হিল ভয়েস, ৮ মার্চ ২০২০, রাঙ্গামাটি: রাঙামাটিতে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে ৮ মার্চ ২০২০ পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের উদ্যোগে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, ১৯৯৭ সালে সম্পাদিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে পাহাড়ের জুম্ম নারীরা পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। পার্বত্য চুক্তির পূর্বে সহিংসতার বিরুদ্ধে ও অধিকারের জন্য জুম্ম নারীদের যে আন্দোলন করতে হয়েছে, চুক্তির পরেও তাদের আন্দোলন করতে হচ্ছে। বক্তারা আরও বলেন, পার্বত্য এলাকার আদিবাসী জুম্ম নারীদের উপর সহিংসতার মাত্রা সবচেয়ে বেশি। এখানে বহিরাগত সেটেলার বাঙালিদের দ্বারা আদিবাসী জুম্ম নারী ধর্ষণ, হত্যা, হয়রানি, যৌন নির্যাতন আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
“সমতায় বিশ্বাসী প্রজন্ম: লড়বে আদিবাসী নারী অধিকার সুরক্ষায় এবং জুম্ম নারীর সমঅধিকার ও সমমর্যাদা নিশ্চিত করুন, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে বৃহত্তর আন্দোলনে সামিল হউন” এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে সকাল ১০:০০ ঘটিকায় রাঙামাটি জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন মহিলা সমিতির রাঙামাটি জেলা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক রিতা চাকমা এবং প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল এর ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এ্যাডভোকেট সুস্মিতা চাকমা। এছাড়া সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহ-সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার, আদিবাসী ফোরাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম এর সভাপতি প্রকৃতি রঞ্জন চাকমা, এম এন লারমা মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনের সভাপতি বিজয় কেতন চাকমা, জনসংহতি সমিতির স্টাফ সদস্য আশিকা চাকমা, জেলা যুব সমিতির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক নান্টু ত্রিপুরা ও জেলা পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জগদীশ চাকমা। সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক শান্তিদেবী তঞ্চঙ্গ্যা এবং সঞ্চালনা করেন ফেডারেশনের নেত্রী রিনা চাকমা।
প্রধান অতিথি এ্যাডভোকেট সুস্মিতা চাকমা বলেন, সারাবিশ্বে বর্তমানে ৭৪ কোটি নারী অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনৈতিক জীবনধারায় বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে, যাদের সামাজিক নিরাপত্তা, সরকারি সেবা ও অবকাঠামোর সুবিধা লাভে কোন সুযোগ নেই বললেই চলে। নারীরা পুরুষের তুলনায় ২.৬ গুণ বেশি অবৈতনিক ও গৃহস্থালি কাজ করে থাকে। তিনজন নারীর মধ্যে অন্তত একজন নারী তাদের জীবনে সহিংসতার শিকার হয়ে থাকে। তিনি আরও বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে লিঙ্গ সমতা অর্জন এবং সকল নারী ও কন্যাশিশুর ক্ষমতায়ন সংক্রান্ত ৫নং লক্ষ্য পরিপূরণের ক্ষেত্রে দরকার গুণগত পরিবর্তন, সমন্বিত উদ্যোগ ও নতুন সমাধান।
বিশেষ অতিথি ঊষাতন তালুকদার বলেন, পার্বত্য এলাকার মানুষ শান্তিপ্রিয় এবং সহজ সরল। এখানে রাজনৈতিক ভাবে সরকার আদিবাসীদের দমন-পীড়ন করছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। উল্টো চুক্তি বিরোধী কাজ করা হচ্ছে। অবহেলার মাত্রা চরম পর্যায়ে পৌছে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে যে কোন অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। তার জন্য সরকারই দায়ী থাকবে। তিনি সবাইকে আহ্বান জানিয়ে বলেন, আসুন সবাই মিলে শান্তি প্রতিষ্ঠা করি।
দেশের আদিবাসীদের এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম নারীদের উপর দিন দিন সহিংসতার মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় বক্তারা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বক্তারা মানুষের জন্য ফাউডেশনের ২০১৯ সালের এক গবেষণার বরাত দিয়ে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে ৪৫ শতাংশেরও বেশি নারী কর্মক্ষেত্রে বা প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে বহু ধরনের সহিংসতার শিকার হয়েছেন। অপরদিকে মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন কাপেং ফাউন্ডেশনের তথ্যেও বরাত দিয়ে বলেন, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ২৬টি আদিবাসী নারীর উপর সহিংস ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় কমপক্ষে ৭ জন আদিবাসী নারীকে ধর্ষণ এবং ৫ জন আদিবাসী নারী ও কিশোরীকে হত্যা বা ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। আর ২০১৮ সালে প্রায় ৫৩ জন আদিবাসী নারী ও শিশু বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার শিকার হয়েছে। তন্মধ্যে সমতলে ২২ জন আর ৩১ জন পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে। এসব সহিংস ঘটনার কোন সুবিচার মেলেনি বলেও উল্লেখ করেন বক্তাগণ।