হিল ভয়েস, ১৭ অক্টোবর ২০১৯, বিশেষ প্রতিনিধি, রাঙ্গামাটি: গত ১৬ ও ১৭ অক্টোবর ২০১৯ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব আসাদুজ্জামান খান কামাল বেশ ঘটা করে দুই দিনের এক সফরে পার্বত্য চট্টগ্রামে আসেন। এসময় খাগড়াছড়ির রামগড়ে এক সমাবেশে এবং রাঙ্গামাটি শহরে দেশের ও পার্বত্যাঞ্চলের আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সুধী সমাজকে নিয়ে অন্তত দুইটি সভায় যোগদান করেন এবং গণমাধ্যমে বক্তব্য প্রদান করেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের যৌথ আয়োজনে ‘তিন পার্বত্য জেলার আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিশেষ সভা’ ও আলোচনা সভার ব্যানারে অনুষ্ঠিত দুইটি সভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পার্বত্য চট্টগ্রামে খুন, সংঘাত, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, অপহরণের বিরুদ্ধে কথা বলেন এবং যেকোন মূল্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ফিরিয়ে আনার কথা বলেন। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে এবং পাহাড়ে যারা চাঁদাবাজি ও রক্তপাত করছে তাদের জন্য ভয়ংকর দিন আসছে বলে তিনি হুমকি প্রদান করেন।
অপরদিকে এসব সভায় সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি, র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটিলিয়ন (র্যাব) এর মহাপরিচালক ও পুলিশের মহাপরিদর্শক প্রমুখ কর্তাব্যক্তিরাও একতরফাভাবে সন্ত্রাস, হানাহানি ও চাঁদাবাজির অভিযোগ তুলে উস্কানীমূলক ও হুমকিমূলক বক্তব্য প্রদান করেন। মাটির তিন ফুটের গভীরে লুকিয়ে থাকলেও সন্ত্রাসীদের বের করে আনা হবে। দুই কোটি লোক বসবাসকারী ঢাকা শহরে এবং অন্য জেলা থেকে ঢাকা শহরে এক কোটি লোকের প্রতিনিয়ত যাতায়াত সত্ত্বেও যেখানে ঢাকা শহর থেকে সন্ত্রাসীদের অনায়াসে খুঁজে বের করা হয়, সেখানে ১৫/১৬ লক্ষ বসবাসকারী পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাসীদের খুঁজে বের করা কোন ব্যাপারই নয় বলে হুমকি প্রদান করা হয়। এধরনের একতরফা অভিযোগ ও হুমকির ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনমনে চরম আতঙ্ক ও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। ধারাবাহিকভাবে চলমান ধরপাকড়, তথাকথিত ক্রসফায়ারে হত্যা, রাত-বিরাতে ঘরবাড়ি তল্লাসী ও জিনিসপত্র তছনছ, নির্বিচারে শারীরিক নির্যাতনের ফলে পার্বত্য জনজীবন আজ যেখানে শ্বাসরুদ্ধকর, সেখানে আবার ‘সামনে ভয়ংকর দিনের’ হুমকি জনমানুষকে চরম আতঙ্কগ্রস্ত ও নিরাপত্তাহীন করে তুলেছে।
বলাবাহুল্য, রাঙ্গামাটিতে অনুষ্ঠিত আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত এসব সভা কার্যত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির প্রক্রিয়াকে সরাসরি লঙ্ঘন করে অনুষ্ঠিত হয়েছে। পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক প্রণীত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ১৯৯৮ অনুসারে সাধারণ প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বিষয়টি সমন্বয় ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব আঞ্চলিক পরিষদের এবং তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন ১৯৮৯ অনুসারে আইন-শৃঙ্খলা সংরক্ষণ ও উন্নয়ন এবং পুলিশ (স্থানীয়) বিষয়টি পার্বত্য জেলা পরিষদের আওতাধীন একটি কার্যাবলী। কিন্তু আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের সাথে কোনরূপ আলোচনা ব্যতিরেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক একতরফাভাবে এসব সভা আয়োজন করা হয়। আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান ও পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানগণকে কেবল উক্ত সভাগুলোতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে মাত্র। সভা আয়োজনের কর্মপরিকল্পনা ও কর্মপদ্ধতি নিয়ে আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোর সাথে কোনরূপ আলোচনা করা হয়নি। তাই আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত এসব সভা পার্বত্য চুক্তি ও পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্যমান আইনকে লঙ্ঘন করেই অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে।
অপরদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত পরিস্থিতি নিয়ে এসব সভায় একতরফা, মনগড়া ও ষড়যন্ত্রমূলক বক্তব্য দেয়া হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের এধরনের অশান্ত পরিস্থিতির পেছনে যে গভীর প্রেক্ষাপট ও ধারাবাহিক ষড়যন্ত্র রয়েছে সে বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে গিয়ে উস্কানীমূলক ও হুমকিমূলক বক্তব্য দেয়া হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে স্বাক্ষরিত ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’র যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে সরকারের অব্যাহত টালবাহানা ও গড়িমসির কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি দিন দিন যে অবনতির দিকে ধাবিত হচ্ছে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রত্যক্ষ মদদ ও যোগসাজশে স্বার্থান্বেষী ও তাবেদার মহলকে দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে খুন, সংঘাত, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, অপহরণ চালানো হচ্ছে সে বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে চেপে যাওয়া হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করা, চুক্তি স্বাক্ষরকারী জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বকে ধ্বংস করা, সর্বোপরি জুম্ম জনগণকে জাতিগতভাবে নির্মূলীকরণের হীনউদ্দেশ্যে সরকার, সরকারি বাহিনী ও শাসক দলের একটি বিশেষ মহল যে চুক্তি স্বাক্ষরের পর পরই ইউপিডিএফ নামধারী চুক্তি বিরোধী সশস্ত্র সংগঠন গঠন ও মদদ দান, সংস্কারপন্থী নামধারী নব্য দালাল চক্রকে আশ্রয়-প্রশ্রয় ও সহায়তা প্রদান, আরাকান লিবারেশন পার্টি (এএলপি) নামধারী বিদেশী সশস্ত্র গ্রুপকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান, চুক্তি পরিপন্থী ও জুম্ম স্বার্থ বিরোধী কার্যক্রম বাস্তবায়ন ইত্যাদি একের পর এক ধারাবাহিক ষড়যন্ত্র চলছে। সরকার, সরকারি বাহিনী ও শাসকদলের বিশেষ মহলের এসব ষড়যন্ত্রের কারণেই আজ পার্বত্য চট্টগ্রামে খুন, রক্তপাত, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, অপহরণের ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব সভায় পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমানে উদ্ভূত পরিস্থিতির পশ্চাতে কায়েমী স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর এই সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রকে সম্পূর্ণভাবে ধামাচাপা দিয়ে গোয়েবলসীয় কায়দায় খুন, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির অভিযোগ চুক্তির অন্যতম স্বাক্ষরকারী পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে তোলা হচ্ছে এবং পরিস্থিতিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার অপপ্রয়াস চালানো হচ্ছে।
উল্লেখ্য যে, ১৬ অক্টোবর ২০১৯ সকালের দিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রথমে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলাধীন রামগড় উপজেলায় নবনির্মিত রামগড় থানা ভবন উদ্বোধন করেন এবং দুপুরে খাগড়াছড়ি জেলা পুলিশের উদ্যোগে রামগড় হাই স্কুল মাঠে সন্ত্রাস, মাদক ও জঙ্গিবাদবিরোধী সুধী সমাবেশে বক্তৃতা করেন। ঐ দিনই তিনি রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা শহরে আসেন এবং সন্ধ্যা ৬টা হতে রাত প্রায় ১০টা পর্যন্ত রাঙ্গামাটি ডেপুটি কমিশনার কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত উক্ত বিশেষ সভায় যোগদান করেন। এর পরদিন ১৭ অক্টোবর ২০১৯ সকাল ১১টার দিকে রাঙ্গামাটি সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে একই বিষয়ে আয়োজিত সভায় যোগদান করেন তিনি। এসমস্ত সভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে আরও উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপি, ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসন সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা এমপি, রাঙ্গামাটি আসনের সাংসদ দীপঙ্কর তালুকদার, সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাংসদ বাসন্তী চাকমা, র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ সাফিনুল ইসলাম, সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল এস এম মতিউর রহমান, পুলিশের মহাপরিদর্শক মো. জাবেদ পাটোয়ারী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিরাপত্তা বিভাগের সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দিন, পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মিসবাহুল ইসলাম, অতিরিক্ত সচিব সুদত্ত চাকমাসহ সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনের জেলা ও বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাবৃন্দ। এছাড়া সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে আয়োজিত সভায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের নেতৃবৃন্দসহ সুধী সমাজের কেউ কেউ উপস্থিত ছিলেন বলে জানা যায়।
উক্ত সভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘তিন পার্বত্য জেলায় হঠাৎ করে রক্তপাত শুরু হয়েছে। ..বেশ কিছু দিন ধরে তিন পার্বত্য জেলায় নির্বিচারে খুন ও চাঁদাবাজির কারণে পরিবেশ অশান্ত হয়ে উঠেছে। ভয়ংকর এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। সেই ভয়ংকর পরিস্থিতি থামানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। যেকোনো মূল্যে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে নিয়ে আসব।’ এছাড়া তিনি বলেন, ‘যেসব স্থান থেকে সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে, সেসব স্থানে নিরাপত্তার স্বার্থে পুলিশ বা বিজিবি সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে, প্রয়োজনে আরো হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিজিবি, পুলিশকেও আমরা কেলিকপ্টার কিনে দেবো। সব জায়গায় আমরা রাস্তা এবং হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা সবকিছু আমরা করবো। যাতে করে এই জায়গায় আবার শান্তি ফিরে আসে।’
বলাবাহুল্য, পার্বত্য চট্টগ্রামে চলমান বিভিন্ন সংঘাত ও সহিংস ঘটনাবলীকে বিচ্ছিন্নভাবে ও একদেশদর্শীভাবে দেখলে এবং দেশের সাধারণ আইন-শৃঙ্খলা ও শান্তির প্রশ্নে বাহ্যিকভাবে অবলোকন করলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য সাধারণভাবে সন্ত্রাসবিরোধী বলেই প্রতীয়মান হতে পারে। অপরদিকে সবকিছু জেনেও কারা এই সন্ত্রাসী কাজ করছে তা সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা না করায় তা বিভ্রান্তিমূলকও বটে। কিন্তু এটা সর্বজনবিদিত যে, দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ও সেনাবাহিনীর একটি মহল সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখে আসলেও, প্রকৃতপক্ষে তারাই আবার এই সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের লালনপালন, প্রশ্রয় ও মদদ দিয়ে আসছেন। বস্তুত পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির লক্ষ্যে কায়েমী স্বার্থবাদী এই মহলটি একদিকে চুক্তি বিরোধী নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে, তেমনি জুম্মদের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব বিলুপ্তকরণের লক্ষ্যে জুম্মদের মধ্যে ‘ভাগ কর, শাসন কর’ নীতি প্রয়োগ করে কখনো ইউপিডিএফ নামে, কখনো ‘সংস্কারপন্থী’, কখনো ‘গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ’ সৃষ্টি করে তাদেরকে ভাড়াটে বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করে চলেছে। এই চুক্তি বিরোধী মহলটি চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে বা চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করার হীন উদ্দেশ্যে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতির নেতাকর্মীদের বিভিন্ন মামলায় মিথ্যাভাবে জড়িত ও অভিযুক্ত করে সন্ত্রাসী সাজিয়ে জেলে পুড়ছে বা এলাকাছাড়া করে চলেছে অথবা গ্রেফতারকৃতদের সন্ত্রাসী বানিয়ে গুলি করে হত্যা করে ক্রশয়াফারে নিহত হয়েছে বলে প্রচার করছে। অপরদিকে ভাড়াটে বাহিনীকে দিয়ে চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজিসহ জনসংহতি সমিতির সদস্য ও সমর্থকদের অপহরণ ও খুন করে চলেছে। উল্লেখ্য যে, চুক্তি স্বাক্ষরের পরপরই চুক্তি বিরোধী ইউপিডিএফ সৃষ্টি করা হয় এবং কায়েমী স্বার্থবাদী মহলটিই এই চুক্তিবিরোধী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে আশ্রয়, প্রশ্রয় ও মদদ দিয়ে থাকে। অপরদিকে একই গোষ্ঠী সেটেলারদের সংগঠন সমঅধিকার, বাঙালি গণ ও ছাত্র পরিষদকে দিয়ে জুম্ম বসতিতে একের পর এক সাম্প্রদায়িক হামলা চালায়।
বলাবাহুল্য, সরকার চুক্তি স্বাক্ষর করলেও চুক্তি বাস্তবায়ন না করার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি আজ জটিল অবস্থায় উপনীত হয়েছে। ফলে যারা সন্ত্রাসের জন্মদাতা তারাও আজ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কথা বলে প্রকৃত সন্ত্রাসীদের আড়াল করার চেষ্টা করছে, অপরদিকে পার্বত্য সমস্যাকে সন্ত্রাসের সমস্যা হিসেবে দেখিয়ে পার্বত্য চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের বিষয়টি ধামাচাপা দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে আরও সেনাশাসন জোরদার ও জায়েজ করার অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে। কিন্তু অত্যন্ত আশ্চার্য ও পরিতাপের বিষয় যে, আজ সেই সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও অস্ত্রধারীদের মদদদাতারাই গলার আওয়াজ বড় করে খুন, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও অস্ত্রবাজির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করছে!
