উদয়ন তঞ্চঙ্গ্যা
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় আদিবাসী জুম্ম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলটি অন্যায়ভাবে ইসলামি রাষ্ট্র পাকিস্তানের সাথে সংযুক্ত করা হয়। তৎসময়ে জুম্ম জনগণ তাৎক্ষণিকভাবে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের এহেন অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। তারা ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ ভারতের সাথে যুক্ত হওয়ার অভিপ্রায়ে রাঙামাটিতে ভারতীয় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন এবং এই উদ্দেশ্যে তৎকালীন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বের নিকট একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণ করেন। কিন্তু তৎকালীন ভারতীয় নেতৃত্ব পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের এই দাবির প্রতি খুব বেশি গুরুত্ব প্রদান করেনি।
ফলত ১৭ আগস্ট ১৯৪৭ অসুমলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে যুক্ত করা হয় মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের সাথে। সংযুক্তির অব্যবহিত পরেই, অমুসলিম অধ্যুষিত এলাকাকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করার নীল-নকশা প্রণয়ন শুরু করা হয় এবং ব্রিটিশ প্রবর্তিত পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি ১৯০০-কে পঙ্গু করে দেওয়ার কাজ শুরু হয়। ১৮৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত স্থানীয় ট্রাইবাল পুলিশ বাহিনী ভেঙে দেওয়া হয়; ইনার-লাইন পারমিট ব্যবস্থা বাতিল করা হয়; এবং অনুপ্রবেশের সুযোগ পেয়ে, পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি ১৯০০ লংঘন করে পূর্ব পাকিস্তানে আশ্রিত ভারত-প্রত্যাগত মুসলিম শরণার্থীদের পার্বত্য চট্টগ্রামে অবৈধ বসতিস্থাপন কর্মসূচি শুরু করা হয়। ফলশ্রুতিতে এসমস্ত কিছু পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্বাভাবিক ও ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টির দিকে ধাবিত হয়।
১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে ব্রিটিশ-প্রবর্তিত পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি ১৯০০ স্বীকৃত হলেও, ১৯৫৪ সালেই পাকিস্তান সরকার ইসলামিকরণ বাস্তবায়নের হীন উদ্দেশ্য নিয়ে জুম্ম জনগণের মতামতকে যাচাই ব্যতিরেকে কাপ্তাইয়ে কর্ণফুলী নদী বরাবর একটি বাঁধ নির্মাণ করার ষড়যন্ত্র শুরু করে। এই বাঁধ নির্মাণের ফলে ২৫০ বর্গমাইল পরিমাণ উর্বর ও বিকাশশীল জমি প্লাবিত হয় এবং এক লক্ষ জুম্ম জনগণ উদ্বাস্তু হয়। চলমান পরিস্থিতির কারণে ৪০ হাজার জুম্ম ভারতে, পক্ষান্তরে ২০ হাজার জুম্ম মিয়ানমারে অভিবাসিত হতে বাধ্য হয়।
এমনকি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরও অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করার পাকিস্তানি পরিকল্পনা অব্যাহতভাবে চলতে থাকে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পরপরই সরকারের ছত্রছায়ায় হাজার হাজার মুসলিম পরিবার পার্বত্য চট্টগ্রামে, বিশেষ করে খাগড়াছড়ি জেলার ফেনী উপত্যকায় অনুপ্রবেশ করে। পক্ষান্তরে সরকার জুম্ম জনগণের উপর একের পর এক দমনমূলক নীতি গ্রহণ করতে শুরু করে। এলক্ষ্যে সরকার ১৯৭৩ সালে দীঘিনালা, আলিকদম ও রুমায় তিনটি সেনানিবাস প্রতিষ্ঠা করে। রাজাকার ও মুজাহিদীন দমনের নামে নিরীহ জুম্ম জনগণের উপর নেমে আসে বহুমুখী নৃশংসতা, দমন ও পীড়ন।
