হিল ভয়েস, ২৫ এপ্রিল ২০২০, বিশেষ প্রতিবেদন, পার্বত্য চট্টগ্রাম: মহামারী করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ রোধে সরকার কর্তৃক সরকারি ছুটি, গণপরিবহন ও শিল্প-কারখানা বন্ধ ঘোষণা তথা সারাদেশে অঘোষিত লকডাউনের ফলে দেশের বিভিন্ন শহরে ও জেলায় হাজার হাজার আদিবাসী জুম্ম শ্রমজীবীরা আটকা পড়ে। অঘোষিত লকডাউনের মেয়াদ ক্রমাগত বৃদ্ধির ফলে ফ্যাক্টরী চালু না হওয়ায় ও বেতন-ভাতা না পাওয়ায় চরম খাদ্য ও আর্থিক সংকটে পড়ে এসব জুম্ম কর্মজীবীরা। স্বল্প বেতনের এসব শ্রমজীবীরা ফ্যাক্টরীর আশেপাশের ফ্লাটবাড়ি ভাড়া করে এক একটি কক্ষে কয়েকজন গাদাগাদি করে থাকেন। এক একটি কক্ষে দীর্ঘদিন ধরে ঠাসাঠাসি করে থাকার ফলে চরম দুর্বিসহ হয়ে উঠে জুম্ম শ্রমজীবীদের জীবন।
এমনিতর অবস্থায় গত ২৪ মার্চ ২০২০ সারাদেশে গত ১৫ এপ্রিল ২০২০ হতে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন কলকারখানায় কর্মরত পাহাড়ি শ্রমজীবী মানুষেরা বাধ্য হয়েই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিজ বাড়িতে আসতে শুরু করেছিলেন। মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে দেশব্যাপী লকডাউনের মধ্যেও জীবনবাজি রেখে ঢাকা, সাভার, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা থেকে খাগড়াছড়ির বিভিন্ন এলাকায় নিজ নিজ গ্রামে ফিরতে থাকা প্রায় এক হাজার কর্মজীবী জুম্মদেরকে সেনাবাহিনী ও পুলিশ কর্তৃক চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি উপজেলা ও খাগড়াছড়ি জেলার মানিকছড়ি উপজেলার সীমান্তে নয়াবাজারে আটকে দেয়া হয়েছে। অপরদিকে রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম জেলার সীমান্তবর্তী রাবারবাগান এলাকায় নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নানা হয়রানির মুখে পড়তে হয়েছে ঘরমুখো জুম্ম কর্মজীবী মানুষের।
গত ১৬ এপ্রিল বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে আটকে পড়া কর্মজীবী জুম্মরা প্রতিবাদ জানালে পুলিশ তাদের ওপর এলোপাতাড়ি লাঠিচার্জ করে। খাগড়াছড়ি জেলার মানিকছড়ি উপজেলার নোয়াপাড়া নামক এক চেক পোস্টে এ ঘটনাটি ঘটেছিল। পুলিশের হামলার পর রাত আনুমানিক ১০.০০ ঘটিকার সময় মানিকছড়িতে আটকেপরা জুম্ম শ্রমিকজীবী ভাই-বোনদের খাগড়াছড়িতে প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় স্ব স্ব জায়গায় তাদেরকে পৌছে দেয়া হবে বলে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে এবং তাদের স্ব স্ব এলাকার স্কুলে ১৪ দিন পর্যন্ত হোমকোয়ারান্টাইনে থাকতে হবে বলে জানিয়ে দেন। তারপর খাগড়াছড়ি জেলার বিভিন্ন উপজেলায় জুম্ম শ্রমজীবী ভাই-বোনেরা নিজ নিজ গ্রামে পৌঁছে গিয়েছিলেন। নিয়ম অনুযায়ী ১৪ দিন হোম