বাচ্চু চাকমা
আজ সারা বিশ্ব জুড়ে করোনা মহামারীর প্রকোপ বেড়ে চলেছে। বিশ্বব্যাপী দেশে দেশে লকডাউন চলছে। বিশ্বের বাঘা বাঘা দেশের রাষ্ট্র প্রধানদের এই করোনা মহামারী সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। এমনই এক মহা সংকটের মুহূর্তে আজ বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র শ্রমিকদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা শুরু করেছে।
উল্লেখ্য যে, কলকারখানার চাকা ঘুরলেই দেশে উৎপাদন হয়। উৎপাদন প্রক্রিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে শ্রমিকশ্রেণি। যেকোন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে শ্রমিকশ্রেণির অবদান অপরিহার্য। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, সৃষ্টির আদিকাল থেকে এই শ্রমিকশ্রেণি অবহেলিত ও বঞ্চিত। শ্রমের ন্যায্য পাওনা আর কর্মঘণ্টা নির্ধারণের দাবী আদায়ের জন্য অগণিত শ্রমিক রাজপথে জীবন উৎসর্গিত করেছেন। রাজপথ করেছেন শ্রমিকের রক্তে রঞ্জিত। বিশ্বের দেশে দেশে শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনের স্মরণীয় ঘটনা লেখা আছে ইতিহাসের পাতায় পাতায়। আজ সেই রক্তে রঞ্জিত ইতিহাস স্মরণে আসছে এবং ভাবছি মানব সভ্যতার প্রতিটি ইট, বালু ও পাথরে যাদের রক্ত ও ঘাম জড়িয়ে আছে, সেই শ্রমিকশ্রেণি ছাড়া কখনোই সভ্যতা গড়ে তোলা সম্ভব ছিল না।
অথচ আজ শ্রমিকের জীবন নিয়ে বাংলাদেশের কলকারখানার মালিকেরা যা ইচ্ছে তাই করছে। এই মরণ বিনাশী করোণা মহামারীর সময়ে দেশে দেশে সকল মানুষকে ঘরে থাকার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। স্লোগান উঠেছে “ঘরে থাকুন, নিজেকে নিরাপদ রাখুন”। তাহলে আজ বাংলাদেশের শ্রমিক ভাই-বোনদের রাস্তায় নামানো হচ্ছে কেন, কলকারখানায় কাজ করার জন্য বাধ্য করা হচ্ছে কেন? পোশাক কারখানা খোলা রেখেই শ্রমিকরাই সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে।
গত ৫ এপ্রিল থেকে পোশাক কারখানা খুলে দেওয়ার খবরে রাস্তাগুলোতে শ্রমিকদের ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। শিমুলিয়া ঘাটে মানুষের উপচেপড়া ভিড়, সেখানে বেশির ভাগই পোশাক শ্রমিক। গাজীপুরে মহাসড়কে শ্রমিকদের ভিড়, নারায়নগঞ্জের রাস্তায় শ্রমিকদের ভিড়, ময়মনসিংহে যানবাহন না পাওয়ায় পোশাক শ্রমিকরা তাদের গন্তব্যে যাচ্ছেন পায়ে হেঁটে। যখন করোণা ভাইরাসের কারণে সরকার ছুটি ঘোষণা করছে, করোনা প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে মানুষকে ঘরে থাকতে বলা হচ্ছে, এমন সময় রাস্তায়, স্টেশনের জায়গায় জায়গায় শ্রমিকদের ভিড় দেখে মনে হয় দেশ মহা সংকটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
একদিকে গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন বিজিএমএইর সভাপতি রুবানা হক বলছেন, রাস্তায় সব শ্রমিক গার্মেন্টস শ্রমিক নয়। এই শ্রমিকরাই গার্মেন্টস শ্রমিক না হোক, যেকোন শিল্প কলকারখানার শ্রমিক তো হতে পারে। তাদের জীবন নিয়ে, তাদের অস্তিত্ব নিয়ে কোন কারখানা মালিকের খেলা করার অধিকার নেই। এরাও বাংলাদেশের নাগরিক, তাদেরও রয়েছে বেঁচে থাকার অধিকার। মনে রাখবেন, এই শ্রমিকের হাত ধরে বিকশিত হয়েছে মানব সভ্যতা। তাদের ঘাম আর রক্তের বিনিময়ে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের প্রতিটি শহরাঞ্চল। বাংলাদেশের প্রতিটি ইমারত, প্রতিটি রাস্তা তাদের শ্রমের ফলে নির্মিত হয়েছে।
আজ করোনা মহামারীর মহাসংকটের সময় তাদের জীবনকে বলি দিয়ে কারখানার চাকা ঘুরাতে চাইছেন, মুনাফার পাহাড় গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছেন। আপনাদের গার্মেন্টস কারখানা, পোশাক কারখানা ১০/২০ দিন বন্ধ রাখার পর নতুন করে আরও চালু করা যাবে। কিন্তু একজন শ্রমিকের জীবন চলে গেলে তাকে ফেরত পাওয়া যাবে না। কলকারখানার মালিকের কাছে শ্রমিকের জীবন তুচ্ছ হতে পারে, কিন্তু শোষিতশ্রেণি মানুষের কাছে তাদের জীবন মহামূল্যবান। মনে রাখবেন, শ্রমিকশ্রেণি ফুলে ফেঁপে উঠলে মালিকশ্রেণিরা পালানোর রাস্তা খুঁজে পাবেন না। তাইতো বলছি, শ্রমিকের শ্রম আত্মসাৎ করার সময় এখন নয়, এখনই সময় হল করোনা ভাইরাসের ছোবল থেকে শ্রমিকদের জীবন রক্ষা করা।
আজকে দেশের লাখ লাখ শ্রমিক প্রতিনিয়ত তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে। শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি, সুনির্দিষ্ট কর্মঘন্টা, শ্রমিকের বিভিন্ন অধিকার ও দায় দায়িত্ব নিয়ে বাংলাদেশের শ্রম আইন ২০০৬ প্রণীত হয়েছে, মহান সংবিধানে শ্রমিকদের অধিকার বিষয়ে বলা হয়েছে, বিশেষ করে ৩৪ অনুচ্ছেদটি শ্রমিকশ্রেণির স্বার্থ রক্ষাকবচ। এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সব ধরণের জবরদস্তি শ্রমনিষিদ্ধ। এছাড়া ৩৮ অনুচ্ছেদে জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষে সমিতি বা সংঘ গঠন করার অধিকার দেওয়া হয়েছে। সংবিধানে ৩৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী যদি বলি তাহলে গোটা বিশ্ববাসীকে ঘরে থাকার কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু বাংলাদেশের শ্রমিকদের কারখানায় নামানো হচ্ছে, রাস্তায় নামানো হচ্ছে, স্টেশনে-গাড়িতে ভিড়, পায়ে হেঁটে কলকারখানায় কাজ করার জন্য আসতে বাধ্য করা হচ্ছে, এটাই কি জবরদস্তি শ্রম আদায় করা নয়? এটাই মহান সংবিধানের ৩৪ অনুচ্ছেদকে চরমভাবে লংগন করা হয়েছে বলা যায় না।
সেজন্য কলকারখানার মালিকদের এই আইনের আওতায় আনা দরকার। তাদের শাস্তি প্রদান করা দরকার। কিন্তু অতীব দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, রাষ্ট্রের সংবিধানে যতোই আইন থাকুক না কেন, সেই আইন অনুযায়ী কারখানা মালিকদের কোন আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। কারণ, এই রাষ্ট্র হল পুঁজিপতিদের তলবি বাহক। পুঁজিপতিদের স্বার্থেই রাষ্ট্র আর রাষ্ট্রের স্বার্থেই হল পুঁজিপতি। রাষ্ট্র আর মালিকশ্রেণি একে অপরের পরিপূরক। তাহলে সকল কলকারখানার মালিকশ্রেণিরা যতোই আইন ভাঙুক না কেন, রাষ্ট্র তাদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করবে না। এটায় হলো পুঁজিপতি রাষ্ট্রের শ্রেণিচরিত্র।
পৃথিবীর ইতিহাসে দিকে যখন ফিরে তাকায় বিভিন্ন দেশের শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে আন্দোলনের ইতিহাস চোখের সামনে স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। একজন শ্রমিকের বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল হল তার শ্রমশক্তি। শ্রম ছাড়া একজন শ্রমিকের কিছুই নেই। শ্রমের বিনিময়ে তাঁকে বেঁচে থাকতে হয়। কারখানা মালিকের কাছে তার শ্রম বিক্রয় করে সে জীবন অতিবাহিত করে। শ্রমিকরা এই মুর্হুতে আরও বেশি অসহায়। দেশ জুড়ে কার্যত চলমান লকডাউন অবস্থার মধ্যে শ্রমিকদের অসহায়ত্ব অন্য সময়ের চাইতে প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে।
গত শনিবার চাকরী হারানোর ভয় ও বকেয়া বেতন পাবার আশায় করোণা মহামারী ভয় ভীতিকে উপেক্ষা করে দলে দলে কাজে যোগ দিতে গ্রাম থেকে শহরাঞ্চলে পাড়ি জমান পোশাক কারখানার শ্রমিকরা। নেই কোন করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের ভয় অথচ মৃত্যুর হাতছানি তবুও এক মুঠো খাবারের আশায় দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে পৌঁছালেন কর্মস্থলে। কারণ তাদের বলা হয়েছিল, কারখানা খুলবে ও বেতন দেওয়া হবে। দ্য ডেইলি স্টার এর শিরোনাম বলছে, “শ্রমিকরা শুধু গার্মেন্টস খাতের মেশিন চালানোর কর্মী নয়, তারা এদেশের নাগরিকও। অন্য নাগরিকের মতো তাদেরও সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার আছে”। কথাটি একদম সত্য। শ্রমিকদের সুরক্ষার কথা চিন্তা করা, তাদের জীবন বাঁচানোর দায়িত্ব সরকারের উপরই দায়িত্ব পড়ে। এবিষয়ে কারখানা মালিকদের যতটা দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা দরকার তার চেয়ে অধিক প্রয়োজন ছিল সরকারের। সরকারকে এই বিষয়ে দ্রুত হস্তক্ষেপ করা ও যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন।
মনে রাখবেন, শ্রমিকরা নিজের গতর খাটিয়ে খায়। কারও উপর বসে বসে খায় না। কাউকে সে শোষণ করে না। সে চায় তার নিজের শ্রমের ন্যায্য মূল্য। শ্রমিকশ্রেণি তার নিজের উপর শোষণের বিরুদ্ধে যেমন রুখে দাঁড়াতে জানে তেমনি জাতিগত শোষণের বিরুদ্ধেও আপসহীনভাবে লড়তে পারে। শ্রমিকদের মধ্যে কোন প্রকার বিভেদ-বৈষম্য থাকতে পারে না। তাদের সবার পরিচয় সর্বহারা মজুর। শ্রমিকরা রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল, মালিকশ্রেণির বিরুদ্ধেও লড়াই করেছিল। কলকারখানার মালিকশ্রেণিরা কিছু কিছু সংস্কার করে থাকে, কর্মঘণ্টা কমিয়ে দেয়, বেতন কিছু বৃদ্ধি করে দেয় এবং অন্যান্য কিছু কিছু সুযোগ সুবিধা দিয়ে শ্রমিকদের আন্দোলন থেকে দূরে রাখতে ব্যর্থ অপচেষ্টা চালিয়ে যায়। এই সংস্কার মালিকশ্রেণির হোক কিংবা সরকার নিজেরই হোক, এই সংস্কার কোন বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে না। এরই ফলে শ্রমিক শুধু কিছু বেশি দামে তার শ্রমশক্তি বেচতে পারে।
