মিতুল চাকমা বিশাল
পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক পরিস্থিতির বিচার-বিবেচনা করলে এটাই আজ সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠী পাহাড়িদের উপর এক অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টায় রত রয়েছে। সম্ভবত এমনই এক কঠিন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে এক বিপ্লবী মনীষী বলেছেন, ‘আমাদের নিজেদের ইচ্ছার কথা হচ্ছে, আমরা একদিনও যুদ্ধ করতে চাই না। কিন্তু পরিস্থিতি যদি আমাদেরকে যুদ্ধ করতে বাধ্য করে, তাহলে আমরা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করতে পারি’। পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিকেও এমন অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে যেখানে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাসের জায়গাতে উত্তরবিহীন অনেক প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে রাজনৈতিকভাবে ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের বিপরীতে শক্তি প্রয়োগের নীতিকে সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। পুরো পার্বত্য এলাকাকে জলপাই রঙ আর বুটের তলাতে নিষ্পেষিত করার হীনযজ্ঞ জোরেসোরে চলমান রয়েছে। পাহাড়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সর্বাপেক্ষা উপস্থিতি, তাদেরই মদদে বিভিন্ন সুবিধাবাদী ব্যক্তি, গোষ্ঠী কর্তৃক একের পর এক সশস্ত্র গ্রুপের উত্থান। অপরদিকে, তাদের উপস্থিতেই একের পর এক অস্ত্রধারী কর্তৃক সন্ত্রাসী হামলা, জনমনে ত্রাস ও আতঙ্ক সৃষ্টি, জনগণকে হয়রানি, চাঁদাবাজি প্রভৃতি ঘটনা দেখলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, ঘটনা কোন দিকে মোড় নিচ্ছে। চুক্তি বাস্তবায়নের বদলে চুক্তিবিরোধী নানা অপশক্তিকে সক্রিয়করণ, চুক্তি বিরোধী নানা অপকর্মকরণ এবং সর্বোপরি পাহাড়কে অশান্তকরণ ইত্যাদি বিষয়গুলো এখন নতুন এক উদ্বেগ হয়ে দেখা দিচ্ছে। সর্বশেষ দীর্ঘ সময়ের পরিক্রমায় এক নতুন জিজ্ঞাসা দেখা দিয়েছে, পাহাড়ে কি যুদ্ধের দামামা বেজে উঠল তবে?
একদা স্বাধীন রাজাদের দ্বারা শাসিত পার্বত্য অঞ্চলকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্তকরণ এবং পার্টিশনের সময়ে এসে অমুসলিম অধ্যূষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যূষিত পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তিকরণ, তৎপরবর্তী পাকিস্তান কর্তৃক জুম্মদের প্রতি সন্দেহের দৃষ্টি এবং অধুনা বাংলাদেশের শাসনামলে জাতিগত নির্মূলীকরণের যে হীনযজ্ঞ, তার সবকটিতেই রয়েছে রাজনৈতিক দূরভিসন্ধি। জুম্মদের সাথে ভারতের নর্থ-ইস্ট তথা ভারতের সংখ্যাগুরু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একটা সাংস্কৃতিক এবং আত্মিক মিল থাকার কারণে পাকিস্তান সরকার সবসময় জুম্মদের সন্দেহের দৃষ্টি দিয়ে দেখেছিল। এমনকি পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামে ইমলামী সম্প্রসারণবাদ পাকাপোক্ত করার লক্ষে কাপ্তাই বাঁধের মধ্যদিয়ে জুম্মদেরকে উচ্ছেদ ও দেশান্তরকরণের প্রক্রিয়া শুরু করে। সেই একই প্রক্রিয়া রয়েছে অধুনা বাংলাদেশের শাসনামলেও। পর্যটন, সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা, সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীর ক্যাম্প স্থাপন, বহিরাগত বাঙালি পুনর্বাসন ইত্যাদির মাধ্যমে স্লো পয়জনিং এর সুত্র ধরে পাহাড়িদের সর্বশান্তকরণ এবং উদ্বাস্তুকরণের প্রক্রিয়া চলছে। ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত ভিন্নতা এবং পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক চাপিয়ে দেওয়া রাষ্ট্রভাষার প্রতিবাদে এবং বিজাতীয় শাসন-শোষণের যাঁতাকল থেকে মুক্তি পেতে যে বাঙালি জাতি দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী এক মহাসংগ্রামের মধ্যদিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা উড্ডয়ন করেছে, সেই বাঙালি জাতির শাসকগোষ্ঠীও একই কায়দায় শাসকের ক্ষমতায় আসীন হয়ে ভিন্ন অপরাপর জাতিদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা শুরু করে এবং বাঙালিকরণের আইনগত ভিত্তি হিসেবে দেশের সর্বোচ্চ আইনে সকল জনগণকে বাঙালি বলে অভিহিত করা হয়েছে।
২১ শতকে এসে বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছে, সেই সময়ে এসেও প্রশ্ন থেকেই যায়, দেশের মানুষগুলো কি আসলেই স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে? গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের দোহাই দিয়ে দেশকে মোলবাদী চক্রের হাতে সমর্পিত করে মুক্তচিন্তাকে গলাটিপে হত্যা, নাগরিকদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তাকে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, বুড়িগঙ্গা, কর্ণফুলির জলস্রোতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। জনগণের মৌলিক মানবাধিকার, রাজনৈতিক অধিকার ও নাগরিক অধিকারকে ভূলুন্ঠিত করে দেশকে একনায়কতান্ত্রিক মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছে।
অপরদিকে, জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে সরকার কর্তৃক স্বীকৃত জাতীয় কমিটি এবং পিসিজেএসএস-এর মধ্যে সম্পাদিত ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তি আজ মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না করে, চুক্তিকে খন্ডিত করে, পার্সেন্টিজের হিসাবে বাস্তবায়নের নাটক দেখানো হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ প্রশাসনকে চট্টগ্রামস্থ সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিসনের হাতে গচ্ছিত রেখে গণতন্ত্রের মানসকন্যা নিশ্চিন্ত নিদ্রায় দিনাতিপাত করছেন, এর চেয়ে বড় হাস্যকর আর কি হতে পারে।
চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম জুম্ম (উপজাতি) অধ্যূষিত অঞ্চল হওয়ার কথা, কিন্তু বর্তমান সময়ে এসে দেখা যায় বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে পাহাড়ে এখন পাহাড়ি-বাঙালি অনুপাত ৫১ঃ৪৯ তে উন্নীত করা হয়েছে এবং বহিরাগতদের এই অনুপ্রবেশ ও পুনর্বাসন প্রক্রিয়া এখনো চলমান রয়েছে, কখনও প্রকাশ্যে কখনও বা অপ্রকাশ্যে। গুরুত্বপূর্ণ অপর একটি ধারাতে বলা হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ সমস্ত আইন-বিধি, প্রবিধান পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন, সংশোধন করা হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় সরকারের পক্ষ থেকেই বরং চুক্তির এই গুরুত্বপূর্ণ ধারাটিকে লঙ্ঘন করে নিজেদের স্বার্থের সুবিধামত পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসন কাঠামোর অন্যতম আইন জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদ আইনকে তোয়াক্কা না করে এবং আঞ্চলিক পরিষদের সাথে কোনপ্রকার পরামর্শ ও মতামত গ্রহণ না করেই ইচ্ছামত আইন প্রণয়ণ করে যাচ্ছে। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যেসমস্ত আইন, বিধি ও প্রবিধানগুলো চুক্তির বিভিন্ন ধারার সাথে সাংঘর্ষিক, সেগুলোর পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংশোধন, সংযোজনেরও কোন উদ্যোগ দেখা যায় নি, বরং চুক্তিকে পাশ কাটিয়ে সেই বিতর্কিত আইনগুলো দিয়েই সরকার তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে চলেছে। সংশোধনযোগ্য এই সমস্ত ৪১টি বিধান এবং প্রয়োজনবোধে বিলুপ্তকরণযোগ্য ১০টি বিধান রয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে গুটিকয়েক বিধানবলীতে আংশিক সংশোধন এবং সংযোজন করলেও সেটি তুলনামূলকভাবে একেবারেই নগণ্য এবং যথাযথ নয়। অপরদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা প্রণয়নের বিষয়টিও শুরু থেকেই ঝুলে আছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা যাচ্ছে না। অপরদিকে জেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়াতে সেখানে সরকার দলীয় লোক দিয়েই অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদ দিয়েই কাজ চালানো হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং জনগণের জন্য সুশাসন এই সমস্ত বিষয়গুলো একেবারেই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে। শুরু থেকেই এই পরিষদগুলো সরকার দলীয় লোকেদের অভয়াশ্রম এবং দুর্নীতির আঁখড়ায় পরিণত হয়েছে। জেলা পরিষদের সাথে কোনরূপ আলোচনা, পরামর্শ ব্যতীত পার্বত্য এলাকার কোন ভূমি সরকার কর্তৃক অধিগ্রহণ করা যাবে না এবং কোন জমি জেলা পরিষদের পূর্বানুমোদন ব্যতীত ক্রয়-বিক্রয়, ইজারা প্রদান করা যাবে না-মর্মে উল্লেখ থাকলেও উক্ত পরিষদগুলোতে সরকার দলীয়দের সংখ্যাধিক্য এবং প্রভাব থাকায় নিজেদের ইচ্ছামাফিক বহিরাগত কোম্পানী, প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রীয় বাহিনী এবং সরকার কর্তৃক ভূমি দখলের মহোৎসব চলমান রয়েছে। এছাড়াও ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, স্থানীয় পুলিশ, পর্যটন ইত্যাদি বিষয়সমূহ জেলা পরিষদে পর্যায়ক্রমে হস্তান্তরের কথা থাকলেও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কেবলমাত্র পর্যটন (স্থানীয়) বিষয়টি আংশিকভাবে হস্তান্তর করেই বাকিগুলোকে গুদাম ঘরে তালাবদ্ধ করে রেখে দেওয়া হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের অন্যতম স্তম্ভ আঞ্চলিক পরিষদ। তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এই পরিষদের পরামর্শক্রমে এবং তত্ত্বাবধানে নিজেদের কাজ পরিচালনা করার কথা থাকলেও বাস্তবিকপক্ষে তার বিন্দুমাত্র প্রতিফলন দেখা যায় না। আঞ্চলিক পরিষদকে পাশ কাটিয়েই বরং উক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের ইচ্ছামাফিক জুম্ম স্বার্থবিরোধী ও চুক্তিবিরোধী নানা কাজ পরিচালনা করে যাচ্ছে।
আইনানুসারে, সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও ৬টি স্থায়ী সেনানিবাস ব্যতীত সমস্ত সামরিক বাহিনী, আনসার ও ভিডিপির অস্থায়ী ক্যাম্পসমূহ পার্বত্য চট্টগ্রাম হইতে পর্যায়ক্রমে সরিয়ে নেওয়া কথা রয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের এবং আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার ২৪টি বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও পার্বত্য চট্টগ্রাম এখনো দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে সামরিক অধ্যূষিত এলাকার তকমা লাগিয়ে রয়েছে। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সুশানের জন্য, জনপ্রতিনিধিত্বশীল এক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও, বাস্তবে তার বিন্দুমাত্র প্রতিফলন ঘটে নি। এছাড়াও বর্তমান সময়ে অত্যাধিক হারে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি এবং তাদের কর্তৃত্ব চোখে পড়ার মতন। চুক্তি সম্পাদনের পরে পাহাড়ে স্থাপিত অবৈধ ৫০০-এর অধিক সেনাক্যাম্প হতে ২০১২ সাল পর্যন্ত মাত্র ৭৪টি ক্যাম্প সরানো হয়েছে। পরবর্তীতে ২০১৯-২০২১ পর্যন্ত সময়ে আবারো নতুন করে ২১টি সেনাক্যাম্প বসানো হয়েছে এবং প্রক্রিয়াধীন রয়েছে চুক্তির পূর্বে থাকা প্রায় সমস্ত ক্যাম্প, যা পাহাড়ের পরিস্থিতিকে আরো গভীরভাবে ঘনীভুত করছে। সামরিক এবং আধা-সামরিক বাহিনী মিলে পাহাড়ে এখনো প্রায় ২ লক্ষ অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত সৈন্যবাহিনী রয়েছে। সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিসনের ৪টি ব্রিগেডের অধীন ৬টি ক্যান্টনমেন্টের আওতায় ১৮টি জোন দ্বারা পরিচালিত ৫ শতাধিক সেনাক্যাম্প রয়েছে, যেগুলো কর্তৃক প্রতিনিয়ত অপরাধমূলক এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা অহরহ ঘটেই চলেছে।
পাহাড়ে আজ কোন পাহাড়ি বাজার করতে গেলে তার বাজারের হিসাব, পরিবারের সদস্য সংখ্যার হিসাব দিতে হয়। সংখ্যার অনুপাতে বাজারের পরিমাণ বেশি হলেই হয়রানি আর জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করা হয়। হাড়ি-পাতিল, ঢেউটিন ইত্যাদি ক্রয় করলে কোন জেএসএস সদস্যের পরিবার দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে কি না, তার তদন্ত শুরু হয়। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে স্বশ্রমে উৎপাদিত ফসল বাজারে বিক্রির উদ্দেশ্যে নিতে গেলে উৎকৃষ্ট পণ্যগুলো সেনাক্যাম্পে রেখে দিতে হয়। বাংলাদেশের নাগরিক হয়েও পাহাড়ের প্রতিটা চেকপোস্টে জাতীয় পরিচয় পত্র দেখিয়ে চলাফেরা করতে হয়। গ্রামে গিয়ে প্রতিটা বাড়ির হোল্ডিং নাম্বার, পরিবারের সদস্য সংখ্যা, কে কি করে, কোথায় থাকে? ইত্যাদি উদ্ভট সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। শহরে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যায়ন করতে যাওয়া কোন জুম্ম ছাত্র হঠাৎ করে বাড়িতে আসলে হয়রানির স্বীকার হয়, ‘তুমি কে? কার ছেলে? এতদিন কোথায় ছিলে? আজকে পাড়ায় নতুন দেখছি? ইত্যাদি অজস্র সব আজব আজব প্রশ্ন। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলিতে সন্ত্রাসী খোঁজার নাম দিয়ে ধর্মীয় নিয়ম-নীতি লঙ্ঘন করে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বেপরোয়া উপস্থিতি দেখা যায়। কোন সামাজিক বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তার হেতু সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করতে গেলেই বাধা দেওয়া হয়, বলা হয় সন্ত্রাসী লুকিয়ে রাখার জন্য নাকি এসব উঁচু প্রাচীর নির্মাণ করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিকে সমর্থন করলেই অপহরণ, গুম, হত্যা, নির্যাতন ও হয়রানি করা হয়।