কোয়ারান্টাইনে তাদের থাকতে হবে, ১৪ দিন পর স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে ছাড়পত্র নিয়ে নিজ বাড়িতে যেতে পারবে। কিন্তু পাহাড়ি শ্রমজীবী মানুষগুলোর গ্রাম দুর্গম এলাকায় হওয়াতে অধিকাংশ সরকারি প্রাতিষ্ঠানিক হোম কোয়ারান্টাইনে থাকতে পারেননি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনপ্রতিনিধি, গ্রামের মুরুব্বি ও বিশেষ করে সচেতন যুব সমাজ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতিটি উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রামে, গ্রাম থেকে অনতিদূরে জঙ্গলে মধ্যে জুম্মদের প্রথাগত নিয়ম মেনে ঐতিহ্যবাহী হোম কোয়ারান্টাইন তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। সকল গার্মেন্টস ফেরত পাহাড়ি শ্রমজীবী মানুষের জন্য ১৪ দিনের জন্য অবশ্যই হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে ৷ তাদের অবশ্যই এলাকাবাসী ও বাড়ির সদস্যদের সাথে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে। করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় আদিবাসী জুম্মদের প্রথাগত হোম কোয়ারান্টাইনের ব্যবস্থা গ্রহণ ও বিভিন্ন এলাকার কোয়ারান্টাইন সম্পর্কে নিম্নে কিছু উদ্যোগতুলে ধরা হল।
অাদিবাসী জুম্মদের কেবল ঐতিহ্যবাহী কোরান্টাইন ব্যবস্থা প্রচলন রয়েছে তা নয়, দু:স্থ, গরীব, বিধবা ইত্যাদি লোকদেরকে সহযোগিতা প্রদান করা কিংবা দুর্যোগ বা বন্যার সময়ে জরুরী সেবা ও সহযোগিতা প্রদানের ব্যবস্থা প্রথাগতভাবে চালু রয়েছে। বর্তমান করোনা মহামারিতেও যুব সমাজকে কিংবা ব্যক্তি বিশেষকে বা বিভিন্ন সংগঠন কর্তৃক কর্মহীন হয়ে খাদ্য সংকটে পড়া লোকদেরও সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানে উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে।
ক. ঐতিহ্যবাহী কোয়ারান্টাইন ব্যবস্থা
মহামারী করোনা প্রতিরোধে এখন পর্যন্ত কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে কোয়ারান্টাইন বা কোয়ারান্টিন, আইসোলেশন ও লকডাইন ইত্যাদি শব্দ বা পদসমূহ পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীসহ বিশ্বের অনেকের কাছে নতুন শোনালেও বাস্তবে সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে এইসব ব্যবস্থাসমূহ বহু আগেই এই অঞ্চলে প্রচলিত ছিল। জানা যায়, গোটা ভারতবর্ষে বিভিন্ন জাতি ও জনগোষ্ঠীর মধ্যে এজাতীয় সংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধ ব্যবস্থা নানাভাবে চালু ছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম আদিবাসীদের সমাজেও স্মরণাতীত কাল থেকে এধরনের মহামারী বা দূরারোগ্য ব্যাধি প্রতিরোধ ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল।
