পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন না করে শেখ হাসিনার সরকার খারাপ নজির সৃষ্টি করছে

সজীব চাকমা

এক.

সবাই জানেন, আজকের পার্বত্য চট্টগ্রামসহ চট্টগ্রাম অঞ্চলের কিয়দংশ জুড়ে স্মরণাতীত কাল থেকে আজকের জুম্ম নামে পরিচিত আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর মানুষরাই বিচরণ, বসবাস ও রাজত্ব করেছিলেন। এই অঞ্চলে প্রাচীনকালে সংঘটিত নানা যুদ্ধবিগ্রহে তাদের ছিল যুগপৎ নানা ভূমিকা ও ভোগান্তি। এমনকি মোঘল ও ব্রিটিশ আধিপত্যের বিরুদ্ধেও তারা লড়েছিলেন বীরত্বের সাথে নিজেদের স্বাধীন সত্তা ও ভূখন্ড রক্ষার লক্ষে। বস্তুত ১৮৬০ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের জেলা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এই আদিবাসী জুম্ম জাতিগোষ্ঠী এই ভূখন্ডে স্বাধীনভাবে স্বশাসন নিয়েই বসবাস করেছিলেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীন হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মরা একপ্রকার স্বশাসনের স্বীকৃতি পায় এবং বহিরাগত অনুপ্রবেশ ও ভূমি আগ্রাসন থেকে রক্ষা পায়। ফলে ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯৮% ভাগই ছিল আদিবাসী জুম্ম।

কিন্তু এর পরবর্তী পাকিস্তান আমলে এবং বিশেষ করে স্বাধীন বাংলাদেশ আমলে শাসকগোষ্ঠীর আধিপত্যবাদী ও বিমাতাসুলভ ভূমিকার কারণে জুম্মদের জাতীয় অস্তিত্ব ক্রমাগত বিপন্নতা ও বিলুপ্তির দিকে ধাবিত হতে থাকে। সাম্প্রদায়িক ও ইসলামি রাষ্ট্র পাকিস্তানি আমলে শুরু হয় উন্নয়নের নামে কাপ্তাই বাঁধ দিয়ে হাজার হাজার জুম্ম পরিবারকে উচ্ছেদ এবং বহিরাগত অনুপ্রবেশের মাধ্যমে জুম্ম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করার ষড়যন্ত্র। এই সময়ে বহু জুম্ম চিরদিনের জন্য জন্মভূমি ও স্বদেশ ছেড়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার (এম এন লারমা) নেতৃত্বে জুম্মরা অনেক আশা-ভরসা নিয়ে সরকারের নিকট তাদের স্বকীয়তা ও জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে স্বায়ত্তশাসন চাইলেন। এক পর্যায়ে ১৯৭২ সালে জুম্মদের স্বাধিকার রক্ষার লক্ষে এম এন লারমার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা হয় জুম্মদের একমাত্র ও প্রতিনিধিত্বকারী প্রথম রাজনৈতিক পার্টি পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি। গণপরিষদ ও সংসদ সদস্য হিসেবে এম এন লারমা সংসদেও জুম্মদের অধিকার রক্ষার জন্য বিশেষ রাজনৈতিক ব্যবস্থা চাইলেন এবং অনেক আবেদন-নিবেদন ও যুক্তি প্রদর্শন করলেন। কিন্তু ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি শাসন-শোষণ ও জুলুমের বিরুদ্ধে লড়াই করে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের শাসনকর্তারা জুম্মদের জাতীয় অস্তিত্বকে ও অধিকারকে অবজ্ঞা করলেন এবং অস্বীকার করলেন। ফলে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রেও জুম্মদের মানবাধিকার ও ভবিষ্যত জাতীয় জীবন অনিশ্চয়তা নিয়েই যাত্রা শুরু করল।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এক সামরিক অভ্যুত্থানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যাকান্ডের পর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সকল পথ রুদ্ধ হলে জনসংহতি সমিতি সশস্ত্র সংগ্রামে যেতে বাধ্য হল। বাংলাদেশ সরকারও ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি কায়দায় জুম্মদের কন্ঠ রুদ্ধ করতে চাইল। সেনাবাহিনী নির্ভর বেসামরিক সরকার বা সামরিক শাসকরা এবং তাদের দোসররা জুম্মদের আন্দোলন দমনের নামে এক ডজনের মত পাশবিক গণহত্যা চালাল, সাধারণ জুম্মদের উপর বহু সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত করা হল, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হল, সহায়-সম্পত্তি ধ্বংস ও লুট করা হল, হাজার হাজার নিরপরাধ জুম্ম গ্রামববাসীকে ঘরছাড়া, গ্রামছাড়া, দেশছাড়া করা হল, খুন, অত্যাচার করা হল, দিনের পর দিন বিনাবিচারে আটক রাখা হল, জেলে প্রেরণ করা হল, অসংখ্য নারী-শিশুকে খুন, অপহরণ, ধর্ষণ, গণধর্ষণ করা হল।

