প্রধীর তালুকদার রেগা
স্বাধীনতা-উত্তর পাহাড়ি মানুষদের আশা, প্রত্যাশা, একই সাথে ভবিষ্যতের আশংকা, সামগ্রিক পরিস্থিতির অনিশ্চয়তা ও সর্বভারতীয় নেতাদের আগ্রাসী সম্প্রসারণবাদী মনোভাব, রাজাদের স্বশাসন বা কর্তৃত্ব রক্ষার অনিশ্চয়তা, অদূরদর্শিতা, সাধারণ সংখ্যালঘু পাহাড়বাসী নেতৃত্বের মধ্যে পশ্চাদপদ জাতীয় চেতনা, অনৈক্য, প্রতিনিধিত্বহীনতা, দোদুল্যমানতা ইত্যাদি ছিল দেশভাগের সময় রাজনৈতিক চালচিত্র।
পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রসঙ্গ:
১৯২০ দশকের শুরুতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সমিতির প্রথম চেয়ারম্যান কামিনী মোহন দেওয়ান পার্বত্য চট্টগ্রামের ভবিষ্যত নিয়ে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সাথে কথা বলতে বোম্বে যান। তখন বেঙ্গল কংগ্রেসের নেতা চিত্তরঞ্জন দাসের মুখে একটাই জবাব পান। সেটা হলো-“স্বাধীন ভারতে জনগণ যে যার মতো করেই রাজনৈতিক ব্যবস্থা পাবে।” কিন্তু ইংরেজ ভারত ছাড়ার সময় যতই ঘনিয়ে আসছে ততই নেতৃবৃন্দের মনে সংশয় বেড়েই চলেছে। কামিনী মোহন দেওয়ান মনে করতেন পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ও জনগণের অধিকার রক্ষার্থে সরাসরি বৃটিশের বিরুদ্ধে লড়াই করাও পিছিয়ে পড়া, অশিক্ষিত ও নিরীহ পাহাড়ি মানুষদের জন্য ক্ষতিকর হবে। তিনি আশা করছিলেন, ভারতের জাতীয় পর্যায়ের নেতাদের কাছ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চাকমাদের বিষয়ে সুস্পষ্ট একটা নীতি বা বক্তব্য। তারা শুধু একটা সাধারণ আশ্বাস দিলেন যে, উপমহাদেশের জাতি, ধর্ম, বর্ণ, সংখ্যালঘু নির্বিশেষে সকল মানুষের আশা আকাক্সক্ষা সমানভাবে মর্যাদা দেয়া হবে। কাউকে বৈষম্যের শিকার হতে হবে না। তিনি বোঝাতে চাইছিলেন যে, আপনারা শিশু আর যুবকদের এক খেলায় খেলতে দিলে তো অবধারিত কে হারবে আর কে জিতবে।
কিন্তু স্নেহ কুমার চাকমার মতো ছাত্র-যুব নেতারা সরাসরি ভারতে অন্তর্ভুক্তির কামনা করেছিলেন এবং প্রচেষ্টাও চালিয়েছিলেন। বোমাঙ সার্কেলের রাজা চাইছিলেন বার্মার সাথে যুক্ত হতে। তাই তারা বান্দরবানে বার্মার পতাকা উড়িয়েছিলেন। আবার ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর আকাক্সক্ষা ছিল ত্রিপুরা রাজ্যের সাথে একীভূত হওয়া।
“১৯৪৭ খ্রীস্টাব্দের আগস্ট মাসে ভারত উপমহাদেশ থেকে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে। দেশ বিভাজনের আগে পার্বত্য চট্টগ্রামের তৎকালীন জনসমিতির চাকমা নেতৃবৃন্দ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে ভারত রাষ্ট্রের সাথে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি উত্থাপন করে রাঙ্গামাটিতে ভারতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। অপরদিকে ত্রিপুরাগণ (ত্রিপুরা সংঘ) দাবি উত্থাপন করেছিলেন স্বাধীন ত্রিপুরা রাজ্যের সাথে অন্তর্ভুক্ত করার। এ সময় ত্রিপুরাগণের রাজনৈতিক অঙ্গণে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বীরেন্দ্র কিশোর রোয়াজা, দয়াভূষণ ত্রিপুরা, পুজগাং মৌজার হেডম্যান মৃত্যুঞ্জয় রোয়াজা, তৈকাথাং মৌজার হেডম্যান অন্ন রোয়াজা, মাটিরাঙ্গা