প্রকৃতপক্ষে শ্রমিকশ্রেণি যাহা চায় এমন একটি সমাজ ব্যবস্থা, যেখানে মজুরদের শ্রমশক্তি বেচবার জন্য পুঁজিপতিদের দরজায় দরজায় ধর্না দিতে হবে না। সে নিজেই হবে কলকারখানার মালিক। আজ যে শ্রমিকদের জীবন অবহেলায় ফেলে রেখেছেন, একদিন সেই শ্রমিক রাজনৈতিক সচেতন হয়ে উঠবে, নিজেদের সুসংগঠিত করে তুলবে, আসল ও চুড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য একদিন প্রস্তুত হবে। রাশিয়ার বুকে একদিন তাই ঘটেছিল, সমগ্র রাশিয়ায় নানা এলাকার হাজার হাজার মজুর বিক্ষোভ এবং ধর্মঘট সংগ্রামে নেমে পড়েছিল। শ্রমিকশ্রেণি তখন তাদের আন্দোলন শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দাবিদাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেনি, গোটা রাশিয়ায় লক্ষ কন্ঠে আওয়াজ তুলেছিল ” স্বৈরতন্ত্র খতম কর”। ছোটখাটো ধর্মঘটের পরিবর্তে শুরু হল সাধারণ রাজনৈতিক ধর্মঘট।
অত্যাচারী জার এর উত্তর দিল বুলেট, বেয়নেট, জেল-জুলুম দিয়ে। সংগ্রামী মজুররা হাতের কাছে ইট, পাটকেল যাহা ছিল তাই দিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিল। ফ্রান্সের বুকে শ্রমিক অভ্যুত্থান হয়েছিল, শ্রমিক বিদ্রোহ ও শ্রমিক আন্দোলন হয়েছে। সে সময় ফ্রান্সের মূল শিল্পকেন্দ্র ছিল দুটি শহরে, প্যারিস ও লিঁয়। লিঁয় কারখানার শ্রমিকরা বেতন বৃদ্ধির দাবি করেন। মালিকরা রাজি না হলে লিঁয়র শ্রমিকরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে সরকারি বাহিনীকে শহর থেকে তাড়িয়ে দেয়।এই প্রথম শ্রমিকরা অস্ত্র হাতে বিদ্রোহ করলেন এবং সশস্ত্র সংঘর্ষে বিজয়ী হলেন। ফ্রান্সের লিঁয় শ্রমিক অভ্যুত্থানের তাৎপর্য এই যে, এই প্রথম শ্রমিকশ্রেণি রাজনৈতিক ক্ষমতার জন্য সংগ্রাম করেছিল এবং সশস্ত্র পথ ধরেছিল। এই পথেই পরবর্তীকালে ১৮৭১ সালে ফ্রান্সের প্যারিসের শ্রমিকরা ইতিহাসের প্রথম শ্রমিক রাজত্ব কায়েম করেছিল।
একইভাবে জার্মানিতে শ্রমিকদের আন্দোলন হয়েছে, ইংল্যান্ডে শ্রমিকশ্রেণির ব্যাপক আন্দোলন হয়েছিল, বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা মেশিন ও কারখানা ভাঙার আন্দোলন করেছিল, কিন্তু রাষ্টযন্ত্র তাদের উপর গুলি চালিয়ে দমন করবার ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়েছিলো। তাহলে শ্রমিকশ্রেণি কোন বালকের খেলার পুতুল নয়, শ্রমিকশ্রেণিকে বলা হয় বিপ্লবের চালিকাশক্তি। আজ সারা বিশ্বে করোনা মহামারীর কারণে লকডাউনের কারণে মানুষ ঘরের বাইরে যেতে পারছে না, কিন্তু বাংলাদেশের কিছু কারখানা মালিকের মুনাফার লোভে শ্রমিকদের রাস্তায়-রাস্তায়, স্টেশনে কিংবা গাড়িতে ভিড় করে চাকরী বাঁচাতে কারখানায় আসতে বাধ্য করা হচ্ছে। মালিকশ্রেণির এই একগুঁয়েমী সিদ্ধান্তের কারণে শ্রমিকদের জীবন যেমনি সুরক্ষিত নয় তেমনি গোটা দেশে মানুষও নিরাপদ নয়। কেননা, শ্রমিকদের মাধ্যমে যদি করোনা ভাইরাস সমগ্র দেশের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এ দায়ভার কে বহন করবে? এর সমগ্র দায়ভার সরকারকেই নিতে হবে।