প্রত্যাহৃত সেনা ক্যাম্পে বিজিবি, পুলিশ ও র্যাব মোতায়েন করা হবে এবং পাহাড়ে চাঁদাবাজদের জন্য ভয়ংকর দিন আসছে বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রচ্ছন্ন হুমকি প্রদান করেছেন। ইতিহাসে দেখা যায়, যারা স্বৈরাচারী ও ফ্যাসীবাদী তারা বরাবরই যে কোন অধিকারকামী আন্দোলনকে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ হিসেবে অভিহিত করে জনমত বিভ্রান্ত ও সামরিক উপায়ে দমন-পীড়নকে জায়েজ করার অপচেষ্টা করে থাকে। বেশি দূরে যাওয়ার দরকার নেই বা অন্য দেশের উদাহরণের দরকার নেই, কয়েক দশক পূর্বেও জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদ সরকারও বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো ‘ভয়ংকর দিনের’ ভয় দেখিয়ে জুম্ম জনগণকে হুমকি দিয়েছিল। কিন্তু জুম্ম জনগণের ন্যায্য আন্দোলনকে নস্যাৎ করা যায়নি। ফলে সামরিক উপায়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হয়ে জাতীয়ভাবে রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের লক্ষ্যে জেনারেল এরশাদ ও খালেদা জিয়া সরকারের সাথে জনসংহতি সমিতির অনুষ্ঠিত আনুষ্ঠানিক বৈঠকের ধারাবাহিকতায় শেখ হাসিনা সরকার ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে উপনীত হতে বাধ্য হন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ সামরিক শাসন ও ফ্যাসীবাদী দমন-পীড়নের মধ্যে রয়েছে। জুম্ম জনগণ প্রায় পাঁচ দশক ধরেই শ্বাসরুদ্ধকর ও নিরাপত্তাহীন অবস্থায় দিন অতিবাহিত করতে বাধ্য হচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা সরকারের স্মরণে রাখা উচিত, একটা জাতীয় ও রাজনৈতিক সমস্যা সামরিক দমন-পীড়ন ও নির্যাতনের মাধ্যমে কখনোই সমাধান করা যায় না।
এমনকি কূটনীতিকদের সাথে আঞ্চলিক দলগুলোর বৈঠকের সময় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রাখার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর চরম সাম্প্রদায়িক ও জুম্ম-বিদ্বেষী মানসিকতারই বহি:প্রকাশ ঘটেছে বলে নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে। তবে বক্তব্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একটা ইতিবাচক দিক উল্লেখ করেছেন সেটা হচ্ছে, ‘চুক্তি অনুযায়ী আমরা এখনও শান্তিচুক্তিকে সম্মান (অনার) করছি। আমরা চাই, এই শান্তিচুক্তিকে অনুসরণ করেই আমরা এই জায়গায় শান্তি নিয়ে আসবো।’ তবে এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, চুক্তির কোন বিষয়গুলো অনুসরণ বা বাস্তবায়ন করে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ফিরিয়ে আনবেন তা তিনি কোন দিক নির্দেশনা বা সুস্পষ্ট বক্তব্য প্রদান করেননি। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পার্বত্য চুক্তি যদি অনুসরণ করে পার্বত্যাঞ্চলে প্রকৃত শান্তি ফিরিয়ে আনতে হলে, তাহলে নিম্নোক্ত বিষয়সমূহ বাস্তবায়ন করা অতীব জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা যায়-
⦿ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম (উপজাতি) অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ করতে হবে এবং এলক্ষ্যে আইনী ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে;
⦿ চুক্তি মোতারেক পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদকে সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, পুলিশ, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন ও পরিবেশ, যোগাযোগ ব্যবস্থা, মাধ্যমিক শিক্ষা, পর্যটন, উন্নয়ন ইত্যাদি কার্যাবলী ও ক্ষমতা নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে হস্তান্তর করতে হবে;
⦿ পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা প্রস্তুত করে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে হবে;
⦿ ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামক সেনাশাসনসহ সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার করতে হবে;
⦿ ভূমি কমিশনের বিধিমালাকে অচিরেই যথাযথভাবে প্রণয়ন করে এবং ভূমি কমিশনে পর্যাপ্ত তহবিল ও জনবল বরাদ্দ এবং রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানে কমিশনের শাখা স্থাপন পূর্বক ভূমি কমিশনের মাধ্যমে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করে জুম্মদের বেহাত হওয়া জায়গা-জমি ফেরত প্রদান করতে হবে;
⦿ চুক্তি মোতাবেক ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তুদের তাদের জায়গা-জমি প্রত্যর্পণ পূর্বক যথাযথভাবে পুনর্বাসন করতে হবে;
⦿ পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল সরকারি ও বেসরকারি চাকরিতে জুম্মদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পার্বত্য জেলার স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়োগ প্রদান করতে হবে;
⦿ চুক্তি মোতাবেক জনমুখী ও প্রকৃতি-বান্ধব উন্নয়নের স্বার্থে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডকে আঞ্চলিক পরিষদের সার্বিক তত্ত্বাবধানে নিয়ে আসতে হবে এবং পার্বত্যবাসীকে নিজেদের উন্নয়ন নিজেরাই নির্ধারণ করতে আত্মনিয়ন্ত্রিত উন্নয়ন ধারা গড়ে তুলতে হবে;
⦿ পার্বত্য চুক্তির সাথে সঙ্গতি বিধানকল্পে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য সকল আইন ও বিধি সংশোধন করতে হবে;
⦿ অলিখিত চুক্তি মোতাবেক সেটেলারদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনকভাবে পুনর্বাসন প্রদান করতে হবে।
বলাবাহুল্য পার্বত্য চুক্তির উল্লেখিত বিষয়সমূহ যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত হলে তবেই পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি ঘটতে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রকৃত শান্তির সুবাতাস বইতে শুরু করবে।
সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল এস এম মতিউর রহমান তাঁর বক্তব্যে ‘ধৈর্যের একটা সীমা আছে’ বলে হুমকি দিয়ে ‘বাঘাইছড়িতে সরকারি দায়িত্ব পালন শেষে ফেরার পথে সরকারি লোককে গুলি করে হত্যা’ ও ‘রাজস্থলীতে একজন সেনা সদস্যকে হত্যার’ যে দু’টি ঘটনার কথা তুলে ধরেছেন সেই দু’টি ঘটনা সেনাবাহিনীরই মদদপুষ্ঠ সংস্কারপন্থী ও এএলপি সশস্ত্র সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর কারণে সংঘটিত হয়েছে তা আজ দিবালোকের মতো স্পষ্ট। এমনকি সম্প্রতি খাগড়াছড়ির মানিকছড়িতে সেনা সদস্য আহত হওয়ার ঘটনাটিও সেনা-সমর্থিত সংস্কারপন্থী সশস্ত্র সদস্যদের কারণেই সংঘটিত হয়েছে। জিওসি মহোদয় অপারেশন উত্তরণের দোহাই দিয়ে যে চুক্তি বাস্তবায়নে সহযোগিতার কথা বলেছেন, কিন্তু তিনি জানেন যে, পার্বত্য চুক্তির ‘ঘ’ খন্ডের ১৭(ক) ধারায় উল্লেখ রয়েছে যে, “সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও স্থায়ী সেনানিবাস (তিন জেলা সদরে তিনটি এবং আলিকদম, রুমা ও দীঘিনালা) ব্যতীত সামরিক বাহিনী, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সকল অস্থায়ী ক্যাম্প পার্বত্য চট্টগ্রাম হইতে পর্যায়ক্রমে স্থায়ী নিবাসে ফেরত নেওয়া হইবে এবং এই লক্ষ্যে সময়-সীমা নির্ধারণ করা হইবে। আইন-শৃংখলা অবনতির ক্ষেত্রে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ে এবং এই জাতীয় অন্যান্য কাজে দেশের সকল এলাকার ন্যায় প্রয়োজনীয় যথাযথ আইন ও বিধি অনুসরণে বেসামরিক প্রশাসনের কর্তৃত্বাধীনে সেনাবাহিনীকে নিয়োগ করা যাইবে। এই ক্ষেত্রে প্রয়োজন বা সময় অনুযায়ী সহায়তা লাভের উদ্দেশ্যে আঞ্চলিক পরিষদ যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করিতে পারিবেন।”
উল্লেখ্য, জিওসি মহোদয় চুক্তির উক্ত বিধান অনুসারে সকল অস্থায়ী ক্যাম্প স্থায়ী নিবাসে ফিরিয়ে নেয়া ও এলক্ষ্যে সময়-সীমা নির্ধারণের উদ্যোগ নেননি। বস্তুত চুক্তির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে তাঁকে অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহারের কোন উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। বরঞ্চ নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলার দোহাই দিয়ে চুক্তির বিধানাবলীকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে প্রত্যাহৃত ক্যাম্প পুনর্বহালের অঙ্গীকার করতে দেখা যায়। তিনি তাঁর বক্তব্যে ‘অপারেশন উত্তরণ’-এর সাফাই গেয়েছেন। কিন্তু যেখানে চুক্তিতে সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহারের কথা রয়েছে সেখানে ‘অপারেশন দাবানল’-এর স্থলে চুক্তি-উত্তর কালে ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামক এক প্রকার সেনাশাসন জারি করা চুক্তির সাথে সম্পূর্ণভাবে সাংঘর্ষিক। এই অপারেশন উত্তরণ-এর দোহাই দিয়েই পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্যমান আইন ও বিধি লঙ্ঘন করে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত সেনাবাহিনীকে পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, উন্নয়ন, ভূমিসহ সকল বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে; গ্রামে গ্রামে তল্লাসী অভিযান, রাত-বিরাতে ঘরবাড়ি তল্লাসী ও জিনিসপত্র তছনছ, অবৈধ গ্রেফতার ও শারীরিক নির্যাতন করতে; সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে খুন-খারাবি, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাস চালাতে মদদ দিতে; সর্বোপরি জুম্মদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা ও ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিতে সেটেলারদের মদদ দিতে প্রতিনিয়ত প্রতীয়মান হয়ে থাকে। শুধু তাই নয়, ২৪ আর্টিলারি ব্রিগেড ও গুইমারা রিজিয়নের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো: তোফায়েল আহমেদের মতো কর্তব্যরত উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তাদেরকে “শান্তিচুক্তির কিছু ধারা দেশের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক” বলেও চুক্তি বিরোধী মতামত ব্যক্ত করতে দেখা যায়।
