হিল ভয়েচ, ২ অক্টোবর, ২০০৯, বুধবার, বান্দরবান: কিছুদিন আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে অবৈধ পাথর উত্তোলনের ঘটনায় ব্যাপক তোলপাড় হয়। তবুও কাউকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি বা গ্রেফতার করা হয়নি। প্রভাবশালী ব্যক্তি ও ব্যবসায়ীরা এখনও সমানতালে বান্দরবান ও রাঙ্গামাটির পাহাড়ি ছড়া, ঝিরি, ঝর্ণা, খাল থেকে পাথর উত্তোলন করে চলেছেন। ক্রমাগত পাথর উত্তোলনের ফলে আদিবাসীদের জীবন-জীবিকা বিপন্ন হচ্ছে কারণ এর ফলে তাদের একমাত্র পানীয় জলের উৎস ঝিরি, ঝর্ণা ও খাল প্রথমেই শুকিয়ে যাচ্ছে। প্রায় সব আদিবাসীই তাদের পানীয় জল, চাষবাস, মাছধরা, গোসল, ধোয়ামোছা ইত্যাদির জন্য এসকল প্রাকৃতিক জলের উৎসের উপর নির্ভরশীল। পাহাড়ি ছড়া, ঝিরি, ঝর্ণা উক্ত উৎসসমূহ থেকে পানি পেয়ে বেঁচে থাকে। পাহাড় ও খাল থেকে অনিয়ন্ত্রিত পাথর উত্তোলন ভূমিধ্বস ঘটায়, পরিবেশের বাস্তুতন্ত্রের তারতম্য ঘটায় ও পানি দূষন ঘটায় যা ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনিরাপদ।
বিগত এক দশক ধরে এ পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। বিশেষ করে চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার রুই খাল, দাক খাল, দাকের পানছড়ি ঝিরি, ডেন ঝিরি ও টংকাবতী খাল থেকে পাথর তোলা হয়। রাঙ্গামাটি জেলাধীন কাউখালী উপজেলার ১৫০ চাকমা পরিবারের প্রত্যন্ত গ্রাম চেলাছড়া থেকে গাছ কাটা হয় ও পাথর উত্তোলন করা হয়। বান্দরবানে বিভিন্ন উপজেলা যেমন- আলিকদম, লামা, থানচি, রুমা, নাইক্ষ্যংছড়ি, রোয়াংছড়ি ও সদর উপজেলা থেকে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করা হয়। গ্রীষ্মকালে যখন পানি শুকিয়ে যায় ও ঝিরি-ঝর্ণা মরা থাকে তখন পাথর উত্তোলনকারী অপরাধীচক্ররা বেশি সক্রিয় হয়। অবৈধভাবে উত্তোলিত এসব পাথর স্থানীয় পৌর কর্তৃপক্ষ, সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল বিভাগ, গণপূর্ত বিভাগ, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগ ব্যবহার করে থাকে। সাধারনত গ্রীষ্মকালে পানি শুকিয়ে যাওয়ার ফলে ছড়া ও খালের পানি প্রবাহ কমে যায় এবং ফলশ্রুতিতে সুপেয় পানির ঘাটতি দেখা যায়। ছড়া-ঝিরি থেকে পাথর উত্তোলন পানি সরবরাহ বা প্রাপ্যতাকে খারাপের দিকে নিয়ে যেতে পারে যেহেতু পাথর প্রাকৃতিকভাবে পানি সংরক্ষণ করে এবং এটি এর উৎসও বটে। পাথর উত্তোলনে পানি শুকিয়ে যাওয়ার ফলে ছড়া-নালার পাশে বসবাসকারী আদিবাসীরা সীমাহীন পানি সংকটে পড়ে এবং পানির বিকল্প উৎস না পেয়ে এলাকা ত্যাগ করে। অবৈধ পাথর উত্তোলন বন্ধে পাথর খেকোদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় প্রশাসন, বনবিভাগ, আইন প্রযোগকারী সংস্থা ও নিরাপত্তাবাহিনীসহ কোন কর্তৃপক্ষই সক্রিয় ভূমিকা পালন করেনি।
বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিল নভেম্বর মাসে পাথর উত্তোলনের সামগ্রিক প্রভাবের উপর স্বেচ্ছায় একটি ছয় মাসের জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করে। সেসময় তারা দেখতে পায়- শ্রমিকরা বড় বড় হাতুড়ি দিয়ে বড় বড় পাথরগুলো ভেঙে ছোট করে ভ্যানগাড়ীতে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। মূলত রাস্তা নির্মাণ ও রাস্তা মেরামতের জন্য এসব পাথর ব্যবহার করা হয়। এরকম নির্বোধ পাথর উত্তোলনের ফলে ১২০০০ পাহাড়ীকে ভুক্তভোগী হতে হয়েছে। বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত ১৭০ কিমি দীর্ঘ সাঙ্গু নদীতে পতিত বান্দরবান জেলার প্রায় সব পাহাড়ি ছড়া শুকিয়ে গেছে।
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, এ অপকর্ম ঠেকাতে স্থানীয় প্রশাসন দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে পারেনি।স্থানীয় হেডম্যান ও কার্বারীদের যোগসাজশে লাভের আশায় এরকম অবৈধ কাজে কিছু সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে টাকা বিনিয়োগের অভিযোগ রয়েছে। দুর্যোগ ও জরুরী প্রস্তুতি চিহ্নিতকরনে স্থানীয় জ্ঞান এবং অর্থায়ন করার নিমিত্তে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা দ্বারা পরিচারিত বাংলাদেশে একটি উদ্ভাবনী গবেষনাগার রয়েছে যা দুর্যোগ প্রস্তুতির ১২টি স্থানীয় উদ্ভাবন খুঁজে পেয়েছে। প্রকল্পটি যৌথভাবে ১৫টি ব্রিটিশ মানবিক এজেন্সির সমন্বয়ে গঠিত স্টার্ট নেটওয়ার্ক ও দুর্যোগ আক্রান্ত সম্প্রদায়ের নেটওয়ার্ক দ্বারা পরিচালিত হয় এবং ইউকে-এইড এতে অর্থায়ন করে থাকে।
২০১৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর বান্দরবানে নিরাপত্তাবাহিনীর যৌথ অভিযানে ১৬ জন শ্রমিককে গ্রেফতার করা হয়। তবে প্রকৃত অপরাধী কেউই ধরা পড়ে নি এবং মজার বিষয় যে, পাথর উত্তোলন ও পাথর ব্যবসা পূর্বেই মতই বহাল তবিয়তে চলমান রয়েছে। ৩১ অক্টোবর ২০১৮ তারিখে শত শত ছাত্রছাত্রী স্থানীয় পানি উৎস থেকে অবৈধ পাথর উত্তোলন বন্ধে জরুরী ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিতে বান্দরবান প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে। পাথর উত্তোলন বন্ধের দাবিতে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন ৪ এপ্রিল ২০১৮ তারিখে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে। ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর পাথর উত্তোলন বন্ধ ও অপরাধীদের গ্রেফতারের দাবিতে বান্দরবন প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে পরিবেশ বান্ধব নাগরিক সমাজ।
সূত্র: কাপেং ফাউন্ডেশন