বস্তুত মাত্র কয়েক দশক আগেও এই অঞ্চলের আদিবাসীদের মধ্যে কুষ্ঠ, যক্ষাসহ বিভিন্ন দূরারোগ্য বা সংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধকল্পে বা রোগীর চিকিৎসায় একধরনের ‘হোম কোয়ারান্টাইন’ বা ‘আইসোলেশন’ ব্যবস্থা চালু ছিল। ছিল মহামারী রোধে গ্রামভিত্তিক বা এলাকাভিত্তিক একধরনের লকডাউন, গ্রামবন্ধ বা এলাকাবন্ধ ব্যবস্থা। যেমন সম্প্রতি বান্দরবান পার্বত্য জেলার অধিকাংশ ম্রো এলাকায় সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় সামাজিক উদ্যোগে গাছ-বাঁশ দিয়ে ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে গ্রামের প্রবেশপথ বন্ধ করে দিয়ে এক ধরনের গ্রাম লকডাউন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। অতীতে কোন এলাকার কোন পরিবারের কেউ দূরারোগ্য বা সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে সংশ্লিষ্ট পরিবার বা এলাকার পক্ষ থেকে সেই রোগীর জন্য সংশ্লিষ্ট পরিবারের কাছাকাছি স্থানে আলাদাভাবে ঘর নির্মাণ করে দেয়া হতো। তার প্রয়োজনীয় সামগ্রী ও খাবারের ব্যবস্থা করা হতো। কোন বৈদ্য বা ওঝা বা চিকিৎসক ঐ বাড়িতে এসেই চিকিৎসা দিতেন। তবে স্বল্প মাত্রার সংক্রামক ব্যাধি হলে বাড়ির ভেতরেই আলাদা কোন কক্ষে বা বিছানায় রাখার ব্যবস্থা হতো।
করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে নিজেদের ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে হোম কোয়ারান্টাইন চালু করেছে আদিবাসীরা। বিশেষ করে সচেতন যুব সমাজের উদ্যোগে স্বেচ্ছায় তারা নিজেদের এলাকার প্রাকৃতিক বন থেকে বাঁশ ও গাছ সংগ্রহ করে তা দিয়ে বেড়া তৈরি করে হোম কোয়ারান্টাইনের জন্য বাড়ি তৈরি করে দিয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। যেমন খাগড়াছড়ি জেলা দীঘিনালা উপজেলা বাবুছড়াতে কোয়ারান্টাইনের জন্য ৭টি ঐতিহ্যবাহী ঘর তৈরি করা হয়েছে। দীঘিনালা উপজেলা ৪নং দীঘিনালা ইউনিয়ন ১নং ওয়ার্ডে যত্নকুমার কারবারি পাড়াতে ১০টি ঘরে ৩৫ জন পাহাড়ি শ্রমজীবী অবস্থান করছেন। একই ইউনিয়নে হেঙ্গত্তে কারবারি পাড়ায় ৩টি ঘরে ১৩ জন অবস্থান করছেন।
দীঘিনালা উপজেলা ১নং মেরুং ইউনিয়ন শিমুলতলী গ্রামে ১টি ঘরে ৬ জন অবস্থান করছেন এবং মেরুং ৭নং ওয়ার্ড ১টি বাড়িতে ৫ জন অবস্থান করছেন। ছোট মেরুং ৫ নং ওয়ার্ড ৪টি ঘরে ১১ জন অবস্থান করছেন। পানছড়ি উপজেলা শান্তিপুর গ্রামে ১৩টি ঘরে ৩১ জন পাহাড়ি শ্রমজীবী ভাই বোন অবস্থান করছেন। খাগড়াছড়ি মহালছড়ি উপজেলা, মাইসছড়ি ইউনিয়নে মানিকছড়ি গ্রামে ১টি ঘরে ২ জন অবস্থান করছেন। মহালছড়ি উপজেলা মহালছড়ি ইউনিয়ন সংড়াছড়িমুখ গ্রামে ৪টি ঘরে ৯ জন অবস্থান করছেন। গুইমারা ২নং হাপছড়ি ইউনিয়ন ৯নং ওয়ার্ড বাগতায়ী কারবারি পাড়া ২টি ঘরে ৪ জন অবস্থান করছেন।