অপরদিকে, রাষ্ট্রীয় বাহিনী পাহাড়ের কিছু উশৃঙ্খল, উচ্চাভিলাষী, সুবিধাভোগী ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীদের উস্কে দিয়ে, তাদেরকে নানাভাবে প্ররোচিত করে এবং অস্ত্রশস্ত্রের সরাসরি যোগান দিয়ে এমন একটা শ্রেণি তৈরি করে দিয়েছে, যাদের প্রধান কাজ হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের নায্য আন্দোলন সম্পর্কে জনগণকে বিভ্রান্তিতে ফেলা, চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে সেনা-প্রশাসনের হাতের পুতুল হিসেবে কাজ করে যাওয়া এবং সর্বোপরি জনসংহতি সমিতির যৌক্তিক আন্দোলনকে ব্যাহত করে দেওয়া। বিপথগামী এই শ্রেণিটির একটি অংশ তথাকথিত বুদ্ধিজীবীর দোহাই দিয়ে এবং আমলাতন্ত্রের খোলস পরে নানাভাবে প্রকাশ্য কিংবা অপ্রকাশ্যে আন্দোলন সম্পর্কে ভুল ব্যখ্যা দিয়ে যাচ্ছে এবং একইসাথে শাসকগোষ্ঠীর দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সেই সাথে পায়ের তলায় মাটি বিহীন ও অধিকারহীন এই জুম্ম জাতির উদীয়মান তরুণ প্রজন্মকে উচ্চাকাঙ্খা ও লালসার স্বপ্ন দেখিয়ে বিপথে পরিচালিত করে আন্দোলনবিমুখ করে রেখে দিচ্ছে। তাদের সম্ভাব্যতা, যোগ্যতা আর সামর্থ্যকে সামগ্রিক স্বার্থের বদলে কেবলমাত্র কতগুলো সামাজিক সংগঠনের খুঁটিতে বেঁধে রেখে দিয়েছে। শাসকগোষ্ঠীর ‘ভাগ করো, শাসন করো’ নীতির পূর্ণ বাস্তবায়নে প্রত্যক্ষভাবে এই অংশটি সহযোগিতা করে যাচ্ছে। জাতিগত বিদ্বেষ এবং সম্প্রদায়গত সামাজিক ও নৈতিক দূরত্ব সৃষ্টি করতে এই অংশটি প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করছে। সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদে উদ্দীপ্ত হয়ে তারা সামগ্রিক স্বার্থের জলাঞ্জলি দিয়ে এক কল্পলৌকিক ভূ-স্বর্গে দিননিপাতের ধান্ধায় রয়েছে।
দ্বিতীয় অংশটিকে সরাসরি সশস্ত্র পন্থায় চাঁদাবাজি ও অস্ত্রবাজির মারফত জনগণকে হয়রানি ও পাহাড়ের পরিস্থিতিকে ভিন্নভাবে উপস্থাপনের রাজনীতিতে ব্যবহার করা হচ্ছে। কিছু সাময়িক ও আংশিক সুবিধার প্রলোভনে পড়ে এই গোষ্ঠীটি এখন পাহাড়ে এক নতুন আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে এই অংশটি এখন জঙ্গল থেকে বেরিয়ে প্রকাশ্যে শহর এলাকায় ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু এই অংশটি আদৌ জানেই না যে, রাষ্ট্রীয় বাহিনীর কৃত্রিম নিরাপত্তার বলয়ে থেকে, রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সম্মুখে তাদের সশস্ত্র উপস্থিতি কী প্রকারে পাহাড়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। পাহাড়ে যে অস্ত্রের ঝনঝনানির দোহাই দিয়ে নিরাপত্তা বাহিনী নিজেদের উপস্থিতিকে বৈধতা দেওয়ার প্রচেষ্টায় মরিয়া, সেই অস্ত্রের ঝনঝনানি নিরাপত্তা বাহিনীর হাত ধরেই হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। শাসকগোষ্ঠীর বি-টীম হিসেবে অপকর্মে রত এই গোষ্ঠীটিই পর্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের আন্দোলনকে ভিন্নদিকে প্রবাহিত করতে অন্যতম ভূমিকা পালন করছে এবং পাহাড়ের তথা সামগ্রিকভাবে ভূ-রাজনীতিতে এই মূর্খ-গবেটরা বিরাট প্রভাব ফেলছে।
সর্বোপরি পাহাড়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বর্তমানে এক ভিন্ন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে। সাধারণভবে এটি চুক্তিপূর্ব অবস্থার মত মনে হলেও বিশেষভাবে এর সামগ্রিক চরিত্র তার থেকেও ভিন্ন এবং ধ্বংসাত্মক। পাহাড়ের সমস্যাকে রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে এর সমাধান যেমন রাজনৈতিকভাবে করার পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছিল, রাষ্ট্র আজ বর্তমান সময়ে এসে সেই প্রক্রিয়া থেকে