হিল ভয়েস, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১, বিশেষ প্রতিবেদক: আজ পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জাতীয় জাগরণের অগ্রদূত, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রাক্তন সভাপতি, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের গণপরিষদ সদস্য ও সাবেক সাংসদ, নিপীড়িত, নির্যাতিত ও অধিকারহারা জাতি ও মানুষের পরম বন্ধু, বিপ্লবী ও মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (এম এন লারমা)’র ৮২তম জন্মদিবস। প্রতিবছর এই দিনটি উপলক্ষে বিভিন্ন সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকে। তবে মহামারী করোনা ভাইরাসের কারণে গত বছর থেকে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে সীমিত আকারে ও অনলাইনে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। এবারেও বিভিন্ন সংগঠন নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে মহান এই নেতার জন্মদিবস বা জন্মবার্ষিকী পালন করবে।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের অনলাইন আলোচনা
আজ বাংলাদেশ সময় সকাল ১১:০০ টায় এই দিনটি উপলক্ষে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম কেন্দ্রীয় উদ্যোগে ‘নিপীড়িত, নির্যাতিত, শোষিত-বঞ্চিত ও অধিকারকামী মানুষের মুক্তির মহানায়ক বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৮২তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে অনলাইন আলোচনা’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে।
উক্ত অনলাইন আলোচনায় সম্মানিত অতিথি হিসেবে যুক্ত থাকবেন আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাসের আহ্বায়ক ফজলে হোসেন বাদশা এমপি, ঐক্য ন্যাপের সভাপতি ও বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ পঙ্কজ ভট্টাচার্য, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সাবেক সাংসদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহ-সভাপতি ঊষাতন তালুকদার, বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী এ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত, এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, আইইডি’র নির্বাহী পরিচালক নুমান আহম্মদ খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন। আলোচনায় সঞ্চালনার দায়িত্ব পালন করবেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং।
এছাড়াও দেশের বরেণ্য রাজনীতিবিদ, নাগরিক সমমাজের নেতৃবৃন্দ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, মানবাধিকার কর্মী, সাংস্কৃতিক কর্মী, সাংবাদিক ও ছাত্র-যুব নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখবেন বলে জানা গেছে।
রাঙ্গামাটিতে তিন সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে আলোচনা সভা
এই দিন সকাল ১০:০০ টায় রাঙ্গামাটি জেলা সদরের দেবাশীষনগর এলাকায় এম এন লারমা স্মৃতি গণপাঠাগার প্রাঙ্গণে দিবসটি উপলক্ষে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। অনুষ্ঠানটির আয়োজক এম এন লারমা স্মৃতি গণপাঠাগার, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল ও এম এন লারমা মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন।
আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করবেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল শাখার সভাপতি, অবসরপ্রাপ্ত উপসচিব শ্রী প্রকৃতি রঞ্জন চাকমা এবং প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য শ্রী গৌতম কুমার চাকমা। এছাড়া সম্বোধি ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’র সাধারণ সম্পাদক ইন্দু লাল চাকমা এবং হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতি ও হিল ইউমেন্স ফোরামের প্রতিনিধিবৃন্দ আলোচনা করবেন বলে জানা গেছে।
গিরিসুর শিল্পীগোষ্ঠীর অনলাইন আলোচনা ও সঙ্গীতানুষ্ঠান
এছাড়া এই দিন বিকাল ৫:৩০ টায় গিরিসুর শিল্পীগোষ্ঠী, রাঙ্গামাটি এর উদ্যোগে ‘জুম্ম জাতীয় চেতনার অগ্রদূত মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৮২তম জন্মদিন উপলক্ষে অনলাইন আলোচনা ও সঙ্গীতানুষ্ঠান’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানটি ফেসবুকে সরাসরি সম্প্রচার করা হবে বলে জানা গেছে।
এম এন লারমার সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্ত
