হিল ভয়েস, ১০ এপ্রিল ২০২০, রাঙ্গামাটি: মহামারী করোনাভাইরাসের বিস্তার জীবন-মরণের আতঙ্কের মধ্যে এবং লকডাউনের কারণে ঘরবন্দী ও খাদ্য সংকটের মুখেও পার্বত্য চট্টগ্রামে শুরু হয়েছে জোরদার সেনা অপারেশন। রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলাধীন বাঘাইছড়ি উপজেলার সার্বোয়াতলী ও সাজেক ইউনিয়নে, রাঙ্গামাটি সদর উপজেলার বালুখালি ইউনিয়নে এবং রাজস্থলী সদরের বিভিন্ন গ্রামে সেনাবাহিনী এই অভিযান পরিচালনা করছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
করোনাভাইরাস মোকাবেলায় চলমান লকডাউনের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত গ্রামে গ্রামে চলছে খেটে-খাওয়া জুম্ম গ্রামবাসীর খাদ্য সংকট, অন্যদিকে ফেব্রুয়ারি শেষান্ত থেকে চলছে হামে আক্রান্ত হয়ে সাজেকসহ অন্তত ৭টি উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে শিশুদের মৃত্যুর মিছিল। গ্রামে গ্রামে চলছে হাহাকার। এমনি সংকটকালে সেনাবাহিনীর এ ধরনের তল্লাসী পার্বত্য জনপদে সৃষ্টি হয়েছে চরম আতঙ্ক ও উদ্বেগ।
জানা গেছে, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা শহরের নিকটবর্তী বালুখালি ইউনিয়নের বাদলছড়ি গ্রামে বিভিন্ন সেনাক্যাম্প থেকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে এসে প্রায় একশ জনের এক সেনাসমাবেশের খবর পাওয়া গেছে। এতে সংশ্লিষ্ট এলাকার জনগণের মাঝে দেখা দিয়েছে নানা উদ্বেগ ও আশঙ্কা।
গত ৬ এপ্রিল ২০২০ সকাল ৯টার দিকে রাঙ্গামাটি সদর উপজেলাধীন বালুখালী ইউনিয়নের মরিচ্যাবিল সেনাক্যাম্প হতে সুবেদার মো: মজিবর রহমানের নেতৃত্বে ৭ কমান্ডো গ্রুপের ১০/১৫ জনের সেনাবাহিনীর একটি দল কাইন্দ্যা-বাদলছড়ি এলাকায় আসে। সেখানে এসে সুবেদার মজিবর রহমান বালুখালী ইউনিয়নের জনৈক এক ইউপি মেম্বারকে বলেন যে, ‘আমাদের লোক আরো আসবে।’ সেখানে তিন/চার ঘন্টা অবস্থান করার পর সেনাদলটি ক্যাম্পে ফিরে যায়।
এরপর গত ৭ এপ্রিল ২০২০ সকাল আনুমানিক ৮টার দিকে ৭ কমান্ডো রাঙ্গামাটি সদর সেনাজোন ও মরিচ্যাবিল সেনাক্যাম্প হতে যৌভাবে ৩০/৩৫ জনের একটি সেনাদল বাদলছড়ি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আসে। অপরদিকে একই দিনে রাঙ্গামাটি সদর সেনাজোন হতে বিকাল বেলায় দুটি ট্রলারে করে ৩৫/৪০ জনের আরও একটি সেনাদল উল্লিখিত স্কুলে এসে উপস্থিত হয়। এছাড়া প্রায় একই সময়ে সুবলং সেনাক্যাম্প হতে আরও ১২ জনের একটি সেনাদল এসে যোগ দেয়। সব মিলিয়ে প্রায় একশ জনের এক সেনাসমাবেশ ঘটানো হয়েছে। তাদের সাথে সাদা পোষাকে সংস্কারপন্থী সদস্যরাও রয়েছে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, সেনাবাহিনীর সদস্যরা বর্তমানে তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে তিনটি স্থানে টাবু টাঙিয়ে অবস্থান করছে। সেই তিনটি স্থান হল- এ্যাডভোকেট মৃণাল কান্তি চাকমার সেগুন বাগান (যা কাইন্দ্যা-বাদলছড়ি সীমানায় অবস্থিত), ঈশ্বরচন্দ্র চাকমার সেগুনবাগান ও বাদলছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেনা সদস্যরা বালুখালীর ধুততাং, কাইন্দা বামেছড়া, বাদলছড়ি, ভিজেহিজিং, হারেক্ষ্যং, হান্দেবোছড়া ইত্যাদি এলাকায় টহল দেয়। সেনা সদস্যরা স্থানীয় জনগণের সাথে উদ্যত ভাষায় কথাবার্তা বলছে। এক সপ্তাহব্যাপী সেখানে অবস্থান করবে বলে জানা যায়। ১০ মার্চ সকালে একটা বোট যোগে বাদলছড়িতে এসে সেনারা টহল দেয় এবং সেনা সদস্যদের সাথে মুখোশ পরা সংস্কারপন্থীদের ৭/৮ জনের একদল সদস্যরাও ছিল বলে জানা যায়।