মৌজার হেডম্যান অশ্বিনী কুমার রোয়াজা, চেঙ্গী মৌজার হেডম্যান বাধ্য কুমার রোয়াজা, ছোট পানছড়ি মৌজার হেডম্যান জগন্নাথ রোয়াজা, বাঙ্গালকাটি মৌজার হেডম্যান গনেশ রোয়াজা প্রমুখ। ত্রিপুরা নেতৃবৃন্দ খাগড়াছড়িতে ত্রিপুরা রাজ্যের জাতীয় পতাকা (গৈরিক বর্ণের ত্রিকোণাকৃতি হনুমান লাঞ্ছিত) উত্তোলন করেছিলেন। স্বাধীন ত্রিপুরা রাজ্যের সর্বশেষ মহারাজা বীর বিক্রম কিশোর মাণিক্য বাহাদুর ভারত থেকে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হবার পূর্বাভাস উপলব্ধি করে হৃত রাজ্যাংশ পুনরুদ্ধার করার জন্য তৎপর হয়েছিলেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন সার্কেল চীফ সহ কতিপয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে তাঁর দরবারে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ধর্মীয় সম্প্রীতির নিদর্শন স্বরূপ রাজধানী আগরতলায় নির্মাণ করে দিয়েছিলেন ‘বেণুবন বৌদ্ধ বিহার’। কিন্তু র্যাডক্লিফ কমিশন পার্বত্য চট্টগ্রামের নেতৃবৃন্দের সকল প্রকার দাবি ও রাজনৈতিক কর্মকান্ড উপেক্ষা করে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পূর্ব পাকিস্তানের সাথে সম্পৃক্ত করার সুপারিশ করে। এ সুপারিশের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হয়।” (সূত্র: মুকুল ত্রিপুরার ফেইস বুক পোস্ট, ৫ই মে ২০১৯)।
যাই হোক। সুবির ভৌমিক আরো লেখেন, ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন কখনো পার্বত্য চট্টগ্রামের ট্রাইবেলদের আগ বাড়িয়ে মূলস্রোতে একাকার করতে পারেনি দু’টো কারণে-(১) ট্রাইবেলদের মধ্যে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনুপস্থিতি আর (২) আংশিকভাবে ট্রাইবেলদের মূলস্রোতে একীভূতকরণে কংগ্রেস ও মুসলিম নেতৃত্বের উদ্যোগের অভাব এবং তাদের মন জয় করতে উপলব্ধিহীনতা। তাছাড়া উপনিবেশিক বৃটিশ সরকারের ধীরে ধীরে ভারত থেকে গুটিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়ার সাথে সাথে পাহাড়ি সম্প্রদায়ের মধ্যেও ঐক্য-সংহতির অভাব ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তাকে বাড়িয়েছে। নেহেরুর কাশ্মীরকে আগলে রাখা ও পার্বত্য চট্টগ্রামকে অবহেলা করার খেসারত আজ স্বাধীনতার ৭০ বছর পরও ভারত মাতাকে দিতে হচ্ছে বলেই অনেকের বিশ্বাস।
১৯৪৭ সালের জানুয়ারি মাসে কংগ্রেসের এক প্রতিনিধি দল (জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে এবি টক্করও ছিলেন) রাঙ্গামাটিতে সফরে এলে পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সমিতি ও হিলম্যান এসোসিয়েশন পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতে অন্তর্ভুক্তির ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। তখনও এই কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ তাদের আশ্বাস দেন যে তারা সেভাবেই বেঙ্গল বাউন্ডারি কমিশনকে সুপারিশ করবেন। কিন্তু তা তারা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। দেশভাগের পর স্নেহ কুমার চাকমা দিল্লীতে সর্দার প্যাটেলের সাথে সাক্ষাত করেন। বেঙ্গল কংগ্রেস কমিটির সাথে কথা বলেন। এ কমিটিতে তাই