হিল ভয়েস, ২ মে ২০২০, পার্বত্য চট্টগ্রাম: গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী সনাক্ত হয়। সনাক্ত হওয়ার পরদিনে দিনে বাড়ছে এ করোনা রোগীর সংখ্যা। এ পর্যন্ত পাঁচ হাজার এর অধিক নিশ্চিত কেস পাওয়া গেছে বালাদেশের বিভিন্ন জায়গায়। তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে দু’টি জেলা বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতেও সন্ধান মিলেছে করোনা রোগীর।
এই করোনা সংকটে সৃষ্টি হয়েছে আরেকটি সংকটের। করোনা সতর্কতায় চলতে থাকা লক-ডাউনিং-এর মধ্যে প্রায় সমস্ত অর্থনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ। বন্ধ রয়েছে হাট-বাজার। যার ফলে পাহাড়ের দরিদ্র জুম চাষী নিজেদের জুমে উৎপাদিত নানা ফসল বিক্রি করতে পারছে না বাজারে। দিনে আনে দিনে খায় গোছের যে পরিবারগুলো রয়েছে তাদের কপালে ভাজ পড়তে শুরু করেছে ইতোমধ্যেই।
বান্দরবানের পেকরু ম্রো’র পরিবারের আলু খেয়ে দিন যাপনের চিত্র উঠে এসেছে জাতীয় পত্রিকায়। সরকাবি–বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ত্রাণ বিতরণের উদ্যোগ নিলেও সেগুলো প্রান্তিক আদিবাসী অঞ্চলে পৌঁছাচ্ছে না বিভিন্ন কারণে আর পৌঁছালেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপর্যাপ্ত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া বান্দরবানের চিম্বুকের এক ম্রো শিক্ষার্থী বলেন, সরকারি ত্রাণ সহায়তার মধ্যে প্রদত্ত চালের যে পরিমাণ তা খুবই অপর্যাপ্ত। আর অন্যান্য সহায়তা সামগ্রী যে পরিমাণ প্রদান করা হচ্ছে তা বড় বড় পরিবারগুলোর জন্য কেবল সপ্তাহের খোরাক। আর এসরকারি সহায়তা যতটা না টেকসই ততটাই বেশি লোক দেখানো। যার ফলে এ সহায়তার উপর আসলে নির্ভর করা যাচ্ছে না। যার ফলে এক ধরনের দু:শ্চিন্তায় কাজ করছে বলে জানান এই শিক্ষার্থী।
পাহাড়ের বিভিন্ন এলাকায় সীমিত পর্যায়ে হাট-বাজার চলমান থাকলেও অন্য জেলাগুলোর মত চলছে না কোনো প্রকার গণপরিবহন। যার ফলে সিএনজি, মোটর বাইক থেকে শুরু করে এধরনের পেশার সাথে সম্পৃক্ত পাহাড়ি পরিবারগুলোও পড়েছে সংকটে। খুব কম সংখ্যক চাকরিওয়ালা বাদ দিলে পাহাড়ের প্রায় অধিকাংশ মানুষই ছোট বা মাঝারি ব্যবসা, কৃষি কাজ এবং জুম চাষের উপরই বেশি নির্ভরশীল।
সমস্ত কিছু এখন বন্ধ হওয়ার ফলে আয়ের পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। যার ফলে সংকট ঘনীভূত হচ্ছে আস্তে আস্তে। এমনি সংকটে পাহাড়ের খাদ্য সংকটে থাকা আদিবাসীদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য একটি উদ্যোগ নিয়েছে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত জুম্ম শিক্ষার্থীসহ পাহাড়ের কিছু আদিবাসী তরুণ।
‘বনফুলের জন্য জুম্ম তারুণ্যের ভালোবাসা’ নামে একটি ফেসবুক পেইজ এবং একটি ইভেন্টের মাধ্যমে তারা পাহাড়ের অসহায় মানুষের জন্য ফান্ড সংগ্রহ করছেন। এই তরুণদের মধ্যে অন্যতম একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী রিবেং দেওয়ান। তিনি একই সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি। এক মুঠো আলাপে রিবেং দেওয়ান বলেন, আমাদের ফান্ডে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন মানবতাবাদী মানুষ হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। বর্তমানে আমাদের ফান্ডে পাহাড়ের অসহায় মানুষদের জন্য লক্ষাধিক টাকা সহায়তা এসেছে। মানবতাবাদী মানুষের অগাধ ভালোবাসায় আমরা মাত্র তিন দিনেই এই অর্থ সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছি।