গত ৯ মার্চ ২০২০ রাতে ১০ টায় বাঘাইছড়ি উপজেলাধীন সারোয়াতুলী ইউনিয়নে ৩নং ওয়ার্ডের শিজক গোলাচিপা এলাকায় মাইনী (লংগদু) ২১ বীর সেনা জোনের অধীনে শিজক আর্মি ক্যাম্প ও দুরছড়ি বাজার আর্মি ক্যাম্প, নিউ ফরেস্ট বিজিবি (চিন্তারাম ছড়া) ক্যাম্পের সেনা ও বিজিবি সদস্যরা যৌথভাবে অভিযান পরিচালনা করে। এসময় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা গ্রামের ৫টি বাড়ি তল্লাশি করে। তল্লাসীকৃত বাড়ির মালিকদের নাম হল বিনয় কুমার চাকমা, রত্নধর চাকমা, ব্যাঙা চাকমা, সুশীল জীবন চাকমা ও সোহেল চাকমা। একই উপজেলার সাজেক ইউনিয়নের প্রত্যক্ষ এলাকায় সেনাবাহিনীর টহল ও তল্লাসী চলছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
অপরদিকে গত ৯ মার্চ ২০২০ বিকাল ৩টা থেকে প্রায় তিনঘন্টা পর্যন্ত রাঙ্গামাটি জেলার রাজস্থলী ক্যাম্পের ২৩ বেঙ্গলের জনৈক মেজরের নেতৃত্বে একদল সেনা জনসংহতি সমিতির রাজস্থলী থানা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক সুভাষ তঞ্চঙ্গ্যার মহবত পাড়াস্থ বাড়ি ঘিরে রাখে। সেসময় সেনা সদস্যরা সুভাষ তঞ্চঙ্গ্যার বাড়ি তল্লাসী চালায় এবং জিনিসপত্র তছনছ করে। তাকে না পেয়ে সেনা সদস্যরা সুভাষ তঞ্চঙ্গ্যার পাসপোর্ট ও কিছু কাগজপত্র নিয়ে যায় এবং সুভাষ তঞ্চঙ্গ্যাকে তাদের কাছে হাজির করে দিতে নির্দেশ দিয়ে যায় বলে জানা যায়। সেসময় সেনা সদস্যরা রাজস্থলী সদরস্থ মৈত্রী পাড়ার হৃদয় কুমার তঞ্চঙ্গ্যার বাড়িও তল্লাসী চালায় বলে জানা যায়।
যে মুহূর্তে জনগণের মধ্যে একদিকে করোনাভাইরাস নিয়ে আতঙ্ক ও জন চলাচলে সীমাবদ্ধতা, অপরদিকে গ্রামে নানা অভাব-অনটনসহ আর্থ-সামাজিক জীবনে স্থবিরতা, এমন সময়ে মরার উপর খরার ঘা-এর সেনাবাহিনীর তল্লাসী অভিযান শুরু করেছে। করোনাভাইরাস মোকাবেলায় চলমান লকডাউন চলাকালে যেহেতু মানুষজনের চলাচলে বাধানিষেধ জারি রয়েছে সেহেতু তল্লাসী অভিযানের নামে সহজে নিরীহ গ্রামবাসীদের ধরপাকড় করা ও ঘরবাড়ি তল্লাসী চালানো সহজ হবে বিধায় করোনাভাইরাসের দু:সময়েও সেনাবাহিনী এই অভিযান পরিচালনা করছে বলে স্থানীয় জনগণ মনে করছে। উল্লেখ্য, সাম্প্রতিককালে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় সেনা অভিযান, বাড়ি তল্লাশি, নিরীহ পাহাড়ি আটক ও নিপীড়ন বৃদ্ধি পেয়েছে।
উল্লেখ্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য এলাকার ৬টি স্থায়ী সেনানিবাস বাদে সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহারের বিধান রয়েছে। তদনুসারে চুক্তি স্বাক্ষরের অব্যবহিত পরে তৎকালীন সরকার ৬৬টি অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার এবং ২০০৯ সালে বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর আরো ৩৫টি অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার করলেও পরবর্তীতে অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণভাবে বন্ধ রেখেছে। এখনো পার্বত্য চট্টগ্রামে চার শতাধিক অস্থায়ী ক্যাম্প রয়েছে বলে জনসংহতি সমিতি দাবি করে আসছে।
উপরন্তু সরকার আরও নতুন সেনাক্যাম্প স্থাপন করে চলেছে। এটি পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার শান্তিপূর্ণ ও রাজনৈতিক সমাধানের প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করা, চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে জুম্মদের অধিকারকে অস্বীকার করা এবং পরিস্থিতিকে জটিল করে জুম্মদের জাতীয় অস্তিত্ব ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র বৈ কিছু নয়। সেই ষড়যন্ত্রেরই অংশ হিসেবে এই সেনাক্যাম্প স্থাপন করা হচ্ছে বলে মনে করেন স্থানীয় জনগণ।
চুক্তি বাস্তবায়ন বন্ধ রাখার পাশাপাশি এভাবে পাহাড়ে সেনা মোতায়েন, অভিযান পরিচালনা এবং নতুন নতুন ক্যাম্প স্থাপন উদ্বেগজনক এবং পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের পথে বড় বাধা বলে মনে করেন স্থানীয় জনগণ।