তাকেও সদস্য হিসেবে কো-অপট করে নেয়া হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করে বাউন্ডারি কমিশন যে বড় অন্যায় করেছে সে বিষয়ে বেঙ্গল কংগ্রেস কমিটি ও সর্দার প্যাটেল উভয়ই একমত ছিলেন। প্যাটেল তাই স্নেহ কুমার চাকমাকে সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার পরামর্শ দেন যাতে ভারতের হস্তক্ষেপ করার পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। প্রয়োজনে সশস্ত্র বিদ্রোহ করতেও বলেছিলেন প্যাটেল। পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে প্যাটেল আশাবাদীও ছিলেন। কারণ তখন সামরিক হস্তক্ষেপ ছাড়া অন্যকোনো পথ খোলা ছিল না পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠের পাকিস্তান থেকে মুক্ত করার। কিন্তু জওহরলাল নেহেরু ছিলেন একেবারেই অনাগ্রহী। তার সংশয় ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতে অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়াস চালালে না জানি পাকিস্তানকে সমগ্র কাশ্মীর অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ দেয়া হয়।
১৯৪৭ সালের ১৭ই মে ত্রিপুরার শেষ রাজা বীর বিক্রম পরলোকগমন করেন। তবে ইতিমধ্যে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, ত্রিপুরা ভারতের অঙ্গ রাজ্যে অর্ন্তভুক্ত হবে। মন্ত্রী গিরিজা শংকর গুহকে রাজা কনস্টিটিউশনাল এসেমব্লীতে ত্রিপুরার প্রতিনিধি হিসেবে মনোনীত করেছেন এবং তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ইন্ডিয়ান ইউনিয়নে ত্রিপুরা রাজ্যকে (মার্জ) সমর্পিত হওয়ার জন্য যা যা ব্যবস্থার প্রয়োজন তা করতে। মহারাজা বীর বিক্রমের মৃত্যুর বছর দুয়েক যেতে না যেতেই মুসলিম লীগ নেতা ও বেঙ্গল এসেমব্লীর প্রাক্তন স্পীকার তোফাজ্জল আলীর প্ররোচনায় কুমিল্লার সন্নিহিত অঞ্চল (ত্রিপুরা রাজার শাসনাধীন চাকলা রোসনাবাদ) সহ পাকিস্তানের অভ্যন্তরে নেওয়ার আন্দোলন গড়ে উঠে। রাজবাড়ীর এক অংশ মন্ত্রী দুর্জয় কিশোরের নেতৃত্বে ও আব্দুল বারেক (আগরতলার বড় ব্যবসায়ী ও মুসলিম লীগের নেতা যাকে গেদু মিঞা নামে মানুষ চিনত)-এর ছত্রছায়ায় ত্রিপুরা রাজ্যকে পূর্ব পাকিস্তানে অর্ন্তভুক্ত করার ষড়যন্ত্র দেশভাগের পরও এক অভ্যন্তরীণ মাত্রা যোগ হয়। রাণী কাঞ্চনপ্রভা সহসা দিল্লীতে ডেপুটেশন দেন এবং বল্লভভাই প্যাটেলের সাথে দেখা করেন এবং কাশ্মীরের (রাজা হরি সিং যেমন পাকিস্তান পন্থী পশতুন উপজাতির উগ্রবাদীরা কাশ্মীর আগ্রাসন করলে দিল্লীর সামরিক সহায়তা চান) মতো সামরিক সহায়তা নিশ্চিত করেন। প্যাটেল দেশভাগের সময় রাজা শাসিত অঞ্চলের বিষয়গুলো তদারকি করছিলেন।
এইচ ভি হুডসনের লেখা দ্যা গ্রেট ডিভাইড বইয়ে জানা যায়, বেঙ্গল ভাগ করার বিষয়ে স্যার সিরিল র্যাডক্লিফ মূলত তিনটি প্রধান প্রশ্নের উত্তরের উপরই নির্ভর করছিলেন।
১। কোলকাতাকে কোন দেশে দেয়া হবে? অথবা দুই দেশের মধ্যেই ভাগ করা যায় কিনা?
২। কোলকাতাকে যদি কোন একটি দেশে অন্তর্ভুক্ত করা হয় তবে অপর দেশের জন্য প্রধান কোন অঞ্চল, সন্নিহিত কোন নদী যার উপর জীবনযাপন এবং সমুদ্র বন্দর নির্ভরশীল আবশ্যক বলে দাবি উত্থাপন করতে পারে?
