হিল ভয়েস, ৮ এপ্রিল ২০২০, খাগড়াছড়ি: বিটিভিতে প্রচারিত করোনা পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে ভিডিও কন্ফারেন্সে খাগড়াছড়িসহ পার্বত্য এলাকায় সম্প্রতি হামের প্রাদুর্ভাব বিষয়ে প্রদত্ত খাগড়াছড়ির ডেপুটি কমিশনার (ডিসি) ও সিভিল সার্জনের বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদ। জেলার সর্বোচ্চ পদাধিকারী কর্মকর্তাদের বক্তব্য সাম্প্রদায়িক ও বর্ণবাদী মানসিকতা বহন করে বলে উল্লেখ করে এই সংগঠন।
গত ৭ এপ্রিল ২০২০ সকাল ১০:৩০টায় প্রধানমন্ত্রীর সাথে অনুষ্ঠিত ভিডিও কন্ফারেন্সে এই প্রসঙ্গে খাগড়াছড়ির ডিসি বলেন, ‘হামে যারা আক্রান্ত তারা পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর। এদের মধ্যে কিছু কুসংস্কার আছে’। তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের এমপি এবং জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের..’। অপরদিকে, খাগড়াছড়ির সিভিল সার্জনও প্রায় একই সুরে বলেন, ‘ত্রিপুরা এলাকার কুসংস্কারের কারণে তারা চিকিৎসা নিতে চায় না’।
মাতৃত্বসুলভ গুণ দিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের খবর নেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয় ৭ এপ্রিলে বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদের সাধারণ সম্পাদক অনন্ত কুমার ত্রিপুরা স্বাক্ষরিত প্রতিবাদপত্রে। ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদের প্রতিবাদপত্রে আরো বলা হয়, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার জেলা প্রশাসক বলেছেন, ‘হামে যারা আক্রান্ত তারা পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর। এদের মধ্যে কিছু কুসংস্কার আছে’।
তিনি সমগ্র ত্রিপুরা সমাজকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন উল্লেখ করে ‘আমাদের এমপি এবং জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের’ বলে দুরভিসন্ধিমূলক ইঙ্গিত করেছেন, যা আমরা মেনে নিতে পারি না।’ ..অন্যদিকে সিভিল সার্জন তাঁর সাথে সুর মিলিয়ে বলেছেন, ‘ত্রিপুরা এলাকার কুসংস্কারের কারণে তারা চিকিৎসা নিতে চায় না’।
এই প্রসঙ্গে ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদের প্রতিবাদপত্রে বলা হয়, ‘জেলার সর্বোচ্চ পদবিধারী দায়িত্বশীল দুইজন সরকারি কর্মকর্তার এহেন দায়সারাগোছের মন্তব্যে আমরা যারপরনাই মর্মাহত হয়েছি এবং ক্ষুব্দ হয়েছি। আমরা মনে করি, তাঁদের এসব মন্তব্য সাম্প্রদায়িক মানসিকতা ও বর্ণবাদী মানসিকতা বহন করে।’
প্রতিবাদপত্রে আরো বলা হয়, তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নের উত্তর সরাসরি না দিয়ে এই প্রাদুর্ভাবের দায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ওপর চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করেছেন। প্রত্যন্ত এলাকায় স্বাস্থ্যকর্মীদের দায়িত্ব যথাযথভাবে মনিটরিং না করা এবং উপদ্রুত এলাকায় সময়মতো চিকিৎসকদের না পাঠানোর বিষয়গুলিকে সুকৌশলে পাশ কাটানো হয়েছে।
ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদ মনে করে, প্রকৃত সত্যকে গোপন রেখে হামের প্রাদুর্ভাবের জন্য কেবলমাত্র ত্রিপুরা সমাজের দু’একটি পরিবারের চিকিৎসা নিতে না পারার বা চিকিৎসা না নেওয়ার বিষয়টিকে সামনে তুলে এনে স্বাস্থ্য্ বিভাগ নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার অপচেষ্টামাত্র। প্রকৃত তথ্য লুকিয়ে রেখে তাঁরা প্রধানমন্ত্রীকে ছেলে ভোলানোর তথ্য দিয়েছেন বলে উল্লেখ করে প্রতিবাদপত্রে এই অপতৎপরতার তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়।
প্রতিবাদপত্রে আরও বলা হয়, ‘আমরা সকলে অবগত আছি, তুলনামূলক দুর্গম এলাকাগুলোতে স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছায় না, বিশেষ করে স্বাস্থ্য কর্মীরা দুর্গম এলাকাগুলোতে টিকা দিতে যান না। অথচ তার দায় কুসংস্কারের উপর চাপানো হলো!’
প্রতিবাদপত্রে আরও বলা হয়, ‘জেলার দূর্গম এলাকাগুলোতে সরকারের পানীয় জলের সুবিধা, স্বাস্থ্য সেবাসহ মৌলিক সেবাসমূহ নিশ্চিত করা হচ্ছে না। আর সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হচ্ছে, কর্তাব্যক্তিদের দ্বারা এসব সীমাবদ্ধগুলোকে স্বীকার না করা, বরং তার দায় শিক্ষা-বঞ্চিত, অবহেলিত, উন্নয়ন-বঞ্চিত মানুষগুলোর উপর চাপিয়ে দেয়া।’
এছাড়া, ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদের পক্ষ থেকে ডেপুটি কমিশনার ও সিভিল সার্জনের সাম্প্রদায়িক ও বর্ণবাদী বক্তব্য প্রত্যাহারপূর্বক তাঁদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা; হামরোগে আক্রান্ত হয়ে যেসব শিশুর জীবন ইতোমধ্যে অকালে ঝরে পড়েছে, তাদের সকলের পরিবারকে যথাযোগ্য ক্ষতিপূরণ দেয়া; হামরোগে আক্রান্ত প্রত্যেক শিশুর পরিবারকে টেকসই জীবিকার জন্য সহায়তা প্রদান করা; বর্তমানে আক্রান্ত গ্রামগুলোসহ জেলার সকল প্রত্যন্ত গ্রামে নিয়মিতভাবে চিকৎসক টিম প্রেরণের মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা; এবং প্রত্যন্ত এলাকার সকল শিশুর জন্য নিয়মিত টিকা ও পুষ্টিসেবা নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়।
উল্লেখ্য, সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ির দীঘিনালা ও পানছড়ি উপজেলাসহ রাঙ্গামাটির সাজেক ও বান্দরবানের লামা ও থানচির প্রত্যন্ত এলাকায় ৩৫০ এর অধিক আদিবাসী শিশু হামে আক্রান্ত হওয়া এবং অন্তত ১১ জন শিশু মারা যাওয়ার খবর পাওয়া যায়। হামের এই প্রাদুর্ভাবের খবর স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিকে প্রচারিত হয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায় যে, প্রধানত স্বাস্থ্যসেবার অভাব, প্রচন্ত পুষ্টিহীনতা ও আর্থ-সামাজিক দূর্বলতার কারণেই এই হামের প্রাদুর্ভাব। প্রায় প্রতিবছরই এই সকল এলাকায় হামের প্রাদুর্ভাব হয় বলে জানা যায়।