নির্বাচনী ইশতেহার ও আদিবাসী ইস্যু: একটি পর্যালোচনা

                                                  মঙ্গল কুমার চাকমা                                                              

            একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল ও জোটগুলো একে একে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নির্বাচনী ইশতেহার অনেকাংশে একটা কাগুজে দলিল হলেও জাতীয় নির্বাচন কালে এর গুরুত্বকে খাটো করে দেখার উপায় নেই। বলাবাহুল্য, নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীন দল বা বিরোধীদল অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি প্রতিপালনে আশানুরূপ আগ্রহ দেখায় না। তবুও জাতীয় নির্বাচন এলে আপামর দেশবাসীর সাথে আদিবাসী জনগণ রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারের প্রতি গভীরভাবে দৃষ্টি দিয়ে থাকে। দেশের নাগরিকদের মধ্যে সবচেয়ে প্রান্তিক ও পিছিয়ে পড়া দরিদ্র জনগোষ্ঠী এবং অবহেলিত আদিবাসী জাতিসমূহ তাদের অধিকার ও উন্নয়ন বিষয়ে কোন দলের কী পরিকল্পনা ও প্রতিশ্রুতি সেসব বিষয় খতিয়ে দেখতে গভীর আগ্রহ নিয়ে নির্বাচনী ইশতেহারগুলোর প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে থাকে। আদিবাসী জাতিসমূহের এই আকাক্সক্ষা থেকেই গত ১৭ ডিসেম্বর দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত হয় আদিবাসী তরুণ অধিকার কর্মী সোহেল হাজং-এর লেখা একটি অনবদ্য কলাম।

ইতিমধ্যে ঘোষিত নির্বাচনী ইশতেহারগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ইশতেহার ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রার বাংলাদেশ’। উক্ত ইশতেহারে “৩.২৯ ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও অনুন্নত সম্প্রদায়” শিরোনামে ১০৯ শব্দ সম্বলিত সমস্যার একটি পটভূমি রয়েছে। এরপর বিগত সময়ে এ বিষয়ে ১৫৮ শব্দের ছয়টি ‘সাফল্য ও অর্জন’ দেখানো হয়েছে এবং সবশেষে ভবিষ্যত ‘লক্ষ্য ও পরিকল্পনা’-এর অংশে ১১০ শব্দের পাঁচটি প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হয়েছে। ‘লক্ষ্য ও পরিকল্পনা’-এর অংশে প্রতিশ্রুতির মধ্যে নতুনত্ব হচ্ছে জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন ও সংখ্যালঘু বিশেষ সুরক্ষা আইন প্রণয়ন। আর সমতলের আদিবাসীদের (আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের ‘আদিবাসী’ আখ্যা থেকে ইউ-টার্ন দিয়ে ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’) জমি-জলাধার-বনের অধিকার, ভূমি কমিশন গঠন, সকল প্রকার বৈষম্যমূলক আইন ও অন্যায় ব্যবস্থার অবসান, সংস্কৃতি ও জীবনধারার স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণ ইত্যাদি বস্তুত ২০০৮ ও ২০১৪ সালের পূর্বের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির পুনরুল্লেখ বলে বলা যায়।

‘সাফল্য ও অর্জন’ অংশে ‘সমতলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জমি, জলাধার ও বন এলাকায় অধিকার সংরক্ষণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণসহ ভূমি কমিশনের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হয়েছে’ এবং ‘ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের জমি, বসতভিটা, বনাঞ্চল, জলাভূমি ও অন্যান্য সম্পদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে’ মর্মে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বাস্তব অবস্থা কি বলে? বিগত ১০ বছরে সমতলের আদিবাসীদের বেহাত হওয়া ভূমি উদ্ধারের জন্য ভূমি কমিশন গঠন তো দূরের কথা, গঠন করার চেষ্টা-চরিত্রের ছিটেফোটাও চোখে পড়েনি। অধিকন্তু বিগত বছরগুলোতে অব্যাহতভাবে ভূমি বেদখল ও স্বভূমি থেকে উচ্ছেদের নির্মম শিকারে পরিণত হয়েছে আদিবাসীরা। আর আদিবাসীসহ সংখ্যালঘুদের ভূমি জবরদখলের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন ও ক্ষমতার বাইরে থাকা প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো নেতা-কর্মীরা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত বলে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদ দাবি করে আসছে। ভূমি বেদখলের সাথে জড়িত ব্যক্তিদেরকে সরকারের বিগত দুই মেয়াদেও অব্যাহত দায়মুক্তির ফলে আদিবাসী ও সংখ্যালঘুদের ভূমি বেদখলের মাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে।

ক্ষমতাসীনদলের এবারের নির্বাচনী ইশতেহারে সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় যে, ‘লক্ষ্য ও পরিকল্পনা’-এর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের কথা উল্লেখ নেই। পার্বত্য চুক্তির ২১ বছরের মাথায় চুক্তি স্বাক্ষরকারী একটি দলের ইশতেহারে চুক্তি বাস্তবায়নের ইস্যুটি না থাকার বিষয়টি অবিশ্বাস্য মনে হলেও বাস্তবতা হচ্ছে তাই। এর মধ্য দিয়ে ‘এ সরকার আর চুক্তি বাস্তবায়ন করবে না’ বলে জনসংহতি সমিতির সভাপতি সন্তু লারমার যে আশঙ্কা তা অনেকটা বাস্তবে প্রমাণিত হতে বসেছে বলে বলা যেতে পারে। অপরদিকে ‘সাফল্য ও অর্জন’ অংশে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুন্তি বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে চুক্তির বিভিন্ন ধারা অনুযায়ী বিভিন্ন বিষয় আঞ্চলিক পরিষদ এবং জেলা পরিষদের নিকট ন্যস্ত করা হয়েছে’ এবং ‘ক্ষমতায়নের এই ধারা চুক্তির শর্তানুযায়ী অব্যাহত রাখার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে’ বলে উল্লেখ রয়েছে। অথচ এটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, এসব পরিষদে এখনো সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, পুলিশ (স্থানীয়), ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন ও পরিবেশ, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদিসহ স্বশাসনের অনেক বিষয় ও কার্যাবলী এখনো ন্যস্ত করা হয়নি। পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের পর ২১ বছর ধরে এসব পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য জেলার স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার প্রণয়নসহ নির্বাচন বিধিমালা ও ভোটার তালিকা বিধিমালা প্রণয়নের কাজ পূর্বের মতো বিগত ১০ বছরেও সরকার সম্পূর্ণভাবে ঝুলে রেখে দিয়েছে যা নি:সন্দেহে উদ্দেশ্য প্রণোদিত।

বিগত একদশক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকাকালে সরকার তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে কতিপয় বিষয় ও কর্ম হস্তান্তর, ৩৫টি অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার, ঢাকায় পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্স নির্মাণ, ২০১৬ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন সংশোধন ইত্যাদি বিষয়সমূহ বাস্তবায়ন করলেও ‘অপারেশন উত্তরণ’সহ অবশিষ্ট চার শতাধিক অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি পূর্বক আদিবাসীদের বেহাত হওয়া ভূমি ফেরতদান, ভূমি ইজারা বাতিল, ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তুদের তাদের স্ব স্ব জায়গা-জমি প্রত্যর্পণ পূর্বক পুনর্বাসন, পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি-অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের জন্য আইনী ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ, চুক্তির সাথে সঙ্গতি বিধানকল্পে ১৯০০ সালের শাসনবিধি ও ১৮৬১ সালের পুলিশ এ্যাক্টসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য আইনসমূহ সংশোধন, পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সেটেলার বাঙালিদের যথাযথ পুনর্বাসন ইত্যাদি বিষয়সমূহ বাস্তবায়নের কোন কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। পক্ষান্তরে সেনা শাসন অব্যাহত রেখে পার্বত্য চট্টগ্রামে ইসলামীকরণের ষড়যন্ত্র জোরদার করে চলেছে।