৩। পূর্ব বঙ্গের সাথে ভৌগলিক ও অর্থনৈতিকভাবে ঘনিষ্ঠ কিন্তু খুবই কম মুসলিম জনসংখ্যা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম কার ভাগে পড়বে?
র্যাডক্লিফ তার কোন সহযোগীর কাছে এ প্রশ্নগুলির সদুত্তর পাননি। বেঙ্গলের গভর্ণরের কথা অনুসারে মাউন্টব্যাটেনের পরামর্শ যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছিল বাউন্ডারী কমিশনের। তার মতামত ছিল যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষদের সার্বিক অর্থনৈতিক জীবন পূর্ববঙ্গের উপর নির্ভরশীল এবং আসামের সাথে তাদের কোন সংযোগ ছিলই না। কর্নফুলি নদীর উপর পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের নির্ভরতার বিষয়টিও মাথায় এসেছিল। অপরদিকে স্বাধীন ত্রিপুরা রাজ্য তার স্বতন্ত্র রাজ্য সীমা নিয়ে দেশভাগের সংশ্লিষ্ট ভৌগলিক এক্তিয়ারের বাইরে ছিল। তাই আসামের জেলা সাউথ লুসাই হিলস (বর্তমানে মিজোরাম)-এর মাধ্যমে আসামের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভবিষ্যতকে জুড়ে দেওয়াও অবাস্তব।
সর্দার বল্লবভাই প্যাটেল ১৩ই আগস্ট ভাইসরয়কে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি প্রতিনিধিদলের সাক্ষাত বিষয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ চিঠি লেখেন যেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, ঐ অঞ্চলের প্রতিনিধিরা অনেক আশঙ্কার মধ্যে রয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় কিনা এই বিষয়ে। তিনি তার চিঠিতে উল্লেখ করেছেন, “আমি পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি প্রতিনিধিদলকে বলেছি যে, মুসলিম ও অমুসলিম জনসংখ্যার বিচারে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাকিস্তানে চলে গেলে এমন অযৌক্তিক হবে সেখানে যদি এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সর্ব শক্তি দিয়ে প্রতিরোধ হয় তা ন্যায্য হবে এবং আমি তাদের সেক্ষেত্রে আমাদের সর্বাত্মক সাহায্যের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছি।” সর্দার প্যাটেল ব্যক্তিগতভাবে মনে করতেন, দেশভাগের শর্তকে অমান্য করে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করা যাবেই না। দেশভাগের শর্ত ও যৌক্তিকতা যেমন সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের জনগণের আশা আকাক্সক্ষা ও জনমতকে উপেক্ষা করে কোনো একটি দেশে অন্তর্ভুক্ত করা কেবল অন্যায় নয় বরং বিপদজনকও হতে পারে।
Lord Mountbatten wrote to London a few days later about the Sardar Patel’s outburst: “The one man I had regarded as a real statesman with both feet firmly on the ground, and a man of honour whose word was his bond, had turned out to be a hysterical as the rest…… So much for his undertaking on behalf of India to accept and implement the awards whatever they might be.”
