হিল ভয়েস, ২ ডিসেম্বর ২০২১, বিশেষ প্রতিবেদক: পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির দুই যুগপূর্তি উপলক্ষ্যে বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে রাঙ্গামাটি জেলার রাঙ্গামাটি পৌর এলাকা, বাঘাইছড়ি, জুরাছড়িসহ বিভিন্ন স্থানে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। বিভিন্ন সমাবেশে বক্তারা বলেন, পার্বত্য চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ায় পার্বত্য সমস্যা দিন দিন জটিল আকার ধারণ করছে। এই অবাস্তবায়িত চুক্তি বাস্তবায়িত করার জন্য লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য বক্তারা তরুণ সমাজকে উদাত্ত আহ্বান জানান।
রাঙ্গামাটি: জনসংহতি সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির উদ্যোগে রাঙ্গামাটির শিল্পকলা একাডেমীতে ২ ডিসেম্বর সকাল ৯:৩০ ঘটিকায় আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। জনসংহতি সমিতির জেলা কমিটির ডা. গঙ্গা মানিক চাকমার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশ সঞ্চালনা করেন জগদীশ চাকমা ও শান্তিদেবী চাকমা। স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি প্রকৃতি রঞ্জন চাকমা।
সমাবেশে স্বাগত বক্তব্য রাখেন হিল উইমেন ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ম্রানু মারমা। অপরদিকে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন, বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টির চট্টগ্রাম জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক অশোক সাহা, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য মেঞোচিং মারমা, সিএইচটি হেডম্যান নেটওয়ার্কের সহ সভাপতি এ্যাড. ভবতোষ দেওয়ান, বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টির রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সদস্য সৈকত রঞ্জন চৌধুরী, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কুশল চৌধুরী, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সভাপতি সুমন মারমা ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ম্রানু মারমা প্রমুখ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রকৃতি রঞ্জন চাকমা বলেন, আজকে আমরা এই দিনটিতে সমবেত হয়েছি তার একটাই উদ্দেশ্য, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়িত হোক। আমরা জানি যে গতিতে চুক্তি বাস্তবায়িত হওয়ার কথা, সেভাবে বাস্তবায়িত হয় নাই। এই পার্বত্য চুক্তির ধারাগুলোর মধ্যে পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন, আঞ্চলিক পরিষদ আইন, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি, উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করা জরুরী। আর এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ছাড়াও অবাস্তবায়িত সব ধারাগুলো যতক্ষণ বাস্তবায়িত না হচ্ছেততদিন আমরা আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যাবে। আমাদেরকে ধৈর্য্য ধরে এই চুক্তিকে বাস্তবায়ন করার জন্য রোডম্যাপ অনুযায়ী আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সভাপতি সুমন মারমা হতাশা করে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির দুই যুগপূর্তিতে হতাশা আর নিরাশ ছাড়া কিছুই পায়নি জুম্ম জনগণ। সময় যতই গড়িয়ে যাচ্ছে সমস্যা ততই জটিল হতে চলেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে যে সমস্যা বিরাজমান ছিল সেটা রাজনৈতিক এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য পার্বত্য চুক্তি সম্পাদন করা হয়েছে। কিন্তু তা না হয়ে সমস্যা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। আজকে জুম্ম ছাত্র ও যুব সমাজকে তা উপলব্ধি করতে হবে। ভাবতে হবে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা কোন দিকে ধাবিত হচ্ছে। সেজন্য আমাদের ছাত্র ও যুব সমাজকে সোচ্চার থাকতে হবে এবং প্রয়োজনীয় যা করণীয় তা করার জন্য অধিকতরভাবে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে সামিল হতে হবে।
বাঘাইছড়ি: ‘বাঘাইছড়ি উপজেলা সর্বস্তরের জনগণ’-এর উদ্যোগে ২ ডিসেম্বর সকাল ৯:৩০ ঘটিকায় বাঘাইছড়ির উগলছড়ি মুখ (বটতলা) নামক স্থানে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।
তুষার কান্তি চাকমার সভাপতিত্বে ও বিল্টু চাকমার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত অালোচনা সভায় স্বাগতিক বক্তব্য প্রদান করেন বাঘাইছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান অলিভ চাকমা। সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এম এন লারমা মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনের আহ্বায়ক বিজয় কেতন চাকমা এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন রুপকারি মৌজার হেডম্যান বিশ্বজিৎ চাকমা। এছাড়া সভায় বক্তব্য প্রদান করেন সারোয়াতুলী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান যতিন রায় চাকমা, বাঘাইছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সম্রাট সুর চাকমা, শিজক মৌজার কার্বারী সমাপ্তি দেওয়ান, সারোয়াতুলী ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মধুসুধন চাকমা