জোরালো প্রতিবাদ সত্ত্বেও, ১৯৭২ সালের সংবিধানে অবাঙালি জুম্ম জনগণকে বাঙালি হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। ১৯৭৮ সালে এই বিতর্কিত ও বর্ণবাদী ধারা পরিবর্তন করা হলেও, আওয়ামীলীগ-নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকার ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী এনে “বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি বলিয়া পরিচিত হইবেন” মর্মে উক্ত ধারা পুনপ্রবর্তন করে, যা আবারও জুম্ম জাতিগোষ্ঠীসহ অবাঙালি জাতিগোষ্ঠীগুলোর বাঙালিকরণের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। অধিকন্তু ১৯৭৯ সালে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের শুরুতে বিস্মিল্লাহির-রহমানির রহিম (দয়াময়, পরম দয়ালু, আল্লাহের নামে) অন্তর্ভুক্ত করা হয়। উপরন্তু ১৯৮৮ সালে অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে “ইসলাম”কে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করা হয়। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা লংঘন করে, বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকার পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে সংবিধানের শুরুতে ‘বিস্মিল্লাহির-রহমানির রহিম’ এবং রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ‘ইসলাম’ বিধানাবলী বজায় রাখে। সংবিধানে এইসব সংশোধনী কেবল ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে পঙ্গু করেছে তা নয়, উপরন্তু রাষ্ট্রীয় নীতিতে ইসলামীকরণের প্রক্রিয়াকে আরও জোরদার করেছে।
দেশ বিভাগের সময় পাকিস্তানের জন্ম দেয়া ইসলামিকরণ ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখে সেনাবাহিনীর সক্রিয় সহায়তায় ১৯৭৯ হতে ১৯৮৫ সময়কালের মধ্যে সরকারি পরিকল্পনা ও আর্থিক সহায়তায় সমতলের ৫ লক্ষাধিক মুসলিম লোকজনকে জুম্ম জনগণের বাস্তুভিটা ও জায়গা-জমিতে বসতি প্রদান করা হয়। ১৯৮০ সালে, ‘অপারেশন দাবানল’ ঘোষণা করে পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি প্রকপ্রকার সামরিক শাসন প্রবর্তন করা হয়। এইভাবে সামরিক দমন-পীড়ন ত্বরান্বিত করে, বহিরাগতদের কর্তৃক অবৈধ বসতিস্থাপন, অবৈধ ভূমি বেদখল এবং জুম্ম জনগণকে তাদের পূর্বপুরুষের ভূমি ও ভিটেমাটি থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ দ্বারা জুম্ম জনগণকে সংখ্যালঘু করে, সাম্প্রদায়িক হামলা ঘটিয়ে, গণহত্যা সংঘটিত করে, সামরিক নিয়ন্ত্রণাধীনে তথাকথিত উন্নয়ন, নির্বিচার গ্রেফতার, নারীর উপর সহিংসতা ইত্যাদি ভুল ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নীতি অবলম্বনের কারণে তৎকালীন শাসকশ্রেণির অধীনে পার্বত্য চট্টগ্রামের সংকট জটিল থেকে আরও জটিল হয়ে উঠে। ফলশ্রুতিতে এধরনের দমন, নৃশংসতা ও অবিচার থেকে মুক্তি পেতে এবং নিরাপত্তার আশায়, ১৯৭৮ সাল থেকে এক লক্ষাধিক আদিবাসী জুম্ম ভারত ও মিয়ানমারে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরও পার্বত্য চট্টগ্রামে ইসলামীকরণ বন্ধ হয়নি। সমতল ভূমি থেকে মুসলিম জনগোষ্ঠী ও মিয়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে অনুপ্রবেশ অব্যাহতভাবে চলছে। চুক্তি স্বাক্ষরের পর ২২ বছর অতিক্রান্ত হলেও, সরকার এখনও পর্যন্ত চুক্তির মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো অবাস্তবায়িত অবস্থায় রেখে দিয়েছে। বর্তমানে এই আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ১১ বছর যাবৎ একনাগাড়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলেও এখনও পর্যন্ত অবাস্তবায়িত বিষয়সমূহ বাস্তবায়নে কোন কার্যকর উদ্যোগ ও পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। বিপরীতে, সরকার একদিকে ইসলামীকরণ নীতি বাস্তবায়ন এবং অপরদিকে জুম্ম জনগণের জাতীয় পরিচিতি একেবারে বিলুপ্ত করার জন্য অব্যাহতভাবে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। ২০০১ সাল থেকে ‘অপারেশন দাবানল’ এর পরিবর্তে ‘অপারেশ উত্তরণ’ প্রতিস্থাপন করে পার্বত্য চট্টগ্রামে একপ্রকার সামরিক শাসন জারী রাখা হয়েছে।
বস্তুত জুম্ম জাতিকে চিরতরে নির্মূল করার হীনউদ্দেশ্য নিয়ে, সরকার তার ইসলামিকরণের ষড়যন্ত্র কার্যকর করে চলেছে। চুক্তি-পরবর্তী সময়ে, সেনাবাহিনী ও সরকারি বাহিনীর সহায়তায় খাগড়াছড়ি জেলার বিভিন্ন এলাকায় মুসলিম সেটেলারদের গুচ্ছগ্রাম সম্প্রসারণ করা হয়েছে এবং ২০০৭ সালে সাইক্লোন সিডর ও ২০০৯ সালে আইলা’র অনেক ক্ষতিগ্রস্ত মুসলমানদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে লংঘন করে তিন পার্বত্য জেলায় বসতি প্রদান করা হয়। বর্তমানে ক্ষমতাসীন দল, সরকার এবং সরকার-নিয়ন্ত্রিত নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ ও প্রতিরক্ষা বিভাগের বিশেষ মহল নিয়ে গঠিত একটি কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বকে ধ্বংস করা এবং চুক্তি বাস্তবায়নে পরিচালিত সকল কর্মসূচি প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে, চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে অকার্যকর করতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। চুক্তি পরবর্তী কালে জুম্ম জাতিগোষ্ঠীর ভূমি বেদখল ও তাদের পূর্বপুরুষের বাস্তুভিটা থেকে তাদেরকে উচ্ছেদ করার লক্ষ্যে সরকারি দল ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য পৃষ্টপোষকতায় উগ্র সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী এবং উগ্রজাতীয়তাবাদী শক্তিকে আদিবাসী জুম্ম জাতিগোষ্ঠীর উপর ২০টি সাম্প্রদায়িক হামলা চালাতে দেখা গেছে। যখনি আদিবাসী জুম্ম জনগণের উপর সাম্প্রদায়িক ও অগ্নিসংযোগের হামলা এবং তাদের ভূমি অবৈধভাবে দখলের ঘটনা ঘটে, রাজনৈতিক অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গি নির্বিশেষে জাতীয় রাজনৈতিক দলসমূহকে সংঘবদ্ধ ও সুসংগঠিতভাবে সামরিক বাহিনী সমর্থিত মুসলিম সেটেলারদের সংগঠনের এককাতারে সামিল হতে দেখা যায়। যদিও জাতীয় পর্যায়ে জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিদ্বেষমূলক প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিরাজ করে, কিন্তুপার্বত্য চট্টগ্রামে ইসলামীকরণ কর্মসূচি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তারা সকলেই হাতে হাত রেখে সংঘবদ্ধভাবে ভূমিকা রেখে চলেছে।
বর্তমান হাসিনা-নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার অমুসলীম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি নিরঙ্কুশ মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করার উদ্দেশ্যে জাতিগতভাবে নির্মূলীকরণ কর্মসূচি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বেসামরিক আমলা, সামরিক, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থাসমূহ ও বিচার ব্যবস্থা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রযন্ত্রের সকল পর্যায় পর্যন্ত সকল শক্তিসমূহ নিবিঢ়ভাবে ব্যবহার করে চলেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্বত্র মুসলিম সেটেলারদের সংগঠিত করে, পার্বত্য গণপরিষদ, পার্বত্য বাঙালি ছাত্র পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমঅধিকার আন্দোলন, বাঙালি ছাত্র ঐক্য পরিষদ ইত্যাদি নামে উগ্রসাম্প্রদায়িক ও উগ্রজাতীয়তাবাদী সংগঠনের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক কর্মকান্ড পরিচালিত হয়ে আসছে, যারা সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ নামে সম্মিলিতভাবে একটি একক সংগঠন গঠন করে। এই উগ্রসাম্প্রদায়িক ও উগ্রজাতীয়তাবাদী সংগঠন প্রতিষ্ঠার পর পরই সংগঠনের ব্যানারে মুসলিম সেটেলাররা ভূমি কমিশনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার লক্ষ্যে গত ২৩ ডিসেম্বর ২০১৯ রাঙ্গামাটিতে ব্যারিকেড দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান-সদস্যদের গাড়িবহর অবরোধ করে।