আগস্টের ১২ তারিখ অফিস সহকারীদের সাথে এক বৈঠকে ভাইসরয় সর্দার প্যাটেলের এমন বিক্ষুদ্ধ গর্জনের আভাসও পেয়েছিলেন যখন তিনি জানতে পারলেন যে হয়তো বা পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মি. ভি পি মেননও আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে, এমন কিছু হলে কংগ্রেস নেতৃত্বের জন্য চরম ক্ষতি হবে যেহেতু তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি নেতাদের বার বার আশ্বস্ত করছিলেন যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলটি পাকিস্তানের অভ্যন্তরে যাবে না। ভারত বিভক্তির বিষয়ে কমিশনের এওয়ার্ড যদি ১৫ আগস্টের পূর্বে তাদের দেয়া হতো তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতে না দিয়ে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সর্দার প্যাটেলরা নিঃসন্দেহে কনিস্টিটিউশনাল এসেমব্লীর মিটিং বর্জন করত। দুর্ভাগ্য কমিশনের এওয়ার্ড প্রকাশিত হয় ১৭ আগস্ট ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার দুই দিন পর। (Viceroy personal report-17, 16 August, 1947, সূত্র: দ্যা গ্রেট ডিভাইড-ব্রিটেইন-ইন্ডিয়া-পাকিস্থান বাই এইচ ভি হুডসন।)
মিজোরাম প্রসঙ্গ:
ইংরেজ খ্রীষ্টান মিশনারীদের ধর্মান্তরিতকরণের মধ্যে সর্বাত্মক সাফল্য সাউট লুসাই হিলসের মিজো সম্প্রদায় উল্লেখযোগ্য। একই সাথে শিক্ষা ক্ষেত্রে মিজোদের অগ্রগতিও চোখে পড়ার মতো। ১৯৪৪ সালে মিজোদের প্রথম শিক্ষিত প্রজন্মের যুবকদের নিয়ে গঠিত হয় প্রথম সংগঠন ‘মিজো কমনস পিপলস ইউনিয়ন’। পরে মিজো ইউনিয়ন নাম ধারণ করে। এরা মিজো ঐতিহ্যগত প্রধানদের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে জনপ্রতিনিধিত্বশীলতার জন্য সক্রিয় হয়ে উঠে। লুসাই হিলসে ডিস্ট্রিক্ট কনফারেন্স নামে এক জনপ্রতিনিধি সভা ছিল। স্থানীয়ভাবে সরকারি প্রশাসনকে সহায়তা করার জন্য এই আধা পরামর্শদাতা সংস্থার নির্বাচনের মিজো ইউনিয়ন তাদের অর্ধেক প্রতিনিধিত্ব গড়ে তোলে। এসময় রাজনৈতিকভাবে মিজো জাতীয় চেতনার উদ্ভব শুরু এখান থেকেই।
ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের ক্ষুদ্র জাতিদের অধিকার রক্ষায় স্থানীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা গঠনের পর্যায়ে বড়দোলোই কমিটি বিভিন্ন অঞ্চলে সফর করছিল। ডিস্ট্রিক্ট কনফারেন্সের নির্বাচনকে মিজো ইউনিয়ন বয়কট করলে মিজো প্রধান (চীফস)-রা ১৯৪৭ সালে ‘ইউনাইটেড মিজো ফ্রিডম অর্গানাইজেশন’ নামে আরো একটি সংগঠন গড়ে তোলে। এই সংগঠনের মাধ্যমে লুসাই হিলসকে ভারতে নয় বার্মায় অন্তর্ভুক্ত করার দাবি উঠে। মিজো ইউনিয়ন এর বিরোধীতা করে। মিজো ইউনিয়নের সেক্রেটারী বাওইচোয়াকা বড়দোলোই কমিটিকে অভিমত দেন যে, “লুসাই হিলস স্বাধীন থাকলে অন্যান্য অঞ্চলের মিজোদের সাথে চিরকালের জন্য বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। বার্মার সাথে যুক্ত হলেও একই কথা। কাজেই লুসাই হিলস ভারতের সাথে থাকাই যুক্তিযুক্ত।” বাওইচোয়াকা আরো দাবি তোলেন যে, মনিপুর ও বার্মার যে এলাকায় মিজোজাতির লোক আছে সেই অঞ্চলও লুসাই হিলসে একীভূত করা হোক। ১৯৪৭ এর এপ্রিলে নাগা নেতা এ জেড ফিজো লুসাই হিলস সফর করেন এবং মিজোদেরও সংঘবদ্ধ করার চেষ্টা করেন যাতে ভারতে অন্তর্ভুক্ত না হয়ে স্বাধীনভাবে থাকতে। কারণ নাগা জাতি স্বাধীনভাবেই জীবনযাপন করে আসছিল। (সূত্র: ইনসার্জেন্ট ক্রসরোড-নর্থ ইস্ট ইন্ডিয়া বাই সুবির ভৌমিক)।
নাগাল্যান্ড প্রসঙ্গ:
