হিল ভয়েস, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৯, রবিবার, কানাডা: ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে পাঁচ প্রবাসী আদিবাসী জুম্ম সংগঠন, যেমন- সিএইচটি ইন্ডিজেনাস পিপলস কাউন্সিল অব কানাডা, ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল ফর দি ইন্ডিজেনাস পিপলস অব সিএইচটি, ফ্রান্সের ইউরোপিয়ান জুম্ম ইন্ডিজেনাস কাউন্সিল, আগরতলা থেকে চাকমা ন্যাশনাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া, নিউইয়র্ক থেকে আমেরিকান জুম্ম কাউন্সিল পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী অধিকারকর্মীদের অপরাধী হিসেবে চিহ্নিতকরণ বন্ধের এবং পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের স্বার্থে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের জন্য রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট একটি জরুরী আবেদন পেশ করে।
জুম্ম সমাজের সংগঠনসমূহ গভীর উদ্বেগ ও দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭ বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস)-এর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি (সংক্ষেপে ‘পার্বত্য চুক্তি) স্বাক্ষরের পর ২১ বছর অতিক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও, চুক্তির মূল বিষয়সমূহ অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে। ফলে শান্তি, উন্নয়ন, বেসামরিকীকরণ, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহের মাধ্যমে ক্ষমতার অংশীদারিত্ব এবং অঞ্চলের সুশাসনের ক্ষেত্রে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অর্থপূর্ণ সম্পৃক্ততার বিষয়ে এখনও অর্থপূর্ণ অগ্রগতি অর্জিত হয়নি।
পার্বত্য চুক্তির অবাস্তবায়িত মূল বিষয়সমূহের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যেমন- পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের আদিবাসী অধ্যুষিত বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ; পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের এখতিয়ারের আওতায় থাকা সকল বিষয় ও কর্মসমূহের হস্তান্তর, যেমন- সাধারণ প্রশাসন, আইন ও শৃঙ্খলা, পুলিশ, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন ও পরিবেশ, এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদি এবং তাদের কার্যকারিতা; পরিষদসমূহের নির্বাচন বিধিমালা ও ভোটার তালিকা বিধিমালা প্রণয়ন করে এই পরিষদসমূহের নির্বাচন অনুষ্ঠিতকরণ; পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের বিধিমালা প্রণয়ন ও ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তিকরণ; অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু ব্যক্তি ও ভারত প্রত্যাগত শরণার্থীদের, তাদের বেদখলকৃত ভূমি তাদের সঠিক মালিকানায় ফেরতদানসহ, তাদের স্ব স্ব বসতবাড়িতে পুনর্বাসন করা; কার্যত সেনাশাসন ‘অপারেশন উত্তরণ’সহ সকল অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করা; অস্থানীয়দের নিকট প্রদত্ত ভূমি লীজসমূহ বাতিলকরণ; পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্যমান সকল চাকুরিতে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়োগকরণ; পার্বত্য চট্টগ্রাম বিধিমালা ১৯০০, বাংলাদেশ পুলিশ আইন ১৮৬১ ও পুলিশ বিধিমালাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য অন্যান্য সকল আইনসমূহ চুক্তির আলোকে সংশোধন করা; যথাযথ সম্মান ও মর্যাদার সাথে বাঙালি মুসলিম সেটেলারদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে পুনর্বাসন করা।
পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সম্পূর্ণ বিচারহীনভাবে সামরিক ও আইন-প্রয়োগকারী বাহিনীর দ্বারা সুপরিকল্পিত মানবাধিকার লংঘন পূর্বের মতই অব্যাহত রয়েছে। সম্প্রতি সরকার ও সামরিক বাহিনী কর্তৃক সন্ত্রাসী, সশস্ত্র অপরাধী, চাঁদাবাজ, বিচ্ছিন্নতাবাদী ইত্যাদি আখ্যায়িত করে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি আনয়নের জন্য আন্দোলনে যুক্ত পিসিজেএসএস ও ইউপিডিএফ (ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট) এর সদস্য ও সমর্থকদেরসহ আদিবাসী অধিকারকর্মীদের সন্ত্রাসী/অপরাধী হিসেবে চিহ্নিতকরণ ভয়াভহভাবে জোরদার করা হয়েছে। যার ফল ডেকে এনেছে একতরফা গ্রেফতার, তথাকথিত ক্রসফায়ার ও বিচারবহিভূত হত্যাকান্ড, জোরপূর্বক নিখোঁজ, আটক ও ভয়ভীতি প্রদর্শন। সন্ত্রাসী ও অপরাধীদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের নামে, সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনী ও পুলিশ অব্যাহতভাবে বাড়ি তল্লাশী, মধ্যরাতে আদিবাসী গ্রামবাসীদের জাগিয়ে অস্ত্র গুজে দিয়ে একতরফা গ্রেফতার, নৃশংস শারীরিক আক্রমণ ও হয়রানি, আদিবাসী নারী ও শিশুর বিরুদ্ধে সহিংসতা চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি, আদিবাসী অধিকারকর্মী যারা জামিনে মুক্ত হচ্ছে তাদেরকে গোয়েন্দা সংস্থা ও সামরিক বাহিনী কর্তৃক বিনা ওয়ারেন্টে ধরে সেনাক্যাস্পে নিয়ে গিয়ে সেখানে নির্যাতন করা হচ্ছে এবং তাদেরকে নতুনভাবে অন্য সাজানো মামলায় জড়িত করে জেলে পাঠানো হচ্ছে এবং ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা কেবল পার্বত্য চট্টগ্রামে নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরেও লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যেমন সম্প্রতি সমতল জেলায় এক বৌদ্ধ ভিক্ষুকে হত্যা করা হয়েছে।
অতএব উপরোক্ত পরিস্থিতির আলোকে, তারা নিম্নোক্ত বিষয়ের উপর জরুরী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিকট আবেদন জানান:
(ক) পিসিজেএসএস ও ইউপিডিএফ এর সদস্য ও সমর্থকরাসহ আদিবাসী মানবাধিকার রক্ষায় নিয়োজিত কর্মীদের অপরাধী হিসেবে চিহ্নিতকরণ বন্ধ করা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে নির্বিচার সামরিক অভিযান, যা অবৈধভাবে বাড়ি তল্লাশি, একতরফা গ্রেফতার, তথাকথিত ক্রসফায়ার ও বিচারবহির্ভুত হত্যাকান্ড, জোরপূর্বক নিখোঁজ, আটক ও ভয়ভীতি প্রদর্শন ডেকে আনে তা বন্ধ করা।
(খ) পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের স্বার্থে, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল হতে কার্যত সামরিক শাসন ‘অপারেশন উত্তরণ’ ও সকল অস্থায়ী ক্যাম্প অবিলম্বে প্রত্যাহারসহ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের জন্য সময়ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করা।
(গ) বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসান ঘটানো এবং ২০১৩ ও ২০১৮-তে অনুষ্ঠিত মানবাধিকার পরিষদের ইউনিভার্সাল পিরিওডিক রিভিউ’র অঙ্গীকার অনুযায়ী নারী ও শিশুসহ আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর ন্যায়বিচার প্রাপ্তি নিশ্চিত করা।
আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করেন কানাডার সিএইচটি ইন্ডিজেনাস পিপলস কাউন্সিল এর সভাপতি প্রীতি বি চাকমা, ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল ফর দি ইন্ডিজেনাস পিপলস অব সিএইচটি এর সভাপতি আদিত্য কে দেওয়ান, ইউরোপিয়ান জুম্ম ইন্ডিজেনাস কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক শাক্য মিত্র চাকমা, চাকমা ন্যাশনাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া এর সহ-সাধারণ সম্পাদক শান্তি বি চাকমা ও আমেরিকান জুম্ম কাউন্সিল এর সভাপতি শান্ত তঞ্চঙ্গ্যা।