অপরপক্ষে সরকারের পৃষ্টপোষকতায় মুসলিম সেটেলারদের সহযোগিতায় মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তিসমূহ উগ্রসাম্প্রদায়িক ও উগ্রজাতীয়তাবাদী শ্লোগান তুলে জুম্ম জনগণের উপর সংগঠিত হামলা, অগ্নিসংযোগ, জোরপূর্বক ভূমি দখল, ভূমি থেকে উচ্ছেদ, ধর্মীয় নিপীড়ন, নারীর উপর সহিংসতা ইত্যাদি মানবতাবিরোধী অপকর্ম অব্যাহতভাবে সংঘটিত করার মধ্য দিয়ে মুসলিম-আধিপত্যবাদী কর্মসূচি কার্যকর করে চলেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইসলামিক ফ্রন্ট, যুবসেনা ও ছাত্রসেনা নামে ইসলামী মৌলবাদী জঙ্গী ও সাম্প্রদায়িক দলসমূহকে তিন পার্বত্য জেলায় বেশ সক্রিয় থাকতে দেখা যায়। এই ইসলামিক সংগঠনসমূহ স্থানীয় প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনীর আশ্রয়-প্রশ্রয়ে তাদের মৌলবাদী কর্মসূচি পরিচালনা করে চলেছে।
ব্যাপক সংখ্যক রোহিঙ্গা বান্দরবান জেলাধীন নাইক্ষ্যংছড়ি, লামা, আলিকদম ও বান্দরবান সদর উপজেলায় এবং রাঙ্গামাটি জেলাধীন রাজস্থলী ও রাঙ্গামাটি সদর উপজেলায় অনুপ্রবেশ করে। তাদেরকে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, জাল স্থায়ী বাসিন্দা সনদ এবং চাকরি সুবিধা প্রদান করা হয়েছে, যার চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো আদিবাসী জুম্ম জাতিগোষ্ঠীর উচ্ছেদকরণ। ২০১২ সালের মে মাসে ও ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে রাখাইন রাজ্যে জাতিগত সহিংসতা ব্যাপক আকার ধারণ করার পর পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জেলায় আবার রোহিঙ্গা মুসলিমদের অনুপ্রবেশ জোরদার হয়েছে। তারা স্থল সীমান্তের মধ্য দিয়ে বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি, আলিকদম, লামা ও থানচিতে প্রবেশ করেছে। কেবল বান্দরবান জেলায় আনুমানিক ৩০,০০০ এর অধিক রোহিঙ্গা বসতিস্থাপন করেছে। অপরদিকে ২০১৭ সালে রাঙ্গামাটি জেলাধীন ৭ উপজেলায় মোট ১২০ রোহিঙ্গা মুসলিম পরিবারের খোঁজ পাওয়া যায় এবং খাগড়াছড়ি জেলায় ৫৬ পরিবার রোহিঙ্গা খুঁজে পাওয়া যায়।
অপরদিকে প্যান ইসলামিক প্ল্যান অনুযায়ী দেশকে একটি ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশে নানা ইসলামিক জঙ্গী গ্রুপকে সক্রিয় থাকতে দেখা যায়। আন্তর্জাতিক ইসলামিক জঙ্গী গ্রুপের সাহায্য ও সহযোগিতায়, বাংলাদেশী ইসলামিক জঙ্গী গ্রুপগুলো জনগণের মধ্যে সদস্য সংগ্রহ, প্রশিক্ষণ প্রদান ও ইসলামি মৌলবাদী আদর্শ প্রচারের ক্ষেত্রে সুকৌশলে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে চলেছে। এটা প্রতীয়মান হয় যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি বিরাজ থাকায় এইসব জঙ্গী গ্রুপগুলো কোন প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই রাষ্ট্রযন্ত্রে ছত্রছায়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামে তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বকে বিবেচনা করে, এই জঙ্গী গ্রুপগুলো পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড় ও অঞ্চলসমূহে তাদের ঘাঁটি স্থাপনের যুৎসই স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে অনুপ্রবেশ দিবারাত্রি উন্মুক্ত থাকায় এবং এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ইসলামি জঙ্গী গ্রুপগুলো প্রত্যন্ত গ্রাম এলাকাসমূহে তাদের ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করে চলেছে।