আর এরই মধ্যে আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে থেকে সম্পূর্ণ অবৈধ ও বেআইনিভাবে এবং রাজনৈতিক অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে চার/পাঁচ লাখ বহিরাগত সাধারণ বাঙালিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে অনুপ্রবেশ ঘটানো হল। বর্তমানে ‘সেটেলার’ ও ‘অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে পরিচিত সেইসব বাঙালিকে জোরজবরদস্তিমূলকভাবে জুম্মদের ভূমি ও জমি বেদখল করে তাতে বসতিদান করা হল। এর মধ্য দিয়ে সাধারণ বাঙালিদের সাথে জুম্মদের মধ্যে এক কৃত্রিম দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টি করা হল। বস্তুত শাসকগোষ্ঠী ও সেনাপ্রশাসকরা চেয়েছিলেন জুম্মদের পাখির মত গুলি করে, পিঁপড়ে মনে করে তাদের বসতবাড়ি গুড়িয়ে দিয়ে, জায়গা-জমি কেড়ে নিয়ে, বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে, মুসলমান বানিয়ে, ডান্দা মেরে ঠান্ডা করে তাদের স্বকীয় অধিকারের আকাক্সক্ষাকে ধুলিস্যাৎ করতে। অপরদিকে দেশবাসী ও বহির্বিশ্বের কাছে জুম্মদের ন্যায্য আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে মিথ্যাভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদী, উপজাতীয় সন্ত্রাসী, রাষ্ট্রবিরোধী ইত্যাদি আন্দোলন বলে অপপ্রচার চালাল। ফলে অচিরেই জুম্মরা নিজভূমে পরবাসী জীবন বরণ করতে লাগলেন এবং গভীর জাতীয় অস্তিত্ব সংকটের সম্মুখীন হলেন। প্রশ্œ দেখা দিল, জুম্মরা কি নিজ ভূমি ও ভূখন্ডে নিজেদের অধিকার নিয়ে জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারবে? নাকি ইসলামি সম্প্রসারণবাদের আগ্রাসনে বিলুপ্ত হয়ে যাবে?

দুই.

মানুষ মাত্রই জন্মগতভাবে স্বাধীন এবং সমান মর্যাদার অধিকারী। সংখ্যালঘু হোক, সংখ্যাগুরু হোক প্রত্যেক জাতিই চায় স্বকীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য এবং আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার নিয়ে টিকে থাকতে ও বিকশিত হতে। অধিকার সচেতন মানুষ হিসেবে জুম্মরাও নিশ্চুপ ও হাত গুটিয়ে বসে থাকেনি। জুম্মদের দাবি ন্যায্য ও ন্যায়সঙ্গত দাবি। শূন্য হাতে শুরু করে জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে ‘শান্তিবাহিনী’র মাধ্যমে দুর্বার সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলা হল। অচিরেই শান্তিবাহিনী চৌকস গেরিলা বাহিনী হয়ে উঠল। এই শান্তিবাহিনীর অনেকেই যেমন অকাতরে বীরত্বের সাথে লড়াই করে জীবন দিয়েছেন, তেমনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অনেক সেনাদলকেও বিধ্বস্ত করতে ও হটিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন। সশস্ত্র লড়াইয়ে থাকলেও জনসংহতি সমিতি বরাবরই আলোচনার মাধ্যমে ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যা সমাধানে বিশ্বাসী এবং সচেষ্ট ছিল। একসময় সেনাপ্রশাসন ও বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য সমস্যাকে রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে স্বীকার করে আলোচনা করতে চাইলে জনসংহতি সমিতি আন্তরিকতার সাথে সম্মতি প্রদান করে। জনসংহতি সমিতি একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে। এক পর্যায়ে এরশাদ সরকার, বিএনপি সরকার ও আওয়ামীলীগ সরকারের সাথে পর্যায়ক্রমে আলোচনার টেবিলে বসে। যার ফলশ্রুতিতে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় কমিটি ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতেই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন সরকারের পক্ষে জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা)।

বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে চুক্তি সম্পাদন হওয়ার অন্যতম কারণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের ও অসাম্প্রদায়িক হিসেবে দাবি করা এই দলটি সেই সময়ে পার্বত্য সমস্যাকে জাতীয় ও রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে স্বীকার করে তা সমাধানে অধিকতরভাবে এগিয়ে এসেছিল। তারা বিভিন্ন সময়ে প্রতিশ্রুতি দেয় যে, ক্ষমতায় গেলে তারা পার্বত্য সমস্যার সমাধান করবে। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ জনসংহতি সমিতি ও জুম্ম জনগণ আশা ও ভরসা করেছিল যে, অন্তত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জুম্ম জনগোষ্ঠীর দুঃখ বোঝেন এবং জুম্মদের দুর্দশা লাঘবে ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসবেন। বাবা, মা, পরিবার হারানো এবং দীর্ঘদিন নিজেই অন্যায়ের শিকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিশ্চয়ই পার্বত্য মানুষের উপর অবিচার ও বঞ্চনা দূরীকরণে ভূমিকা রাখবেন। উল্লেখ্য, সেই সময় স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের পর জুম্মরা পরপর পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি সংসদীয় আসনে আওয়ামীলীগের প্রার্থীকে নির্বাচিত ও বিজয়ী করেছিলেন।

বলাবাহুল্য, পার্বত্য চট্টগ্রামের এইসব ইতিহাস অনেকেই জানেন। তবুও এসব তুলে ধরার উদ্দেশ্য হলো- যারা জানেন তাদেরকে আবারও স্মরণ করিয়ে দিতে এবং যারা জানেন না তাদেরকে জানাতে যে, জুম্মদের ন্যায্য অধিকারের দাবি কোনো রূপকথার গল্প বলা নয়। দুই দশকের অধিক গণতান্ত্রিক ও সশস্ত্র সংগ্রাম ছেলেখেলা ছিল না। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবির কথা মস্করার কথা নয়। পার্বত্য চুক্তি আকাশ থেকে টুপ করে পড়েনি অথবা কারোর দান-দক্ষিণায় পাওয়া জিনিস নয়। রক্তপিচ্ছিল সংগ্রামের পথ বেয়ে বহু মানুষের রক্ত, অসংখ্য মানুষের অসীম দুঃখ-দুর্দশা ও আত্মত্যাগ এবং বহু মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত হওয়া এই পার্বত্য চুক্তি। এটি আদিবাসী জুম্মসহ পার্বত্য অধিবাসীদের ন্যায্য অধিকারের সনদ। কাজেই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে যে কোনো ধরনের টালবাহানা, ষড়যন্ত্র, প্রতারণা, অবজ্ঞা প্রদর্শন, স্বার্থান্বেষণ, দালালি, মিথ্যাচার, রাজনৈতিক ধান্ধাবাজি কোনোভাবে কাম্য ও শুভ হতে পারে না। যারা পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন না করে বা চুক্তিকে পদদলিত করে সমস্যা সমাধানের কথা বলেন এবং দমন-পীড়ন করে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি স্থাপনের কথা বলেন তারা জনগণকে নিয়ে ধোঁকাবাজি করছেন এবং চরম রাজনৈতিক অনৈতিকতার উদাহরণ সৃষ্টি করছেন।

তিন.