রাঙ্গামাটি জেলা বাঘাইছড়ি ৩০নং ইউনিয়নে নব পেরাছড়া গ্রামে জুম্মদের ঐতিহ্যবাহী ৫টি ঘরে ১১ জন পাহাড়ি শ্রমজীবী অবস্থান করছেন। খেদারমারা ইউনিয়নে নলবনিয়া গ্রামে ১৭ জন শ্রমজীবী ভাই বোন অবস্থান করছেন। বাঘাইছড়ি উপজেলা ৩৫নং ইউনিয়ন ও ৯নং ওয়ার্ডে ঝগড়াবিল গ্রামে ৩টি ঘরে ১৪ জন ও ৩৩নং মারিশ্যা ইউনিয়ন কাচালং পাড়ে ১টি ঘরে ৫ জন অবস্থান করছেন এবং বঙ্গলতলী ইউনিয়ন বঙ্গলতলী গ্রামে ৪টি ঘরে ১৪ জন অবস্থান করছেন।
নানিয়াচর উপজেলা ৬নং ওয়ার্ড বগাছড়ি কুকুরমারা গ্রামে ২টি ঘরে ৯ জন অবস্থান করছেন। একই উপজেলা ২নং সাবেক্কং ইউনিয়নে দিসাইন পাড়ায় ৩টি ঘরে ১২ জন অবস্থান করছেন এবং একই উপজেলা ২নং সাবেক্কং ইউনিয়ন লারমা পাড়ায় ১টি ঘরে ৩ জন অবস্থান করছেন, একই ইউনিয়নে সোনারাম কারবারি পাড়ায় ২টি ঘরে ৫জন অবস্থান করছেন ও একই ইউনিয়নে ঝরবো মাহাজন পাড়া গ্রামে ৩ টি ঘরে ৮ জন অবস্থান করছেন। ঘিলাছড়ি ইউনিয়ন চৌধুরী ছড়া ১ টি ঘরে ২ জন অবস্থান করছেন বলে খবর পাওয়া যায়। নানিয়াচর উপজেলা, গিলাছড়ি ইউনিয়নে মাইসছড়ি গ্রামে ২টি ঘরে ৭ জন অবস্থান করছেন।
রাঙ্গামাটি সদর উপজেলায় গুইছড়ি ৭নং ওয়ার্ডে ১টি ঘরে ১ জন অবস্থান করছেন। বন্দুকভাঙা ইউনিয়ন মাস্যেপাড়া গ্রামে ১টি ঘরে ২ জন মহিলা অবস্থান করছেন। বন্দুকভাঙা ইউনিয়নে দামেছড়া গ্রামে ১টি ঘরে ১ জন অবস্থান করছেন। বন্দুকভাঙা ৭নং ওয়ার্ড তিনগজ্জে গ্রামে ৩টি ঘরে ১৩ জন অবস্থান করছেন। রাঙ্গামাটি সদর উপজেলা সাপছড়ি ইউনিয়নে নারেইছড়ি গ্রামে ৩টি ঘরে ৯ জন অবস্থান করছেন। কুদুকছড়ি ইউনিয়নে পেরাছড়া গ্রামে ৩টি ঘরে ১৬ জন অবস্থান করছেন বলে জানা যায়। জীবতলী ইউনিয়নে দল্লেছড়ি গ্রামে ৯নং ওয়ার্ডে ১টি ঘরে ২ জন অবস্থান করছেন।
লংগদু উপজেলায় ডানে আতরকছড়া ২নং ওয়ার্ডে ১টি ঘরে ২ জন অবস্থান করছেন। লংগদু ইউনিয়ন কাট্টতলী বড় আদামে ২নং ওয়ার্ড ১টি বড় ঘরে ২১ জন অবস্থান করছেন। লংগদু হারিহাবায় ১টি বড় ঘরে ১৭ জন অবস্থান করছেন। বরকল উপজেলা ১নং শুভলং ইউনিয়ন গুগরছড়ি গ্রামে ২টি ঘরে ৪ জন অবস্থান করছেন। কাউখালী উপজেলা ৪নং ওয়ার্ড তালুকদার পাড়া গ্রামে ১৩টি ঘরে ১৩ জন অবস্থান করছেন। একই উপজেলা উল্টা পাড়া গ্রামে ৫টি ঘর তৈরি করা হয়েছে।
রাঙ্গামাটির মানিকছড়ি ২নং ওয়ার্ড ৭টি ঘরে ১৯ জন অবস্থান করছেন।এছাড়া বাঘাইহাট ও সাজেক ইউনিয়নে প্রায় ৩০ টি জয়াগায় জুম্মদের প্রথাগত ঐতিহ্যবাহী অস্থায়ী হোম কোয়ারান্টন ঘর তৈরি করা হয়েছে। এরমধ্যে বাঘাইহাট, ভাইবাছড়া, হাজাছড়া, নাঙ্গলমারা, উলুছড়া, নন্দরাম, ডিপুপাড়া, শুকনোছড়া, করল্ল্যাছড়ি, এগুচ্ছাছড়ি ও ভাইবোনছড়া উল্লেখযোগ্য।
