হিল ভয়েস, ১৭ অক্টোবর ২০১৯, বান্দরবান: তিন পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহ তাদের ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের স্টাফ সদস্যদের শিক্ষা সফরে বিদেশে পাঠানোর জন্য প্রতিবছর দেড় কোটি টাকার অধিক ব্যয় করে থাকলেও, এমন সফর থেকে অর্জিত জ্ঞানের প্রয়োগ অস্পষ্টই থেকে যায়।
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ নুরুজ্জামানের তথ্য অনুসারে, সদস্যদের বিভিন্ন দেশে পাঠাতে প্রত্যেক পরিষদ মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে প্রতি বছর ৫০-৬০ লাখ টাকা গ্রহণ করে। “পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহ শক্তিশালীকরণ এবং তাদের কর্মচারীদের দক্ষতা উন্নয়ন” (স্ট্রেংথেনিক হিল ডিসট্রিক্ট কাউন্সিলস এন্ড ডেভেলপিং স্কিলস অব দেয়ার অফিসিয়ালস) নামে এক প্রকল্পের আওতায় তহবিলসমূহ বন্টন করা হয়ে থাকে। তবে, দ্য ডেইলি স্টার এই বছর বিভিন্ন সময়ে এইসব সফরে গিয়েছেন এমন অন্তত ১০ ব্যক্তির কাছে গেলে, তাদের কেউই সফরসমূহ থেকে প্রকৃতপক্ষে তারা কী শিক্ষা পেয়েছেন বলতে পারেন নি।
জানুয়ারি ও সেপ্টেম্বরের মধ্যে, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও মন্ত্রণালয়ের মোট ৮৩ জন কর্মকর্তা ও অন্যান্য সদস্য সাত পর্যায়ে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, চীন ও জাপান সফর করেন।
ডেইলি স্টার মন্ত্রণালয়ের ভ্রমণের অনুমোদন করা দাপ্তরিক চিঠিগুলোর নকল সংগ্রহ করেছে।
যারা ভ্রমণে গেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন পরিষদসমূহের সদস্য, চেয়ারম্যান, পরিষদসমূহ ও মন্ত্রণালয়ের হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা, হিসাব পরীক্ষণ কর্মকর্তা ও অন্যান্য স্টাফ সদস্যরা। চিঠি অনুসারে তাদের কারো কারো পরিবারের সদস্যরা সফরসঙ্গী হয়েছেন।
চিঠিসমূহ আরও উল্লেখ করেছে যে, সরকারের তহবিল থেকেই কর্মকর্তা ও অন্যান্য কর্মচারীদের খরচ বহন করা হবে, কিন্তু তাদের পরিবারের সদস্যদের নিজেদের খরচ বহন করতে হবে।
পার্বাত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক অতিরিক্ত সচিবের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মোঃ নজরুল ইসলাম, যিনি এই বছর ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া সফর করেছেন, তার সাথে যোগাযোগ করা হলে, তিনি বলেন, “খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ শিক্ষা সফরের জন্য বিদেশ যেতে পকেট খরচ হিসেবে আমাকে ১০০০ ইউএস ডলার দিয়েছিল।” তবে, নজরুলকে পরিষদের নিকট অর্থ প্রদানের কোন ভাউচার দাখিল করতে বলা হয়নি। সফর থেকে তিনি কী শিক্ষা পেয়েছেন তা জানতে চাইলে, তিনি বলেন, তিনি দুটো দেশের কিছু সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক স্থান পরিদর্শন করেন। তবে তিনি বলতে পারেননি, সফরসমূহ তার চাকরির সাথে কতটুকু সম্পর্কযুক্ত।
ডেইলি স্টার বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের হিসাব রক্ষণ ও হিসাব পরীক্ষণ কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবদুল মাজেদের সাথেও যোগাযোগ করেন, যিনি এই বছর চীন ও মালয়েশিয়া যান। কোন কিছু বলতে অস্বীকার করে এই কর্মকর্তা এই সংবাদ প্রতিনিধিকে এব্যাপারে তার সিনিয়র কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলার পরামর্শ দেন।
বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ মাহবুবুর রাহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “বাইরের দেশ থেকে আমাদের কোন কিছু শেখা প্রয়োজন, তবে এটা সত্য, আমরা আমাদের দেশে আমাদের অভিজ্ঞতা যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারি না।”
বিদেশ সফর থেকে অর্জিত তাদের জ্ঞান ও দক্ষতা কেন তারা প্রয়োগ করেনি তা জিজ্ঞেস করা হলে, তিনি আর কোন কিছু বলতে অস্বীকার করেন এবং পরিষদের অন্যান্য সিনিয়র কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলতে এই সংবাদ প্রতিনিধিকে অনুরোধ করেন।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী ফোনে এই সংবাদ প্রতিনিধিকে বলেন যে, এইসব বিদেশ সফরসমূহ সুফল বয়ে আনে। সুফল সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে, তিনি বলেন, তিনি ব্যস্ত এবং ফোনটি কেটে দেন।
এসব সফরকে আনন্দ ভ্রমণ হিসেবে অভিহিত করে, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য বাঞ্ছিতা চাকমা বলেন, “এগুলো সরকারের তহবিলের সম্পূর্ণ অপব্যবহার ছাড়া কিছু নয়।”
খাগড়াছড়ি সরকারী কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ ও সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) এর খাগড়াছড়ি শাখার সভাপতি বোধিসত্ত্ব দেওয়ানও এইসব শিক্ষা সফর সম্পর্কে প্রশ্ন তোলেন।
তিনি বলেন, “কেউ জানে না এসব বিদেশ সফর থেকে তারা কোন ধরনের জ্ঞান অর্জন করেন এবং বাংলাদেশে ইহা তারা কিভাবে প্রয়োগ করেন। এসব সফরসমূহ কেবল তাদের প্রমোদের জন্য তহবিলের অপব্যবহার ছাড়া কিছু নয়।”
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব আসমা তাসকিন বলেন, “এমন সফরের উদ্দেশ্য হচ্ছে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করা। এসব সফরে যাওয়া কেউ যদি এগুলিকে আনন্দ ভ্রমণ হিসেবে বিবেচনা করেন, তাহলে এটা তার ব্যক্তিগত ব্যর্থতা।” ফেরার পর সফরে অংশগ্রহণকারীদের কোন মূল্যায়ণ থাকে কিনা সে ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে, উপ-সচিব বলেন, তাদের এমন কোন কর্মপদ্ধতি নেই।
তিনি বলেন, ফেরার পর স্টাফ সদস্যরা, বিষয়টির উপর বিস্তারিতভাবে না বলে, সিনিয়র কর্মকর্তাদের সামনে তাদের সফর ও শিক্ষার উপর পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপনা প্রদর্শন করেন।
সূত্র: দ্য ডেইলি স্টার, ১৭ অক্টোবর ২০১৯