হিল ভয়েস, ১১ ডিসেম্বর ২০২১, ঢাকা: পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির দুই যুগ পূর্তি উপলক্ষ্যে অবিলম্বে চুক্তি’র শত ভাগ বাস্তবায়নের দাবীতে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের উদ্যোগে এক বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে।
আজ ১১ ডিসেম্বর (শনিবার), সকাল ১০.০০ টা’য় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশ থেকে উক্ত দাবিতে একটি মিছিল শুরু করে সংগঠনটি। মিছিল’টি ঢাবি’র কলাভবন প্রদক্ষিণ করে ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ ভবন পেরিয়ে শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের সামনে গিয়ে শেষ হয়। মিছিল শেষে একটি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় রাজধানী শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের সামনে।
পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক জিকো চাকমা’র সঞ্চালনায় এবং কেন্দ্রীয় তথ্য প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক রেং ইয়ং ম্রো’র সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংগঠনটি’র কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যবিলন চাকমা। এছাড়া উপস্থিত থেকে সংহতি বক্তব্য রাখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’র সহ-সভাপতি ও সাবেক সাংসদ ঊষাতন তালুকদার, সংগঠনটি’র কেন্দ্রীয় স্টাফ সদস্য চঞ্চনা চাকমা। এছাড়াও উপস্থিত থেকে সংহতি বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস।
স্বাগত বক্তব্যে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যবিলন চাকমা বলেন, আজ পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের দুই যুগ অতিক্রান্ত হচ্ছে। চুক্তির মূল উদ্দেশ্য ছিল নিপীড়িত আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং পার্বত্য সমস্যাকে শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করা। কিন্তু চুক্তির এই লিখিত দলিল থাকার পরও সরকার আজ অবধি বিভিন্নভাবে তালবাহানা করে যাচ্ছে। চুক্তি যদি বাস্তবায়ন করা না হয় তাহলে আগামীতে পাহাড়ে সকল অনাকাঙ্খিত ঘটনার জন্য সরকারকেই দায় নিতে হবে।
চুক্তি বাস্তবায়ন না করাটা প্রতারণা’র দাবী করে জনসংহতি সমিতি’র সহ-সভাপতি ও সাবেক সাংসদ ঊষাতন তালুকদার বলেন, বর্তমান সরকার একাধারে অনেক বছর ক্ষমতায় আছেন। আর চুক্তির আজ চব্বিশ বছর হল। এটা কী কম সময়? পার্বত্য সমস্যা কেবল একটি আঞ্চলিক সমস্যা নয়, এটি একটি জাতীয় সমস্যা, সেটা বুঝে নিয়েই সরকার চুক্তি করেছিল। আর সেজন্য সমগ্র দেশের মানুষকে এই সমস্যা নিয়ে ভাবতে হবে।
তিনি আরো বলেন, আমরা ত্রিশ লক্ষ শহীদ ও দু’ লক্ষ মা-বোনের সম্রমের বিনিময়ে স্বাধীনতা পেয়েছি। কিন্তু চুক্তি হওয়ার পরেও দেশের একটি অঞ্চল (পার্বত্য অঞ্চল) কীভাবে নিগৃহীত থাকবে, উপেক্ষিত থাকবে? আর চুক্তি নিয়ে কেন অপপ্রচার হবে বলেও প্রশ্ন রাখেন তিনি। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামকে কেন এভাবে জঞ্জাল অবস্থায় রাখা হয়েছে? সরকার বলে আমরা (পাহাড়ী’রা) বিভক্ত হয়ে গিয়েছি। দুর্বল হয়ে গিয়েছি। কিন্তু এই বিভক্তি, উপদল সৃষ্টি কার পয়সায় হচ্ছে, কার পকেট থেকে হচ্ছে তা জানতে চান সাবেক এই সাংসদ। পার্বত্য চুক্তি কেবল সন্তু লারমা ও আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ্’র সাক্ষরিত চুক্তি নয়, এটি পার্বত্য সমস্যা’কে সমাধানের জন্যই করা হয়েছে। কাজেই পাহাড়ের সমস্যা সমাধানে অবিলম্বে পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নেরও দাবী জানান জনসংহতি সমিতি’র এই নেতা।
সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, যে বাঙালি চব্বিশ বছর পাকিন্তানের জাতিগত নিপীড়নের শিকার হয়েছে, ভাষাগত নিপীড়নের শিকার হয়েছে; সে বাঙালিই এখন পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের নিপীড়ন করছে। পাহাড়ে যা চলছে তা নির্জলা সামরিক শাসন। পার্বত্য চুক্তির দুই যুগ পেরিয়ে গেছে। অনেক প্রতারণা হয়েছে, অনেক জালিয়াতি হয়েছে। আদিবাসীদের জমি দখল হয়েছে, ভমি দখল হয়েছে, নারী দখল হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে লেক’ এর বিনিময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার কথা। কিন্তু সে বিদ্যুৎ এখনো আদিবাসীরা পায়নি। বরং আজকে সেখান থেকে বিতাড়িত হয়ে এক লক্ষ চাকমা ভারতে’র অরুণাচলে বাস করে। কাজেই পার্বত্য সমস্যা সমাধানে অবিলম্বে পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন দাবী করেন এই শিক্ষক।
সংহতি বক্তব্যে জনসংহতি সমিতি’র স্টাফ সদস্য ও নারী নেত্রী চঞ্চনা চাকমা বলেন, পার্বত্য চুক্তি হয়েছে, কিন্তু আজও পর্যন্ত সেই চুক্তি বাস্তবায়নের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। পার্বত্য চট্টগ্রামে কার্যত ৫২ বছর ধরে সেনাশাসন চলছে। এই সেনা শাসন পাকিস্তান আমল থেকে আজ পর্যন্ত অব্যাহত আছে। অন্যদিকে সংবিধানে আদিবাসীদের বাঙালি বানানো হয়েছে। এভাবে নানা প্রতারণা ও নিপীড়নের ভেতর দিয়ে আদিবাসীদের’কে নিশ্চিহ্ন করা হচ্ছে বলেও দাবী করেন এই নারী নেত্রী।
এদিকে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নিপন ত্রিপুরা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়ন, শান্তি ও সম্প্রীতি’র জন্য চুক্তি করা হয়েছিল। তাছাড়া চুক্তিতে পাহাড়ের মানুষের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষরের পরও পাহাড়ে অপারেশন দাবানলের পর অপারেশন উত্তেরণের নামে পাহাড়ে সেনাশাসন চলমান। চুক্তির মাধ্যমে যে ভূমি কমিশন গঠন করা হয়েছে তাও যথাযথভাবে কার্যকর করা হচ্ছে না। বরং সেখানে পুনর্বাসিত সেটলার বাঙালি’দের সংগঠন পার্বত্য নাগরিক পরিষদ’কে নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হচ্ছে ও জুম্ম জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন একটি গোষ্ঠীকে মদদ দিয়ে বিভিন্ন দল গঠন করা হচ্ছে। এসব বন্ধ করা না হলে পাহাড়ের ছাত্র সমাজ তাদের করণীয় নির্দিষ্ট করতে দ্বিধা করবে না বলেও হুশিয়ারী দেন এই ছাত্র নেতা।
এদিকে সমাবেশের সভাপতি ও পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় তথ্য প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক রেং ইয়ং ম্রো সভাপতির বক্তব্যে বলেন, পার্বত্য চুক্তি নিয়ে শঠতা ও প্রতারণার উৎকৃষ্ট উদাহরণ আমরা বিগত দুই যুগ ধরে দেখে এসেছি। দুই যুগ পরও চুক্তি’র বাস্তবায়ন তো হয়ই নাই বরং রাষ্ট্র পক্ষ পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের দিবসে উৎসব করছে। এই প্রতারণা ও সদিচ্ছার অভাব প্রত্যেকটি পরতে পরতে দেখতে পায়। সম্প্রতি বান্দরবানের চিম্বুকে হাজার হাজার একর জমি দখলের চেষ্টা করা হয়েছে। চুক্তির পরও আমাদের পাহাড়ীদের’কে যন্ত্রণা’র মধ্যে রাখা হয়েছে এবং মানুষ তার অধিকারের কথা বলতে পারছে না। যারা পাহাড়ে আইন শৃংখলা রক্ষার নামে গেছে তাদের দ্বারাই আইন শৃংখলা’র অবনতি ঘটতে চলেছে বলেও অভিযোগ করেন এই ছাত্রনেতা। এসবের অবসানে অবিলম্বে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবীও করেন তিনি।
সমাবেশে আরো বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় সভাপতি অনন্ত বিকাশ ধামাই, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক দীপক শীল এবং বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অলিক মৃ প্রমুখ।