গত ১৮ এপ্রিল ২০২০, দ্য ডেইলি স্টার প্রকাশিত সংবাদে চট্টগ্রাম ফেরত নানিয়ারচর উপজেলার খামারপাড়া এলাকার বাসিন্দা সুপ্রিয় চাকমা শিমুল বলেন, ‘নিজের পরিবার এবং গ্রামবাসীদের করোনা থেকে ঝুঁকিমুক্ত রাখতে আমি এবং আমার কয়েকজন বন্ধু মিলে গ্রামের পাশে একটি বনে অস্থায়ী ঘর বানিয়ে আছি। আগামী ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকার পর বাড়িতে ঢুকবো।’ বাঘাইছড়ি উপজেলার খেদারমারা গ্রামের সুকিরণ চাকমা বলেন, ‘যারা বাইরে থেকে আসছে তাদেরকে গ্রামের সবাই মিলে হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করার জন্য অস্থায়ী ঘর তুলে দিচ্ছি। সেই সঙ্গে তাদের খাওয়াসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করছি। তারা যেন সেই অস্থায়ী ঘরে ১৫-২০ পর্যন্ত নিশ্চিন্তে থাকতে পারে সে ব্যবস্থা করেছি।
খ. ঐতিহ্যবাহী সামাজিক সাহায্য-সহযোগিতা
নানা কারণে আদিবাসী সমাজ আর্থ-সামাজিক দিকে থেকে পিছিয়ে থাকে বটে, তবে তাদের সমাজে তখনও কিছু অত্যন্ত মানবিক, সুন্দর ও অতুলনীয় সামাজিক রীতি-নীতি ও মূল্যবোধ সক্রিয় ও অনুসৃত হয়ে থাকে। যেমন চাকমাদের মধ্যে প্রচলিত মালেয়া প্রথা বা এক ধরনের স্বেচ্ছায় সামাজিক সহযোগিতার রীতি – যা নিজস্ব ভাষায় ও আঙ্গিকে অন্য সম্প্রদায়ের মধ্যেও চর্চিত – তা অত্যন্ত তাৎপর্যবাহী এক সামাজিক প্রথা। যা সমাজের মানুষের প্রতি মানুষের সহযোগিতা, সহমর্মিতা, সংহতি ও সুষম উন্নতির মূল্যবোধকে জাগিয়ে দেয় এবং সুদৃঢ় করে। একসময় গ্রামে গ্রামে বিধবা ও গরীব জুমচাষীদের দুর্দশায়, সংকটে সমাজের অন্যান্যদের এগিয়ে আসার চর্চা ছিল যথেষ্ট। বিশেষ করে এক্ষেত্রে এগিয়ে থাকত যুব সমাজ।
করোনা ভাইরাসের কারণে খাদ্য সংকটে পতিত জুম্মদেরকে আদিবাসীদের চিরায়ত পদ্ধতির আলোকে জুম্ম স্বেচ্ছাসেবক ও সংস্থাদের ত্রান বিতরণের খবর পাওয়া গেছে। করোনা পরিস্থিতিতে দেশে চলমান লকডাউনের কারণে অসহায় হয়ে পড়া রাঙামাটির সাজেক এলাকার মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি প্রকৌশলীদের সংগঠন হিল ইঞ্জিনিয়ার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ। সংগঠনটির সদস্যরা গত ১৯ এপ্রিল ২০২০ সাজেক ইউনিয়নের ৩৪টি গ্রামের প্রায় ছয়শ অসহায় পরিবারের মাঝে ত্রাণ সহায়তা বিতরণ করেছে।
শিক্ষা উন্নয়ন সংস্থা দেওয়া ফেইসবুকে গত ২৩ এপ্রিল ২০২০, কোভিড ১৯ সৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবেলায় চাকমা সার্কেলের উপদেষ্টা রাণী য়েন য়েন এর উদ্যোগে ব্র্যাকের সহায়তায় শিক্ষা উন্নয়ন সংস্থা ও ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরাম, বাংলাদেশ (টিএসএফ) এর মাধ্যমে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার ৯টি উপজেলায় সংহতি ত্রাণ বিতরন কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়েছে।
