হিল ভয়েস, ৫ মে ২০২০, রাঙ্গামাটি: প্রাণঘাতি করোনাভাইরাস মহামারী চলাকালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে নতুন অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপনের তোড়জোর শুরু করেছে। রাঙ্গামাটি জেলায় সম্প্রতি কমপক্ষে ৪টি স্থানে ক্যাম্প স্থাপনের কাজ চলছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
জনসংহতি সমিতির তথ্য মতে, গত ২০১৯ সালে রাঙ্গামাটি জেলায় ৪টি নতুন ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। এভাবে নতুন ক্যাম্প স্থাপন করা পার্বত্য চুক্তির সরাসরি লঙ্ঘন হিসেবে দেখছেন অনেকে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায় যে,বিলাইছড়ি উপজেলাধীন কেংড়াছড়ি ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের মেরাংছড়া মারমা পাড়ায় একটি নতুন সেনা ক্যাম্প স্থাপনের কাজ চলছে। উক্ত জায়গার মালিক হচ্ছেন মাঅং কার্বারী, মিসাউং মারমা, সিংলাপ্রু মারমা ও রুনাইপ্রু মারমা।
ক্যাম্প স্থাপন করার জন্য গত ২ মে ২০২০ গাছকাটছড়া সেনাক্যাম্প (৬ ইষ্ট বেঙ্গল) হতে প্রায় শ খানেক সেনা সদস্য মেরাংছড়া মারমা পাড়া পরিদর্শন করে। ৫ মে ২০২০ মঙ্গলবার বিলাইছড়ি জোন (৬ বেঙ্গল) কমান্ডার লে: কর্ণেল তানভির আহমেদ মাহমুদ পাশা এই নতুন ক্যাম্প নির্মাণের কাজ পরিদর্শন করেছেন বলে জানা গেছে।
বরকল উপজেলাধীন আইমাছড়া ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের (চাইচাল মৌজাধীন) বৈদ্য পাড়া ও মদন পাড়ার সংলগ্ন এলাকায় একটি নতুন ক্যাম্প স্থাপনের কাজ জোরেসোরে চলছে বলে জানা যায়। এই স্থানটি বরকল উপজেলা ও জুরাছড়ি উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকা।
ক্যাম্প স্থাপনের জন্য জুরাছড়ি থেকে গত ২৯ এপ্রিল ১৪ জনের একদল সেনা ও ৩০ এপ্রিল ২৪ জনের আরেক দল সেনা এবং বরকল থেকে ১লা মে তারিখে ২৯ জনের একদল বিজিবি উক্ত এলাকায় গিয়ে অবস্থান নিয়েছে বলে স্থানীয় সূত্র নিশ্চিত করেছে। ৩ মে জুরাছড়ির বনযোগীছড়া জোনের কম্যান্ডিং অফিসারও জায়গা পরিদর্শন করেছে।
বর্তমানে মেজর নাজিমুলের নেতৃত্বে সেনা সদস্যরা ‘শিল মাজ্যা কাব’ নামক স্থানে রয়েছে এবং তার উপরের আরেকটি স্থানে সুবেদার আনোয়ারের নেতৃত্বে বিজিবি সদস্যরা অবস্থান করছে বলে স্থানীয় সূত্র থেকে জানা যায়।
রাঙামাটি সদর উপজেলার মগবান ইউনিয়নের বড়াদাম মৌজার দেপ্পোছড়ি এলাকায় প্রতাপ দেওয়ানের রেকর্ডীয় জায়গা থেকে প্রত্যাহারকৃত ক্যাম্পের স্থানে নতুন ক্যাম্প স্থাপনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে বলে স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে। গত ২৮ ও ২৯ এপ্রিল পর পর দুইদিন রাঙ্গামাটি সেনা জোন ও কাপ্তাই সেনা জোনের সেনা সদস্যরা দেপ্পোছড়ি এলাকা পরিদর্শন করে।
রাঙ্গামাটি জেলার লংগদু উপজেলার গুলশাখালী শান্তিনগর এলাকার প্রত্যাহৃত বিজিবি ক্যাম্পের জায়গায় আরেক নতুন ক্যাম্প স্থাপনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। গত ১৯ মার্চ রাজনগর বিজিবি জোনের একদল বিজিবি সদস্য উক্ত স্থানটি পরিদর্শন করে। উক্ত জায়গাটি গুলশাখালী মৌজার বাসিন্দা সন্তোষ চাকমার নামে বন্দোবস্তির প্রক্রিয়াধীন রয়েছে এবং সামাজিকভাবে ফুটবল খেলার মাঠ হিসেবে সংরক্ষিত হয়ে আসছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহারের বিধান রয়েছে।
সরকারের তথ্য মতে পার্বত্য চুক্তির পর পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে দুই শতাধিক ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু জনসংহতি সমিতির তথ্য মতে, চুক্তির উক্ত বিধান অনুসারে চুক্তির অব্যবহিত পরে ১৯৯৮ সালে প্রথম দফায় ৩১টি অস্থায়ী ক্যাম্প ও দ্বিতীয় দফায় ৩৫টি ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়।
এরপর ২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর আরো ৩৫টি ক্যাম্প (কাপ্তাই ব্রিগেড অফিসসহ) প্রত্যাহার করা হয়। তিন দফায় ১০১টি ক্যাম্প প্রত্যাহারের পর পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনো চার শতাধিক অস্থায়ী ক্যাম্প বলবৎ রয়েছে বলে জনসংহতি সমিতির দাবি।
পার্বত্য চুক্তির পর কোন ইনসার্জেন্সী না থাকলেও কাউন্টার ইনসার্জেন্সী প্রোগ্রাম হিসেবে ১৯৭৭ সালে প্রবর্তিত ‘অপারেশন দাবানল’ এর স্থলে সরকার ২০০১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামে একপ্রকার সেনাশাসন জারি করে। অন্যদিকে পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহারের পরিবর্তে সরকার একের পর এক নতুন ক্যাম্প স্থাপন করে চলেছে।