পর্যটন শিল্পসহ পার্বত্য জেলাগুলোর উন্নয়নে ইতোমধ্যে বেশ কিছু প্রকল্প গ্রহণ, পার্বত্য অঞ্চলে ভূমি অধিগ্রহণকালে সমতল ভূমির ন্যায় বাজার মূল্যের তিন গুণ ক্ষতিপূরণ প্রদান সিদ্ধান্তের কথা ‘সাফল্য ও অর্জন’ হিসেবে ইশতেহারে তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু যেখানে চুক্তিতে বিধৃত স্বশাসনের অধিকারগুলো বাস্তবায়িত হয়নি এবং তৎপ্রেক্ষিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ অনেকটা অকার্যকর অবস্থায় রয়েছে, সর্বোপরি আদিবাসীদেরকে স্বভূমি থেকে ক্রমাগত উচ্ছেদ ও ভূমি জবরদখল অব্যাহত রয়েছে এবং পার্বত্যাঞ্চলের জুম্মদের মানবাধিকার যেখানে প্রতিনিয়ত ভূলন্ঠিত হয়, সেখানে পার্বত্যাঞ্চলকে তথাকথিত উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে দেয়ার অর্থ হচ্ছে একটি রাজনৈতিক সমস্যাকে সামরিক ও অর্থনৈতিক উপায়ে সমাধানের র্প্বূবর্তী ভ্রান্তনীতি অনুসরণ করা, যার ফলশ্রুতিতে পূর্বের মতো পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে দিন দিন জটিল থেকে আরো জটিলতার দিকে ঠেলে দেওয়া এবং সামরিক ও উপনিবেশিক কায়দায় পার্বত্য অঞ্চলে শাসন চালিয়ে যাচ্ছে।

বিগত একযুগ ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বাইরে থাকা অন্যতম দল বিএনপির ইশতেহারে “ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়” শিরোনামে দু’টি লক্ষ্য তুলে ধরা হয়েছে। সেগুলো হলো- “পাহাড়ি ও সমতলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জীবন, সম্পদ, সম্ভ্রম ও মর্যাদা সুরক্ষা করা হবে। অনগ্রসর পাহাড়ি ও সমতলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর চাকুরী ও শিক্ষাক্ষেত্রে সকল সুবিধা এবং পার্বত্য অঞ্চলের উন্নয়ন কার্যক্রম জোরদার করা হবে।” এবং “দল, মত, জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে ক্ষুদ্র-বৃহৎ সকল জাতি গোষ্ঠীর সংবিধান প্রদত্ত সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মকর্মের অধিকার এবং জীবন, সম্ভ্রম ও সম্পদের পূর্ণ নিরাপত্তা বিধান করা হবে। এই লক্ষ্যে ধর্মীয় সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে।”