চাকমা রাণী, ব্র্যাক, টিএসএফ, সংশ্লিষ্ট উপজেলার বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদের নেতৃবৃন্দ ও জাবারাং কল্যাণ সমিতি’র প্রতিনিধিরা পার্বত্য চট্টগ্রামে করোণা মহামারী কারণে সৃষ্ট খাদ্য সংকট মোকাবেলায় গরীব আদিবাসীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। সংহতি ত্রাণ বিতরনের জন্য খাগড়াছড়িতে তালিকাভুক্ত হয়েছে মোট ১,৬৮৯টি পরিবার। এই তালিকা তৈরির ক্ষেত্রে মূলতঃ ২টি দিক বিবেচনা করা হয়েছে প্রথমত দরিদ্র ও অসহায় মানুষ খাবার সংকটে আছে কিন্তু এখনো কোন সরকারি ও বেসরকারি ত্রাণ পায়নি এবং দ্বিতীয়ত যারা দুর্গম এলাকায় বসবাস করেন তাদেরকে প্রধান্য দেওয়া হয়েছে। উপজেলা ভিত্তিক ভাগ করা হয়েছেঃ খাগড়াছড়ি সদর ৬৩১ পরিবার, দীঘিনালা ১২১ পরিবার, পানছড়ি ১১৪, মহালছড়ি ১৫০, মাটিরাঙ্গা ২৩৫, গুইমারা ১০২, মানিকছড়ি ১১৬, লক্ষীছড়ি ১০০ও রামগড় ১২০ পরিবার।
প্রত্যন্ত অঞ্চলের ঘরে ঘরে ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে ৫ এপিল থেকে প্রো-বেটার লিভিং বাংলাদেশ (পিবিএল) এবং উন্মেষ যৌথভাবে ফান্ড রেইজিং এর কাজ করে যাচ্ছে। প্রথম পর্যায়ে নববর্ষের দিনে বরকল সীমান্তবর্তী খুব্বাং এলাকায় ৪২ পরিবারের কাছে ১৫ কেজি চাল, এক কেজি চিদোল এবং এক লিটার তেলসহ সর্বমোট ৪২০০০ টাকার ত্রাণ বিতরণ করা হয়। হরিনা বাজার থেকে থেগা দোর দিয়ে দুইদিন এভাবে নেওয়ার পর গত ১৯ এপ্রিল ২০২০ পিবিএল এবং উন্মেষ-এর ত্রাণগুলা পৌঁছেছে করল্যাছড়ি গ্রামে। যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম পানি পথ। পানি শুকিয়ে যাওয়াতে সরকারি ত্রাণ পৌঁছাতে পারেনি। আর দূর্গমতার পরিমাপও পাহাড়ের এই আনাচে-কানাচে না ঘুরলে উপলব্ধি করা কঠিন হবে। ত্রাণ বিতরণের ক্ষেত্রে একারণেই জেলা উপজেলা সদরের কাছাকাছি (অন্তত যেখানে বাজার আছে) এলাকার চাইতে এই প্রান্তিক এলাকার মানুষদের পাশে অবস্থান করেন সবসময়ই। রাঙ্গামাটি সদর উপজেলাধীন বন্ধুকভাঙ্গা ইউনিয়নের মগ পাড়ায় ২৫ পরিবার এবং কুমড়া পাড়া ১৫ পরিবার’সহ সর্বমোট ৪০ পরিবারের নিকট উপহার সামগ্রী হিসেবে চাল, ডাল, লবন, পেয়াজ, তেল এবং সাবান তুলে দেওয়া হয়।
বাঘাইছড়ির শিজকস্থ সূর্যোদয় ক্লাব যুব সমাজ ফেইসবুক ওয়াল থেকে জানা যায়, শিজক এলাকার যুব সমাজের পক্ষে একটা মহতি উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। তারা বলেছেন, আমাদের সমাজের অধিকাংশ জনগোষ্ঠী গরীব। তিন ভাগের এক অংশ দেশের প্রতিটি গার্মেন্টস সেক্টরের শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সেই সব শ্রমিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অতি কষ্টে নিজ নিজ গ্রামে বাড়িতে ফিরে এসেছেন। কারণ নিজের জীবনের মায়া সবারই থাকে। কিন্তু গ্রামে ফিরে