হিল ভয়েস, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১, রাঙ্গামাটি: রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলাধীন রাঙ্গামাটি সদর উপজেলার পাশাপাশি জীবতলী ইউনিয়ন, মগবান ইউনিয়ন এবং কাপ্তাই উপজেলার কাপ্তাই ইউনিয়ন এলাকায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং সেনামদদপুষ্ট সংস্কারপন্থী ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সদস্যদের কর্তৃক প্রায়ই যৌথ টহল অভিযান ও সেনা তৎপরতা পরিচালনা করার অভিযোগ পাওয়া যায়। সেনা ও সন্ত্রাসীদের এসব যৌথ সশস্ত্র তৎপরতায় জনগণকে প্রায়ই নির্যাতন, হয়রানি, বাড়ি তল্লাশি ও হুমকির শিকার হতে হচ্ছে বলে জানা গেছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ২২ সেপ্টেম্বর ২০২১ ভোর রাত ৩:০০ টার দিকে কাপ্তাই সেনা জোনের ২৩ ই বেঙ্গল রেজিমেন্টের জোন কমান্ডার লে: কর্নেল মো: মিজানুল হক (পিএসসি) এবং ৫৬ ই বেঙ্গল রেজিমেন্টের জোন কমাণ্ডার লে: কর্নেল মো: আনোয়ার জাহিদ (পিএসসি) এর অধীনে এস ব্যান্ড সেনা ক্যাম্পে দায়িত্বরত সুবেদার মো: রিয়াজের নেতৃত্বে ও রাঙ্গামাটি সদর সেনা জোনের ৭ আর ই বেঙ্গল রেজিমেন্টের জোন কমান্ডার লে: কর্নেল মো: ফেরদৌস (পিএসসি) এর অধীনে গবঘোনা সেনা ক্যাম্পে দায়িত্বরত ক্যাপ্টেন মো: মাহবুবের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর একটি দল জীবতলী ইউনিয়নের ভাইবোনছড়া এলাকায় টহল অভিযান পরিচালনা করে। এসময় সেনা সদস্যদের সাথে যোগ দেয় সেনাবাহিনী ও স্থানীয় আওয়ামীলীগ মদদপুষ্ট হেগেরা চাকমা (৩৫) ও বাচ্চু চাকমা (৩২) এর নেতৃত্বে সংস্কারপন্থী ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সন্ত্রাসীদের একটি ক্ষুদ্র দল। জানা গেছে, সেনা ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর প্রায় ৫০ জন সদস্য এই অভিযানে অংশগ্রহণ করে।
জানা গেছে, সেনা ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সদস্যরা কাপ্তাই ইউনিয়ন এলাকায় টহল অভিযানে প্রথমে বড়ঢালা গ্রামে দীপক চাকমা (৩৮), পীং-দীনময় চাকমার বাড়ি ঘেরাও করে বাড়িতে ব্যাপক তল্লাশি চালায় এবং দীপক চাকমার স্ত্রীকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজসহ বিভিন্ন ভয়ভীতি প্রদর্শন করে। দীপক চাকমা এসময় বাড়িতে ছিলেন না। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কাপ্তাই ইউনিয়ন কমিটির সদস্য বলে জানা গেছে।
এরপর সেনা ও সন্ত্রাসী সদস্যরা একই ইউনিয়নের কলমীছড়া মুখ গ্রামের চিগন্যা চাকমা (৪৫), পী-দীলিপ কুমার চাকমার বাড়ি ঘেরাও করে বাড়ির লোকদের ঘুম থেকে তুলে বাড়িতে তল্লাশি চালায়। চিগন্যা চাকমা একজন নিরীহ জুমচাষী বলে জানা যায়।
এরপর সেনা ও সন্ত্রাসী সদস্যরা পার্শ্ববর্তী একটি জুমঘর ঘেরাও করে তাতে তল্লাশি চালায় বলে জানা যায়। তবে তার আগেই সেখানে থাকা সোনামনি চাকমা (৪২), পীং-উমেশ চন্দ্র চাকমা ও রাঙাইয়্যা চাকমা (৩০), পীং-দীলিপ কুমার চাকমা সেখান থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় বলে জানা যায়। তবে এসময় সেনা সদস্যরা সোনামনি চাকমার একটি ড্রাইভিং লাইসেন্স ও স্মার্ট ফোন এবং রাঙাইয়্যা চাকমার মোবাইল ফোন ও আইডি কার্ড নিয়ে যায় বলে জানা যায়।
উল্লেখ্য, সোনামনি চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির জীবতলী ইউনিয়ন শাখার সাধারণ সম্পাদক এবং রাঙাইয়্যা চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতির জীবতলী ইউনিয়ন শাখার সহ-সভাপতি বলে জানা যায়। সেনাবাহিনীর গ্রেপ্তার ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অপহরণ, হামলার ভয়ে তারা দীর্ঘদিন ধরে বাড়ি থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বলে জানা গেছে।