উক্ত আলোচনা সভায় জিওসি তাঁর বক্তব্যে আরও বলেছেন “চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পর তারা চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করেছেন, এটা দু:খজনক। যারা চুক্তি করেছিল সেই জনসংহতি সমিতির তখন যে জনসমর্থন ছিলো তা এখন আর নেই। …তখন সরকার যার সাথে চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন, তখন তার যে সমর্থন ছিল, আমাদের একটি জরিপ ও ক্যালকুলেশনে দেখেছি, বর্তমানে তিনি মাত্র ১০% মানুষের প্রতিনিধিত্ব করছেন।…তাদের মাঝে দেশপ্রেম বলতে কিছুই নেই, তারা বরাবরই রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত থাকে।” জিওসি মহোদয় আইন-শৃঙ্খলা বিষয়ে বক্তব্য দিতে গিয়ে রাজনৈতিক নেতার মতো দেশপ্রেম মেপে দিচ্ছেন এবং জনগণের রায় নির্ধারণ করে ‘মাত্র ১০%’-এর সার্টিফিকেট দিয়ে দিচ্ছেন, যা হাস্যকর। উচ্চ পদস্থ একজন সামরিক কর্মকর্তা হয়ে চাকরিরত অবস্থায় কোন শিষ্টাচার নীতির আলোকে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরকারী ও আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যানের মতো একজন প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদার ব্যক্তির বিরুদ্ধে এধরনের কথা বলতে পারেন তা বোধগম্য নয়। তবে এ থেকে অনায়াসে বুঝা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত সেনাবাহিনী কতটা উদ্যত ও কর্তৃত্বপরায়ণ এবং নিজেদের চুক্তি বিরোধী ভূমিকাকে জায়েজ করতে কীভাবে সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির জিগির তুলে ধরে পরিস্থিতিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার ষড়যন্ত্র করতে পারেন।
র্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ হুমকি দিয়ে বলেছেন, “এই অঞ্চলে ১৬ লাখ মানুষ বসবাস করে, আর ঢাকা শহরে বসবাস করে দুই কোটির ওপরে। প্রত্যহ আরও এক-দেড় কোটি মানুষ ঢাকা শহরে যাওয়া আসা করা সত্ত্বেও ঢাকা শহর থেকে অনায়াসে সন্ত্রাসী খুঁজে বের করা হয় সেখানে ১৫/১৬ লাখ বসবাসকারী পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাসী বের করা কোন ব্যাপারই নয়”। অপরদিকে স্বরাষ্ট্র সচিব কামাল উদ্দিন একই সুরে কথা বলে এই মর্মে হুমকি দিয়েছেন যে, “বাংলাদেশের মানুষ ১৭ কোটি, তার মধ্যে এই তিন জেলায় বসবাস করে ১৬ লাখ মানুষ, যা মোট জনসংখ্যার এক পার্সেন্টেরও কম। আমরা ১২ লাখ রোহিঙ্গা ম্যানেজ করতে পারছি, এখানে ম্যানেজ করাটা কোন ব্যাপার না।” যেহেতু সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির অভিযোগ কেবল জুম্ম জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে, তাই র্যাব মহাপরিচালক ও স্বরাষ্ট্র সচিবের ইঙ্গিতটা এমন যে, ১৭ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে কয়েক লক্ষ পাহাড়ি লোককে ‘ম্যানেজ’ করা কোন ব্যাপারই নয়। তাঁদের এমনিতর জনমিতিগত পরিমাপক বক্তব্যে নি:সন্দেহে জুম্ম জনগণকে স্মরণ করে দেয় সেই উগ্র জাতীয়তাবোধ ও জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের ফ্যাসীবাদী নৃশংসতাকে।
র্যাব মহাপরিচালক আরো বলেছেন, “আমরা যদি জঙ্গি বিতাড়িত করতে পারি, জলদস্যু মুক্ত করতে পারি, মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারি, তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামের এই সমস্ত লোককে মাটির তিনহাত নিচে থেকেও বের করে আনার ক্ষমতা রাখি।” আইজিপি ড. মো: জাবেদ পাটোয়ারীও একই ধঙে বলেছেন যে, “আমরা কিভাবে সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গীবাদ দমন করেছি, মাদকের ব্যাপারে কিভাবে জিরো টলারেন্স নীতিতে আমাদের মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সারাদেশ চষে বেড়াচ্ছেন। সুতরাং এই তিন পার্বত্য জেলার সমস্যা সমাধান করা আমাদের জন্য কঠিন কিছু না।” তাঁদের এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম অবস্থা সম্পর্কে তাঁদের চরম অজ্ঞতারই প্রকাশ পেয়েছে। যথাক্রমে দেশের এই এলিট বাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধানদের এমনিতর অজ্ঞতাই যদি থেকে থাকে, তাহলে দেশের সাধারণ মানুষ পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সম্পর্কে কতটুকু সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ জ্ঞান রাখেন তা বলাই বাহুল্য। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা একটি জাতীয় ও রাজনৈতিক সমস্যা এবং সারাদেশের বিদ্যমান মাদক সমস্যা কিংবা ধর্মীয় জঙ্গীবাদ বা সুন্দরবনের জলদস্যু সমস্যার মতো সমস্যা নয়, সেই ন্যূনতম বোধটুকুও তাদের মধ্যে অনুপস্থিত তা নি:সন্দেহে উদ্বেগজনক ও লজ্জাজনক। উক্ত আলোচনা সভায় খাগড়াছড়ি আসনের সাংসদ ও টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা যথার্থই বলেন, সমতলের সন্ত্রাসীদের কায়দায় আত্মসমর্পণ করার প্রক্রিয়া পাহাড়ে প্রযোজ্য হবে না। সমতলের প্রেক্ষাপট আর পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রেক্ষাপট এক নয়। বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে ভিন্ন। তিনি আরও বলেন, পাহাড়ের আইন-শৃঙ্খলার উন্নয়ন ঘটানো দরকার। তবে তা আলাপ আলোচনার ভিত্তিতে করা দরকার বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।