নাগাল্যান্ডেও খৃষ্টান মিশনারীদের মাধ্যমে শিক্ষার প্রচারের কারণে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব হয় এবং তাদের দ্বারাই ১৯১৮ সালে ‘নাগা ক্লাব’ নামে একটি সংগঠন সৃষ্টি হয়। তারও পরে ১৯৪৬ সালে ‘নাগা ন্যাশন্যাল কাউন্সিল’ (এন এন সি) গঠন হয়। এসব সংগঠন সৃষ্টির সাথে ইংরেজদের পৃষ্ঠপোষকতা ছিলই। নেহেরুর কথায় অসন্তুষ্ট হয়ে এন এন সি দেশভাগের পর পরই কমপক্ষে ১০ বছরের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন নাগা সরকার গঠনের দাবি করেছিল। দাবি উঠেছিল গ্রেট বৃটেনেরই তত্ত্বাবধানে নাগাল্যান্ডে তাদের স্বশাসন। পরবর্তী সময়ে নাগাদের অধিকার ও তাদের আশা-আকাক্সক্ষা অনুসারে উন্নয়ন আর কাস্টমারি ল-এর সম্পূর্ণ সংরক্ষণে আশ্বাস পেয়ে গভর্ণর আকবর হাইডারীর সাথে চুক্তিবদ্ধ করা হয় নাগাদের। ছল চাতুরী আর আপাতত সব রকম অধিকারের আশ্বাস দিয়ে দুর্বল রাজা ও জাতিগোষ্ঠীগুলিকে ভারতীয় ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্ত করাই ছিল সম্প্রসারণবাদী সকল নেতৃত্বের কৌশল।
এ জেড ফিজোকে নাগা জাতির জনক বলা হয়। তিনিই নাগাদের ভারতের অধীনে না থাকার জন্য নির্বাচন বয়কট করে স্বাধীনভাবে নাগাল্যান্ড রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখিয়েছেন। ১৪ আগস্ট ১৯৪৭ ফিজো নাগা অঞ্চলকে স্বাধীন হিসেবে ঘোষণা দেন। তিনি ১৯৫১ সালের ডিসেম্বরে জওহরলাল নেহেরু আসামের তেজপুর সফরে এলে সাক্ষাত করেন এবং নাগাজাতির স্বাতন্ত্র্যতার কথা বলে স্বাধীন নাগাল্যান্ডের ব্যাপারে বক্তব্য দেন। ১৯৫২ সালে দিল্লীতে এবং জুলাই মাসে আবার ডিব্রুগড়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করেন। ১৯৫৩ সালের এপ্রিল থেকে ভারতবিরোধী কার্যকলাপ বন্ধ করতে নাগাল্যান্ডের আনাচে কানাচে সামরিক অভিযান পরিচালিত হয়। ১৯৫৪ সালের সেপ্টেম্বরে পিপলস সোভরেইন রিপাবলিক অব ফ্রি নাগাল্যান্ড গঠন করেন। ১৯৫৬ সালে মার্চের ২২ তারিখ নাগা সেন্ট্রাল গর্ভমেন্ট গঠন করেন। পরে ১৯৫৯ সালে ফেডারেল গভর্ণমেন্ট অব নাগাল্যান্ড নামে পরিচিতি পায়। কিন্তু নেহেরু কোনো কিছুই কর্ণপাত করেন নি। বরবারই নাগাল্যান্ডকে ভারতের প্রশাসনিক ও সামরিক উপায়ে কব্জার মধ্যে নিয়ে আসার চেষ্টায় ছিলেন। ফিজো বার্মায় পালিয়ে যান এবং ধরা পড়েন। সেখান থেকে ১৯৫৬ সালের ডিসেম্বরে পালিয়ে যান পাকিস্তানে। পাকিস্তান থেকে লন্ডন চলে যান ফিজো। ১৯৬৩ সালে নাগাল্যান্ডকে দিল্লী পূর্ণ রাজ্য হিসেবে ঘোষণা করার পর স্বাধীন নাগাল্যন্ডের সপক্ষে ও ভারতবিরোধী আন্দোলন তীব্র আকার নেয়।
মেঘালয় প্রসঙ্গ:
বর্তমান মেঘালয়ে ছিল খাসি, গারো ও জয়ন্তিয়া জাতিগোষ্ঠিগুলির ২৫টি আধা-স্বাধীন খাসি রাজ্য। দেশভাগের সময় তারাও তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নিয়ে সোচ্চার হতে থাকে। তারা ভারত কিংবা পাকিস্তান কোন একটি দেশে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পক্ষে ছিল না। বিশেষত প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ ও পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে তারা কারো সাথে সমঝোতার বিরুদ্ধে ছিল।
