসীবাদী কায়দায় দমন-পীড়ন চালাচ্ছে, তাই আমাদেরকেও বলপ্রয়োগের ধারায় অগণতান্ত্রিক পথকেই বেছে নেয়া উচিত। সেক্ষেত্রে আমাদেরকে অধিকতর বৃহত্তর আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। বর্তমান সময়ে যারা ছাত্র-যুব সমাজ রয়েছে পার্বত্য চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করতে জ্বলে উঠতে হবে। দোদুল্যমানতায় না থেকে আসুন অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সামিল হতে মরণপণ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই।
পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা একটি রাজনৈতিক ও জাতীয় সমস্যা। এই রাজনৈতিক সমস্যাকে অর্থনৈতিক উপায়ে ও সামরিক কায়দায় সমাধানের পূর্বের শাসকগোষ্ঠীরা যেভাবে ব্যর্থ হয়েছে, তেমনি পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামক সেনাশাসন জারি রেখে ও তথাকথিত ‘উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে দিয়ে’ বর্তমান সরকারের পার্বত্য সমস্যা সমাধানের ষড়যন্ত্রও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য। তাই সরকারের উচিত হবে, অনতিবিলম্বে পার্বত্য চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের করে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমধান করা।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে পার্বত্য সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণের জন্য ১৯৯৮ সালে ইউনেস্কো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জাতিসংঘের ইউনেস্কো ‘হুপে-বোয়ানি’ শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করে। ২০০৯ সালে ভারত সরকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পার্বত্য শান্তিচুক্তি সম্পাদন করে শান্তি স্থাপনে অবদার রাখার জন্য ইন্দিরা গান্ধী শান্তি পুরস্কার প্রদান করে। কেবল শান্তি পুরষ্কার দিয়েই ইউনেস্কো বা ভারত সরকার দায়িত্ব শেষ করতে পারে না। যে চুক্তির জন্য তারা শেখ হাসিনাকে এত বড় আন্তর্জাতিক পুরষ্কারে ভূষিত করেছে সেই চুক্তি যদি বাস্তবায়িত না হয় এবং শান্তি নিশ্চিত না হয়, তাহলে এত বড় সম্মাননায় ভূষিত করা অর্থহীন ও লোকদেখানো হয়ে দাঁড়াবে। তাই তাদের প্রদত্ত পুরষ্কারের সার্থকতার জন্য পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য তাদেরকে জোরালো ভূমিকা নিতে হবে। তাই ইউনেস্কো, ভারত সরকারসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকারের উপর সর্বাত্মক জোরালো রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা অপরিহার্য।
সোহেল তনচংগ্যা: soheltanchangya2222@gmail.com