পূর্বের মতো এবারের ইশতেহারেও বিএনপি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন, সমতলের আদিবাসীদের ভূমি অধিকারের মূল বিষয়গুলো সযত্নে এড়িয়ে গেছে। এ থেকে এটা নি:সন্দেহে বলা যায় যে, আদিবাসী জাতিসমূহের সমস্যার অন্যতম প্রধান দিকসমূহ, যেমন পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক বিশেষ শাসন ব্যবস্থা ও সমতলের আদিবাসীদের জীবন ধারার নিরাপত্তাসহ আদিবাসী জনগণের ভূমি সমস্যা সমাধানে বিএনপির ইশতেহারে প্রতিফলন নেই। বলাবাহুল্য ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরকালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট পার্বত্য চুক্তির বিরোধিতা করেছিল। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গেলে পার্বত্য চুক্তি বাতিল করবে মর্মে ১৯৯৭ সালে চুক্তি স্বাক্ষরকালে বিএনপি ঘোষণা করলেও ২০০১ সালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে বিএনপি অবশ্য পার্বত্য চুক্তি বাতিল করেনি। ‘জেলা ও উপজেলা যুব উন্নয়ন কার্যালয়’ রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদে কিছু বিষয় হস্তান্তর করলেও চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। বরঞ্চ চারদলীয় জোট সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে নানাভাবে ক্ষুন্ন করে। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনব্যবস্থার মর্যাদা ক্ষুন্ন করার নানা কার্যক্রম গ্রহণ করে। বিএনপির ইশতেহার পর্যবেক্ষণে এটা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা ও দেশের আদিবাসী জাতিসমূহের সমস্যা রাজনৈতিক উপায়ে সমাধানের ক্ষেত্রে বিএনপি এখনো দুই দশক পূর্বের সাম্প্রদায়িক অবস্থান থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি এবং জুম্ম জনগণসহ আদিবাসী জাতিসমূহের অস্তিত্ব সংরক্ষণে এখনো নীরব।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট-এর নির্বাচনী ইশতেহারে “২৭. ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী” শিরোনামে উল্লেখ করা হয় যে, “সংখ্যালঘুদের মানবিক মর্যাদা, অধিকার, নিরাপত্তা এবং সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় ন্যূনতম ঘাটতি খুব গুরুত্বের সাথে নিয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে। সংখ্যালঘুদের ওপর যে কোনো রকম হামলার বিচার হবে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে। পাহাড় এবং সমতলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের সংস্কৃতি রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হবে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকায় অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বৃদ্ধির মাধ্যমে তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন করা হবে।”

সংখ্যালঘুদের ওপর যে কোনো রকম হামলার বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের লক্ষ্য নি:সন্দেহে ইতিবাচক বলে বিবেচনা করা যায়। তবে নির্বাচনী ইশতেহারের বয়ান থেকে এটা বলা যেতে পাারে যে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টও পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা ও দেশের আদিবাসীদের সমস্যাকে কেবল অর্থনৈতিক সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করতে আগ্রহী। এ সমস্যাকে রাজনৈতিক ও জাতীয় সমস্যা হিসেবে, ভূমি অধিকার প্রতিষ্ঠার ইস্যু হিসেবে দেখতে অনাগ্রহী। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক উপায়ে ও জাতীয়ভাবে সমাধানের লক্ষ্যে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নেও ঐক্যফ্রন্ট ইশতেহারে কোন প্রতিশ্রুতি নেই। অথচ গণফোরামের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ একসময় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন এবং দেশের আদিবাসী জাতিসমূহের সাংবিধানিক স্বীকৃতি বিষয়ে ছিলেন অতিশয় সোচ্চার। ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শরিক গণফোরাম, জাসদ (রব), নাগরিক ঐক্যের মতো গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িকতার দাবিদার রাজনৈতিক দলগুলো থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও আদিবাসী ইস্যুতে ইশতেহারে আরো সুস্পষ্ট, সুনিদিষ্ট ও বাস্তবসম্মত রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি থাকা উচিত ছিল বলে বলা যেতে পারে।

জাতীয় পার্টি (এরশাদ) এর ১৮ দফা নির্বাচনী ইশতেহারে আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নামে পৃথক কোন প্রতিশ্রুতি নেই। তবে “ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা” শিরোনামে ১৮তম দফায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ৩০টি আসন সংরক্ষণ, চাকরি ও উচ্চশিক্ষার সুযোগ, সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় ও কমিশন গঠনের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। জাতীয় পার্টির ইশতেহারেও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ও আদিবাসীদের অন্যতম প্রধান সমস্যা- ভূমি সমস্যার বিষয়টি উল্লেখ নেই। বরাবরের মতো জাতীয় পার্টির ইশতেহার অন্যতম স্বাতন্ত্র্য বিষয় হচ্ছে দেশে প্রাদেশিক ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং ফেডারেল সরকার। প্রাদেশিক ব্যবস্থায় একসময় পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে নিয়ে পৃথক একটি প্রদেশের প্রস্তাব থাকলেও পরে তা তুলে দেয়া হয়। এবারের ইশতেহারেও সেই প্রস্তাব পুনর্বহাল করা হয়নি।

