লামায় গাছ কাটা ও চুরির অভিযোগে করোনাভাইরাসের লকডাউনের বেড়া ভেঙ্গে ২ জন ম্রো গ্রেপ্তার

হিল ভয়েস, ৩ এপ্রিল ২০২০, বান্দরবান:  বান্দরবান জেলার লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের ঢেঁকিছড়া নোয়াপাড়ার মেরিডিয়ান কোম্পানির জমিতে সশস্ত্র ম্রোদের অনধিকার প্রবেশ এবং কোম্পানীর গাছ কাটা ও চুরির অভিযোগে মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে নির্মিত লকডাউনের ঐতিহ্যবাহী বেড়া ভেঙ্গে পুলিশ গ্রামের কার্বারীসহ দুইজন ম্রো গ্রামবাসীকে গ্রেফতার করেছে বলে প্রথম আলোর বান্দরবান প্রতিনিধি বুদ্ধ জ্যোতি চাকমার ফেসবুক স্টাটাস থেকে জানা যায়।

উক্ত ফেসবুক স্টাটাস থেকে জানা যায় যে, মেরিডেয়ান কোম্পানীর অভিযোগ হচ্ছে গত ২০ মার্চ ২০২০ কোম্পানির জমিতে সশস্ত্র ম্রোরা অনধিকার প্রবেশ করে। রাবার বাগানের জন্য ইজারা নেওয়া জমি থেকে আকাশমনি গাছ কাটে ২৫০টি, চুরি করে আরো ১৫০টি গাছ। চুরি হওয়া ১৫০টি গাছের মূল্য সাত লাখ টাকা। নষ্টকৃত ১০০টি গাছের মূল্য পাঁচ লাখ টাকা। এই অভিযোগ এনে কার্বারীসহ (গ্রামপ্রধান) আটজন পাড়াবাসীর বিরুদ্ধে ২৯ মার্চ ২০২০ লামা থানায় মামলা করে মেরিডিয়ান কোম্পানী।

পুলিশের ভাষায় ভয়ঙ্কর এসব সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করতে ৩ এপ্রিল ২০২০ ভোরে পুলিশ করোনাভাইরাস প্রতিরোধে নির্মিত পাড়ার ঐতিহ্যবাহী লকডাউন ভেঙ্গে গ্রামে প্রবেশ করে। পুলিশ ঢেঁকিছড়া নোয়াপাড়ার লকডাউনের বেড়া ভেঙ্গে পাড়ায় ঢোকে। কার্বারীসহ দুইজনকে ধরে নিয়ে যায়। ম্রো গ্রামবাসীরা বলেছেন, করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে তাঁরা ঐতিহ্যগত নিয়মে দুর্যোগকালীন পাড়াবন্ধ বা পুয়াভং করেছেন। সেটি পুলিশ ভেঙ্গে দিয়েছে।

বুদ্ধজ্যোতি চাকমা তার ফেসবুক স্টাটাসে উল্লেখ করেন যে, সরকারি নির্দেশ আছে করোনাভাইরাসে লকডাউন চলাকালে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী, জনশৃঙ্খলা ভঙ্গের ভয়াবহ আসামি না হলে সাধারণ মামলায় কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে না।

ঢেঁকিছড়া নোয়াপাড়ার নিরীহ ম্রোদের বিরুদ্ধে মেরিডিয়ান এগ্রো লিমিটেড কোম্পানির অভিযোগ আজকের নয়। কোম্পানি কয়েক বছর ধরে পাড়াটি উচ্ছেদের চেষ্টা করছে। একবার তো এক সপ্তাহের মধ্যে পাড়া ছেড়ে চলে না গেলে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার আলটিমেটামও দিয়েছিল। গত বছরের জুলাইয়ের শেষের দিকে লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে এসে পাড়াবাসীর সমস্ত জমি দখলের চেষ্টা করেছে। এ সময় ম্রোরা বান্দরবানের ডেপুটি কমিশনারসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করেছিলেন। এছাড়া বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ ঘটনার সংবাদ প্রকাশিত হলে প্রশাসন নড়েচড়ে বসে।