১৯৪৮ সালের ১৭ই আগস্ট ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ২৫টি খাসিয়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠী ভিত্তিক প্রধানের রাজ্যকে ভারতে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাবিত চুক্তিকে চুড়ান্ত করেন। ১৯৪৭ সালের ১৩ই অক্টোবর সর্দার প্যাটেলকে লেখা এক চিঠিতে জওহরলাল নেহেরু উল্লেখ করেন যে, এই অঞ্চলের মানুষদের বিশেষ অধিকারের স্বীকৃতি পাওয়া উচিত। আসামের গভর্ণর ছিলেন তখন আকবর হাইডারী। নেহেরু চেয়েছিলেন সীমান্তবর্তী এই খাসি রাজ্যগুলির বিশেষ গুরুত্ব বজায় রাখতে। যেহেতু আগেই এ সকল অঞ্চলের ট্রাইবেল জাতিগুলিকে নিয়ে অনেক বিড়ম্বনা সইতে হয়েছে। তাই ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরের ১৫ তারিখ থেকে মার্চের ১৯ তারিখ পর্যন্ত ২৫টি খাসি রাজ্যের প্রধানগণ শিলঙে আসামের গভর্ণর আকবর হাইডারীর কাছে শর্ত সাপেক্ষে চুক্তিতে সই করতে থাকে। তবে অন্যান্য রাজ্যগুলি যে প্রক্রিয়ায় ভারতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে খাসি রাজ্যগুলি সেভাবে ভারতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার নয়। তারা চুক্তিবদ্ধ হয়েছে কিন্তু অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
মনিপুর প্রসঙ্গ:
উত্তরপূর্ব ভারতের সকল অঞ্চল ও রাজ্যকে ভারতের কব্জায় আনতে সবচেয়ে বেশি বেগ পেতে হয়েছে সর্বশেষ মেইথেই রাজা বোধচন্দ্র সিংহের মনিপুরকে নিয়ে। মনিপুরের রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট নেতা হিজাম ইরাবত-এর প্রজা সংঘ পার্টির (১৯৪৬ সালে গঠিত) নেতৃত্বে স্বাধীন মনিপুর সরকারও ঘোষণা দেয়া হয়। ভারতে অন্তর্ভুক্তি নয়, স্বাধীন মনিপুরও তাদের কামনা বাসনা ছিল। সমাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাকে যারা বিরোধীতা করে তারা মনিপুর কংগ্রেস নামে অন্য একটি রাজনৈতিক দলের জন্ম দেয়। মনিপুরের বৃটিশ আই পি এস অফিসার এফ এফ পিয়ারসন-র উদ্যোগে ১৯৪৮ সালে এসেম্বলী নির্বাচনও হয়ে একটি কোয়ালিশন সরকারও গঠন করা হয়। মনিপুর কংগ্রেস মনিপুরকে ভারতে অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়াস চালালে ইরাবত এবং মহারাজা বোধচন্দ্র দুজনেই বিরোধীতা করে। সর্দার প্যাটেলের প্রস্তাবনা ছিল মনিপুর, কাছার, লুসাই হিলস এবং ত্রিপুরাকে নিয়ে ‘পূর্বাচল’ নামে একটি রাজ্য গঠন করা।
অন্যদিকে বার্মার কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাবে মনিপুরের সম্ভাব্য দখল নিয়েও মনিপুর কংগ্রেস নেতৃত্ব আশঙ্কাগ্রস্ত ছিল। আকবর হাইডারী ইতিমধ্যে মনিপুরের অন্তর্ভুক্তির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য মনিপুর সফর করেন এবং মহারাজা বোধচন্দ্রকে শিলঙে আমন্ত্রণ করেন ১৯৪৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। অথচ সেই মিটিঙে আকবর হাইডারী মহারাজাকে মনিপুর ভারতে অন্তর্ভুক্তির চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করার গোপন পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন। প্রথম দিনেই তাকে স্বাক্ষর করতে বললে বোধচন্দ্র আপত্তি তোলেন এবং তার মন্ত্রীপরিষদের সাথে আলোচনা না করে স্বাক্ষর করতে অসম্মতি জানালে তাকে গৃহবন্দী করা হয়। সর্বশেষে ২১ সেপ্টেম্বর ১৯৪৯ তাঁকে বাধ্য করা হয় স্বাক্ষর করতে। (সূত্র: ইন্টিগ্রেশন অব ইন্ডিয়া-দ্যা স্টোরি অব দি সেভেন সিস্টারস- অভিষেক ভট্টচারিয়া, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১৬)।