ভাবতেও কষ্ট লাগে, মুনাফার কাছে শ্রমিকদের জীবনকে তুচ্ছ মনে করা হচ্ছে। মানুষের জীবনের চেয়ে কি মূল্যবান কতিপয় কারখানা মালিকের সম্পত্তির অধিকার? সেই লোভী কারখানা মালিকদের দাবি প্রয়োজনে শ্রমিকদের জীবন শেষ হয়ে যাক, তবু ঘুরতেই হবে তাদের কারখানার চাকা। আপনারা কি জানেন, শ্রমিকের হাত ধরে তৈরি হয়েছে দেশের সংসদ ভবন, গণভবন, ফাইভ স্টার হোটেল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠাগুলো। এই শ্রমিকশ্রেণির হাত দিয়ে বানানো হয়েছে পোশাক কারখানায় পরিহিত কাপড়চোপড়, প্যান্ট শার্ট এবং জুতা। রাস্তা ঘাটে বাস, ট্রাক চলাচল করছে, সেই রাস্তগুলোও তৈরি হয়েছে শ্রমিকদের হাত ধরে।
ঢাকা শহর হোক কিংবা চট্টগ্রাম শহর হোক দেশের সকল বড় বড় শহরগুলো উন্নতির পথে শ্রমিকদের হাত রয়েছে। দেশের সকল স্থল বন্দরগুলো শ্রমিক ছাড়া চলে না। কারখানায় শ্রমিক না থাকলে কারখানাগুলো অচল, গোটা দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির পেছনে শ্রমিকশ্রেণিরাই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। আজ সরকার বলছে এদেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে অথবা দেশ মধ্যম আয়ের দেশে রুপান্তরিত হতে যাচ্ছে, খাদ্যের স্বয়ং সম্পূর্ণ এই বাংলাদেশ। এসবগুলো সম্ভব হয়েছে শ্রমিকদের গতর খাটিয়ে, তাদের শ্রমশক্তি বিক্রয় করে দেশের এ সাফল্য। এতো বড় মহান অবদান রেখে চলেছেন শ্রমিকরা তারপরও কি সরকার তাদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা করবে? ভাবতেও অবাক লাগে, মানবতার একি চরম সংকট!
পরিশেষে মানুষ শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে নিজেকে বিলিন করে দিয়েছে। মানুষ এই অমানবিকতার বিরুদ্ধে সরাসরি বিদ্রোহ করতে বাধ্য হয়। এর থেকে প্রমাণিত হয় যে, শ্রমিকশ্রেণি নিজেকে মুক্ত করতে সফল এবং অবশ্যই তা করবে। শ্রমিকশ্রেণি সম্পর্কে মাকর্স ও এঙ্গেলসের বিশ্লেষণ হল এই যে, শ্রমিকশ্রেণি নিজেকে মুক্ত করার সঙ্গে সঙ্গে গোটা মানবজাতিকে মুক্ত করবে। পবিত্র পরিবার গ্রন্থে দুইজন আদর্শিক বন্ধু লিখেছিলেন, “শ্রমিকশ্রেণি নিজেদের জীবনযাত্রার পরিস্থিতির ধ্বংস সাধন না করে নিজেদের মুক্ত করতে পারে না। জীবন ধারণের যে অমানবিক অবস্থা সমকালীন সমাজে রয়েছে তার সার্বিক ধ্বংস না করে শ্রমিকশ্রেণি নিজেদের জীবনযাত্রার অবস্থার অবসান করতে পারে না। শ্রমের যে পাঠশালায় শ্রমিকরা পাঠ গ্রহণ করে তা জটিল হলেও তা তাদের কঠোর কর্মক্ষম করে তোলে এবং সেটা খুবই কার্যকর হয়”।