বহুদূরে অবস্থান করছে। বরং পূর্বেকার মতোই আবারও পেশীশক্তি ও অস্ত্রশক্তির জোর দেখিয়ে শক্তিবাজি আর অস্ত্রবাজির শোডাউন করে যাচ্ছে। সমস্যাকে শান্তিপূর্ণভবে সমাধানের বিপরীতে আরো বেশি করে সমস্যাকে ঘনীভূত করা হচ্ছে। অপরপক্ষে মূল সমস্যাটিকে একপাশে রেখে সেখানে অপ্রধান এবং গৌণ অনেক সমস্যার উদ্ভব ঘটানো হয়েছে, যেগুলো পাহাড়ের পরিস্থিতিকে দিন দিন জটিল থেকে জটিলতর করে তুলেছে। তাছাড়া বিগত কয়েক বছর ধরে সরকারের তরফ থেকে বিশেষ করে ২০১৬ সালে ভূমি কমিশন আইন-২০০১ সংশোধনের পরে চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য আশানুরূপ কোন উদ্যোগও দেখা যায় নি। ফলশ্রুতিতে সমস্যাটি আলোচনার টেবিল থেকে আবারো সংঘাতের দিকে পা বাড়ানোর প্রক্রিয়ায় পৌঁছাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি ও কর্তৃত্ব, তাদের কর্তৃক বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর উত্থান এবং রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক চুক্তি বিরোধী নানা অপপ্রচার এই পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলছে। সমস্যা সমাধানে রাষ্ট্রপক্ষের ভূমিকাটা যেখানে সবচেয়ে বেশি হওয়ার কথা, সেই জায়গাতে এখন চরম শূণ্যতার ভাব দেখা যাচ্ছে। নমনীয়তার বদলে আরো কট্টরতার দিকে পা বাড়াচ্ছে রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের ক্ষমতায় থাকা শাসকগোষ্ঠী। এমতাবস্থায় রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সরকারকে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে আরো সংবেদনশীল হওয়া অত্যন্ত জরুরী। দেশের একটা অংশকে বাদ দিয়ে সামগ্রিক উন্নয়ন, সুশাসন যাই বলি না কেন, তা কোনভাবেই সম্ভব নয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিশেষ শাসিত অঞ্চল, সুতরাং বিশেষ এই অঞ্চলকে বিশেষভাবে বিবেচনা করে, স্থানীয় অধিবাসীদেরকে সাথে নিয়ে সামগ্রিকভাবে দেশের উন্নয়ন ত্বরাণি¦ত করতে হবে, এছাড়া দ্বিতীয় কোন পন্থা থাকতে পারে না।
বৈশ্বিক করোনা মহামারীর ফলে সমগ্র বিশ্বের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নতুন দিকে মোড় নিয়েছে, ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে এখন অধিকাংশ রাষ্ট্রই আত্মরক্ষাত্মক এবং বিপরীত দিকে দেশের মধ্যে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য প্রাণপণ প্রচেষ্টা করে যাচ্ছে। এমনিতর পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীরও উচিত নিজেদের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিকে বিশেষ করে পাহাড়ের পরিস্থিতিকে শান্ত রাখা এবং তার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের জন্য রোডম্যাপ ঘোষণা করা। সংকটময় এই মুহূর্তে রাষ্ট্রের উচিত আরো জনগণের নিকটে পৌঁছানো, দূরত্ব বাড়িয়ে, শক্তিপ্রয়োগ করে অতীতে কোনভাবেই শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় নি, ভবিষ্যতেও হবে না। তাই রাষ্ট্রকে এ বিষয়ে আরো সচেতনতার সাথে আলোচনার টেবিলটিকে উন্মুক্ত করে দিতে হবে।
অপরদিকে, উপরোক্ত সমস্যাগুলো থেকে উত্তরণের জন্য জুম্ম জনগণের পক্ষ থেকে ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক গণ-আন্দোলন ছাড়া কোন বিকল্প নেই। আর এই সুমহান দায়িত্বের ভার বর্তমান প্রজন্মকেই কাঁধে তুলে নিতে হবে। শেকড়ের টানে স্বজাতির ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে আত্মকেন্দ্রিকতার শৃঙ্খল ভেঙে শাসকের রক্তচক্ষুর কোনপ্রকার তোয়াক্কা না করেই অগ্রসর হতে হবে। তার জন্য সবচেয়ে জরুরী বিষয় হচ্ছে, পরিস্থতির সামগ্রিক মূল্যায়ন করতে পারা। কোন বিষয়কেই আর পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই, সমস্ত কিছুকেই বিশেষভাবে বিশ্লেষণ করার সামর্থ্য এবং যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। শাসকগোষ্ঠী যতই বিভেদের বীজ ছড়িয়ে নিজেদের জাল বিস্তার করুক, আমাদের প্রত্যেক জুম্ম তারুণ্যকে দৃঢ়হস্তে তার মোকাবেলা করতে হবে। ঐতিহাসিকভাবে কোন সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তনে যুব সমাজের ভূমিকাটা অপরিহার্য। সামনের সারিতে থেকে তারাই মুক্তির পথ দেখিয়েছে সাধারণ জনগণকে।
বিভাজনের রাজনীতি নয়, ঐক্যবদ্ধ রাজনীতিতে তারুণ্য এগিয়ে আসুক। বর্তমান প্রজন্মের তারুণ্যকে রাজনীতি বিমুখ করতেই রাষ্ট্র এবং তার বাহিনী পাহাড়ে নানা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সৃষ্টি করে দিয়েছে, এই সত্যকে অনুধাবন করার সময় এসেছে। শাসকগোষ্ঠীর সৃষ্টি করে দেওয়া সেই সমস্ত গ্রুপগুলোর না আছে কোন রাজনৈতিক ভিত্তি, না আছে কোন জাতীয় বা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। মোদ্দাকথায়, সত্য কখনই দুই বা ভিন্ন হতে পারে না। সত্য একটাই এবং অভিন্ন, আর সেটা হচ্ছে পাহাড়ের জুম্ম জনগণের রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের একমাত্র কান্ডারী সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি। এই পার্টি জুম্ম জনগণের অধিকারের প্রশ্নে কখনও আপোষের পথে পা বাড়ায় নি, বরং সদা-সর্বদা সম্মুখ সারিতে থেকেই নেতৃত্বের হাল ধরে এগিয়েছে। বর্তমান সময় তথ্য-প্রযুক্তির যুগ।
এখন বলা হয়, তথ্যই শক্তি। সুতরাং আপনার হাতে থাকা প্রযুক্তির উৎকর্ষতাকে কাজে লাগান। সেই সুপ্ত শক্তিকে জাগানোর সময় এসেছে। আত্ম-অহমিকা, ব্যক্তিচিন্তা আর সুবিধাবাদিতায় ডুবে না থেকে সময় এসেছে সামগ্রিকতায় নিজেকে সঁপে দেওয়ার, সময় এসেছে অসহায় জুম্ম জাতির কাঁধে নির্ভরতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার। শাসকগোষ্ঠীর সৃষ্ট সকল অপশক্তি এবং তাদের হীন কাজকর্মের মুখোশ জুম্ম জনগণের সামনে উন্মোচন করে দিতে হবে। তাদেরকে সামাজিকভাবে বয়কট ও রাজনৈতিকভাবে প্রতিরোধ করতে হবে। সামাজিক মাধ্যম এবং সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে তথা জাতীয়ভাবে পাহাড়ের আন্দোলনকে বিকশিত করতে হবে।
জুম্ম জনগণের অবিসংবাদিত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে তারুণ্যের উদযাপন আজ বড্ড প্রয়োজন, যারা নিজেদের ব্যক্তিগত সমস্ত কিছুকে বিসর্জন দিয়ে একটি নতুন সমাজ বিনির্মাণে ব্রতী হতে রাজী। যাদের ধমনীর প্রতি শিরায় শিরায় এম এন লারমার রক্ত ধাবমান, সেই সমস্ত তরুণকে এগিয়ে আসতে হবে, লড়াই করতে হবে। বিকাশের পথে অবলুপ্তি আর অবলুপ্তির পথেই বিকাশ, এই চিরন্তন সত্যকে ধারণ করে এগোতে হবে। পাহাড়ের সামগ্রিক পরিস্থিতি এখন ধ্বংসের মুখোমুখি, যেদিন এই ধ্বংসোন্মুখ পরিস্থিতি তার শেষ সীমার সর্বোচ্চ চূড়াতে অবস্থান করবে, সেই থেকেই শুরু হবে নতুন কিছু। ধ্বংসস্তুপের ভেতর এক নতুন পদ্মের আবির্ভাব ঘটাতে হবে। যে পুষ্পের প্রত্যেকটি পাপড়িতে থাকবে ভিন্ন ভাষাভাষি ১৪টি আদিবাসী মহান জাতিগোষ্ঠী। পূবের আকাশে উদিত লাল সূর্যের সাথে সাথে শুরু হবে এক নতুন সকাল।
সংগ্রাম দীর্ঘজীবী হোক!