বাম গণতান্ত্রিক জোটের ইশতেহারে “১৮. বিভিন্ন জাতিসত্তা, আদিবাসী সমাজ ও দলিতদের যথাযথ স্বীকৃতি ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করা” শিরোনামে আদিবাসী হিসেবে বিভিন্ন জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও জাতিসংঘের আদিবাসী অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্রের অনুস্বাক্ষর; ভূমি কমিশনের মাধ্যমে আদিবাসীদের জমি ফেরত দেয়া, পর্যায়ক্রমে সামরিক বাহিনী প্রত্যাহারসহ পার্বত্য চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন; সমতলের আদিবাসীদের জন্য ভূমি কমিশন গঠন ও খাসজমি বন্টনে তাদেরকে অগ্রাধিকার বিষয়গুলো অনুর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাম গণতান্ত্রিক জোটের এই ইশতেহারে মোটামুটি আদিবাসীদের সমস্যার মৌলিক ইস্যুগুলো সমাধানের প্রতিশ্রুতি যথাযথভাবে তুলে ধরা হয়েছে বলে বলা যেতে পারে। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি-বাঙালি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, পাহাড়ে প্রথাগত প্রতিষ্ঠানের শোষণ নিয়ন্ত্রণ বন্ধ করা ইত্যাদি বিষয়গুলো অস্পষ্ট ও বিভ্রান্তিকর বলে প্রতীয়মান হয়েছে।

এছাড়া বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টির ‘ভিশন-মুক্তিযুদ্ধ ৭১’ নামে ইশতেহারে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি, মাতৃভাষায় শিক্ষা, পার্বত্য চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন, অন্যায়-অবিচার বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছে। একই ধারায় ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ (ইনু), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টিও ইশতেহার ঘোষণা করেছে।

এবারের নির্বাচনী ইশতেহারগুলোতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসমূহ সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় গঠন, সংখ্যালঘু কমিশন গঠন ইত্যাদি নতুন প্রতিশ্রুতি তুলে ধরেছে। এটা নি:সন্দেহে ইতিবাচক এবং আদিবাসী ও সংখ্যালঘু অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একধাপ অগ্রগতি বলা যায়। তবে আদিবাসীসহ সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণে জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার পরিষদসমূহে আসন সংরক্ষণের জন্য জাতীয় পার্টি ব্যতীত অন্য কোন দলের ইশতেহারে ঠাঁই পায়নি। বলাবাহুল্য, জাতীয় সংসদে আদিবাসীদের জন্য ১৫টি আসনসহ সংখ্যালঘুদের জন্য ৬০টি আসন সংরক্ষণের জন্য জাতিগত, ভাষাগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা দাবি করে আসছে। সেই রাজনৈতিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত না করে কেবল সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় গঠন করা গোড়ায় পানি না ঢেলে আগায় ঢালার সামিল বলে বিবেচনা করা যায়। বস্তুত আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি দেশে গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও সমাজ বিনির্মাণের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে গ্রোথিত। কিন্তু এবারের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারগুলোতে এ বিষয়গুলো ছিল অবহেলিত, অস্পষ্ট ও বিভ্রান্তিকর। রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারে প্রধানত উন্নয়নের প্রতিশ্রুতিতেই ছিল ঠাসা। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন, জাতিসত্তা সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান ইত্যাদি বিষয়গুলো ছিল কার্যত উপেক্ষিত। এটাই হচ্ছে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বড় ধরনের আদর্শিক চ্যালেঞ্জ।

More From Author