এম এন লারমার জন্ম ১৯৩৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলাধীন নানিয়ারচর উপজেলার বুড়িঘাট মৌজার স্বনামখ্যাত মহাপুরম বা মাওরুম গ্রামে। ১৯৬০ দশকে কাপ্তাই বাঁধের ফলে সৃষ্ট কাপ্তাই হ্রদের নীচে অন্যান্য বহু গ্রামের সাথে এই গ্রামটিও ডুবে যায়। তাঁর পিতা চিত্ত কিশোর চাকমা ছিলেন একজন গুণী শিক্ষক, সমাজহিতৈষী ও দেশপ্রেমী এবং মাতা সুভাষিণী দেওয়ান ছিলেন ধৈর্য্যশীলা ও ধর্মপ্রাণা এক নারী। তাঁর আপন জ্যেঠা কৃষ্ণ কিশোর চাকমা ছিলেন একজন অত্যন্ত মেধাবী শিক্ষার্থী এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষা প্রসারের আন্দোলনে সর্বজনশ্রদ্ধেয় এক ব্যক্তিত্ব। বস্তুত পার্বত্য চট্টগ্রামে আধুনিক শিক্ষার প্রসার, জুম্ম জাতীয় চেতনা বিকাশ ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে এম এন লারমাদের পরিবারটির বৈপ্লবিক ও নেতৃত্বের ভূমিকা ছিল অবিসংবাদিত।
তাঁর দুই ভাই ও সবার বড় একমাত্র বোন, সবাই পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্মদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং অতুলনীয় ত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তাঁর বড় ভাই শুভেন্দু প্রভাস লারমা ১৯৮৩ সালে তাঁরই সাথে একই ঘটনায় শহীদ হন। অপরদিকে তাঁর ছোটভাই জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) তাঁর মৃত্যুর তাঁর যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে আবির্ভূত হন। জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম এর সভাপতি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর একমাত্র বড় বোন জ্যোতিপ্রভা লারমা মিনু জনসংহতি সমিতির নারী সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি ১৯৫৮ সালে রাঙ্গামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক, ১৯৬০ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে আই এ এবং ১৯৬৫ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। এরপর ১৯৬৮ সালে বিএড এবং ১৯৬৯ সালে এলএলবি সম্পন্ন করেন। এছাড়া তিনি ১৯৬৬ সাল হতে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত হাই স্কুলে শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম বার এসোসিয়েশনে আইনজীবী হিসেবে যোগদান করেন।
এছাড়া তিনি ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৬৩ সালের শুরু পর্যন্ত পাহাড়ি ছাত্রদের সম্মেলনে ও সংগঠনে এবং বিভিন্ন আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬১ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও আন্দোলনের উদ্যোগ নেন। ১৯৬৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি নিবর্তনমূলক আইনে পুলিশ কর্তৃক চট্টগ্রামের পাথরঘাটাস্থ পাহাড়ি ছাত্রাবাস হতে গ্রেপ্তার হন। দুই বছরের অধিক সময় কারাগারে থাকার পর ১৯৬৫ সালের ৮ মার্চ চট্টগ্রাম কারাগার থেকে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি লাভ করেন।
পরবর্তীতে ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তাঁরই নেতৃত্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট ৪ দফা সম্বলিত আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিনামা পেশ করা হয়। ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে জুম্মদেরকে ‘বাঙালি’ হিসেবে আখ্যায়িত করার প্রতিবাদে তিনি গণপরিষদ অধিবেশন বর্জন করেন। ১৯৭২ সালে তাঁরই নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি গঠিত হয় এবং তিনি এর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালে তিনি বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং একই বছর জনসংহতি সমিতির সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি বাকশালে যোগদান করেন।
১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট থেকে তিনি আত্মগোপনে চলে যান। এরপর তাঁর ও তাঁর ভাই সন্তু লারমার নেতৃত্বে জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র শাখা ‘শান্তিবাহিনী’ দিয়ে শুরু হয় সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় তিনি ১৯৭৭ সালে জনসংহতি সমিতির প্রথম জাতীয় সম্মেলনে এবং ১৯৮২ সালে দ্বিতীয় জাতীয় সম্মেলনে পরপর সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন।
১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর ভোর রাতে বিভেদপন্থী গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চক্রের বিশ্বাসঘাতকতামূলক অতর্কিত এক আক্রমণে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলাধীন পানছড়ি উপজেলার খেদারছড়া থুমে আট সহযোদ্ধাসহ নির্মমভাবে নিহত হন তিনি।