এক্ষেত্রে আলোচনা সভায় চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়ের বক্তব্যও বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেছেন যে, “আমার পূর্ণ আস্থা আছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি, তিনি এই সমস্যার সমাধান করতে পারেন। এখানে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান উপস্থিত নেই। আমি মনে করি তাঁর (সন্তু লারমা) সঙ্গে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ যত বেশি হয়, তত বেশি ভালো। এতে সব না হলেও আমাদের কিছু না কিছু সমস্যা যেগুলো আছে সেগুলোর সমাধান হবে।” তিনি আরো বলেছেন, “১৯৯৭ সালের আগের অবস্থায় যদি সমাধান হতে পারে, তাহলে এখানে দুইটি কিংবা চারটি আঞ্চলিক দলের সমস্যাও সমাধান হবে।” পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও স্বতন্ত্র শাসনব্যবস্থাকে তুলে ধরে রাজা দেবাশীষ আরো বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামে বিওপি ও বিজিবির ছাউনি স্থানান্তর, প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে মাঝে মধ্যে জটিলতা দেখা দেয়। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে সমতলে প্রযোজ্য অধিগ্রহণ আইনটি এখানে প্রযোজ্য নয়। এখানে বিশেষ রেগুলেশন রয়েছে।”
আলোচনা সভায় পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সম্পর্কে স্বরাষ্ট্র সচিব নতুন সংজ্ঞা আরোপ করে বলেছেন যে, “এই তিন জেলায় যে সমস্যা তা কোন ধর্ম বা জাতিগত সমস্যা নয়, এটি শুধুমাত্র গোষ্ঠীগত স্বার্থের সমস্যা, আর্থিক সমস্যা, সন্ত্রাসের সমস্যা। নৃ-তাত্ত্বিক মানুষের সাথে সাধারণ মানুষের কোন সমস্যা নেই।” বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পার্বত্য সমস্যা একটি জাতীয় ও রাজনৈতিক সমস্যা। পার্বত্য সমস্যা যে একটি জাতীয় ও রাজনৈতিক সমস্যা তা ১৯৮৫ সালে তৎকালীন এরশাদ সরকারের সাথে জনসংহতি সমিতির আনুষ্ঠানিক বৈঠক চলাকালে সরকার পক্ষ স্বীকার করে নিয়েছিলেন। রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকারের সাথে জনসংহতি সমিতির ঐতিহাসিক চুক্তিও সম্পাদিত হয়েছে। ২০১৬ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদের বৈঠকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন সংক্রান্ত তারকা চিহ্নিত প্রশ্নের উত্তরে প্রদত্ত ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুনর্ব্যক্ত করেন যে, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা রাজনৈতিক সমস্যা’। পার্বত্য চট্টগ্রামের এই রাজনৈতিক সমস্যাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য স্বরাষ্ট্র সচিবের মতো দেশের আমলাতন্ত্রের একশ্রেণির স্বার্থান্বেষী মহলের এধরনের গভীর ষড়যন্ত্রের কারণেই আজ পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া তথা পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়ে আছে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্যমান জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা স্বরাষ্ট্র সচিবের বক্তব্য থেকে সহজেই প্রমাণিত হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার হীনউদ্দেশ্যে পুলিশ প্রধান ড. পাটোয়ারী বলেছেন যে, “পর্যটনের অপার সম্ভাবনা এই তিন জেলায় রয়েছে, কিন্তু কতিপয় দুষ্কৃতির কারণে এ শিল্পের বিকাশ ঘটছে না, এখানে যদি সব স্বাভাবিক থাকতো, তাহলে সারাদেশের মানুষ একনজর দেখার জন্য এখানে ভীড় জমাতো, শুধু তাই নয়, বিদেশী পর্যটকের প্রচুর আগমন ঘটতো। …কতিপয় দুষ্কৃতিকারীকে আমরা প্রতিহত করে ছাড়বোই।” এই পর্যটন শিল্পের দোহাই দিয়ে হাজার হাজার একর জমি জবরদখলের কারণেই জুম্মদের শত শত পরিবার যে উচ্ছেদ হয়ে পড়েছে বা উচ্ছেদের মুখে রয়েছে এবং তাদের জীবন-জীবিকা বিপন্ন হয়ে পড়েছে তা আইজিপি মহোদয়ের জানা থাকলেও স্বীকার করার কথা না। কারণ তাঁর মতো আমলা ও প্রভাবশালীরাই সবচেয়ে বেশি পার্বত্য জেলায় অবৈধভাবে জমি লীজ নিচ্ছে বা পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন করছে। আর তিনি বিদেশী পর্যটকের দোহাই দিচ্ছেন, অথচ তারাই বিদেশীদের পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রবেশে এবং সরকারি কর্মকর্তাদের উপস্থিতি ব্যতিরেকে জুম্মদের সাথে বিদেশীদের কথা বলতে বাধানিষেধ আরোপ করেছেন।
আর পার্বত্য চুক্তিতে ‘পর্যটন’ বিষয়টি পার্বত্য জেলা পরিষদের আওতাধীন কার্যাবলী। কিন্তু এই পর্যটন বিষয়টি পরিচালনার জন্য পার্বত্য জেলা পরিষদকে যথাযথভাবে এখতিয়ার দেয়া হয়নি। চুক্তিকে লঙ্ঘন করে পার্বত্য জেলা পরিষদকে সীমিত এখতিয়ার দেয়া হয়েছে। অপরদিকে পার্বত্য জেলা পরিষদকে পাশ কাটিয়ে তথা বিদ্যমান আইন লঙ্ঘন করে সেনাবাহিনী, বিজিবি, জেলা প্রশাসনসহ বহিরাগত প্রভাবশালী ধনী ব্যক্তিরা পর্যটন ব্যবসায় জেকে বসেছে এবং পর্যটন শিল্প সম্প্রসারণের নামে বনসম্পদ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস, আদিবাসী গ্রাম উচ্ছেদ, মাদকাসক্তি ও পতিতাবৃত্তি বিস্তার ইত্যাদি অপকর্ম সাধন করে চলেছে। আইজিপি সাহেব পার্বত্যাঞ্চলের এই অসহায় ও প্রতিনিয়ত বঞ্চনার আগুনে দগ্ধ পাহাড়ি জনগণের মর্মবেদনা অনুভব করতে পারবেন বলে মনে হয় না। তাই তাঁর মতো ক্ষমতাধর লোকেরা একতরফা ও একচোখাভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, হানাহানির