প্রধান অতিথি ও প্রধান বক্তা বিজয় কেতন চাকমা বলেন, শৃঙ্খলাই একটি জাতিকে শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে। যাদের শৃঙ্খলা নেই তারা কোনদিন মুক্তিলাভ করতে পারে না। তিনি যুব সমাজকে শৃঙ্খলভাবে জীবন যাপন করতে বলেন। তিনি তরুণদের উদ্দেশ্য করে বলেন,‘আজকে যৌবন যার যুদ্ধে যাবার সময় তার’। আপনারা যদি বিশৃঙ্খলা হয়ে যাও তাহলে আমাদের সমাজ, আমাদের জাতি দুর্ভোগে পড়বে। তোমদের ভবিষ্যৎ তোমাদেরকে ঠিক করতে হবে। দেখতে দেখতে আজ চুক্তির দুইযুগ পার হয়ে গেল। চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো এখনো অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে। আজ আমাদের ভূমির অধিকার, প্রশাসনিক অধিকার, ভোটাধিকার কিংবা অন্যান্য অধিকার কিছুই নেই। আজ পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামে ইচ্ছে কররেই আদিবাসীদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। তিনি তরুণ সমাজকে এই অবাস্তবায়িত চুক্তি বাস্তবায়িত করার জন্য লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে যাবার উদাত্ত আহ্বান জানান।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে যতিন রায় চাকমা বলেন, চুক্তির ২৪ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়াতে পাহাড়ে নানা ধরনের সম্প্রদায়িক ঘটনা, ধর্ষণ, খুন ইত্যাদি সংঘটিত হচ্ছে। তিনি পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সরকারের রোডম্যাপ ঘোষণার জন্য সরকারের কাছে আহ্বান জানান।
মধূসুধন চাকমা তার বক্তব্যে বলেন, নির্যাতিত, নিপীড়িত, শোষিত, বঞ্চিত জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রাণাধিকার অধিকার আদায়ের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহিত সমিতি আজ ক্ষোভ ও অসন্তোষের সাথে ২৪তম বর্ষপূর্তি উদযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। তিনি বলেন,জনসংহতি সমিতি দুই দশকের অধিক সশস্ত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ১৯৯৭ সালে ২রা ডিসেম্বর এই চুক্তি সম্পাদিত করতে সরকারকে বাধ্য করেছিল। এই চুক্তি স্বাক্ষরের আজ দীর্ঘ ২৪ বছর অতিক্রান্ত হলেও বাংলাদেশ সরকার চুক্তি বাস্তবায়নে গড়িমসি করে চলেছে। আমি মনে করি, সরকারের চুক্তি বাস্তবায়নের সদিচ্ছা নেই। আমাদের ঐক্য-সংহতি অধিকতর পরিমাণে জোরদার করে আন্দোলন-সংগ্রাম করে চুক্তি বাস্তবায়নে সচেষ্ট হতে হবে।
সম্রাট সুর চাকমা (সাবেক চেয়ারম্যান ৩২ নং বাঘাইছড়ি ইউনিয়ন পরিষদ) আজ শান্তি চুক্তির দীর্ঘ ২৪ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়িত না হওয়ায়, ভূমি সমস্যা সমাধান না হওয়ায় আজ আমাদের জঙ্গলের মধ্যে কষ্টে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। তিনি বলেন সরকারের সদিচ্ছা থাকলে এই চুক্তি বাস্তবায়ন করা কোন ব্যাপারই নয়। তিনি বাংলাদেশ সরকারের কাছে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের উদাত্ত আহ্বান জানান।
স্বাগত বক্তব্যে অলিভ চাকমা বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক ইচ্ছায় জনসংহতি সমিতির সাথে চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়া সত্ত্বেও ২৪ বছরেও চুক্তির মৌলিক বিষয় বাস্তবায়িত না হওয়াটা খুবই দু:খজনক এবং হতাশার। তিনি বলেন, এ চুক্তি শুধুমাত্র পাহাড়িদের জন্য নয় এই চুক্তি সকল পার্বত্যবাসীর। তিনি পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন করার জন্য সকলকে আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান।
সভাপতি তুষার চাকমা তার বক্তব্যে প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের প্রাণের দাবি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযতভাবে পূর্ণ বাস্তবায়নের আহ্বান জানান।
জুরাছড়ি: আজ ২ ডিসেম্বর জুরাছড়ি উপজেলার মৈদুং ইউনিয়নে এক সমাবেশের আয়োজন করা হয়। চঞ্চল কুমার চাকমার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে স্বাগত বক্তব্য রাখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ৩নং মৈদং ইউনিয়ন শাখার সাধারণ সম্পাদক সুভাষ তঞ্চঙ্গ্যা। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সমিত চাকমা ও বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অমরধন চাকমা কৃষি বিষয়ক সম্পাদক যুব সমিতি জুরাছড়ি থানা শাখা। এছাড়া সভায় বক্তব্য প্রদান করেন ১৩৩নং জুরাছড়ির মৌজার কার্বারী ললিত কুমার চাকমা, ১৩৭নং পানছড়ি মৌজার কার্বারী ফুল চন্দ্র চাকমা সহ বিভিন্ন গ্রামের সভাপতি এবং প্রতিনিধিবৃন্দ।
প্রধান অতিথি তাঁর বক্তব্যে বলেন যে, সরকার যেহেতু চুক্তি বাস্তবায়ন করবে না, তাই আমাদের সকলকে এক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। এবং ছাত্র ও যুব সমাজকে এগিয়ে এসে আগামীর কঠিন কঠোর লড়াইয়ের দায়িত্ব কাঁধে নিতে হবে। যে আশা ও প্রত্যাশা নিয়ে জুম্ম জনগণের পক্ষ হয়ে সন্তু লারমা পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরে উপনীত হয়েছেন সে আশা পুরণ করতে হলে আগামীতে সবাইকে এক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে এবং সে জন্য আমাদেরকে আরও অনেক কঠিন বাস্তবতার সাথে মোকাবেলা করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে।