সুমিত বণিক
বান্দরবান পার্বত্য জেলার সদর উপজেলার একটি প্রত্যন্ত গ্রামের নাম আমতলি তঞ্চঙ্গ্যাপাড়া। আধুনিক নাগরিক সুযোগ সুবিধা বলতে গেলে কিছুই নেই। নির্মল প্রকৃতির মাঝেই বেঁচে থাকার স্বপ্ন খুঁজে বেড়ায় এখানকার মানুষগুলো। প্রকৃতি যেমন আপন মমতায় বান্দরবানসহ তিন পার্বত্য জেলায় নৈসর্গিক অনেক সৌন্দর্যের অনুষঙ্গ বিলিয়ে দিয়েছেন, তেমনি ঐ মানুষগুলোর জীবনও অনেকাংশেই প্রকৃতি নির্ভর।
সেই পাড়ারই সুরেন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যার মেয়ে ঝর্ণা তঞ্চঙ্গ্যা (ছদ্ম নাম)। স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে ৭ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী, বয়স ১২। দিনটি ছিল রবিবার, সেদিন তার গণিত পরীক্ষা ছিল। পরীক্ষার হলে হঠাৎ করেই তার পেটে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করে। ঘটনার আকস্মিকতায় দ্রুত পরীক্ষা শেষ করে বাড়ি ফিরে আসে ঝর্ণা। ফেরার পর স্কুলের পোশাক পরিবর্তন করার সময় খেয়াল করলো পা গড়িয়ে রক্ত পড়ছে। পাশাপাশি পরিহিত কাপড়েও রক্তের দাগ লেগে আছে। কোন রকম মানসিক পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই এটাই ঝর্ণার জীবনে ঘটে যাওয়া মাসিকের সাথে প্রথম পরিচয়। যার জন্য ছিল না কোন বাহ্যিক প্রস্তুতি। প্রস্তুতি বলতে তার বড় বোনদের কাছ থেকে শোনা, বয়ঃসন্ধিকালে এধরণের শারিরীক পরিবর্তন ঘটতে পারে।
পাশাপাশি, এরকম হলে কিভাবে কাপড় ব্যবহার ও পরিবর্তন করতে হয়, সেটাও কিছুটা জানার সুযোগ হয়েছিল, সেটাও প্রতিবেশি বড় বোনদের সুবাদেই। কিন্তু এ বিষয়টির সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার জন্য পরিবারের কেউ তাকে কোন প্রয়োজনীয় তথ্য দেয়নি, বলেনি কোন পূর্ব প্রস্তুতির কথাও। যখন সে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে উঠলো, তখন সে পড়ালেখার জন্য তার জেঠিমার বাড়িতে চলে যায়। বছর না পেরুতেই হঠাৎ তার মা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। ঝর্ণার জীবনে নেমে আসে এক দূর্বিষহ অন্ধকার। মায়ের অনুপস্থিতি ঝর্ণার জীবনে একবিশাল ছন্দপতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পরবর্তী মাসিকের সময়গুলোতে মায়ের অনুপস্থিতিতে ঝর্ণা কিছুটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। প্রথমে ইতস্ততবোধ করলেও নিরুপায় ঝর্ণা পাড়ার প্রতিবেশি কাছের বড় বোনদের সাথে তার সমস্যাটি বিনিময় করে। তারা ঝর্ণাকে তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু পরামর্শ দেয়। তবে মাসিক কেন হয়, বা না হলে কি হয়, এসব কিছুই জানা ছিল না ঝর্ণার।
তবে একটা জিনিস ঝর্ণা নিশ্চিতভাবে জেনেছিল যে, মেয়ে হলে একটা সময়ে পর সবারই প্রাকৃতিক নিয়মে মাসিক শুরু হয় এবং সেটা খুবই স্বাভাবিক। এ ঘটনায় প্রথমবার কোন চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়ার প্রয়োজন মনে করেনি, বা তার পরিবারের কেউ এই বিষয়ে গভীরভাবে ভাবেনি। ঝর্ণা নিজের মতো করেই মাসিক ব্যবস্থাপনার কাজটি চালিয়ে যাচ্ছিলো। মাসিকের প্রথম দিকে সে বাড়িতে থাকা পুরোনো কাপড় ব্যবহার করতো। তবে মাসিকের সময় ব্যবহৃত কাপড় ধোয়া তার জন্য কিছুটা লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সে সব সময় চেষ্টা করতো, মাসিকের সময় ব্যবহৃত কাপড় অন্যদের নজর এড়ানোর জন্য, তাই সে অন্য বড় কাপড়ের ভাঁজে রেখেই ব্যবহৃত কাপড়টি ধুয়ে ফেলতো। সময়ের আবর্তে একটা সময় পর সে তার জীবনের মাসিক সম্পর্কিত অনুভূতিগুলো প্রিয় বান্ধবীদের সাথেই বিনিময় করতে লাগলো।
কিন্তু কিছুদিন পরে তার জীবনে ঘটে যায় নতুন এক বিপত্তি। প্রথম মাসিকের কিছুদিন পর প্রথম এক-দুই মাস মাসিক নিয়মিত হতো, কিন্তু পরবর্তীতে প্রতিমাসে দুইবার করে মাসিক হওয়া শুরু করলো। অনিয়মিত মাসিক হওয়ার দরুণ সে শারীরিকভাবে ক্রমাগত দুর্বলতা অনুভব করতে লাগলো। উপায়ন্তর না দেখে স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীর পরামর্শ নেয়। তিনি তাকে চট্টগ্রামে একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দেন। পরবর্তীতে চিকিৎসক তার সকল সমস্যা শুনে তাকে ব্যবস্থাপত্র দেন। ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী নিয়মিত ঔষধ সেবনের পর মাসিক পুনরায় স্বাভাবিক নিয়মে (প্রতিমাসে একবার) ফিরে আসে।
ঝর্ণা ৮ম শ্রেণীতে উঠার পর স্থানীয় একটি বেসরকারি সংস্থার আয়োজনে অনুষ্ঠিত মাসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতামূলক সভায় অংশ নেয়। তাদের মাধ্যমেই প্রথম জেনেছিল, মাসিকের সময় ব্যবহৃত কাপড় কড়া রোদে শুকাতে হবে। তাছাড়া ছায়াযুক্ত স্থানে শুকালে ব্যবহৃত কাপড়ে অনেক রোগ জীবাণু থেকে যাওয়ার সম্ভাবনার মতো বিষয়গুলো। প্রচলিত সামাজিক-রীতি অনুযায়ী, মাসিক হলে সাধারণত বাড়ির জ্যেষ্ঠ নারী সদস্যরা বিহারে (মন্দিরে) গিয়ে পূজা দেওয়া থেকে বিরত থাকতে বলেন। একটি বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ধর্মীয় গুরু (ভান্তে)গণ থেকে সে এই ব্যাপারে কোন বিধি-নিষেধ পায়নি। পাশাপাশি লোকমুখে প্রচলিত হিসেবে শুনেছে, মাসিকের সময় নাকি তেঁতুল খাওয়া বারণ। কারণ হিসেবে জেনেছে, ঐ সময় তেঁতুল খেলে নাকি রক্তের ঘনত্ব কমে যায়, তাই আরো বেশি রক্তক্ষরণ হওয়ার আশংকা থাকে।
উপরের ঘটনাটি বান্দরবান পার্বত্য জেলার একজন ঝর্ণার জীবনে ঘটে যাওয়া প্রথম মাসিকের অভিজ্ঞতার কাহিনী। তবে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অধিকাংশ মেয়েদের জীবনে ঘটে যাওয়া প্রথম মাসিকের অভিজ্ঞতাটি প্রায় একই রকম। বান্দরবান পার্বত্য জেলায় এমন হাজারো ঝর্ণা আছে। যাদের প্রথম মাসিকের কাহিনীগুলো এর থেকেও অনেক বেশি মর্মান্তিক ও মর্মস্পর্শী। আমাদের চারপাশে এমন অনেক ঝর্ণা আছেন, যাদের শুধুমাত্র অস্বাস্থ্যকর মাসিক ব্যবস্থাপনার কারণে জীবনটাই ঝড়ে গেছে, কিংবা আজীবনের জন্য ভঙ্গুর হয়ে গেছে জীবনের অনাগত দিনগুলো।
আশার কথা হলো, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অর্থায়নে সিমাভি নেদারল্যান্ডস্ ও বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ (বিএনপিএস) এর সহায়তায় পার্বত্য চট্টগ্রামের ১০টি স্থানীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলায় আওয়ার লাইভস্, আওয়ার হেলথ্, আওয়ার ফিউচারস্ (আওয়ারএলএইচএফ) প্রকল্পের আওতায় ১২ হাজার কিশোরী ও যুবতী নারীকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এই উদ্যোগের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের কিশোরী মেয়ে ও যুবতী নারীদের মর্যাদাপূর্ণ, বৈষম্যহীন এবং সহিংসতামুক্ত জীবন গঠনে সহায়তা করা, তাদেরকে ক্ষমতায়িত করা এবং মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ে কিশোরী ও নারীদের প্রয়োজনীয় দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০১৯ সাল থেকে কাজ করছে প্রকল্পটি।
মাসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ২০১৪ সালের বাংলাদেশ ন্যাশনাল হাইজিন বেজলাইন সার্ভে (বিএনএইচবিএস) পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ৩৬ শতাংশ মেয়েই প্রথম মাসিকের আগে মাসিক সম্পর্কে জানে না। এ কারণে অনেক মেয়েকেই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। এ ক্ষেত্রে পরিবার, বিশেষ করে মায়েদের দায়িত্ব তার কিশোরী মেয়েকে এ সম্পর্কে জানানো। একই সঙ্গে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে এব্যাপারে সচেতন ও সংবেদনশীল ভূমিকা পালন করে, সে জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আবার নারী ও কিশোরীদের একটি বড় অংশ অপরিষ্কার কাপড় ব্যবহার করে। কিশোরীদের মাত্র ১০ শতাংশ এবং বয়স্ক নারীদের ২৫ শতাংশ মাসিকের সময় স্যানিটারি ন্যাপকিন বা স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করে।
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতি ৬ ঘণ্টা অন্তর অন্তর স্যানিটারি ন্যাপকিন পাল্টানো দরকার। তা না হলে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে এবং প্রজননতন্ত্রের নানা জটিল রোগ দেখা দিতে পারে। সরকার ও বেসরকাররি সংস্থার অপর একটি যৌথ গবেষণায় দেখাগেছে, গ্রামে মাত্র ৯ শতাংশ ও শহরে ২১ শতাংশ বিদ্যালয়গামী ছাত্রী স্বাস্থ্যসম্মত প্যাড ব্যবহার করে। আর সামগ্রিকভাবে ৮৬ শতাংশ কিশোরী ব্যবহার করে পুরোনো, অপরিচ্ছন্ন কাপড়। গবেষণায় দেখা গেছে, নারীর মাসিককালীন পরিচ্ছন্নতা নিয়ে এখনও সমাজে সেভাবে সচেতনতা সৃষ্টি হয়নি। বিষয়টি নিয়ে পরিবারের সদস্যদের সাথে খোলামেলা আলোচনার মানসিকতা এখনো আমাদের সমাজে তৈরি হয়নি।
অস্বাস্থ্যকর মাসিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা, স্বাস্থ্যকর ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণগুলির অসহজলভ্যতা এবং দুর্বল স্যানিটেশন অবকাঠামো সমগ্র বিশ্বের নারী ও মেয়েদের শিক্ষার সুযোগ, স্বাস্থ্য এবং সামগ্রিকভাবে সামাজিক অবস্থানকে বাধাগ্রস্থ করছে। ফলস্বরূপ, লক্ষ লক্ষ নারী ও মেয়েদেরকে তাদের সম্পূর্ণ সম্ভাবনায় পৌঁছানো থেকে বিরত থাকতে হচ্ছে।
নীরবতা ভেঙ্গে সচেতনতা বৃদ্ধিতে এবং মাসিকের সাথে সম্পর্কিত চারপাশের বিদ্যমান এই নেতিবাচক সামাজিক নিয়মগুলো পরিবর্তন করতে বিশ্বব্যাপী ২৮ মে বিশ্ব মাসিক স্বাস্থ্য দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ২০১৩ সালে জার্মানভিত্তিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ‘ওয়াশ ইউনাইটেড’ কর্তৃক এই দিবসটি পালন করা শুরু হয়েছিল। ২০১৪ সালে প্রথম উদযাপনের পর থেকে সারা বিশ্বে এই দিবসটি পালনের চাহিদা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। ২০২০ সালে দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ‘মহামারীতে মাসিক থেমে থাকে না : কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের এখনই সময়। এ দিবসটি উপলক্ষ্যে জাতীয় এবং স্থানীয় সরকারী সংস্থা, ব্যক্তি, বেসরকারী সংস্থা এবং গণমাধ্যমের সমন্বয়ে সমন্বিতভাবে মাসিক স্বাস্থ্যের প্রতি উন্নয়নযোগ্য দিকগুলো গুরুত্বসহকারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরে রাজনৈতিক অগ্রাধিকার বাড়াতে ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য প্রচারাভিযান চালায়।
যদিও শিশু ও কিশোর-কিশোরীরা কোভিড-১৯ (করোনা ভাইরাস) এ গুরুত্বর অসুস্থ্ হওয়ার সম্ভাবনা অন্যদের তুলনায় কম। তবুও যেহেতু তারা স্কুলে যেতে পারছে না, বন্ধুদের সাথে বাইরে খেলতে পারছে না বা পরিবারের বাইরে প্রিয় আত্মীয় স্বজনদের সাথে দেখা করতে পারছে না। তাই তারা মানসিকভাবে কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছে। সেই সাথে করোনা ভাইরাসের কারণে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার স্থবিরতার মধ্যে মাসিকের সময় জটিলতায় চিকিৎসা কেন্দ্রে যাওয়া ও উপযুক্ত স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সেই সাথে ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় ব্যবহার্য উপকরণের সহজপ্রাপ্যতা নিশ্চিত করা ও স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে পালন করা সম্ভব হচ্ছে না। সর্বোপরি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে স্বাস্থ্যসম্মত মাসিক ব্যবস্থাপনা। যেটি নারীর সামগ্রিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করছে। যা দেশের স্বাস্থ্য খাতের সাফল্য ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের পথেও বড় এক অন্তরায়।
মাসিকের মত একটা স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক বিষয় নিয়েও লজ্জা আর সংকোচের শেষ নেই বাংলাদেশের সমাজে। এ ব্যাপারে সচেতন ও সংবেদনশীল ভূমিকা ছাড়া প্রত্যাশিত পরিরবর্তন অসম্ভব। সরকারি উদ্যোগ, সহায়তা ও সমর্থন ছাড়া এ পরিস্থিতি বদলানো খুব কঠিন। আমরা আশা করি সরকার, বেসরকারি সংস্থা, গণমাধ্যমের সক্রিয় ও কার্যকর ভূমিকার মাধ্যমে পরিবর্তন হবে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসাএই অচলাবস্থার।
লেখক : সুমিত বণিক, জনস্বাস্থ্যকর্মী ও প্রশিক্ষক, বান্দরবান। ইমেইল: sumit.bnps@gmail.com