সম্প্রতি জানা গেছে যে, বিদ্যমান সাম্প্রদায়িক বাতাবারণ এবং তুলনামূলকভাবে পাহাড়ি অঞ্চলের নিরাপদ স্থানের সুযোগ নিয়ে, জেএমবি পার্বত্য এলাকায় জমি লীজ নিয়ে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করেছে, যা গত ২৪ নভেম্বর ২০১৯ (somoyekhon.net, ২৫ নভেম্বর ২০১৯) ঢাকার পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতারকৃত তিন জেএমবি সদস্য স্বীকার করেছে। তাছাড়া নিষিদ্ধ জঙ্গী গ্রুপ আনসার আল-ইসলামের চার সক্রিয় সদস্য, যাদেরকে গত ৩ অক্টোবর ২০১৯ ঢাকা থেকে আটক করা হয়, তারাও স্বীকার করেছে যে, তারা বান্দরবান জেলার আলিকদম এলাকায় এক মাসের প্রশিক্ষণ নিয়েছে। পাহাড়ি এলাকায় প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করে গ্রেফতারকৃত জঙ্গী ব্যক্তিরা সাংগঠনিক পরিকল্পনা পরিচালনার উদ্দেশ্যে ঢাকায় কর্মস্থলে আসে বলে জানা যায় (The Independent, ১২ অক্টোবর ২০১৯)।
বস্তুত অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করার ষড়যন্ত্রকে প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের কোন বিকল্প নেই। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম অধ্যুষিত বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ; পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্বলিত পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন; ‘অপারেশন উত্তরণ’ একপ্রকার সামরিক শাসনসহ সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার; পার্বত্য চট্টগ্রামে বহিরাগতদের বসতিস্থাপন প্রতিরোধে কার্যকর আইন প্রণয়ন ও ভূমি মালিকানা অর্জনে বিধিনিষেধ; পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে মুসলিম সেটেলারদের সম্মানজনকভাবে পুনর্বাসন; পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্যমান সকল চাকরিতে জুম্ম জনগণকে বিশেষ অগ্রাধিকার প্রদান করে স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়োগ ইত্যাদিসহ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ অতীব জরুরি। উল্লেখ্য যে, সকল অস্থায়ী ক্যাম্প ও ‘অপারেশন উত্তরণ’ একপ্রকার সামরিক শাসন প্রত্যাহার অবশ্যই জরুরি ভিত্তিতে করণীয়। অপারেশন উত্তরণ প্রত্যাহারই হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির একমাত্র পথ।
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলাদেশ সরকার বিগত ২২ বছরে চুক্তি বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেনি। এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য কোন উদ্যোগ গ্রহণ করবে না। বরং বাস্তবতা হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে চিরতরে জুম্ম জাতিগোষ্ঠীকে বিলুপ্তকরণের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি নিরঙ্কুশ মুসলিম-অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করার চূড়ান্ত পর্যায় শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগ সরকারের চলমান শাসনামলেই কার্যকর হচ্ছে। এক্ষেত্রে আদিবাসী জুম্ম জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য সর্বাত্মক প্রতিরোধ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া ছাড়া কোন বিকল্প নেই বলে নি:সন্দেহে বলা যেতে পারে।