তাদেরকে আর ও কঠিন পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। ১৪ দিন হোম কোয়ারান্টাইনে থাকতে হবে। আর আত্মীয় স্বজন তো গ্রামে এমনিতেই গরীব তাদেরকে কিভাবে এতদিন বসিয়ে খাওয়াবে? আমাদের দঃ শিজক মূখ গ্রামের সকলের মতামতের ভিত্তিতে ওয়াড সদস্য এবং ক্লাবের সার্বিক তত্ত্বাবধানে গ্রামের বিত্তবানদের কাছ থেকে চাঁদা উত্তোলন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি যাহাতে তাদেরকে যতদিন হোম কোয়ারান্টাইনে রাখা হচ্ছে ততদিন ভরনপোষণ করা ষায়। এভাবে আমাদের গ্রাম ও পার্শ্ববর্তী গ্রাম নোবেল করোনা ভাইরাসের হাত থেকে সুরক্ষিত থাকবো বলে তারা বিশ্বাস করে। তাদের এলাকাতে প্রায় ৪০ জন শ্রমজীবী হোম কোয়ারান্টাইনে আছে বলে নিশ্চিত করেন।
খাগড়াছড়ির শাপলা ত্রিপুরা ও কল্লোল রোয়াজা দম্পতি প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানুষের কাছে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছাতে দিনরাত পরিশ্রম করে চলেছেন। আর সংহতি জানিয়ে তাঁদের ত্রাণ তহবিলকে সমৃদ্ধ করতে ইতিমধ্যেই এগিয়ে এসেছে দেশ বিদেশের অনেক বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষী। এই দম্পতির উদ্যোগে এই পর্যন্ত খাগড়াছড়ির কয়েকটি উপজেলাতে ৫০০ অভাবগ্রসস্ত পরিবারের মাঝে শাপলার ভালবাসা ও সংহতির খাদ্য সামগ্রী পৌছানো হয়েছে। তাছাড়াও চাহিদা অনূযায়ী বিভিন্ন এলাকায় পরিচিত জনের মাঝে হিসাবের বাইরে আরও অনেক স্থানীয় পর্যায়ে খাদ্য সহযোগিতা সমন্বয় করছেন তারা।
ত্রিপুরা শ্রমিক কল্যাণ ফোরাম, চট্টগ্রাম মহানগর ত্রিপুরা কল্যাণ ফোরাম ও য়াক বাকসা ক্লাব খাগড়াছড়ি জেলার বিপন্ন পরিবারের মাঝে মানবিক সহায়তা প্রদান করেছে। অভিলাষ ত্রিপুরা ফেইসবুক ওয়ালে লিখেছিলেন, কোভিড-১৯ মানব জাতিকে সমষ্টিগতভাবে শত বছরে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করলেও এ অদৃশ্য শক্তির মোকাবিলা পৃথিবীতে অসাধারণ মানবিকতা, সৃষ্টিশীল নেতৃত্ব ও অভূতপূর্ব টিমওয়ার্কের অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করার সুযোগ করে দিয়েছে। যতই সরকারী সহযোগিতা থাকুক, পার্বত্য চট্টগ্রামের ভৌগলিক ও আর্থ সামাজিক বাস্তবতায় সামাজিক উদ্যোগ ও ব্যক্তিগত উদ্যোগই পারবে এ মহামারীর বহুমুখী প্রভাবকে ঠিক মতো ম্যানেজ করতে। এবার প্রত্যন্ত অঞ্চলের ক্ষুধার্ত অসহায় মানুষের পাশে আবারও দাঁড়িয়েছেন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক। সিনিয়র ম্যানেজমেন্টের সাথে দ্রুততম সময়ের মধ্যে যোগাযোগ ও সমন্বয় করে তিনি খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি জেলার ৩,০০০ কর্মহীন প্রান্তিক পরিবারের মাঝে আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করেছেন।