অপরদিকে, গত ২১ সেপ্টেম্বর ২০২১ সকাল ৯:০০ টার দিকে সেনাবাহিনীর কাপ্তাই সেনা জোনের একদল সেনা সদস্য ও প্রবেশ চাকমার নেতৃত্বে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর একদল সদস্য যৌথভাবে কাপ্তাই উপজেলার হরিণছড়া এবং জীবতলী ইউনিয়নের রেংখ্যং মুখ, ধল্যাছড়ি ও আশেপাশের এলাকায় টহল অভিযানে গিয়ে অতর্কিতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। এতে এলাকার জনগণের মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগ ও আতঙ্কের সৃষ্টি হয়।
জানা গেছে, এসময় সেনা সদস্যরা রেংখ্যং মুখ, ধল্যাছড়ি গ্রামের দীপক চাকমা, পীং-বিনিময় চাকমা ও ক্রোলাইচিং মার্মা (৩০), স্বামী-দীপক চাকমা নামের দুই নিরীহ গ্রামবাসীকে ব্যাপক মারধর করে। এছাড়া আরও কয়েকজন জুম্ম গ্রামবাসীর মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়া হয় বলে জানা যায়। তবে, এব্যাপারে এখনও বিস্তারিত জানা যায়নি।
গত ৩১ আগস্ট ২০২১ রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলাধীন রাঙ্গামাটি সদর উপজেলার জীবতলী ইউনিয়নের চৌংড়াছড়ি গ্রাম এলাকায় টহল অভিযানে গিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি দল এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করে টনক চাকমা (৩২) এক নিরীহ জুম্ম গ্রামবাসীকে আহত করে। এসময় সেনাদলের সাথে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সন্ত্রাসী দলের সদস্য পরানধন চাকমাসহ কয়েজজনকে দেখা যায় বলে জানা যায়।
গত ১৯ আগস্ট ২০২১ প্রায় ২৫ জনের একটি সেনাদল কাপ্তাই উপজেলাধীন কাপ্তাই ইউনিয়নের হরিণছড়া বাজারে অবস্থান করে বলে জানা যায়। সেনারা সেখানে অবস্থানের পর প্রায় কাছাকাছি জায়গায় ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সন্ত্রাসীদের একটি দলও অবস্থান গ্রহণ করে। এরই মধ্যে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সন্ত্রাসীরা সেনাদলটির নাকের ডগায় চাঁদা উত্তোলন চালিয়ে যায় বলে জানা যায়।
গত ৬ আগস্ট ২০২১ সংস্কারপন্থী ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সন্ত্রাসীদের কর্তৃক জীবতলী ইউনিয়নের বাঘছড়ি দজর এলাকা থেকে অমর কুমার চাকমা (৩৮), রূপ কুমার চাকমা (২৮) ও কাজল কুমার চাকমা (২৩) নামে ৩ নিরীহ জুম্মকে অপহরণ ও মারধর করা হয়। অপহরণের দুই দিন পর তাদের স্থানীয় জীবতলী সেনা ক্যাম্পে হস্তান্তর করা হয়। এরপর ৯ আগস্ট ২০২১ সেনাবাহিনী মারধর করার পর উক্ত তিন গ্রামবাসীকে তাদের আত্মীয়দের নিকট ছেড়ে দিয়েছে বলে খবর পাওয়া যায়।
গত ৩০ জুলাই ২০১২ ভোর ৪:০০ টার দিকে জীবতলী সেনানিবাসের সেনা সদস্য এবং অধীর চাকমা হেগেরা ও অচেন্তু চাকমার নেতৃত্বে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সন্ত্রাসীদের কয়েকজন সদস্যসহ সেনা ও সন্ত্রাসীদের ২৪ জনের একটি যৌথ দল পার্শ্ববর্তী গুইহাবা ছড়া গ্রামে যায়। সেনা সদস্যরা সেখানে শান্তি রাণী কার্বারিকে জিজ্ঞেস করে যে, এই গ্রামে সন্ত্রাসী আছে কিনা। একই গ্রামের শোভারাজা চাকমাকে জিজ্ঞেস করা হয় যে, তাকে চাঁদা দিতে হয় কিনা, কত টাকা করে দিতে হয়। এভাবে আরো অনেক গ্রামবাসীকে চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে নানা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে হয়রানি করা হয়।