বিরুদ্ধে কথা বললেও পর্যটনের দোহাই দিয়ে আদিবাসীদের উচ্ছেদ ও জমি হারানোর বিরুদ্ধে কখনোই টু শব্দটিও করবেন না তা বলাই বাহুল্য। অনুরূপভাবে র্যাব মহাপরিচালক যেভাবে প্রশ্ন রেখে বলেছেন, “এখানে একশ্রেণির লোক বিশ্ববিদ্যালয় করতে বাধা দেয়, মেডিকেল কলেজ করতে বাধা দেয়, তারা কারা?” তাঁর উদ্যত কথাবার্তা থেকে এটা সহজে বলা যায় যে, তাঁর এই প্রশ্নের যথাযথ ও যুক্তিগ্রাহ্য উত্তর দেয়া হলেও তিনি সহজে বিষয়টা বুঝবেন এটা ভাবার কোন অবকাশ নেই। যে রাজনৈতিক দল ও যে দলের নেতৃত্বের অগ্রণী ও বলিষ্ঠ ভূমিকায় পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষা বিস্তার ঘটেছিল সেই দল বা নেতৃত্ব কেন বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিকেল কলেজ বিরোধিতা করছে তা বুঝতে হলে যে পরিমাণে গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল মানসিকতার অধিকারী হতে হয় সেই রকম বড় মাপের উদারতা ও চিন্তা-চেতনা র্যাব মহাপরিচালকের মতো লোকদের থাকবে বলে মনে হয় না।
আইজিপি বলেছেন যে, “প্রথম দিন আমরা প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের কথা শুনেছি, দ্বিতীয় দিন আমরা জনপ্রতিনিধি ও সুশীল সমাজের কথা শুনলাম।” র্যাব মহাপরিচালক বলেছেন, “আমরা এসেছি সাম্প্রতিককালে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন পার্বত্য জেলায় আকস্মিকভাবে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি যে অবনতি লক্ষ করছি এটার কারণ জানতে।” স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও তাঁর সফরসঙ্গী প্রায় প্রত্যেকে একই সুরে কথা বলেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো যাদের কাছ থেকে তিন পার্বত্য জেলার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কথা শুনেছেন তারা কারা? বলা অপেক্ষা রাখে না যে, পার্বত্য জেলায় যারা প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা রয়েছেন তারা বহিরাগত, সাম্প্রদায়িক ও পার্বত্য চুক্তি বিরোধী। সুতরাং সেইসব উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিষয়ে কী ধরনের মতামত আসবে তা বলাই বাহুল্য। জনপ্রতিনিধি ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে আলোচনা সভায় চুক্তি বিরোধী ও ক্ষমতাসীন দলের লোক, যারা বক্তব্য দিয়েছেন তাদের মধ্যে কয়েকজন বাদে সবাই সুযোগসন্ধানী তাঁবেদার ব্যক্তি। তাদের কায়েমী স্বার্থ হাসিলের জন্য পরিস্থিতিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে তারা বিভ্রান্তিমূলক, সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য-প্রণোদিত অভিমত তুলে ধরবেন তা না বলাই শ্রেয়। যেমন- আওয়ামীলীগের স্থানীয় নেতা এবং খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদের দুই চেয়ারম্যান যথাক্রমে কংজরী চৌধুরী ও বৃষকেতু চাকমা পার্বত্য চুক্তি ও চুক্তি মোতাবেক প্রণীত পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রণীত জাতীয় ভোটার তালিকা অনুয়ায়ী পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার দাবি জানিয়েছেন বলে জানা গেছে। পার্বত্য চুক্তির ফসল হিসেবে পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠিত হয়েছে এবং সেই পরিষদে আসীন হয়ে তারা আবার পার্বত্য চুক্তি পরিপন্থী মতামত প্রদান করছেন। চরম চুক্তি বিরোধী ও তাঁবেদারি দৃষ্টিভঙ্গি না হলে এধরনের আত্মঘাতী ও স্ববিরোধী মতামত কেউ তুলে ধরতে পারে না।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর আজ ২২ বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে। আওয়ামীলীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার আজ দীর্ঘ ১১ বছর ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় রয়েছে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারকে এ যাবৎ এগিয়ে আসতে কোন দৃশ্যমান ও সদিচ্ছাপূর্ণ উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। চুক্তি করে চুক্তি বাস্তবায়ন করা হবে না, প্রতারণা করা হবে, জুম্ম জনগণকে জাতিগতভাবে নিশ্চিহ্নকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে, পক্ষান্তরে নিজেদের ব্যর্থতাকে ও প্রতারণামূলক ভূমিকাকে ধামাচাপা দিতে তথাকথিত খুন, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির অভিযোগ তুলে দমন-পীড়নের হুমকি দেয়া হবেÑ এটা কোন গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তির নীতিবোধ হতে পারে না। মোদ্দা কথা হচ্ছে যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা হলে, সামরিক উপায়ে দমন-পীড়নের পরিবর্তে চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের উদ্যোগ নেয়া হলে, তবেই পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধান হবে। অন্যথায় পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হতে বাধ্য এবং তার জন্য সরকার কখনোই দায়ভার এড়াতে পারে না।