মানবিক সহায়তা সংগ্রহের দলের মধ্যে থাকা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রেং ইয়ং ম্রো বলেন, আধুনিক প্রযুক্তি, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত পাহাড়ের প্রত্যন্ত এলাকার মানুষ এমনিতেই নানা সমস্যায় পীড়িত। সে জায়গায় করোনার মত মহামারী দুর্গম অঞ্চলে আরো বিভিন্ন অসুবিধার তৈরি করে দিচ্ছে। করোনায় লক-ডাউনিং এর না হওয়ার আগেও বান্দরবানের থানচিসহ সাজেকও বিভিন্ন দুর্গম অঞ্চলে যেখানে প্রায় সময় খাদ্যভাব দেখা দেয়, সেখানে এমনি এক শ্বাসরুদ্ধকর বাস্তবতায় সেসব দুর্গম অঞ্চলে খাদ্যভাব আরো চরম আকার নিবে বলে আমরা নিশ্চিত।
তিনি আরো বলেন, রোয়াংছড়ির ঢেবাছড়া অঞ্চলে অনেক তঞ্চঙ্গ্যা পরিবার দুই কেজি চালে এক সপ্তাহ পার করছে বলে আমার কাছে খবর আছে। সে জায়গায় আমাদের মত প্রজন্মের তরুণরা নিশ্চয় চুপ করে থেকে দায় এড়াতে পারি না। তাই আমরা আমাদের সাধ্য নিয়ে তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর জন্যই এ ধরনের একটি উদ্যোগকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে তাদের মাধ্যমে পরিচালিত পেইজ থেকে ইতোমধ্যে বিভিন্ন কন্ঠশিল্পী ও চিত্রশিল্পী সংহতি জানাচ্ছেন তাঁদের সামর্থ দিয়ে। ইতোমধ্যেই পাহাড়ের বিশিষ্ট শিল্পী কালায়ন চাকমা গানে গানে সংহতি জানিয়েছেন। রেমনিসেন্স ব্যান্ডের সদস্যরা গান গেয়ে একইভাবে সংহতি জানিয়েছেন। চিত্রশিল্পী তিতাস চাকমা, সূত্রা চাকমাসহ অনেকেই এই তরুণদের সাথে সংহতি জানিয়েছেন।
‘বনফুলের জন্য জুম্ম তারুণ্যেও ভালোবাসা’ নামের মানবিক সহায়তা উত্তোলন কার্যক্রমে অন্যতম সহযোগী হিসেবে আছেন কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা। তিনি বলেন, আমরা মূলত বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে যা জানতে পেরেছি অনেক প্রান্তিক জনপদে অভাবী মানুষ অনিশ্চিয়তার মধ্যে আছে। যার জন্য মূলত তরুণদেরকে সংগঠিত করে আমিও তাদের সহযোগীতা করছি।’
উত্তোলিত সহায়তা কোথায় বিতরণ করা হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা আপাতত তথ্য সংগ্রহ করছি বিভিন্ন দিক থেকেই।পাহাড়ের কোন কোন জায়গায় এ সংকট বেশি সেগুলো প্রথমে চিহ্নিত করবো। তারপরে অন্যান্য আরো যে সামাজিক সংগঠন ও গ্রুপসমূহ কাজ করছে তাদের সকলের সাথে সমন্বয় করে আমরা ‘মোস্ট ভালনারেবল’ পাহাড়ি জনপদগুলোতে আগে এ সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করবো। তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে সবচেয়ে সংকটে থাকা পাহাড়ের প্রত্যন্ত জায়গাগুলো চিহ্নিত করা হচ্ছে বলেও জানান এ উদ্যোগের অন্যতম সংগঠক।
এছাড়া দেশ বিদেশের মানবতাবাদী মানুষদের সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন আয়োজকরা। আয়োজকদের দেয়া বিকাশ ও রকেট নাম্বারে এ সহযোগিতা পাঠানো যাবে বলে জানিয়েছেন এই তরুণরা।
বিকাশ একাউন্টসমূহ হল- ০১৮৬৮৯৪২৫৭১ (চন্দ্রা ত্রিপুরা), ০১৫৫৮৯৫১৪৪৫ (সতেজ চাকমা), ০১৭৩২৮৯৩৭৯৯ (সঞ্চারী চাকমা), ০১৮৫৬৬০১৮৯৭ (রিবেং দেওয়ান), ০১৫৩৩৫৫৯৯০ (জিকো চাকমা), ০১৭২৫১৪৩২৮৩ (অন্তর চাকমা)।
রকেট একাউন্টের মাধ্যমে এর সহযোগিতা পাঠানো যাবে বলেও জানিয়েছেন আয়োজকরা। রকেট একউন্ট- ০১৬৮২৩৯৯৩৯৭৯ (পূর্ণা দেওয়ান), ০১৫৫৮৯১৩৬৮৪০ (জশোয়া দেওয়ান)
সূত্র: ipnewsbd.com