হিল ভয়েস, ২ মে ২০২০, রাঙ্গামাটি: এপ্রিল মাসে ২৫টি ঘটনায় সেনাবাহিনী ও বিজিবি কর্তৃক ৭ জনকে আটক, ১৩ জনকে মারধর ও হয়রানি, ৮ জনকে সাময়িক আটক, ১৩টি বাড়ি তল্লাসী ও ত্রাস সৃষ্টির লক্ষ্যে একবার ব্লাঙ্ক ফায়ার, হাসপাতালে নেয়ার পথে সেনাবাহিনী কর্তৃক তল্লাসীর নামে পৌনে একঘন্টা আটকে রাখায় একজন গর্ভবতী নারীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বলে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মাসিক মানবাধিকার প্রতিবেদন উল্লেখ করা হয়েছে।
এছাড়া এপ্রিল মাসে সেনা-সমর্থিত সংস্কারপন্থী ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সশস্ত্র সন্ত্রাসী কর্তৃক ৩ জনকে গুলি করে হত্যা এবং একজন ছাত্রসহ ৪ জনকে অপহরণ ও মোটা অংকের মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
এপ্রিল মাসে জুম্ম গ্রামবাসীদের উচ্ছেদ করে ভূমি জরদখলের লক্ষ্যে জুম্মদের ৫ হাজার রাবার গাছ পুড়িয়ে দেয়া, গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়া হুমকি প্রদান, হয়রানিমূলক মামলায় জুম্ম গ্রামবাসীদের গ্রেফতারের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে।
আজ ২ মে ২০২০ জনসংহতি সমিতির তথ্য ও প্রচার বিভাগ এপ্রিল মাসের “পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকার পরিস্থিতির উপর মাসিক প্রতিবেদন” অনলাইনে প্রকাশ করে।
প্রতিবেদনে বলা হয় যে, বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে এ বছর পার্বত্য চট্টগ্রামের রাংগামাটি, বান্দরবন ও খাগড়াছড়ি জেলায় বসবাসরত আদিবাসী জুম্ম জাতিগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী জাতীয় উৎসব বিজু, সাংগ্রাই, বৈসু, বিষু, বিহু পালন স্থগিত করা হয়। কোভিড-১৯ ভাইরাস সংক্রমণ রোধকল্পে জনসমাগম এড়িয়ে চলা ও সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখার স্বার্থে এই প্রাণের উৎসব ব্যাপকভাবে পালন না করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
একের পর এক সাধারণ ছুটি ঘোষণা, দীর্ঘ দিন ধরে শিল্প-কারখানা বন্ধ থাকা এবং বেতন-ভাতা না পাওয়ার ফলে চট্টগ্রাম, ঢাকা, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় কর্মজীবী হাজার হাজার জুম্ম চরম আর্থিক সংকটে পড়ে। ফলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এসব কর্মজীবী জুম্ম যুবক-যুবতীরা এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলার স্ব স্ব ঘরবাড়িতে ফিরতে শুরু করেন। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় যানবাহনের চরম ভোগান্তি ছাড়াও চট্টগ্রাম জেলার সাথে তিন পার্বত্য জেলা সীমানায় তাদের পড়তে হয়েছে সেনাবাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অবর্ণনীয় হয়রানি ও নির্যাতনে।
দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামে চলছে প্রাণঘাতি মহামারী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব। কোভিড-১৯ সংক্রমণ প্রতিরোধে লকডাউনের ফলে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামেও চলছে একদিকে কর্মহীন হয়ে পড়া খেটে-খাওয়া মানুষের খাদ্য সংকট, অন্যদিকে করোনাভাইরাস সংক্রমণের আতঙ্ক।
এধরনের চরম দুর্যোগ ও সংকটের মধ্যেও পার্বত্য চট্টগ্রামে থেমে নেই সেনাবাহিনী, বিজিবি ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান। জুম্ম গ্রামবাসীদের নানাভাবে হয়রানি ও উচ্ছেদ করে অবাধে চলছে দেশের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী ও বহিরাগত ভূমিদস্যুদের ভূমি জবরদখল। ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে জুম্মদের জায়গা-জমি বেদখল, অবৈধ ধরপাকড় ও নির্যাতন, ঘরবাড়ি তল্লাসী, সেনাবাহিনী কর্তৃক সশন্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে মদদ ইত্যাদি ফ্যাসীবাদী ঘটনা আরো বেশি জোরদার হয়েছে।
তারই অংশ হিসেবে ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে সেনাবাহিনী ও বিজিবি কর্তৃক ৭ জনকে আটক, ১৩ জনকে মারধর ও হয়রানি, ৮ জনকে সাময়িক আটক, ১৩টি বাড়ি তল্লাসী ও ত্রাস সৃষ্টির লক্ষ্যে একবার ব্লাঙ্ক ফায়ার, হাসপাতালে নেয়ার পথে সেনাবাহিনী কর্তৃক তল্লাসীর নামে পৌনে একঘন্টা আটকে রাখায় একজন গর্ভবতী নারীর মৃত্যুর ঘটনা সংঘটিত হয়েছে।
বান্দরবান জেলায় ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ নেতা ও বহিরাগত ভূমিদস্যু কর্তৃক জুম্ম গ্রামবাসীদের উচ্ছেদ করে ভূমি জরদখলের লক্ষ্যে জুম্মদের ৫ হাজার রাবার গাছ পুড়িয়ে দেয়া, গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়া হুমকি প্রদান, হয়রানিমূলক মামলায় জুম্ম গ্রামবাসীদের গ্রেফতারের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। প্রায় সাড়ে চার হাজার একর সামাজিক জুম ভূমি দখলের পূর্বের ধারাবাহিক তৎপরতা করোনা সংকটকালে গেলো এপ্রিল মাসে আরো জোরদার হয়েছে।
অপরদিকে সেনা-সমর্থিত সংস্কারপন্থী ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সশস্ত্র সন্ত্রাসী কর্তৃক ৩ জনকে গুলি করে হত্যা এবং একজন ছাত্রসহ ৪ জনকে অপহরণ ও মোটা অংকের মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এসব সশস্ত্র গোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব সংরক্ষণের লড়াইকে ধ্বংস করার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রের দোসর হয়ে উঠেছে। তারা রাষ্ট্রীয় বাহিনীর ক্যাম্পের লাগোয়া ঘাঁটি স্থাপন করে মোটরযান ও নৌযান নজরদারী ও তল্লাসী করছে।
সেনাবাহিনীর তল্লাসী অপারেশনে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে জুম্ম জনগণকে হয়রানি করছে। সেনাবাহিনীর গাড়ি যোগে গিয়ে তাদের টার্গেটকৃত নিরীহ লোকজনকে হত্যাকরে সেনাশিবিরে ফিরে যাচ্ছে। নিরীহ মানুষকে অপহরণ করে জিম্মি করছে এবং লক্ষ লক্ষ টাকা মুক্তিপণ আদায় করছে।
এমনকি করোনাভাইরাসের বিশ্বব্যাপী মহামারীও সেনাবাহিনীর দমন-পীড়ন বন্ধ করতে পারেনি, বন্ধ করতে পারেনি ভূমিদস্যুদের পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি বেদখল, এবং সেনাবাহিনীকে সন্তুষ্ট করার জন্য সেনা-সমর্থিত সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বর্বরোচিত অপকর্ম ও মুক্তিপণ আদায়ের তৎপরতা ইত্যাদি।