জাতিগত শোষণ-আগ্রাসন-আধিপত্য এবং ঔপনিবেশিক, সামরিক, আমলাতান্ত্রিক, স্বৈরতান্ত্রিক, বৈষম্যমূলক শাসনব্যবস্থার কারণে নানা দেশে জাতিগত সমস্যা ও সংঘাত দেখা দেয়। একসময় রাশিয়া সংখ্যালঘু জাতিসমূহকে অধিকতর আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার ও স্বায়ত্তশাসন প্রদান করে এবং পশ্চিমা দেশসমূহে গণতান্ত্রিক, সমমর্যাদা ও সমতার ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটিয়ে এই জাতিগত সমস্যার সমাধানে অনেক সফলতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বহু জাতি, বহু সংস্কৃতির বিশাল দেশ প্রতিবেশী ভারতেও এখনও অনেক সমস্যা থাকলেও সেখানে বিভিন্ন সংখ্যালঘু বা আদিবাসী জনজাতির মানুষ পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সমতলের আদিবাসীদের তুলনায় বহুগুণে তাদের জাতিগত স্বীকৃতি ও স্বায়ত্তশাসনের অধিকার উপভোগ করে থাকে। এছাড়া ভারতে বাংলাদেশের তুলনায় মানুষের সাধারণ নাগরিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার অনেক শক্তিশালী। পার্বত্য চট্টগ্রামের মত পৃথিবীর কোথাও আদিবাসী এলাকায় দীর্ঘস্থায়ী সেনাশাসন তো নেইই, যত্রতত্র সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ ও উপস্থিতির কথা জানা যায় না।

কিন্তু বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিগত সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে চুক্তি করেও চুক্তি নিয়ে যে মিথ্যাচার ও প্রতারণা শুরু করেছে এবং তা বাস্তবায়ন না করে লংঘন করার পথ অবলম্বন করেছে তা নজিরবিহীনভাবে নেতিবাচক, বিপর্যয়কর ও অসততাপূর্ণ। ফলে ১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার পার্বত্য চুক্তি করে যে শান্তির শ্বেত কপোত উড়িয়েছিল সেই সরকারই আবার চুক্তির সাথে প্রতারণা করে সেনাশাসন, সেনা কর্তৃত্ব জারি করে সেই শ্বেত কপোতকে ভূলুন্ঠিত করে পদদলিত করে চলছে। চুক্তি স্বাক্ষরের পর কিছু ধারা বাস্তবায়িত করা হলেও এবং চুক্তির আলোকে পার্বত্য মন্ত্রণালয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, পার্বত্য জেলা পরিষদ, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন, ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনবার্সন কমিটি ইত্যাদি স্থাপন ও গঠন করা হলেও সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধিমালা প্রণয়ন বা কার্যকর এবং চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়িত না হওয়ায় চুক্তির প্রকৃত সুফল থেকে জুম্ম জনগণসহ সাধারণ পার্বত্য অধিবাসীরা বঞ্চিত হয়ে রয়েছে। কোনো ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি হয়নি এবং একজন জুম্মও তাদের ভূমি ফেরৎ পায়নি। স্থায়ী অধিবাসীদের নিয়ে ভোটার তালিকা হয়নি। সেনাশাসন ও অস্থায়ী সেনা ক্যাম্পসমূহ প্রত্যাহার করা হয়নি। নতুন করে সেনা ক্যাম্প স্থাপনসহ সেনাশাসন, সেনা কর্তৃত্ব ও সেনানির্যাতন জোরদার করা হয়েছে। বহিরাগত অনুপ্রবেশ ও নতুনভাবে ভূমি বেদখল বন্ধ হয়নি। চুক্তির পরেও জুম্মদের উপর ২০টির অধিক ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হয়েছে। প্রশাসনের ছত্রছায়ায় সুপরিকল্পিতভাবে জুম্মদের ইসলামে ধর্মান্তরিতকরণের কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি কর্তৃক এবং সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনী কর্তৃক নানা অজুহাতে জুম্মদের বাগান-বাগিচা, জুমভূমি ধ্বংস করে ভূমি বেদখল করা হচ্ছে, বিলাসবহুল পর্যটন ব্যবসা করা হচ্ছে।

দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে সরকার চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে একটি কথাই বলে যাচ্ছে- চুক্তির ৯৮% ভাগ বা অধিকাংশই অথবা চুক্তির ৪৮টি ধারা বাস্তবায়ন করা হয়েছে এবং বাকীগুলো আংশিকভাবে হয়েছে বা প্রক্রিয়ায় রয়েছে। অথচ দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকেও চুক্তির বাস্তবায়ন সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। উপরন্তু সরকার প্রতিনিয়ত চুক্তি লংঘন করে চলেছে এবং জুম্মদের জাতীয় অস্তিত্ব ও স্বার্থ পরিপন্থী নানা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে চলেছে। চুক্তির বর্ষপূর্তির সময় তারা আবার আড়ম্বরপূর্ণভাবে আনন্দ-ফূর্তির মধ্য দিয়ে নানা অনুষ্ঠানও করছে। কাজেই চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে সরকার যা বলছে বা যে হিসেব দিচ্ছে সেটা মিথ্যাচার ও প্রতারণার শামিল। এটা কোনোভাবে শুভবোধসম্পন্ন নয় এবং শুভলক্ষণ নয়। সত্য ও সততার একটা মূল্য আছে, সত্য ও সততা কী জনগণ তা জানে, সরকার সেটাও ভুলে গেছে।

পার্বত্য চুক্তির ২৪ বর্ষপূর্তিতে ঢাকায় আয়োজিত এক আলোচনা সভায় চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) বলেছেন, ‘পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে সরকার আন্তরিক নয়। বরং শাসকদল এখন পাহাড়ে দমন-পীড়নের পথ বেছে নিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম আজ বড় কারাগারে পরিণত হয়েছে। সেখানে বলার অধিকার নেই, জীবিকার অধিকার নেই। কারাগারের হাজতিরা যেমন করে থাকে, আজ তেমন করে পাহাড়ের মানুষ।’ তিনি আরও বলেন, ‘আজকে পার্বত্য অঞ্চলে জুম্ম জনগণকে যেভাবে শোষণ, বঞ্চনা ও নিপীড়ন করা হচ্ছে তা বলার ভাষা নেই। জনসংহতি সমিতি চুক্তির আলোকে যে আইনগুলো প্রণীত হয়েছে সেগুলোর বাস্তবায়ন চায়। কিন্তু সরকার জনসংহতি সমিতিকে সন্ত্রাসী দল হিসেবে চিহ্নিত করে বিভিন্ন স্তরে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাকর্মীদের নানাভাবে দমন-পীড়ন করছে। অনেক নেতাকর্মীকে আজ মামলা দিয়ে, গ্রেফতার করে, হামলা চালিয়ে নিপীড়ন চালানো হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রায় ৩০০ মামলা হয়েছে।’

কথা দিয়ে কথা রাখা বা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ না করা একটি গুরুত্বপূর্ণ মানবিক গুণ এবং পারস্পরিক বন্ধুত্বের অন্যতম ভিত্তি। পারস্পরিক বিশ্বাস, আস্থা গড়ে তোলা এবং শান্তি ও সমঝোতা স্থাপনের ক্ষেত্রেও এটা অপরিহার্য। পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে বর্তমান সরকার যা বলছে এবং যা করছে তা নিঃসন্দেহে প্রতারণা ও অসততার শামিল। এটি সরকার, সরকার দলের নেতা ও নেতৃত্ব সম্পর্কে অবশ্যই সুদুরপ্রসারী আস্থা ও বিশ্বাসের সংকট সৃষ্টি করবে এবং করেছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়িত হলে নিশ্চয়ই পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতির এবং আদিবাসীসহ পার্বত্য অধিবাসীদের সার্বিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন ব্যবস্থার উন্নতি হতে পারত। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের অধিবাসীরা নিঃসন্দেহে সবদিক দিয়ে অগ্রগতি লাভ করত। পার্বত্য চট্টগ্রাম স্থায়ী শান্তির অভিমুখে পদার্পন করতে পারত। বিভিন্ন জাতি মধ্যে, পাহাড়ি-বাঙালির মধ্যে এক মানবিক সম্প্রীতি ও শান্তির আবহ সৃষ্টি হত। সরকার যদি চুক্তি বাস্তবায়ন করত তা সারা বিশ্বের জন্য রোল মডেল হতে পারত। শুধু পার্বত্য চট্টগ্রাম নয়, সারা বাংলাদেশের মানসজগতে একটি উন্নত ও ইতিবাচক মূল্যবোধ জাগ্রত হত। কিন্তু এখনো পর্যন্ত শেখ হাসিনার সরকার প্রকৃতপক্ষে বেছে নিয়েছে প্রতারণা ও পুরনো দমন-পীড়নেরই পথ। অবশ্যই এটি একটি অত্যন্ত খারাপ নজিরই সৃষ্টি করছে।

More From Author