হিল ভয়েস, ০১ এপ্রিল ২০২০, বান্দরবান: বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান মো: শফিউল্লাহ কর্তৃক পর্যটনের নামে প্রায় এক হাজার একর জায়গা অবৈধ দখল করা হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন আদিবাসীরা। এসব ভূমি আদিবাসীদের জুম ভূমি ও মৌজা ভূমি বলে জানা গেছে।
সরেজমিন তদন্তে জানা যায় যে, ২৭০নং নাইক্ষ্যংছড়ি মৌজার প্রায় ১০০ একর, ২৭২নং জারুলিয়াছড়ি মৌজার প্রায় ৩৫০ একর, ২৬৯নং সোনাইছড়ি মৌজার প্রায় ৫৫০ একর মিলিয়ে আদিবাসীদের প্রায় এক হাজার একর জুম ভূমি পর্যটনের নামে দখল নেওয়া হয়েছে। জায়গাগুলো জুমখোলা পাড়ার ৩০ পরিবার, ক্যকরোপ পাড়ার ৮০ পরিবার, ক্যং পাড়ার ১১০, লামার পাড়ার ৯০ ও সিংথোয়াই পাড়ার ৫০ পরিবারের লোকেরা জুম চাষ করে থাকে। এরা সবাই চাক ও মারমা সম্প্রদায়ের লোকজন। আদিবাসী জুম্ম বাসিন্দারা জানান, যুগ যুগ ধরে বন্য জন্তুর সঙ্গে লড়াই করে জুম চাষ করে তারা জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন।
২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ধীরে ধীরে উক্ত আওয়ামীলীগ নেতা পাড়াবাসীদের জায়গা আস্তে আস্তে দখলে নিতে থাকেন। তদন্তে দেখা যায়, সোনাইছড়ির ওই পর্যটনের স্থান থেকে নাইক্ষ্যংছড়ি সদরের দূরত্ব প্রায় ৮ কিলোমিটার। ড্রেজার দিয়ে দুই পাশের পাহাড় কেটে ঝিরিতে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। চলাচলের সুবিধার জন্য সেই বাঁধের আকার বড় করা হয়েছে। রাস্তা প্রশস্ত করার জন্য বড় বড় পাহাড় কেটে সমান করার কাজ চলছে।
এরই মধ্যে ১৫টি পাহাড় কেটে পরিবেশ ধ্বংস করে প্রায় ৮ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। ঝিরি ভরাট করে বাঁধ নির্মাণের কাজ চলছে। পাহাড় কাটা অবৈধ হলেও এবং পর্যটনের জন্য প্রশাসনের কোনো অনুমতিই না নিয়েই ক্ষমতার জোরে ওই আওয়ামী লীগ নেতা এই অবৈধ দখল জায়েজ করে চলেছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। আদিবাসীদের ভয়ভীতি আর পর্যটন এলাকায় চাকরির লোভ দেখিয়ে এসব জায়গা দখল করা হচ্ছে। জুম চাষ করতে না পারায় এ বছর অতি দরিদ্র কয়েক শত আদিবাসী পরিবার খাদ্য সমস্যায় পড়বে। এছাড়া উপার্জনের অন্য কোনো উপায় নেই আদিবাসীদের। পাশাপাশি ওই কয়েকশ’ পরিবারেরই জীবিকা হুমকিতে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আরো জানা যায়, গত বছর আরও কয়েকটি পাহাড় কেটে কাঁচা রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। পর্যটকদের চলাচলের জন্য কাটা ১৫টি পাহাড়ের মধ্যে ৪টিই অনেক বড় আকারের ছিল। আদিবাসী পাড়াবাসীদের তিলে তিলে গড়ে তোলা ফলজ বাগানও দখল হয়ে গেছে। কয়েকজনের রাবার বাগানও দখলে চলে গেছে। অবৈধ দখলকৃত পর্যটনের জায়গাতে রাস্তা ও বাঁধ নির্মাণের জন্য বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ থেকে এক কোটি ২০ লাখ টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। গত অর্থবছরে এই অর্থ ছাড় দেওয়া হয়। এই অর্থের মধ্যে ঝিরিতে একটি ৪০ মিটার বাঁধ এবং টু-ভ্যান বক্স কালভার্ট নির্মাণ কাজ ধরা হয়েছে। চেয়ারম্যান মো. শফিউল্লাহর বিরুদ্ধে প্রশাসনের নিকট এলাকার লোকজন জায়গা দখল বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েছে। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের নেতা হওয়ায় তার বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
অপরদিকে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার দৌছড়ি ইউনিয়নেও গহীন বনে ভূমিদস্যুরা কয়েক শত একর বনভূমি দখলে নিয়ে নির্বিচারে গাছ-বাঁশ কেটে চলছে। জানা যায় যে, বনদস্যুরা আদিবাসী ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বাড়ির আশপাশের কয়েকশত একর পাহাড়ি জমি দখলে নিতে বনের সব গাছ-বাঁশ কেটে সাবাড় করছে। এসব বনজ সম্পদ নানা জায়গায় তারা পাচার করছে। বাকী বনজসম্পদ আগুনে পুড়ে ফেলছে। সেখানকার আদিবাসী জুম্মদের আয়-রোজগারের উৎস পাহাড়ের বাঁশ, ফুল ঝাঁড়– ও গাছ সহ পাহাড়ের বিভিন্ন বনজ সম্পদ সংগ্রহ ও জুম চাষ। তাদের আয়ের এ উৎস ধ্বংস করতে চেষ্টা করছে বহিরাগত ভূমিদস্যুরা। এটা আদিবাসী জুম্ম জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা ও বন্যহাতি সহ বন্যপ্রাণীদের অস্তিত্বের জন্যে অশনি সংকেত।
সূত্র: “মার্চ ২০২০: পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকার পরিস্থিতির উপর মাসিক প্রতিবেদন” শীর্ষক জনসংহতি সমিতির রিপোর্ট