হিল ভয়েস, ১৪ অক্টোবর ২০১৯, খাগড়াছড়ির: পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাথমিক স্তরের পাহাড়ি শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের কার্যক্রম শুরু হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগেই। চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা ভাষায় প্রাক্–প্রাথমিক ও প্রাথমিকে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন হলেও ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম থমকে আছে শিক্ষকের অভাবে। খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় এ সমস্যা সমাধানে এগিয়ে এসেছেন একদল চাকমা তরুণ। ‘চাঙমা সাহিত্য বা’ নামের সাহিত্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংগঠনের সদস্য তাঁরা। উপজেলার ৯৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোনো সম্মানী ছাড়াই চাকমা শিশুদের মাতৃভাষায় পাঠ দিচ্ছেন তাঁরা। শেখাচ্ছেন বর্ণপরিচয়। তাঁদের কারণে উপজেলার কয়েক হাজার শিশু এখন চাকমা ভাষায় লিখতে ও পড়তে পারে।
চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি শুরু হয় চাঙমা সাহিত্য বা–এর বর্ণমালা শেখানোর কার্যক্রম। সেই থেকে এ পর্যন্ত ৩ হাজার ১০২ জন শিশুকে চাকমা বর্ণমালা শিখিয়েছেন এই সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীরা। ভাষা শেখানোর জন্য ‘পত্তম আদি পুদি’ নামের বর্ণ শিক্ষার বই প্রকাশ করেছে সংগঠনটি। বইটি সম্পাদনা করেছেন সংগঠনের সভাপতি ইনজেব চাকমা।
জানতে চাইলে ইনজেব চাকমা বলেন, ‘আমরা আলোকিত মানুষ পলান সরকারের একটি কথায় উদ্বুদ্ধ হয়েছি। তাঁর একটি উক্তি ছিল, বই পড়লে আলোকিত হই, না পড়লে অন্ধকারে রই। পলান সরকার গ্রামে গ্রামে বই বিলিয়েছেন। আমরাও মনে করি, নিজ ভাষায় বই না পড়লে অন্ধকারে থাকতে হবে। তাই চাকমা ভাষার বর্ণমালার সঙ্গে চাকমা শিশুদের পরিচিত করাচ্ছি আমরা।’
গত মঙ্গলবার সকালে উপজেলা সদর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ বাবুছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, চাঙমা সাহিত্য বা–এর সদস্য সোহাগী চাকমা দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের চাকমা বর্ণমালা শেখাচ্ছেন। সোহাগী চাকমা ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়ে বড় বড় করে চাকমা বর্ণমালা লিখেছেন। তাঁরা মুখে মুখে উচ্চৈঃস্বরে শিক্ষার্থীরা পড়ছে চুচ্যাঙা- কা, গুজঙ্যা- খা, পিজপুঝা- আ।
সোহাগী চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, তিনি দীঘিনালা সরকারি ডিগ্রি কলেজে স্নাতক শেষ বর্ষের ছাত্রী। তিনি চাঙমা সাহিত্য বা সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। এ সংগঠন থেকে চাকমা বর্ণমালা শিখে দক্ষিণ বাবুছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সপ্তাহের মঙ্গলবারে প্রাক্-প্রাথমিক, প্রথম শ্রেণি ও দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের চাকমা বর্ণমালা শেখান।
ওই বিদ্যালয়ের খুদে শিক্ষার্থীদের অনেকেই জানাল, ঘরে বাবা-মায়েরাও চাকমা বর্ণমালা জানে না বলে এত দিন তারা পড়তে পারেনি। আর এখন চাঙমা সাহিত্য বা–এর স্বেচ্ছাসেবীদের কারণে তারা বর্ণশিক্ষা পেয়েছে। চাকমা ভাষায় পড়তে পেরে ভীষণ খুশি তারা।
বানছড়া আনন্দময় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা বেনু মারমা বলেন, ‘আমার বিদ্যালয়ে চাঙমা সাহিত্য বা–এর পক্ষ থেকে সপ্তাহের একদিন এসে প্রাক্-প্রাথমিক, প্রথম শ্রেণি ও দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের চাকমা বর্ণমালা শেখানো হয়। শিক্ষার্থীরাও মনোযোগ সহকারে চাকমা বর্ণমালার সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। লিখছে ও শিখছে।’
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষক মাঈন উদ্দিন ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, উপজেলার ৯৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাঙমা সাহিত্য বা ভাষা শিক্ষার কার্যক্রম চালাচ্ছে। এটা একদিকে যেমন চাকমা শিক্ষার্থীদের বর্ণমালার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে, অন্যদিকে বিদ্যালয়ের চাকমা সম্প্রদায়ের শিক্ষক, শিক্ষিকাদের জন্যও সহায়ক হচ্ছে। বিদ্যালয়গুলোতে মাতৃভাষায় পাঠদান কার্যক্রমে শিক্ষক–শিক্ষিকারা এ অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারবেন।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চাকমা লেখক সদস্য আনন্দ মোহন চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, চাঙমা সাহিত্য বা নামে যে সামাজিক সংগঠন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের চাকমা বর্ণমালা শেখাচ্ছে, এটা অত্যন্ত প্রশংসনীয় উদ্যোগ। তবে সরকারিভাবে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া না হলে পাঠদান কার্যক্রমে গতি আসবে না।
চাঙমা সাহিত্য বা–এর সভাপতি ইনজেব চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুধু পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বিশ্বের অনেক জাতির ভাষা, বর্ণমালা হারিয়ে গেছে। আমরা চাই না আমাদের ভাষা, বর্ণমালা হারিয়ে যাক। আমরা চাই, প্রতিটি চাকমা শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই যেন আমাদের বর্ণমালা চেনে এবং বর্ণমালায় লিখতে পারে।’
সূত্রঃ প্রথম আলো, পলাশ বড়ুয়া, দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি