হিল ভয়েস, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ঢাকা: গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে আগত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জুম্ম ছাত্রদের আদিবাসী সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করার জন্য এক সাংস্কৃতিক সংগঠন ঢাকা ইউনিভার্সিটি জুম লিটারেচার এন্ড কালচারাল সোসাইটি-এর ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য উৎসব-২০২০ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্মস এন্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি), বাংলাদেশের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর এক মানবাধিকার সংগঠন কাপেং ফাউন্ডেশন ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এই কর্মসূচিতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের ডীন প্রফেসর ড. সাদেকা হালিম। এছাড়া বিশিষ্ট আদিবাসী গবেষক ও লেখক পাভেল পার্থ, কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা, বাংলাদেশ আদিবাসী সাংস্কৃতিক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক চন্দ্রা ত্রিপুরা ও ডাকসুর কেন্দ্রীয় সদস্য চিবল সাংমা অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। কর্মসূচিতে সভাপতিত্ব করেন সোসাইটির সহ-সভাপতি থোয়াই নু অং চাক (কেনি) এবং সঞ্চালনা করেন সোসাইটির জশোয়া দেওয়ান। সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদক রাতুল তঞ্চঙ্গ্যা স্বাগত বক্তব্য রাখেন।
প্রধান অতিথি ড. সাদেকা হালিম তাঁর বক্তৃতায় অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, বিশ্ব এমন এক পর্যায়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে যেখানে আমরা সকল ধরনের বৈষম্য দেখতে পাচ্ছি। তিনি আরও বলেন, যখন আমরা বৈষম্য সম্পর্কে কথা বলি, তখন আমরা এইসব বৈষম্য লাঘবে এগুলির ইতিবাচক দিকগুলো কৌশলে বিশ্লেষণ করি। তাঁর মতে করোনা ভাইরাস নয়, বরং ধর্মকে একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে রাজনৈতিক গোলযোগ পৃথিবীকে বিষাক্ত করেছে এবং এটা অবশ্যই প্রত্যাশিত নয়। তবে এখনও আমরা হিন্দু ও মুসলিমরা একত্রে তাদের গ্রাম পাহারা দেওয়ার উদাহরণ দেখতে পাই, যা আমাদেরকে বেশ ইতিবাচক শিক্ষা দেয়, বলেন সমাজ বিজ্ঞানী। তিনি আরও বলেন যে, গবেষণাকালে তিনি তাঁর আদিবাসী বন্ধুদের সাথে তাঁর জীবনের এক দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেন। এই গবেষণা কেবল একটি গবেষণা হয়নি, বরং এটা তাঁকে তাঁর আদিবাসী বন্ধুদের আরও কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। তিনি আরও বিশ্বাস করেন যে, এটা তাঁর উপর আদিবাসী জনগণের বিশ্বাস ও আস্থার একটি জায়গা সৃষ্টি করেছে, যা দীর্ঘদিনের কষ্ট ও ঘনিষ্টতার ফল। তিনি আদিবাসী ছাত্রদের মধ্যে আরও ঐক্য ও পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া জোরদার করার পরামর্শ দেন।
বিশিষ্ট আদিবাসী গবেষক ও লেখক পাভেল পার্থ তাঁর অতিথির বক্তব্যে আদিবাসী যুবকরা ধীরে ধীরে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উপাদানসমূহ হারিয়ে ফেলছে এবং বিভিন্ন আদিবাসী বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার ভুলে যাচ্ছে বলে দুঃখ প্রকাশ করেন। তাঁর মতে, আদিবাসী সমাজের চেয়ে বরং রাষ্ট্রের বিভিন্ন কাঠামো ও প্রতিষ্ঠানসমূহই এইসব সাংস্কৃতিক উপাদানসমূহ হারিয়ে যাওয়ার জন্য দায়ী। এছাড়াও তিনি প্রত্যেককে তিক্ত সত্য স্মরণ করিয়ে দেন যে, ঢাকায় অনেক আদিবাসীর জায়গা ছিল। সেগুলির মধ্যে একটি হচ্ছে মগবাজার, যা ছিল রাখাইন অধ্যুষিত, অন্য একটি হচ্ছে মনিপুরী পাড়া যেখানে ন্যাশনাল এ্যাসেম্বলি প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে, আরেকটি হচ্ছে তেজতুরি পাড়া যেখানে দেশের প্রথম বিমান বন্দর স্থাপন করা হয়েছে যা ছিল তুরি আদিবাসী সম্প্রদায়ের আবাসভূমি, জাতীয় প্রেস ক্লাব যেখানে রবিদাস আদিবাসী জনগণ বাস করত এবং এই সকল দৃষ্টান্তসমূহ জোরপুর্বক করা হয়েছে। গবেষক আদিবাসী সম্প্রদায়ের সকল নাম পরিবর্তনকে একটি মজার ব্যাপার হিসেবে ভিন্নমত পোষণ করেন এবং এমনকি সকল আদিবাসী এলাকাসমূহকে একটি বাঙালি নাম দেওয়া হয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।
আলোচনা সমাপ্ত হয় অনুষ্ঠানের সভাপতি থোয়াই নু অং চাক (কেনি) এর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে। এছাড়া দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে, ‘এক টুকরো পার্বত্য চট্টগ্রাম’ শীর্ষক একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনী আয়োজন করা হয়, যা পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী সম্প্রদায়ের জীবন ও সংগ্রামকে বুঝিয়ে দেয় এবং চিত্রায়ন করে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের আদিবাসী ছাত্রদের মধ্যে একটি বিতর্ক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়, যার প্রতিপাদ্য ছিল ‘সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কারণে আদিবাসী ভাষা ও সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে’। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের আদিবাসী ছাত্ররাও তাদের নিজেদের ভাষায় তাদের অনুভুতি প্রকাশ করে। এরপর আলোচনা অধিবেশনের পর একটি তাৎপর্যপূর্ণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়।
