হিল ভয়েস, ২৫ এপ্রিল ২০২০, রাঙ্গামাটি: পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের দোহাই দিয়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) অভিনব ও হাস্যকরভাবে একটি ক্যাম্প প্রত্যাহারের সাইনবোর্ড টাঙিয়েছে। বিজিবির ভাষায় ‘শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে’ ক্যাম্পটির প্রত্যাহারের কথা বলা হলেও পার্বত্য চুক্তি সম্পর্কে তাদের চরম অজ্ঞতারই বহি:প্রকাশ ঘটেছে বলে অনেকে অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায় যে, গত ২৩ এপ্রিল ২০২০ রাঙ্গামাটি জেলার বরকল উপজেলাধীন আইমাছড়া ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের করল্যাছড়ি মৌজার দশরথ পাড়া বিজিবি ক্যাম্পের বিজিবি সদস্যরা একই এলাকায় কালাপুনোছড়ায় স্থানান্তর হয়েছে।
কিন্তু বিজিবির পক্ষ থেকে টানানো ‘সতর্কীকরণ বোর্ডে’ বলা হয়েছে যে, “শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে প্রত্যাহারকৃত নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্পে অবৈধ অনুপ্রবেশ নিষিদ্ধ”।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ‘ঘ’ খন্ডের ১৭(ক) ধারায় বলা হয়েছে যে, “সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে চুক্তি সই ও সম্পাদনের পর এবং জনসংহতি সমিতির সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আসার সাথে সাথে সীমন্তরক্ষী বাহিনী (বিডিআর) ও স্থায়ী সেনানিবাস (তিনজেলা সদরে তিনটি এবং আলিকদম, রুমা ও দীঘিনালা) ব্যতীত সামরিক বাহিনী, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সকল অস্থায়ী ক্যাম্প পার্বত্য চট্টগ্রাম হইতে পর্যায়ক্রমে স্থায়ী নিবাসে ফেরত নেওয়া হইবে এবং এই লক্ষ্যে সময়-সীমা নির্ধারণ করা হইবে।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আঞ্চলিক পরিষদের একজন সদস্য বলেন, পার্বত্য চুক্তির উল্লেখিত ধারায় বিজিবি (পূর্বতন বিডিআর) ক্যাম্প প্রত্যাহারের কথা বলা হয়নি। তাই কোন অর্থে এই দশরথ বিজিবি ক্যাম্পের সদস্যদেরকে পার্শ্ববর্তী অন্য বিজিবি স্থানান্তরকে “শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে প্রত্যাহার” বুঝানো হয়েছে তা বোধগম্য নয়। এভাবেই নিরাপত্তা বাহিনীগুলো ও বর্তমান সরকার পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়টা বিভ্রান্তমূলকভাবে উপস্থাপন করে অপপ্রচার চালিয়ে থাকে বলে তিনি জানান।
আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য আরো উল্লেখ করেন যে, পার্বত্য চুক্তিতে বিজিবি ও ৬টি স্থায়ী সেনানিবাস ব্যতীত অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যহারের কথা রয়েছে। উপরন্তু চুক্তি স্বাক্ষরের পর চুক্তিকে লঙ্ঘন করে তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকার ২০০১ সালে ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামে একপ্রকার সেনাশাসন জারি করে। চুক্তি অনুসারে উক্ত সেনাশাসন সর্বাগ্রে প্রত্যাহার করা জরুরী বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন। অপারেশন উত্তরণ-এর মতো সেনাশাসন সহ এখনো পার্বত্য চট্টগ্রামে চার শতাধিক ক্যাম্প পার্বত্য চট্টগ্রামে বলবৎ রয়েছে বলে উক্ত জনপ্রতিনিধি জানান।
চুক্তির উক্ত খন্ডের ১৭(খ) ধারায় আরো বলা হয়েছে, “সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীর ক্যাম্প ও সেনানিবাস কর্তৃক পরিত্যক্ত জায়গা-জমি প্রকৃত মালিকের নিকট অথবা পার্বত্য জেলা পরিষদের নিকট হস্তান্তর করা হইবে।”
স্থানীয় সূত্রে জানা যায় যে, প্রত্যাহৃত ক্যাম্পের জায়গার মালিক সংঘরাজ কার্বারীর ছেলে জ্ঞান রতন চাকমাকে ডেকে ক্যাম্প কর্তৃপক্ষ জায়গাটি বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন, কিন্তু আবার সাইনবোর্ড টানিয়ে “প্রত্যাহারকৃত নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্পে অবৈধ অনুপ্রবেশ নিষিদ্ধ” ঘোষণা দিয়ে গেছে বিজিবি।
তার অর্থ হচ্ছে উক্ত জায়গার মালিকরা উক্ত জায়গায় যেতে পারবে না এবং কোন ঘরবাড়ি নির্মাণ বা বাগান-বাগিচা গড়ে তুলতে পারবেন না। এককথায় উক্ত ক্যাম্পের জায়গাটি এখনো বিজিবি পুরোপুরি হস্তান্তর করেনি। এটাই হচ্ছে পার্বত্য চুক্তির সরাসরি বরখেলাপ।
পার্বত্য চুক্তিকে লঙ্ঘন করে ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামক একপ্রকার সেনাশাসন জারির ফলে সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে একদিকে অবাধে ধরপাকড়, তল্লাসী, মারধর, বিচার-বহির্ভূত হত্যা চালিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, ভূমি, উন্নয়নসহ সকল বিষয়ে হস্তক্ষেপ এবং চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে চলেছে।