পৃথিবীর দেশে দেশে এবং বাংলাদেশের বাস্তবতায় ও তাই পরিলক্ষিত হয় যে, এক শোষক শ্রেণির বদলে আরেক শোষক শ্রেণির ক্ষমতা দখল। জনগণের ভূমিকা এখানে কিছুটা সীমাবদ্ধ। তবে ভবিষ্যতে বিপ্লব হবে সমগ্র জনগণের স্বার্থে, তাদের সামগ্রিক মুক্তির প্রশ্নে। বিপ্লব বলতে এখানে শুধুমাত্র গতিকয়েক জনের ভূমিকা নয়, বরং গণসংগ্রামের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, ব্যাপক জনগণের অংশগ্রহণের কথা বলা হয়েছে। এই সংগ্রামে নেতৃত্ব দেবে জনগণেরই অগ্রগামী অংশ শ্রমিকশ্রেণি। যেই শ্রমিকরা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করতে জানে, সেই শ্রমিকের জীবন নিয়ে কেন এতোটাই পরিহাস করছেন। আমি শুধুই এটাই জানি, বাংলাদেশের কোন আইন এবং আন্তর্জাতিক কোন আইন অনুযায়ী চলে না শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা।
একজন গার্মেন্টস মালিক জানান, আগামীকাল যারা কারখানায় আসবে না, তারা বেতন পাবে না এমন ঘোষণা ছড়িয়ে পড়ার কারণে গ্রামে যাওয়া শ্রমিকরা ঝুঁকি নিয়ে ঢাকায় আসছেন। তবে এতে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে বলে তার ধারণা। এতো বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে জেনেও কেন তাদেরকে আসতে বলা হল? কেন ঝুঁকি নিয়ে গার্মেন্টস কারখানা খোলা হচ্ছে, এমন প্রশ্নের জবাবে কারখানা মালিক বলেন, বেতন কিন্তু শ্রমিকদের ব্যাংক হিসেব বা মোবাইল ব্যাংক হিসেবে চলে যাবে। কাজেই বেতন বিষয় নয়। বিষয় হলো- প্রণোদনা ।
তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, গার্মেন্টস মালিকদের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে প্রণোদনা চাওয়া হয়েছিল। সরকার প্রধান ঘোষণাও দিয়েছিলেন প্রণোদনার। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক যে সার্কুলার জারি করেছে, তাতে বলা হয়েছে, ৫ হাজার কোটি টাকার তহবিল থেকে আমরা ঋণ পাবো ২ শতাংশ সার্ভিস চার্জের বিনিময়ে। এটা প্রণোদনা নয়। কারণ, ঋণের টাকা ফেরত দিতে হবে। এই দুর্যোগকালীন মুহুর্তে এই ধরনের ঋণ চাইছিলাম না। চাইছিলাম প্রণোদনা, যা ফেরত দিতে হবে না। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, ২ শতাংশ ইন্টারেস্ট দিয়ে ঋণ নিতে হবে। সরকারের গাফিলতির কারণে শ্রমিকদের আজ এই বেহাল অবস্থা।
পোশাক কারখানা মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ গত ২ এপ্রিল গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানিয়ে দিয়েছে যে, ৪ এপ্রিলের পর থেকে কারখানা মালিকরা প্রতিষ্ঠান খুলতে পারবেন, কোনও বিধি নিষেধ থাকছে না। মালিকদের সংগঠনগুলোর এধরনের অদূরদর্শী বা ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে উদাসীন কর্মকর্তাদের কারণে আজ শ্রমিকদের বিপথগামীতার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। গোটা দেশের শ্রমিকদের ঝুঁকি মধ্যে ফেলে না দিয়ে বরং তাদের পেট ভরানোর দায়িত্ব নিয়ে সরকার এগিয়ে আসুক। শ্রমিকরাও এদেশের মানুষ, তারাও এদেশের নাগরিক, তাদেরও নিরাপদ জীবন পাওয়ার অধিকার আছে। তারাও অন্যান্য নাগরিকের মতোই চায় নিরাপদ জীবন।