গ্রামের ম্রোদের অভিযোগ হচ্ছে, সরকারি দপ্তরের অসাধু কেউ কেউ কোম্পানির ভাড়াতে হয়ে কাজ করে। কারণ টাকা যার কাছে আইন তার হাতে। এজন্য এখন ম্রোদের আতঙ্কের আরেক নাম আইন। এ আইন দিয়ে তাদের ফাঁসানো হয় ও হচ্ছে।

মেরিডিয়ান কোম্পানির দাবি হচ্ছে, ১৯৯৪ সালে রাবার বাগানের জন্য ইজারা নেওয়া তিন হাজার একরের অধিক জমির কাগজ তাদের রয়েছে। ম্রোরা বলেছেন, যেখানে তারা বসবাস করছেন সেটি বাপ-দাদা চৌদ্দ পুরুষের জুম চাষের জমি। কাগজ দেখালে কী জমি কারো হয়ে যায়? রাবার বাগানের জন্য ইজারা নেওয়া জমিতে রাবার ছাড়া অন্য কিছু করা যাবে না ইজারাশর্তে বলা আছে। তাও ইজারার ১০ বছরের মধ্যে রাবার বাগান করতে না পারলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইজারা বাতিল হবে। তাহলে রাবার বাগানে ইজারা প্লটে আকাশমনি গাছ কাটলো কোথা থেকে? কাটলে তো রাবার গাছ কাটার কথা।

ম্রোরা বলেছেন তাঁরা জুম কাটছিলেন তাঁদের জুমের জমিতে। বাড়ি মেরামতের জন্য বন থেকে ১০-১২টি গাছ কেটেছেন। সেটি কোম্পানি দাবি করছে বাগানের গাছ। সেগুলো বাগানের গাছ নয়, বনের গাছ বলে জানান ম্রোরা।

পাড়ার ইনচ্যং ম্রোরা জানিয়েছেন করোনাভাইরাস প্রতিরোধে লামায় ২৪ মার্চ রাত ৮ টা থেকে লকডাউন ঘোষণা করেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), কক্সবাজারে একজন করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার কারণে। কিন্তু ২৫ মার্চ ভোরে কোম্পানি নামধারী ভূমিদখলদাররা পাড়ায় পুলিশ নিয়ে আসে। পুলিশ কয়েকজন পাড়াবাসীকে ধরে নেওয়ার চেষ্টা করে। করোনা ভয়াবহতায় ২৭ মার্চ থেকে ম্রোরা পাড়া লকডাউন করেছে। পাড়াবন্ধের সময়ে কোম্পানির লোকজন হুমকি-ধামকি দিয়ে আসছিল। সেই ধারাবাহিকতায় ৩ এপ্রিল শুক্রবার পুলিশ এসে লকডাউন ভেঙে পাড়ায় ঢোকে। পাড়ার কার্বারী লংকম ম্রোসহ দুইজনকে ধরে নিয়ে যায়।

ঠিক যেন উনবিংশ শতাব্দির শেষার্ধে বিরসা মুন্ডাদের মতো অবস্থা। দিকুরা পুলিশ ও প্রশাসন দিয়ে কাগজ বা দলিল তৈরি করে মুন্ডাদের মুরুারিজগতকে কেড়ে নিয়েছিল। ম্রোদেরও সেই একই অবস্থা করেছে ও করছে কোম্পানি নামধারী ভূমিদস্যু দিকুরা। প্রশাসনের তৈরি করা দলিলে ম্রোরা বাপ-দাদা চৌদ্দগোষ্ঠী ধরে বসবাসের জায়গা-জমিতে দখলদারে পরিণত হয়েছে। দিকু দস্যুরা হয়েছে ভূমির মালিক! কী সেলুকাস! এ দেশে কি এখনও উপনিবেশিকরা রয়ে গেছে? এমন প্রশ্ন রেখেছেন সিনিয়র সাংবাদিক বুদ্ধ জ্যোতি চাকমা।

More From Author