হিল ভয়েস, ১৬ এপ্রিল ২০২০, খাগড়াছড়ি: মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে দেশব্যাপী লকডাউনের মধ্যেও জীবনবাজি রেখে ঢাকা, সাভার, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা থেকে খাগড়াছড়ির বিভিন্ন এলাকায় নিজ নিজ গ্রামে ফিরতে থাকা প্রায় এক হাজার কর্মজীবী জুম্মদেরকে সেনাবাহিনী ও পুলিশ কর্তৃক চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি উপজেলা ও খাগড়াছড়ি জেলার মানিকছড়ি উপজেলার সীমান্তে নয়াবাজারে আটকে দেয়া হয়েছে।
১৬ এপ্রিল বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে আটকে পড়া কর্মজীবী জুম্মরা প্রতিবাদ জানালে পুলিশ তাদের ওপর এলোপাতাড়ি লাঠিচার্জ করে। খাগড়াছড়ি জেলার মানিকছড়ি উপজেলার নোয়াপাড়া নামক এক চেক পোস্টে এ ঘটনাটি ঘটেছে বলে জানা যায়। এতে নারীসহ বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে সুমিতা দেওয়ান (২১), রিতা চাকমা (১৯), শান্তি প্রিয় চাকমা (২২), শিউলি চাকমা (১৬) ও রিমা চাকমা (১৯) গুরুতর আহত হয়েছেন বলে জানা যায়। তাদের মধ্যে সুমিতা দেওয়ানের বাড়ি খাগড়াছড়ি জেলার মহালছড়ি উপজেলাধীন মুবাছড়িতে, অন্যদিকে রিতা চাকমার বাড়ি রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলাধীন বাঘাইহাটে বলে জানা যায়। এসময় দুই পাহাড়ি নারী শ্রমিক ঘোরতর আঘাতপ্রাপ্ত হলে স্থানীয় ফার্মেসীতে তাদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে জানা যায়। ঘটনার সময় খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তামান্না মাহমুদ উপস্থিত ছিলেন বলে তথ্য সূত্রে খবর পাওয়া গেছে।
উল্লেখ্য যে, এসব ঘরমুখো লোকজন বিভিন্ন শিল্পকারখানায় কর্মরত স্বল্প বেতনের চাকরিজীবী। করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে দীর্ঘদিন ধরে লকডাউনের ফলে শিল্পকারখানা বন্ধ থাকায় এবং বেতন না পাওয়ায় তারা অর্থ সংকটে পড়ে। এমতাবস্থায় বাধ্য হয়ে তারা যার যার গ্রামে ফিরতে শুরু করে। সর্বশেষ আটকে পড়া পাহাড়ি শ্রমিকের মধ্যে দীঘিনালায় আছেন ২৪৭ জন, বাঘাইছড়ি উপজেলায় ২৯২ জন, খাগড়াছড়ি মহালছড়ি ৭৫ জন, খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার ৮৮ জন, পানছড়ি উপজেলায় ২২৩ জন, লংগদু উপজেলায় ২২ জন, মাটিরাঙ্গা উপজেলায় ৪৯ জন ও রামগড়ে ৪ জন।
ইতিমধ্যে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসন করোনা ভাইরাস সংক্রমণ রোধে খাগড়াছড়িতে প্রবেশ পথগুলো বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে জেলার সীমান্ত নয়াবাজার এলাকায় আটকে দেওয়া হয়েছে কয়েকশত এসব পাহাড়ি কর্মজীবীকে। আটকে পড়াদের মধ্যে অধিকাংশই নারী। তাদেরকে খাগড়াছড়িতেও যেতে দেয়া হচ্ছে না, আবার শহরেও ফিরতে দেয়া হচ্ছে না বলে আটকে পড়া লোকজন অভিযোগ করেছেন।
জানা যায়, গত ১৫ এপ্রিল বুধবার চট্টগ্রাম থেকে খাগড়াছড়িতে ঘরমুখো কয়েকশত শ্রমজীবী মানুষকে খাগড়াছড়ি-ফটিকছড়ি সীমান্ত নয়াবাজার সেনা ক্যাম্পের চেকপোষ্ট এলাকায় সেনাবাহিনী ও পুলিশ আটকিয়ে দেয়। এর আগে খাগড়াছড়ি শহরের প্রবেশমুখ জিরোমাইলেও কিছু মানুষকে আটকিয়ে দেয়া হয়।
তবে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ রোধে সামাজিক-শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার কথা বলা হলেও আটকে দেওয়া এসব মানুষকে রাখা হয়েছে গাদাগাদি করে। ফলে ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি আরো বাড়ছে বলে মনে করছেন সচেতন মহল। তারা প্রশাসনের এমন অব্যবস্থাপনার সমালোচনা করেছেন। আটকে পড়া শতশত জুম্ম শ্রমজীবীদের জন্য অতিদ্রুত হোম কোয়ারান্টাইনে রাখতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী জানিয়েছে সচেতন মহল।
বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও আমেরিকা প্রবাসী মংসানু মারমা বাথোয়াই তাঁর ফেসবুক ওয়ালে এই বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন, “এ কোন মশকরা! খেটে-খাওয়া, শ্রমজীবী, সাধারণ মানুষদের প্রশাসন এ কী করলো? হাজার হাজার মানুষ খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি প্রবেশের বিভিন্ন পোয়েন্ট – মানিকছড়ি, রানীরহাটে আটকে আছে। তাদেরকে নিজ এলাকায় প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। এবং সেখানে প্রশাসনে তাদের থাকা খাওয়ার ব্যাবস্থাও নেই। কিছু কিছু পুলিশ আবার চাঁদা নিতেও শুরু করেছে। পুলিশ লাঠি মেরে এ ফুটফুটে মেয়েসহ আরো অনেককে মারাত্মক জখমও করে বসলো। শহরে তাদের কারখানা বন্ধ, বেতন নেই । নিজের গ্রামে ফিরলে জীবনটা হয়তো বাচঁবে। সেকারণে এ যাত্রা । এ রকম দৃশ্য, বিপর্যয় এখন সারা বিশ্বের। করোনার কারণে বিশ্ববিপর্যয় থেকে একদিন পৃথিবী মুক্ত হবে। কিন্তু আমাদের বিবেকহীন এসব থেকে আমরা কী কখনো মুক্তি পাবো? এ লজ্জা লুকাবো কীভাবে? অশ্রু জলে আমার আকুতি, এ সময় এ রকম ছবিগুলো অনেক অনেক বেদনার..” বলে তিনি উল্লেখ করেন।
‘সম্মা দিত্তি’ নামে একজন ব্যক্তি তার ফেসুবুক ওয়ালে লিখেন যে, “বিদেশ থেকে যদি বিমানে করে শত শত মানুষ বাংলাদেশে প্রবেশ করাতে পারে। তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিজের মাতৃভূমিতে আমরা কেন যেতে পারব না? জেলা প্রশাসক তথা বাংলাদেশ সরকারের কাছে জবাব চাই। সেনাবাহিনী ও পুলিশ প্রশাসনের এহেন কর্মকান্ডের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায়। নিরাপদে বাড়ি ফিরতে চাই। আমরা আমাদের এলাকায় প্রবেশ করতে পারবো না কেন? তার জবাব চাই” বলে তিনি উল্লেখ করেন।
মন্টি চাকমা সিএইচটি নামে এক ব্যক্তি তার ফেসবুকে স্টাটাস দেন, গার্মেন্টস শ্রমিকদের নিয়ে আজ সরকারের ভুল সিদ্ধান্তের ফলে এ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। ফলে সমস্যার সমাধান কিভাবে করা যায় সেটা না করে পরিস্থিতি আরো জটিল থেকে জটিলতর করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে এক শ্রেণি কায়েমী শাসকগোষ্ঠী।
শান্তি প্রিয় ভিক্ষু নামে আরেক ব্যক্তি তার ফেবসুকে লিখেছেন যে, গার্মেন্টস সেক্টরগুলো এমন সময় বন্ধ ঘোষণা দিলেন যখন কিনা সারাদেশে অঘোষিত লকডাউন অবস্থায় রয়েছে পুরো দেশ। এ অবস্থায় গার্মেন্টস শ্রমিকরা না পারছে শহরে থাকতে না পারছে নিজ বাড়ি যেতে। এমতাবস্থায় শ্রমিকরা তাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাড়িতে ফেরার পথে আরেক জীবন যুদ্ধে পড়তে হলো।
বাচ্চু চাকমা নামে আরেকজন তার ফেসবুকে উল্লেখ করেন যে, সরকার এবং গার্মেন্টস মালিকদের ভুলের কারণে এই পরিস্থিতি উদ্ভব হয়েছে। সারা দেশের পরিস্থিতি এমনিই জটিল আকার ধারণ করছে। সরকার এবং গার্মেন্টস মালিকদের এধরনের দায়িত্ব জ্ঞানহীন আচরণ কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু তাই বলে কর্মজীবী মানুষের উপর এই বর্বরোচিত হামলা কেন করা হল? বলে তিনি প্রশ্ন রাখেন।
কালায়ন তালুকদার তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেন যে, দুই এক দফায় পার্বত্য চট্টগ্রামে স্ব স্ব এলাকায় শ্রমিকরা পায়ে হেটে আসার চেষ্টা করলে খাগড়াছড়ি মানিকছড়ি নোয়া বাজার ও রামগড় সোনাইপুল চেক পোস্টে শ্রমিক ভাইদের উপর পুলিশ বাহিনী বেধড়ক মারধর ও লাঠিচার্জ করে গুরুতর জখম করে। বর্তমানে ইপিজেড শ্রমিকরা বিভিন্ন ঝুঁকিতে মানবেতর জীবনযাপন করছে। তিনি তাদেরকে যথাযথ প্রাতিষ্ঠানিক হোম কোয়ারান্টাইন রেখে স্ব স্ব এলাকায় আসার মানবিক বিবেচনা করার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী ও তিন পার্বত্য সংসদীয় আসনের সাংসদদের।