পল্লব চাকমা তার বক্তৃতায় আদিবাসীদের ইস্যুগুলো নিজেদের হিসেবে যারা নেন এমন আরও বাঙালি বন্ধু তৈরি করতে আদিবাসী ছাত্রদের পরামর্শ দেন। তিনি আরও মনে করেন যে, সবচেয়ে অগ্রসর মন-মানসিকতাসম্পন্নরাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়ন করেন। সুতরাং, যারা এই প্রতিষ্ঠানের আদিবাসী ছাত্র তাদেরকেই আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর বিভিন্ন ইস্যুগুলো তুলে ধরার জন্য এগিয়ে আসা উচিত। আদিবাসী ছাত্রদের ‘দূত’ হিসেবে সম্বোধন করে, তিনি তাদেরকে তাদের বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুদেরকে আদিবাসী জনগণের জীবন ও সংস্কৃতির ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরতে উৎসাহিত করেন। কারণ এই বন্ধুরাই ভবিষ্যতে কর্পোরেট ও ব্যুরোক্র্যাট হবেন, যারা দেশকে নেতৃত্ব দেবেন। এইভাবে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী সম্পর্কে ইতিবাচক মানসিক পরিমন্ডল যার সাথে বেড়ে উঠেছেন তা তাদের ভবিষ্যত কর্মকান্ডে প্রতিফলিত হবে। অতীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আদিবাসী ছাত্রদের মধ্যে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা ছাত্রদের সবচেয়ে বেশী প্রাধান্য ছিল। কিন্তু বর্তমানে ¤্রাে, চাক ও খুমি ছাত্রদের উপস্থিতি ক্যাম্পাসকে সমৃদ্ধ করেছে এবং তাই তিনি বিশ্বাস করেন যে, বাংলাদেশ নিশ্চিতভাবেই বৈচিত্র্যের শক্তি নিয়ে এগিয়ে যাবে।
ডাকসুর কেন্দ্রীয় সদস্য চিবল সাংমা বলেন যে, ২১ ফেব্রুয়ারি চেতনা কেবল একটি ভাষার অর্থ বোঝায় না, ইহার বিস্তার ব্যাপক। তাই তিনি প্রত্যেককে তার নিজের ভাষা চর্চার পরামর্শ দেন। অপরদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রসঙ্গে বক্তব্য দেয়ার সময় তিনি বলেন, আমরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আদিবাসী ভাষাসমূহের প্রতিনিধিত্ব করতে সক্ষম হইনি। টিএসসিতে (শিক্ষক-ছাত্র কেন্দ্র) ২৩টি সংগঠন রয়েছে, এবং দুঃখজনকভাবে সেখানে আমাদের প্রতিনিধিত্ব করার কেউ নেই। তারপর তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন যে, আমরা (আদিবাসী ছাত্ররা) নিজেরা আদিবাসী জনগণকে যথাযথভাবে প্রতিনিধিত্ব করতে সক্ষম হইনি। ডাকসু নেতা এভাবে আদিবাসী জনগণকে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য একটি সংগঠনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়ে, সোসাইটিকে ইহার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার সুপারিশ করেন।
বাংলাদেশ আদিবাসী সাংস্কৃতিক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক চন্দ্রা ত্রিপুরা অতিথি বক্তা হিসেবে তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন যে, আমাদের তরুণ সমাজকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে চিন্তা ও কাজ করতে হবে, যাতে আদিবাসী সাংস্কৃতিক সংগ্রাম অব্যাহতভাবে সামনে এগিয়ে যায়। তিনি সুপারিশ করেন যে, যদি আমরা (তরুণরা) কেবল অন্যদের দোষারোপ করি, আমরা আমাদের সংস্কৃতি রক্ষা করতে সক্ষম হবো না। কারণ আমরা যদি আমাদের সংস্কৃতি সংরক্ষণ না করি, কেউই করবে না। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে বলেন যে, আমাদের ভাষা ও সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষার সংগ্রাম সেই পথ থেকেই শুরু করা উচিত যেখানে আমাদের চেহারা ও ভাষার কারণে প্রায়ই মৌখিকভাবে আমাদের হয়রানি করা হয়। তিনি সেইসব অপমানজনক কথাবার্তা শুনে উত্তেজিত না হয়ে বরং আদিবাসী ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে তাদেরকে বলার উপর জোর দেন।
রাতুল তঞ্চঙ্গ্যা তার স্বাগত বক্তব্যে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী আদিবাসী জনগণের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি উপস্থাপন করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে কর্মসূচিটি আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া তিনি আরও বলেন যে, আদিবাসী সংস্কৃতি ও মূলধারা বাঙালি সংস্কৃতির মধ্যে সেতু সৃষ্টির একটি প্রচেষ্টা হিসেবে কয়েকটি কর্মসূচির আয়োজন করা হয় এবং ‘ভাষা ও সাহিত্য বৈচিত্র্য উৎসব-২০২০’ তাদের মধ্যে একটি।
পরিশেষে, রাতুল তঞ্চঙ্গ্যাকে সভাপতি, নুথোয়াই মারমাকে সাধারণ সম্পাদক ও ঐতিহ্য চাকমাকে সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত করে ঢাকা ইউনিভার্সিটি জুম লিটারেচার এন্ড কালচারাল সোসাইটি’র ৪৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। ভাষা ও সাহিত্য বৈচিত্র্য উৎসব ২০২০ এর প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল- ‘বৈচিত্র্যের শক্তির মাধ্যমে ভাষা ও সংস্কৃতির মুক্তি’।